2.21.2008

বহমান সমাজ বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে কবিতা লেখা ও কবির নির্ভরযোগ্যতা

তপন কুমার রুদ্র

আমি এবং অনেকেই হয়ত বড় বেশী ভালোবেসে কবিদের বলি, ‘ওরা ভাবুক, ওরা ভাবতে ভাবতেই কবিতা লেখে। ওদের কোন জাতি নেই, ওদের জাত থাকতে নেই।’ সেই ভালো, কবির জাত না থাকাই ভালো। কিন্তু কবিদের সবার উপরে মানুষ হওয়াটাই আশু প্রয়োজন। ‘নিছক কবির কবিতা’ বড়ই ভয়ংকর। পক্ষান্তরে একজন মানুষের মতো মানুষ, খাঁটি মানুষ, কবিতা লিখে লিখে যিনি নিজের ও পরের বাঁচার ধারাটিকে প্রবলভাবে বিচিত্র এবং আলোকিত করে তুলতে সক্ষম হবেন। তখন তাঁর নিজের উচ্চারণে কিংবা ঘোষণায় নয়, বরং অজস্র সজ্ঞান মানুষ তাঁকে কবি বলে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হতে পারেন। তাই কবি-লিখিয়েদের কাছে সময়ের একটা সতর্কবার্তা এমনই ভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছেÑ ‘শুধুমাত্র কবি হবার জন্য কবিতা লেখার পাগলামিটা করো না।’

আমারও তাই মনে হয়। যে তরুণ কিংবা যে কোন বয়সের বন্ধুটি কবি হবার জন্য আজ বড় চঞ্চল। এক্ষুনি কবি তাকে হতেই হবে এমনই যার ভাব, তাঁর কাছে দিন-রাত্তির মধ্যে কোন ব্যবধান নেই সব একাকার। আশাভঙ্গের বেদনাই হতে পারে তাঁর তাৎক্ষণিক পাওনা। বন্ধুদের সহানুভূতি আর অপরের বিরক্তি হতে পারে তার উপরি পাওনা। উপকারটি হয়তো তিনিই করতে পারেন যিনি ধমক দিয়ে তাঁকে বলে দিবেন- ‘একমাত্র সংবেদনশীল একজন মানুষ হতে পারে কবিতার স্রষ্টা এবং যথার্থ কবিতাই প্রকৃত কবির কাক্সিক্ষত পরিচয় ক্রমাগত জন্ম দিতে থাকে।’
তাই কবি হবার জন্য কবিতা লেখার চেষ্টা বাদ দিলেই ভালো হয়। এখানে ব্যবহারকারী হবার আগে, প্রেমিক হবার বিবেকী দায়িত্বটি পালন করা অত্যন্ত জরুরি।

কবিতাও বড় চতুর। না ধরা গোপনগঞ্জের মত ওর রহস্য। ওকে দখল করতে গেলে ওর জন্য প্রেম খরচ করতে হবে জীবনের মূল্যে। এর জন্য সাধনা উদ্বেগময় হলেও তা গভীরভাবে অন্তর ঘনিষ্ঠ হতে হবে। খাঁটি অর্থে জীবন সংশ্লিষ্ট হতে পারলে কবিতা প্রেম কখনোই কাউকেই পুরোপুরি হতাশ করবে না। খুব তাড়াতাড়ি কবিতা কারুর পাওনা চুকিয়ে দেয় না। এটাও বিশ্বাস করতে হবে। একবিংশ শতাব্দীর এই দ্বিধাগ্রস্থ প্রারম্ভে যিনি আসলেই কবি হবার জন্য বড় বেশি চঞ্চল তার তো আছে অনেক অনেক সান্তনা ও সম্ভাবনা। কারণ চাইলেই তিনি বইয়ের পৃষ্ঠা খুলতে পারেন, পৃষ্ঠা খুললেই তো এমন অনেককে পাওয়া যায় যাঁরা না ধরা যাতনায় দারুণভাবে পরীক্ষিত এবং এদের অনেকেই অনেকাংশে সফল কবিতা প্রেমিক। হতে পারেন তিনি হোমার, সেক্সপিয়র, কালিদাস, ভারতচন্দ্র, হুইটম্যান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা নজরুল। তিনি হতে পারেন সুকান্ত, জীবনানন্দ, সুধীন কিংবা নির্মলেন্দু গুণ। আজকের কবিতা প্রেমিকরা জন কিটস এর ‘সাইকী’কে আলিঙ্গন করতে পারেন। শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা’ নামের রূপটিকে স্বশরীরের কাছে টেনে নিতেও পারেন। কত রস ও রসিকের সন্ধান নব্য কবিদের নাগালের সীমানায় ও ধরা দেয়ার অপেক্ষায়। উদ্যোগে আর চিনে নেয়াতে তার যত অহঙ্কারী আলস্য অথবা অহেতুক দেরি।

