2.21.2008

বিশ্বায়নে বাংলাদেশের অর্থনীতি

এম. এম. আকাশ

অপুঁজিবাদী বিশ্বায়ন : বাজার ভিত্তিক নয় শক্তি ভিত্তিক
বিশ্বায়ন মর্মবস্তুর দিক থেকে কোনো নতুন ধারণা নয়। যদিও আদিম সাম্যবাদী সমাজে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া অনুপস্থিত ছিল কিন্তু দাস ও সামন্তযুগে সীমিত পরিসরে হলেও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য জলত। দাস যুগে আফ্রিকা থেকে দাস সংগ্রহ করে অন্যান্য স্থানে বিক্রি করা হতো কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় দাসদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল না। কাজেই দাস যুগের সীমিত বিশ্বায়ন (আন্তর্জাতিক বাণিজ্য অর্থে) ছিল বলপূর্বক। একই কথা সামন্ত যুগের বিশ্বায়নের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেও বিশ্বায়ন ছিল সীমিত। পুঁজিবাদী দেশগুলো সোভিয়েত ইউনিয়ন বা পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর সাথে কখনই ব্যাপক ধরনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করেনি। বর্তমানে বিশেষত ৯০’র দশক থেকে যে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া চলছে সেটি মূলত পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন এবং এর চরিত্র দাস কিংবা সামন্তযুগের বিশ্বায়নের মতো বলপূর্বক না হলেও পুরোপুরি স্বতঃস্ফুর্ত বিনিময়-নির্ভরও নয়। এর পরিসরে তুলনামূলকভাবে অধিকতর বিস্তৃত এবং গভীর।

পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন : বাজার ও শক্তির দ্বান্দ্বিক ঐক্য
পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের তত্ত্বানুযায়ী দাবি করা হয় যে, এর ফলে পুঁজি, পণ্য, সেবা, শ্রমশক্তি এবং তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ বিচরণ ঘটবে এবং সামগ্রিকভাবে বিশ্ব অর্থনীতির উন্নয়ন হবে। কিন্তু একটি প্রশ্ন এখানে গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো পুঁজি, পণ্য কিংবা প্রযুক্তির এই অবাধ চলাচল কি স্বতঃস্ফুর্তভাবে হবে? কোনো ধরনের কেন্দ্রীয় সমন্বয় ছাড়া যদি এদের মুক্তভাবে বিচরণ করতে দেয়া হয় তাহলে অরাজকতা সৃষ্টি হতে বাধ্য। সুতরাং দেখা যাচ্ছে পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের জন্যও একটি কেন্দ্রীয় শাসন বা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা আছে। পুঁজিবাদী বিশ্বের হর্তা-কর্তারা তা ভালভাবেই বোঝেন। উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলো বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সমন্বয়কারী সংস্থার জন্ম দিয়েছে। এর মধ্যে প্রধান দুটি হলো বিশ্বব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (International Monetary Fund-IMF)। ২য় মহাযুদ্ধের পরে আমেরিকার ব্রেটন উডস শহরে মার্শাল চুক্তির অধীনে এই দুটি সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। এ কারণে এদেরকে একত্রে বেটন উডস সংস্থাও বলে। সম্প্রতি এর সাথে যুক্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থা (World Trade Organization-WTO)। বর্তমানে এই ত্রয়ীই পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন : অনিবার্য সীমাবদ্ধতাসমূহ
এখন আমরা যদি পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করতে যাই তাহলে প্রথমেই এর কিছু কিছু নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা দরকার যা থিওরির সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। প্রথমত চলমান বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় পুঁজি কিংবা পণ্যের অবাধ চলাচল নিশ্চিত করা হলেও শ্রমশক্তির ক্ষেত্রে সেটা আদৌ ঘটেনি। আমেরিকার বাজারে বাংলাদেশের পুঁজি, পণ্য অথবা সেবা স্বাধীনভাবে প্রবেশ করতে পারে, অথচ আমাদের শ্রম আমদানীর ব্যাপারে তারা মোটেও আগ্রহী নয়। এর ফলে যেসব দেশের মূল সম্পদ পুঁজি তারা লাভবান হয় ঠিকই কিন্তু যাদের মূল সম্পদ শ্রমশক্তি তারা তুলনামূলকভাবে ততটা সুবিধা পায় না। তাই পুঁজিবাদী বিশ্বায়নে শুরু থেকেই একটি কাঠামোগত সুযোগ বৈষম্য থেকে যায়। সব খেলোয়াড়রাই সমান সুবিধা নিয়ে সমান বিশ্ব মর্যাদায় খেলার সুযোগ পায় না। দ্বিতীয়ত ইদানীং ইন্টারনেটের প্রসারের ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং তথ্য প্রযুক্তি খুব সহজেই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলতে শুরু করেছে। কিন্তু পুঁজিবাদীরা জ্ঞানের এই অবাধ প্রবাহ সহজে মেনে নিতে পারছেন না। তারা লক্ষ্য করেছেন যে, এতে তাদের ভীষণ অসুবিধা কেননা তাদের বিভিন্ন প্রোগ্রাম, বিভিন্ন উদ্ভাবন খুব সহজেই নকল বা ছিনতাই (Pirated) হয়ে যাচ্ছে। ফলে পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের যারা কর্তা তারা একটা নতুন আইন করেছেন, যার নাম Intelectual Property Rights এবং এর মাধ্যমে জ্ঞানের অবাধ চলাচলকে তারা রুদ্ধ করে দিতে চাচ্ছেন। বিশ্বায়ন সংক্রান্ত WTO প্রণীত আন্তর্জাতিক সনদে যেসব দেশ বর্তমানে স্বাক্ষর করেছে তারা এই আইন মানতে বাধ্য। তাহলে দেখা যাচ্ছে পুঁজিবাদী বিশ্বায়নে পুঁজি, পণ্য এবং সেবার স্বাধীন চলাচলের ব্যবস্থা থাকলেও শ্রমশক্তি এবং জ্ঞানের অবাধ বিচরণের ক্ষেত্রে নানা কৃত্রিম বাধা প্রদান করা হচ্ছে। এ কারণেই চরিত্রগত দিক থেকে এই বিশ্বায়ন অসম।
ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণে দেখা যায় এই ধরনের বিশ্বায়নের কাঠামোটিও অগণতান্ত্রিক। কেন অগণতান্ত্রিক তার কারণ নিচে উল্লেখ করা হলো। বিশ্বায়নের জন্য অপেক্ষাকৃত গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা হতে পারেতা জাতিসংঘ। কিন্তু যেহেতু জাতিসংঘ ‘একদেশ এক ভোট’- এই পন্থা অনুসরণ করে এবং যেহেতু শিল্পোন্নত দেশগুলো সারা বিশ্বে সংখ্যায় লঘিষ্ট, সেহেতু এই গণতান্ত্রিক ভোট পদ্ধতিতে ধনী দেশগুলো তাদের স্বার্থসিদ্ধি করতে পারবে না। এই পুঁজিবাদী দেশগুলো জাতিসংঘকে বিশ্বায়নের দায়িত্ব না দিয়ে দায়িত্ব দিয়েছে বিশ্বব্যাংক IMF এবং WTOকে। বিশ্বব্যাংক এবং ওগঋ এর ভোটদান পদ্ধতি হচ্ছে যে দেশ এই সব সংস্থার ফান্ডে যতবেশি চাঁদা দিয়ে থাকে তার ভোটের গুরুত্ব সংখ্যাগতভাবে ততবেশি। নিচের ছক থেকে দেখা যায় বিশ্বব্যাংক ও IMF এর ভোটের সিংহভাগই শিল্পোন্নত দেশগুলো কিনে নিয়েছে। যার মধ্যে প্রধান হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

দেশ-----শতকরা হিসেবে ভোট (বিশ্বব্যাংক)-----শতকরা হিসেবে ভোট (IMF)

যুক্তরাষ্ট্র -------- ১৯.৬৩ -------------------- ১৯.৩
জাপান --------- ৯.৪৩ --------------------- ৪.৬
জার্মানি --------- ৭.২৯ --------------------- ৫.৮
যুক্তরাজ্য -------- ৬.৯৯ ------------------- ৬.৭
ফ্রান্স ---------- ৪.৭৬ --------------------- ৪.৮
চীন ----------- ২.৫৫ ------------------- ২.৬