কবিতা নামের রূপসী তিলোত্তমাটির প্রতি ধৈর্য্যশীল প্রেমজ্ঞাপনের পথেই আমরা আবিষ্কার করতে পারি নিজের অপারগ আগ্রহের দরিদ্র ছবিটি। সেই একই পথে এগুলে সকলেই হয়ত বুঝতে পারব নিজের কাজের সীমাবদ্ধতা কত দূর। কারণ অন্যের লেখা কোন কবিতার অসংলগ্ন ঝংকার যদি নিজ কানে বেসুরো ঠেকে, অপরিচ্ছন্ন বোধ হয়, তবে নিজের লেখার অসুর তীরটি কেন নিজের কানে বিঁধবেনা? একটি অপ্রতিদ্বন্দ্বী সত্য এই যে, যিনি কবিতা বা অন্য কিছু লেখেন তাঁর প্রতিটি লেখার প্রথম পাঠক তিনি নিজেই। সেখানে তাঁকে নিরপেক্ষ হতে হবে। আবেগান্ধ না হয়ে নিজের লেখার নিরপেক্ষ পাঠক ও নিরপেক্ষ বিচারক হতে পারলে নিজের হতাশা যাবে দূরে, তার জায়গায় জেঁকে বসবে আত্মবিশ্বাস। এরপর তাবৎ কালের শ্রেষ্ঠ কিছু কবিতাকে ভালোবেসে পড়লে সৃজনশীল শক্তির শেকড় আরও দৃঢ় ও গভীরগামী হবেই।

কবিতা কি? এ প্রশ্নটিও চাঙ্গা হয়ে উঠেছে বলে মনে হয়। নোট বই আর গাইড বই এর যুগে ত্বরিৎ গতিতে সংক্ষিপ্ত উত্তর পাওয়ার তাগিদে সবাই যখন চঞ্চল, তখন কবি খ্যাতি প্রত্যাশীরাই বা কেন তার ব্যতিক্রম হবেন। ধৈর্য্যশীল উত্তরদাতাকেও বাধ্য হয়ে তাড়াতাড়ি সংক্ষিপ্ত পথ খুঁজতে হতে পারে। এমন একটা সংক্ষিপ্ত পথ দেখা যাক কবিতার সংজ্ঞা নিরূপণে সফল হওয়া যায় কিনা? ভিক্টোরিয় যুগের ইংরেজ কবি ও সমালোচক ম্যাথু আরনল্ড বলেছিলেন, "The best words in the best order" (অর্থাৎ উপযুক্ত শব্দগুলোকে সর্বোত্তম বিন্যাসে উপস্থাপনের নামই কবিতা)। আশি-পঁচাশি বছর পরও এই সংজ্ঞাটি বেশ জনপ্রিয়। তবে ইতিমধ্যে অন্য যে সব দূরের ও কাছের কবিদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তাঁদের মহত্তম কবিতাগুলো আন্তরিক আগ্রহে বিশ্লেষণ করলে একটু বেশি রকমের স্বচ্ছ ধারণা পেতে পারি নাকি? ‘চেষ্টায় অসাধ্য নেই’- কথাটি মানতে না চাইলেও অন্তর থেকে জোর দিয়ে বলা যায়, ‘চেষ্টায় দোষ নেই।’

কবিতা গুণের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে, মহত্তম কবিতার প্রায় সকল শব্দই বহুমাত্রিক অর্থ ও ব্যাঞ্জনা দান করে। তখনই কোনো লাইন এমনকি কোন ক্ষুদ্র বর্ণনা কবিতার মান পেয়ে যায় যখন তার অন্তর্গত শব্দ বা শব্দগুচ্ছ অভিধানে নির্দিষ্ট করা অর্থের সীমানা অতিক্রম করে ব্যাপ্ত অর্থে বিচিত্র হয়ে ওঠে। একটি উদাহরণের হয়ত প্রয়োজন হয়ে পরছে 'Fragrant Eyed' (সুগন্ধি চোখ) এই মনোগ্রাহী বাক প্রতিমাটি ইংরেজ কবি কিটস এর বিখ্যাত কবিতা 'Ode to Psyche' থেকে নেয়। এখানে এক দেবীপুত্র ও আর এক দেবীকন্যার মিলনছবি প্রকটিত হয়েছে হৃদয় ছোঁয়া শব্দ বিন্যাসে, তারই এক ক্ষুদ্র অবসরে কবি উল্লেখিত এই বাকপ্রতিমাটি ব্যবহার করেছেন। “সুগন্ধি চোখ” এমনই এক দৃশ্যপট যেখানে চোখও দেখছি ফুলও দেখছি আবার সুগন্ধের স্পর্শও পাচ্ছি। কিন্তু চিহ্নিত অর্থের তুলনায় অনেক বেশি কিছু পাচ্ছি নাকি? একজনের চোখ আর একজনের চোখে কখন এবং কেন সুগন্ধি হয়ে ওঠে। আসলে কিটস এর ‘সুগন্ধি চোখ’ শুধুমাত্র সুগন্ধ আর শুধুমাত্র চোখ নয়। এর ব্যাঞ্জনা ও ভাবের গভীর আবেগ সংবেদনশীল পাঠককে অভিনব কিছু একটা আবিষ্কার করতে প্রেরণা যোগায়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের এমনই অসংখ্য কবিতা আছে যার শব্দ বিন্যাসের কোষে কোষে আমরা আবিষ্কার করতে পারি। নিজের অন্তরে জাগ্রত যেসব চিত্র ও প্রবণতা নিয়ত একটি মানুষকে জাগিয়ে রাখছে যেসব প্রতিচ্ছবি ও প্রতিধ্বনি কবিগুরুর অজস্র গানে, কবিতাতে এমনকি তাঁর ছোট গল্পে বহু লাইনে বিশ্বস্ত মাত্রায় প্রতিভাত হচ্ছে, তাঁর ‘সোনার তরী’ কাব্যের ‘নিদ্রিতা’ নামের কবিতায় পড়া একটি পংক্তিমালা এই প্রসঙ্গে ব্যবহার না করে পারছিনা-
“নিমেষে পাছে সকল দেশে জাগে...
শঙ্কা মোর চলিল আগে আগে
কমল ফুল বিমল শেজখানি
নিলীন তাহে কোমল তনুলতা
মুখের পানে চাহিনু অনিমেষে
বাজিল বুকে সুখের মত ব্যথা "