বিশ্বব্যাংক এবং IMF এর মৌলিক নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন আনতে গেলে ৮৫% প্রাধান্য দরকার হয়। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একাই যে কোনো ধরনের মৌলিক পরিবর্তনের প্রচেষ্টাকে থামিয়ে দিতে পারে। এই সংস্থাগুলো থেকে সব সিদ্ধান্ত আসে সেগুলো সাধারণভাবে শিল্পোন্নত দেশগুলোর স্বার্থ রক্ষা করে এবং অবাধ প্রতিযোগিতার ছদ্মাবরণে অসম বাণিজ্য প্রতিযোগিতার জন্ম দেয়। এ ধরণের অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার নিয়ন্ত্রণাধীন যে বিশ্বায়ন তার ফলাফল দু’টি: ধনী এর ফলে আরও ধনী হবে এবং গরীব আরও গরীব হবে। এটি যেমন দেশের বা সমাজের ভেতরে ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে হবে তেমনি বিভিন্ন দেশের মধ্যেও বৈষম্য বৃদ্ধি হবে। অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত ধনী দেশগুলো আরও ধনী হবে এবং দরিদ্র দেশগুলো আরও দরিদ্র হবে। একই ভাবে যাদের হাতে পুঁজি এবং পণ্য আছে প্রচলিত ব্যবস্থায় তাদের আয় উন্নতি বাড়বে, যদিও তারা সংখ্যায় খুবই কম। আর যাদের তা নেই তারা পিছিয়ে পড়বে। এ কারণেই বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় ধনী ও গরীব দেশগুলোর মধ্যে যেমন বৈষম্য বৃদ্ধি পায় তেমনি প্রতিটি দেশের ভিতরেও ধনী ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে বৈষম্য বেড়ে যায়। এটি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যেমন সত্যি তেমনি সত্যি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও। তেমনি সত্যি উত্তর এবং দক্ষিণের দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান ব্যবধান।

পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন : ক্রমবর্ধমান বৈষম্য
বিশ্বায়ন যে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্যকে প্রকটিত করে তোলে তার প্রমাণ মেলে এই পরিসংখ্যানগুলো থেকে। জাতিসংঘের HumanDevelopment Reportরিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৯৩ সালে পৃথিবীর মোট এঘচ’র GNP'র পরিমাণ ছিল ২৩ ট্রিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ১৮ ট্রিলিয়ন ডলার এসেছিল উন্নত শিল্পায়িত দেশগুলো থেকে আর ৫ ট্রিলিয়ন ডলার এসেছিল তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো থেকে যার জনসংখ্যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার শতকরা ৮০ ভাগ। ৩০ বছর আগে পৃথিবীর দরিদ্রতম ২০ শতাংশ জনগণের কাছে ছিল পৃথিবীর মোট আয়ের ২.৩%। বর্তমানে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১.৪% এ। অপরদিকে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ২০ শতাংশ জনগণের কাছে ছিল পৃথিবীর মোট আয়ের শতকরা ৭০ ভাগ যা বর্তমানে বেড়ে গিয়ে হয়েছে ৮৫%। বর্তমানে পৃথিবীর ৪৫% জনগণের আয়ের সমান অর্থের মালিক মাত্র ৩৫৮টি ধনী পরিবার। এগুলো হচ্ছে জাতিসংঘের Human Development Report এ এমন কিছু তথ্য প্রকাশিত হয়েছে যা বিশ্বায়নের নেতিবাচক ভূমিকাকেই উন্মোচিত করে। যেমন: এই রিপোর্টে প্রকাশ- পৃথিবীর ৫৭% জনগণের (যারা ৬৩টি দরিদ্র দেশে বাস করে) আয় পৃথিবীর মোট আয়ের মাত্র ৬%। ১৯৮৯ থেকে ৯৯ এই সময়ের মধ্যে পৃথিবীর মোট চরম দরিদ্র লোকের সংখ্যা একটিও কমেনি। ১৯৯৮-৯৯ সালে উন্নয়নশীল দেশসমূহের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১.২% যা বিগত যে কোনো বছরের তুলনায় কম। অর্থাৎ বিশ্বব্যাংকও স্বীকার করছে যে বিশ্বায়নের সার্বিক চিত্র খুবই হতাশাব্যঞ্জক। অন্তত প্রচলিত বিশ্বায়ন দারিদ্র্য নিরসনে বা বৈষম্য নিরসনে যে পর্যাপ্ত নয়, তা এসব পরিসংখ্যান নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করেছে।

বাংলাদেশে বিশ্বায়নের সূচনা
এতো গেল সমস্ত বিশ্বের প্রেক্ষাপট, এবার দেখা যাক বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিশ্বায়নের প্রভাব কি। কোন দেশে বিশ্বায়ন হচ্ছে কি হচ্ছে না অর্থনীতিবিদরা তা পরিমাপ করার জন্য আমদানি ও রপ্তানির মোট মূল্য যোগ করেন এবং এই যোগফল দেশের মোট জাতীয় আয়ের কতটুকু তা বের করেন। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বিশ্বায়নের সঙ্গে সঙ্গে এই অনুপাত বাড়তে থাকে। বাংলাদেশে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া কবে শুরু হয়েছে সেটা যদি আমরা দেখতে চাই তাহলে আমাদেরকে ১৯৮০ পরবর্তী বছরগুলোর দিকে তাকাতে হবে। ১৯৮০ পর্যন্ত বাংলাদেশ পুরোপুরি মুক্তবাজার অর্থনীতির দর্শন গ্রহণ করে নেয়নি। ১৯৮২ সালে জেনারেল এরশাদ যখন সামরিক শাসন চালু করেন এবং New Industrial Policy ঘোষণা করলেন তখন থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্বায়নের অধীনে তথাকথিত মুক্তবাজারের অর্থনীতির দিকে যাত্রা শুরু করে।

১৯৮৫-৮৬ সালে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংক প্রস্তাবিতStructural Adjustment Policy (SAP) গ্রহণ করে যার মূল বিষয় ছিল তিনটি: প্রথমত বেসরকারিকরণ অর্থাৎ পাবলিক সেক্টরের আয়তন কমিয়ে ফেলা, দ্বিতীয়ত বাজার উন্মুক্ত করা এবং তৃতীয়ত সরকারি আয়-ব্যায়ের সামঞ্জস্যতা বিধান, যার মধ্যে প্রধান প্রবণতাগুলো ছিল ভর্তুকি প্রত্যাহার করা, প্রয়োজনে উন্নয়ন ব্যয় কমানো এবং সামাজিক খাতে ব্যয় সংকোচন করা। এরপর থেকেই বলা যায় ধাপে ধাপে এইসব পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাণিজ্য বিস্তারের মাধ্যমে আমরা চলমান বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার সাথে একীভূতি হয়েছি। যাই হোক এরপরেও ১৯৮০-৮৪ সাল পর্যন্ত আমাদের দেশে বিশ্বায়ন তেমন একটা দ্রুত তালে এগোয়নি। ১৯৮৪ থেকে ৯৪ সার পর্যন্তও বাণিজ্য বিস্তার ধীর গতিতেই হয়েছে কিন্তু ৯৪ এর পর থেকে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বাণিজ্য বিস্তার হয়েছে। ১৯৮৪ সালে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মূল্য ছিল জাতীয় আয়ের মাত্র ২০ শতাংশ কিন্তু ১৯৯৮ সালে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মূল্য ছিল দেশের জাতীয় আয়ের ৪৫ শতাংশ। এখানে উল্লেখ্য যে, এই সময়ের মধ্যে আমাদের রপ্তানি আয় তুলনামূলকভাবে খুব একটা বাড়েনি। মূলত আমদানি ব্যয় দ্রুত বাড়ার কারণেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মূল্য মোট আয়ের অনুপাত হিসেবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

১৯৯৪ সালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকার এবং একটি ঘনিষ্ঠ সূত্রের মতে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান বিশ্বব্যাংকের Alternative Director এর পদ পাওয়ার আশায় বিশ্বব্যাংকের অনেক কর্মসূচি যতটুকু পালন করা দরকার তার চেয়ে অনেক বেশি বাস্তবায়ন করেছেন। অর্থাৎ “বাবু যত বলে পরিষদ বলে শতগুণ”- এই নীতিতে তিনি খুব দ্রুত বাজার উদারীকরণ করেন। উদ্দেশ্য সত্য কি না তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তিনি যে তা করেছেন এটা সত্য! ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে Unweighed গড় শুল্ক হার ছিল ৫৭.৩%। ১৯৯২-৯৩ সালে এসে সেটি দাঁড়ায় ৪৭.৪%-এ এবং ১৯৯৩-৯৪ সালে মাত্র এক বছরের ব্যবধানে সেই শুল্ক হার আরও কমিয়ে ৩৬-এ আনা হয়। এভাবে রাতারাতি বাজার উন্মুক্তকরণের ফলে দেশী শিল্প তীব্র প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয় এবং প্রায় এক হাজার শিল্প রুগ্ন হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসেও শুল্ক হার কমানোর এই ধারার বিরুদ্ধে কৌশলগত নিন্দা জানালেও এ থেকে নিজেরা সরিয়ে আসেননি। যদিও আওয়ামী মন্ত্রীরা নির্বিচারে বাজার উদারীকরণের জন্য সাইফুর রহমানের দোষ দিয়ে থাকেন তারপরও দেখা যায় Unweighed শুল্ক হার ১৯৯৫-৯৬ এর ২২.৩% এর চেয়ে কমে ১৯৯৭-৯৮ এ ২০.৭% এ দাঁড়ায়। অর্থাৎ সাধারণভাবে বলা যায় আমাদের শাসকশ্রেণী পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাসমূহের বশ্যতা স্বীকার করেই বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। উল্লেখ্য যে, শুল্ক হার শূন্যে নামিয়ে আনাই হচ্ছে বর্তমানে বিশ্বায়নের মোড়লদের অন্যতম প্রেসক্রিপশান।

পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন : বিদেশী পুঁজি বিনিয়োগের মিথ!
পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের কিছু ইতিবাচক ভূমিকার কথা দাবি করা হয়। গ্লোবাল গুরুরা বলে থাকেন এর ফলে যে শুধুমাত্র দেশীয় শিল্প প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ধ্বংস হয়ে যাবে তা নয় বরং বিদেশী পুঁজির ব্যাপক বিনিয়োগও ঘটবে এবং এর ফলে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, নতুন প্রযুক্তি আসবে ইত্যাদি। তাহলে আমাদের দেখা দরকার বিশ্বায়নের ফলে বাংলাদেশে কতটা বৈদেশিক পুঁজি এসেছে। শিল্পোন্নত দেশের পুঁজিপতিরা তাদের উদ্বৃত্ত ক্যাপিটাল সেই সব দেশে বিনিয়োগ করে থাকে যেখানে শ্রম অপেক্ষাকৃত বেশি দক্ষ কিন্তু সস্তা এবং যেখানে ব্যবসার জন্য ভাল অবকাঠামোগত সুবিধা আছে। এ কারণেই তারা চীন বা ভিয়েতনামে পুঁজি বিনিয়োগ করে যদিও আদর্শগত দিক থেকে এ দৃ'টো দেশের সাথে তাদের কোন মিলই নেই। পক্ষান্তরে খুবই স্বল্পোন্নত দেশ, যেখানে অবকাঠামোগত সুবিধা নেই, ঘন ঘন লোডশেডিং হয়, যেসব দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভাল না এবং শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ না দিলে কাজ করতে পারে না সেসব দেশে তার পুঁজি বিনিয়োগে কুণ্ঠিত থাকে। এক হিসেবে দেখা যায়, ১৯৯৭ সালে শিল্পোন্নত দেশ থেকে ৩য় বিশ্বের দেশসমূহে বিনিয়োগকৃত মোট পুঁজির পরিমাণ ছিল ১২৯ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে সর্বমোট বিনিয়োগ হয়েছে ১ বিবিলয়ন ডলারেরও কম। বাংলাদেশে ১৯৭৭ সালে বিদেশী বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল Export Processing Zone। ১৯৭৭-৯০ সারের মধ্যে EPZ সমূহে যে বিদেশী বিনিয়োগ হয়েছিল তার মাত্র ২৪% ছিল শিল্প পুঁজি। এই সময়ে এসব বিদেশী বিনিয়োগের সূত্রে যে পরিমাণ নতুন প্রযুক্তি আমাদের দেশে এসেছিল তার মূল্য ছিল মোট বিনিয়োগের মাত্র ১২.৮%।