তাঁর ‘বাঁশি’ কবিতার সেই শব্দমালাগুলোই বা কম কীসে-
“ঘরেতে আসেনা সে
মন তার নিত্য আসা যাওয়া
পরনে ঢাকাই শাড়ি
কপালে সিঁদুর”
‘বাঁশি’ কবিতার উপরোক্ত শব্দগুলোর অর্থের কোনো সীমানা নেই। শব্দগুলোর প্রচলিত অর্থ এখানে বিচিত্র মাত্রায় বিস্তৃত পরিসর লাভ করেছে। প্রতিটি মানব মনে দৃঢ়মূল একটি আকাক্সক্ষা ক্রিয়াশীল তাহল এমন এক সুন্দরকে কামনা করা যা আসলে কোনো দিনই কেউ স্পর্শ করতে পারেনা। স্পর্শ করা তো সম্ভবই নয় বরং বলতে পারি চিরবাঞ্চিত সেই সুন্দরের বাসনা কেবল অনুভবে ও চিন্তায় তাকে মনের চোখেও পূর্ণ অবয়বে কেউ দেখতে পায়না। অতএব সেই চিরবাঞ্চিত সুন্দর মনে আসে বারবার, কিন্তু ঘরে অর্থাৎ বাস্তবে কদাচিত আসে। চিরন্তন এই বাসনায় সুখ আছে তবে দুঃখও সেখানে গভীর। বিশ্বজনীন এই অপূর্ণ আবেগ বিশ্বকবি তার ‘বাঁশি’ কবিতায় কি অদ্ভূত সুষমায় শিল্পমণ্ডিত আকারে প্রতিভাত করেছেন। সেই সাথে আরও যা করেছেন তা কেবল তার মতো কবির পক্ষেই সম্ভব। সেটি হল এই, যখন তিনি বলেছেন ‘পরনে ঢাকাই শাড়ি কপালে সিঁদুর।’ চিরন্তন মানব বাসনা বা মানব বেদনা একটি হৃদয়ে স্থায়ী হওয়া একটি সুন্দর কামনার বঙ্গজ প্রতিকৃতি, অর্থাৎ ‘পরনে ঢাকাই শাড়ি কপালে সিঁদুর’ এ যেন সিন্ধু ও বিন্দুর অপূর্ব মিলন; এক অসাধারণ শৈল্পিক সমন্বয়, যা গুণে-জ্ঞানে আর ধ্যানে অনুভবে পূর্ণ ও অথচ মার্জিত। আমাদের সমকালের কবিদেরও সেই ক্ষমতা অর্জনে নিবেদিত হওয়া আশু দরকার। সেই ক্ষমতা যা বহুমাত্রিক বাকপ্রতিমা নির্মাণের জন্য প্রয়োজন।

এমনটাও হয় যে একটি মাত্র শব্দ যা একটি নামের কিংবা একজন ব্যক্তির উল্লেখ বা একটি ইতিহাসের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে এমন একটি বিশাল প্রতিশ্রুতিময় চেতনা প্রবাহ পরিস্ফুট হতে পারে কালজয়ী ব্যঞ্জনা নিয়ে। এর জ্বলজ্বলে উদাহরণ অবশ্যই দেয়া যায়। মাত্র একুশ বছর বয়সে মারা যাওয়া কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘লেনিন’ কবিতাটিতেই সেই কাব্যশক্তির উদাহরণ পাওয়া যায়। কবিতাটির গোড়ায় লাইন দুইটি এমন-
“লেনিন ভেঙেছে রুশে জনস্রোতে অন্যায়ের বাধ
অন্যায়ের মুখোমুখি লেনিন প্রথম প্রতিবাদ।”