তবে বিশ্বায়নের ফলে বাংলাদেশে সবচেয়ে উদ্বেগজনক যে ঘটনাটি ঘটেছে তাহলো ধনী দরিদ্রের আয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য বৃদ্ধি। বৈদেশিক বাণিজ্য, বৈদেশিক সাহায্য ও বিদেশী পুঁজির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার সুবাদে মুষ্টিমেয় কিছু লোক রাতারাতি বিরাট ধনীতে পরিণত হয়েছে। ১৯৮৫-৮৬ সালে যখন বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয় তখন বাংলাদেশের দরিদ্রতম ২০% জনগণের মাথাপিছু আয় ছিল ১৫৩১ টাকা আর সবচেয়ে ধনী ২০% জনগণের মাথাপিছু আয় ছিল ১০০৮৫ টাকা। ১৯৯৫-৯৬ সালে দরিদ্রতম ২০% মানুষের আয় দাঁড়ায় ১৫৭১ টাকা অথচ ২০% ধনী জনগণের আয় বেড়ে হয় ১৩৭৮২ টাকা। এই ২০% এর মধ্যে যারা কোটিপতি তাদেরকে আলাদাভাবে হিসাব করলে হয়তো এই বৈষম্য বৃদ্ধির চমকপ্রদ হারটি আরও সুষ্ঠু হয়ে ধরা পড়তো অর্থাৎ বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও বিশ্বায়নের সুবিধা আয়ত্ব করতে পেরেছে কেবল ধনীরাই এবং ধনী-গরীবের বৈষম্যও এতে করে বেড়ে গিয়েছে। পাটশিল্প ধ্বংস হয়ে যাবার পরে গার্মেন্টস বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি শিল্প। আমাদের রপ্তানি আয়ের ৭৬%-ই আসছে গার্মেন্টস থেকে। অনেকেই বলে থাকেন যে বিশ্বায়ন না হলে গার্মেন্টস শিল্পের এই বিকাশ সম্ভব হতো ন। এ কথাটা সত্যি। কিন্তু এখানে ফাঁকি হচ্ছে এই জায়গায় যে গার্মেন্টস আমাদের রপ্তানি আয়ের ৭৬% দিচ্ছে এটি হলো মোট মূল্য (Gross Value)। এর মধ্যে দুই তৃতীয়াংশই ব্যয়িত হয় প্রয়োজনীয় কাঁচামাল কিনতে। এই রপ্তানী শিল্পটি মূলত আমদানি নির্ভর, আমরা শুধুমাত্র গড়ে ২৫% মূল্য সংযোজন করে থাকি। তবে যেখানে যেখানে Backward Linkage তৈরি সম্ভব হয়েছে, সেখানে সেখানে এই মূল্য সংযোজন হার বৃদ্ধি পাবে। উপরন্তু সস্তা শ্রম ও কোটার কারণে ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে আমাদের গার্মেন্টস যে সুবিধা বর্তমানে ভোগ করে আসছে, ২০০৪ সালের পর সেই সুবিধা আর থাকবেনা। থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত প্রভৃতি কাপড় উৎপাদনকারী দেশ কোটা পদ্ধতি বলবৎ থাকার কারণেই তারা তাদের অতিরিক্ত উৎপাদিত কাপড় বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে। কোটা ব্যবস্থা না থাকলে এই দেশগুলো নিজেরাই তৈরি পোশাক রপ্তানির হার বাড়িয়ে দেবে। তারা আমাদের দেশে কাপড় নাও রপ্তানি করতে পারে। তখন চড়া দামে আমরা কাপড় এবং অন্যান্য কাঁচামাল কিনতে বাধ্য হবো।

কিন্তু এভাবে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণেই আমরা তখন হয়তো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবনা। সেই সম্ভাব্য সংকট মোকাবেলার জন্য আমাদের দেশের স্বল্প দৃষ্টিসম্পন্ন (Myopic) সরকার বা পুঁজিপতি শ্রেণীর কোনো চিন্তা আছে বলে মনে হয়না। কিছু সেমিনার ও ঢাক-ঢোল পেটানোই সার। গার্মেন্টস শিল্পে আমরা যে ২৫% মূল্য সংযোজন করেছি সেটা মূলত আসে সস্তা শ্রম বিক্রি থেকে। এ কারণে বিদেশী অর্থনীতিবিদরা আমাদের গার্মেন্টস কারখানাগুলোকে বলে থাকেন ‘ঘামের দোকান’ এবং পশ্চিমা পুঁজিবাদীদের বক্তব্য হচ্ছে তারা আমাদের মতো স্বল্পোন্নত দেশে শিল্পায়ন হতে দেবে কিন্তু তার চরিত্র হবে এই ঘামের দোকানের মতোই। উন্নত প্রযুক্তি এবং জনশক্তি ব্যবহার করে যে শিল্প তা তারা এখানে গড়ে উঠতে দিচ্ছেননা। আর অবাধ পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের অসম প্রতিযোগিতার আওতায় থেকে সংরক্ষণ সুবিধা ছাড়া সে ধরণের শিল্প যে গড়ে উঠতে পারেনা তা বলাই বাহুল্য। এই যদি হয় বাস্তবতা তাহলে আন্তর্জাতিক শ্রম বিভাজনের যে চক্রে আমরা পড়ে যাবো তাতে আমাদের ভাগ্যে পড়বে Inferior শিল্প আর পুঁজিবাদী উন্নত দেশগুলোর ভাগে পড়বে Superiorশিল্প। এবং এই চক্র থেকে আমরা কোনদিনই বেরিয়ে আসতে পারবনা। এ প্রসঙ্গে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থনীতিবিদদের বক্তব্য হচ্ছে, স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে এভাবে ঘামের দোকান দিয়েই শুরু করতে হবে। এরপর যারা প্রতিযোগিতায় ভাল করবে তারা এগিয়ে আসবে। যেমনটি ঘটেছে দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, হংকং এবং সিঙ্গাপুরের ক্ষেত্রে। সম্প্রতি ইস্ট এশিয়ান ক্রাইসিসের সময় এই দেশগুলোর অর্থনীতি যেভাবে ভেঙে পড়েছে তাতে এই যুক্তির আকর্ষণী ক্ষমতাও বিপুলভাবে হ্রাস পেয়েছে।

বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে আমাদের দেশে নির্বিচারে সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু যেহেতু আমাদের বেসরকারি খাত প্রস্তুত ছিলনা, রুগ্ন শিল্প কারখানা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিয়েও কোনো লাভ হয়নি বরং নতুন করে খেলাপী ঋণের সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বায়নের আরেকটি দিক হচ্ছে সরকারি ব্যয় কমানো। কিন্তু সাধারণ প্রশাসন বা সামরিক খাতের মতো অনুৎপাদনশীল খাতে এই ব্যয় কমানো সম্ভব হয়নি। ফলে তুলনামূলকভাবে ব্যয় কম বৃদ্ধি করা হয়েছে শিক্ষা কিংবা স্বাস্থ্য খাতে। বাংলাদেশে যদিও শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ের মোট পরিমাণ বেড়েছে কিন্তু অন্যান্য অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি হারে। যেটুকু ব্যয় সামাজিক খাতে বৃদ্ধি পেয়েছে সেইটুকু বরাদ্দকৃত অর্থ টার্গেট গ্রুপের কাছে পৌঁছেছে কিনা সে বিষয়েও বিতর্ক রয়েছে। ব্যয়ের কোয়ালিটি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

নিরাপত্তা জাল, এনজিও এবং মাইক্রো ক্রেডিট
বিশ্বব্যাংকের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জেমস উলফসনের একটি সাক্ষাৎকার ১৯৯৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর দৈনিক মুক্তকণ্ঠে প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি ঐ সাক্ষ্যাৎকারে বলেছিলেন:
১। পৃথিবীতে এখন ৩০০ কোটি লোক আছে যাদের দৈনিক আয় ২ ডলারের কম।
২। এদের মধ্যে ৩০ কোটির আয় এমনকি ১ ডলারেরও কম।
৩। ১০ কোটি লোক আছে যারা প্রতিদিন ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমাতে যান।
৪। ১৫ কোটি শিশু আছে যারা স্কুলে যেতে পারছেনা।

এই পরিস্থিতিকে বর্ণনা করার পর তিনি আরো বলেন, ‘আমরা একটি টাইম বোমার উপর বসে আছি- যদি কিছু করা না যায়, তাহলে আমাদের শিশুরা যখন বড় হবে ততদিনে এই টাইম বোমা বিস্ফোরিত হবে।’ কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই অবস্থা নিরসনে বিশ্বব্যাংক ও গ্লোবাল গুরুরা বাস্তবে কি পদক্ষেপের পরামর্শ দিচ্ছেন। বস্তুত তারা অনুঋণ, আত্মকর্মসংস্থান, নিরাপত্তা জাল ইত্যাদি এমন কতকগুলো গরীব মানুষের জন্য টার্গেট কর্মসূচির কথা বলছেন যা দিয়ে পৃথিবীর কোথাও দারিদ্র্য স্থায়ীভাবে দূর করা যায়নি। এসব কর্মসূচির ফলে দরিদ্ররা সাময়িকভাবে তলিয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পায় কিন্তু নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়। অর্থনীতির মূলধারা তথা বৃহদায়তন শিল্প ও কৃষি খাতের উৎপাদনে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে দারিদ্র্য থেকে স্থায়ীভাবে মুক্ত হওয়া সম্ভব হয়না। কম পুঁজি, কম লাভ, কম আয় ও অসংখ্য মধ্যস্বত্ত্বভোগীর বোঝা মাথায় নিয়ে দারিদ্র্য ও কষ্টের মধ্যেই কোনো মতে বেঁচে থাকতে হয় তাদেরকে। এভাবেই দারিদ্র্য বিস্ফোরিত হয়না ঠিকই, কিন্তু দারিদ্র্য টিকে থাকে দীর্ঘ কাল। বিশ্বব্যাংকের এই প্রেশক্রিপশান বর্তমানে আসলে দারিদ্র্য নিয়ে মধ্যবিত্ত ম্যানেজারদের ব্যবসায় পরিণত হতে চলেছে। বিশ্বব্যাংকের নিজের হিসাবেই দেখানো হয়েছে যে, তারা ১০ কোটি দরিদ্রকে জনপ্রতি ১০০ ডলার হিসেবে মোট ১০ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু এই ঋণ প্রদানের “ম্যানেজমেন্ট কস্ট” (Management Cost) হিসাব করা হয়েছে ১১.৬ বিলিয়ন ডলার। তাহলে দেখা যাচ্ছে, প্রতি ডলার ঋণ দরিদ্রকে পৌঁছে দেয়ার জন্য মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা পাবেন ১.১৬ ডলার। এটা কি প্রমাণ করে? গ্লোবালাইজেশনের গুরুরা আমাদের দেশের জন্য যে পলিসি নির্ধারণ করে নিজেদের দেশে সেই পলিসি তারা মানেননা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কৃষিতে ভর্তুকির কথা। কৃষিতে ভর্তুকি উঠিয়ে নেয়ার জন্য তারা সব সময় ৩য় বিশ্বের দেশগুলোর উপর চাপ প্রয়োগ করে থাকে। কিন্তু এক হিসেবে দেখা যায়, ১৯৯৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র চালের বাজার মূল্যের উপরে ৪৯ শতাংশ হারে ভর্তুকি দিয়েছে, জাপানে এই হার ছিল ৩৬৮% এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে ১২২ শতাংশ। একই বছর গরুর মাংসের বাজার মূল্যের উপরে যুক্তরাষ্ট্র ৩৮ শতাংশ, জাপান ১১৩ শতাংশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ১১২ শতাংশ হারে ভর্তুকি দিয়েছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে “ভর্তুকি প্রত্যাহার করে মুক্তবাজার” প্রবর্তনের বিষয়টি দেশ ও পণ্য নিরপেক্ষ নয়। ধনী দেশের কৃষি পণ্যের জন্য হবে এক নিয়ম আর গরীব দেশের গরীব চাষীর জন্য হবে আরেক নিয়ম।

বিশ্বায়ন বিরোধী বিক্ষোভের ঢেউ
আজ অগণতান্ত্রিক পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে শুধু তৃতীয় বিশ্ব নয়। উন্নত দেশগুলোতেও বিক্ষোভের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ছে। এই সব বিক্ষোভে শামিল হচ্ছেন বন্ধ কারখানার শ্রমিকরা। সবুজ দলের তথা পরিবেশ আন্দোলনের প্রতিনিধিরা, অসংখ্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, শান্তিবাদী, সমতাপন্থী এবং বামপন্থী দল ও গোষ্ঠীবৃন্দ। তাদের প্রধান আওয়াজ হচ্ছে “বিশ্বব্যাংক আইএম এফ ও WTO তথা জি-৮ দেশগুলোর নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন প্রত্যাখ্যান করে জনগণের কল্যাণে জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল বৈশ্বিক সংস্থার নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক বিশ্বায়ন চালু করতে হবে। পৃথিবীর বড় বড় শহরগুলোতে এই আন্দোলন চলছে। তাদের এই আন্দোলনের একটি সংক্ষিপ্ত সাম্প্রতিক কালপঞ্জি নিচে দেয়া হলো:

মে ১৯৯৮: জেনেভাতে WTO এর সম্মেলন চলাকালে দাঙ্গা হাঙ্গামা।
১৮ জুন ১৯৯৯: লন্ডনের Financial Center এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ এবং সকল আর্থিক কার্যক্রম বন্ধ।
৩০ নভেম্বর ১৯৯৯: সিয়াটলে WTO সম্মেলনের বিরুদ্ধে জঙ্গী বিক্ষোভ।
২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৯: পৃথিবীর ১১০টি নগর এক সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ভবিষ্যত সভা বিরোধী বিক্ষোভ।
২৬ নভেম্বর ২০০০: বিক্ষোভের মুখে প্রাগে অনুষ্ঠিতব্য সভা পণ্ড হয়ে যায় ও উদ্রোক্তারা সভা স্থগিত ঘোষণা করেন।
২৭ মে ২০০১: বার্সিলোনায় অনুষ্ঠিতব্য বিশ্বব্যাংকের সম্মেলন বিক্ষোভের মুখে স্থগিত ঘোষণা।
জুলাই ২০০১: জেনেভাতে জি-৮ এর অনুষ্ঠিতব্য সম্মেলনের বিরুদ্ধে প্রবল বিক্ষোভ এবং সংঘর্ষে একজন বিক্ষোভকারীর মৃত্যু।

এইসব ঘটনা থেকে বোঝা যায় ভবিষ্যতে বর্তমান পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া বিনা চ্যালেঞ্জে সামনে এগোতে পারবে না।

No comments:

উপরে ফিরে যান