কবি যদি এখানেই থেমে যেতেন তা হলেও রক্ষা পেতাম আমরা, যারা বড় বেশি চঞ্চল কেবল কবি হবার জন্য। কারণ এই লাইন দুইটিতে ‘লেনিন’ নিছক একটি ইতিহাসের প্রতি ইঙ্গিত। কিন্তু আবার যখন দেখি-
‘আজকেও রুশিয়ার গ্রামে ও নগরে হাজার লেনিন যুদ্ধ করে...
বিপ্লব স্পন্দিত বুকে মনে হয় আমিই লেনিন।’
তখনই পড়তে হয় বিপাকে। কিভাবে ‘লেনিন’ বা একটি নাম যার উচ্চারণ ঘটল একটা সংগ্রামশীল চেতনা ও প্রবাহের প্রতীক রূপে। এখানে লেনিনকে বুঝতে হচ্ছে একটি আদর্শ ও একটি বিশাল অঙ্গিকারের দ্যুতিময় স্থাপত্য রূপে।
কবিতা তো গদ্য নয়। এর একটি উচ্চারণে বিধৃত হবে বহুমাত্রিক ইঙ্গিত। যেন এও এক ছলনা। যে বোঝাবেনা কিছুই অথচ ভালোবাসলে তাকে বোঝা বড় বেশি কঠিন নয়। তবে এতটুকুও বোঝা যায়না এমন কোনো প্রতিমা কবিতা নামের গৌরব অর্জন করেছে তা কেউ বিশ্বাস করতে পারেনা বলেই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। ইঙ্গিতময়তার জোরেই নারী পুরুষের কাছে বড় প্রিয় এবং পুরুষও নারীর কাছে তেমনটা। তবে একটু বেশি খোলামেলা বলেই হয়ত পুরুষ নিয়ে নারীর স্বপ্ন ততটা আকুল নয়, যতটা পুরুষরা ব্যাকুল নারীর জন্য। সম্ভবত, তাই ইতিহাস বলে দেয় পুরুষ রোমান্টিক কবির সংখ্যার তুলনায় নারী রোমান্টিক কবি সংখ্যা বড় সীমিত। তবে এই ক্ষণে এই নারী-পুরুষ প্রসঙ্গটি অবান্তর মনে হলেও দোষের কিছু নেই। আমাদের কালের কবিরা অবশ্যই একটা কথা ভাবতে পারেন। তাঁরা নিজেকে প্রশ্ন করতে পারেন, ‘কি নেই আমাদের?’ কেননা এমন একটা পৃক্ষাপট বিরাজ করছে যেখানে রুচিশীল এবং সচেতন ব্যক্তিমাত্রই অনুভব করছেন একটা অব্যক্ত অভাব। যাঁদের রুচি-রুটি তথা ভাতের অভাব নেই তাঁদের মধ্যেই যারা রুচিশীল, অন্তত তাঁরা বোধ করছেন ‘কিছু একটা’ নেই যা থাকা দরকার ছিল। নিত্যদিনের জীবন চর্চায়, জীবিকার অন্বেষায়, শিক্ষা অর্জনে কিংবা সামাজিক এবং পেশাগত কাজকর্মে সবাই যেন অতৃপ্ত। কি যেন নেই যা থাকা উচিত ছিল। নেই নেই এই ভাবটা সবাইকে পীড়িত করছে। এই পীড়ন বর্তমান বাস্তবতায় সমাজ সচেতনতারই অঙ্গ। এই সচেতনতা কবিকেও ধারণ করতেই হবে। অবশ্য অনেক কবি বন্ধু ইতিমধ্যে ভাবতে শুরু করেছেন, শুধু কবিতা নয় জীবন নিয়েও তাদের এই ভাবনা।

আমাদের কি নেই? আছে তো অনেক কিছু। প্রায় দেড় হাজার বছরের সাহিত্য চর্চা আমাদের ইতিহাস- আমাদের আছে একজন রবীন্দ্রনাথ, আছে একজন কবি নজরুল, আরও আছে একজন সুকান্ত, আছে আপন ভরা একজন জীবনানন্দ দাস। আমাদের আছে বিশ্বনন্দিত ২১শে ফেব্র“য়ারি, আরও আছে রক্তাক্ত ইতিহাস, একাত্তুরের মুক্তি সংগ্রাম, আর সৃজনশীল বজ্রকণ্ঠ। আমরা ভুলতে পারিনা আমরাও টংক ও তেভাগা আন্দোলনের মত সংগ্রামী ইতিহাসের উত্তরাধিকারী। অথচ ‘কি নেই, কি নেই?’ -এই প্রশ্ন আমাদের বিবেককে বিদ্ধ করছে অনুক্ষণ। সম্ভবত, এর একটা উত্তর আছে সেটা এই আমরা পরস্পরের কাছে সকলেই বিশ্বাসঘাতক। আমাদের নিজেদের কাছে নিজেরাই নির্ভরযোগ্য নই। আসল অভাবটা এখানেই। নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি নেই, নির্ভরযোগ্য শিক্ষক নেই, নির্ভরযোগ্য ডাক্তার নেই, নির্ভরযোগ্য রাজনৈতিক নেতা ক্রমেই যেন অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। আমরা ভুলে যাচ্ছি নির্ভরযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কথা; যথার্থ ধর্মজ্ঞানসম্পন্ন মানুষও যেন বড়ই দুষ্প্রাপ্য। নির্ভরযোগ্য কবির চেহারাও কল্পনা করা অসম্ভব হয়ে পরেছে। কারণ হিপোক্রিসি অর্থাৎ ভণ্ডামী যখন জাতির সকল কবজায় মরচে ধরিয়ে দিচ্ছে তখন নির্ভরযোগ্যতা এক ‘ইমপসিবল কোয়ালিটি’ হিসেবে গণ্য হতে বাধ্য। আজকের কবিকে নির্ভরযোগ্য খাঁটি মানুষ হিসেবে দাঁড়াতে হবে। কাউকে তোষণ করা কিংবা অহেতুক কাউকে চটানো কোন নির্ভরশীল কবির দায়িত্ব নয়। তিনি যা সত্য বলে ভালোবাসেন তাই কবিতার আঙ্গিকে ফুটিয়ে তোলা তার আদর্শ। পূর্বপুরুষের ঋণ শোধের অঙ্গিকার আর সমকালের অভাবী মানুষ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে পেতে হবে কবিতা লেখার প্রেরণা আর সেই উৎস থেকে কবিতার বাণী যতক্ষণ পুষ্টি সঞ্চয় করতে পারবে না ততক্ষণ কবিকে সংগ্রাম করতে হবে নিজের সীমাবদ্ধতা ও অসামর্থের বিরুদ্ধে। এই সংগ্রাম শেখার জন্য চাই নিরন্তর ইতিহাস চর্চা ও কবিতা পাঠের অনুশীলন আর চাই কবিতার প্রতি নির্ভরযোগ্য অগাধ ভালোবাসা।

একবিংশ শতাব্দীর আরম্ভ পর্বে বাংলাদেশে কবিতার চর্চায় একটা ভিন্ন মাত্রিক ‘আরম্ভের’ শুরু হলো। হয়ত নতুন শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের সংস্কৃতি একটু বেগ পেতে পারত। একটা ঐতিহাসিক উদাহরণ থেকে এই ‘আরম্ভের’ সূচনাটা ঠিক কেমন হবে তার রূপরেখা নির্দিষ্ট করতে আমরা প্রেরণা পেতে পারি। লাটিন আমেরিকার দেশ চিলিতে পাবলো নেরুদা বলে একজন কবি ছিলেন। বিশ শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশক এবং সত্তর দশকের গোড়া পর্যন্ত সময়কালে তার দায়বদ্ধ কাব্যসংগ্রাম পরম সুস্থ্যতায় জাতীয় সংঘবদ্ধ মুক্তিকামী অঙ্গিকারে সংগঠিত হতে একটি আদর্শনিষ্ঠ পথে এগিয়ে নিয়েছিল। সেই কবিই জাতির প্রয়োজনে জনগণের দাবীতে রাষ্ট্রপতি পদের জন্য নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আবার জাতির বৃহত্তর স্বার্থে তারই আদর্শের অনুসারীদের পরামর্শে সেই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। বিপরীতমুখী দুইটি সিদ্ধান্তই কালের বিচারে ছিল ঐতিহাসিক এবং গবেষণা করে দেখার মতো বিষয়। সভ্যতার আসল কারিগর মেহনতি মানুষের উদ্দেশ্যে তাঁর অজস্র কাব্য উচ্চারণের মধ্যে অত্যন্ত স্মরণীয় একটি ঘোষণা এমন “হারাবার মতো আছে শুধু শৃংখল অথচ জয় করবার মতো আছে গোটা পৃথিবীটা।” তিনি আরও বলেছেন “তোমাদের পিঠ ফাটা, হাত ফাটা, আছে উপবাস কিন্তু তারপরও তোমাদের আছে একজন কবি।” সেই জন্যই আজ অবশ্যই কেউ মনে করতে পারে শুধু মাত্র আরও কজন রবীন্দ্রনাথ নয়, চাই আরও অনেক অনেক জন পাবলো নেরুদা। এ চাওয়াতে অপরাধ হলে দোষ কি?

সময় সমাগত মনকে ডেকে তুলবার জন্য যে কবি সমন্বিত সৌন্দর্যের একান্ত পূজারী এবং বিবেকের কাছে বিশ্বস্ত সেই চাইলে হতে পারে পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য। সময়ের বিচারে সেই প্রয়োজনীয় যোগ্যতা কবিরা অর্জন করুক। একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে হোক তার আরম্ভ। কবিদের গন্তব্য স্থির হোক মানব মুক্তির বৃহত্তম সংগ্রামে।

No comments:

উপরে ফিরে যান