2.21.2008

কৃষক শ্রমিক ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধ

শামছুন নাহার চৌধুরী

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিস্তার আকাশের মতই বিশাল। মাত্র কয়েকজনের চোখে তা দেখা সম্ভব নয়। অনেকগুলো খণ্ডচিত্র জোড়া দিলেও তা হয়ে উঠতে পারে একটি আংশিক চিত্রমাত্র, কেননা এ যুদ্ধে যারা অংশ নিয়েছিলেন তারা এদেশেরই লক্ষ লক্ষ নারীপুরুষ যারা পেশায় নানাভাবে জড়িত এবং লক্ষ লক্ষ শহীদ যারা প্রাণ দিয়েছিলেন তাদের কথা কে কিভাবে লিখবে! তাদের নাম সহ যুদ্ধে অবস্থানের কাহিনী হয়তোবা লেখা যাবে কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে তারা কি ভেবেছিলেন তা কে জানে! আর সে জন্যই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চিরকালই থেকে যাবে অসম্পূর্ণ। এমনিভাবেই হয়তোবা সর্বকালে সর্বদেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনায় অসম্পূর্ণতা রয়ে গেছে।

এমনিভাবে আমাদের বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনায় যারা অগ্রগামী হয়েছেন তাদের অধিকাংশ লেখায় (আমার পড়ার আওতায়) যুদ্ধের মূলকাহিনী লিপিবদ্ধ হয়েছে অত্যন্ত বর্ণনামূলকভাবে। যা তথ্যে পূর্ণ এবং রোমাঞ্চকর ও বেদনাময়। সে সব কাহিনী পড়লে অনেকসময় মনে হয় আমিই বুঝি বা দাঁড়িয়ে আছি সেই যুদ্ধের ময়দানে। অবস্থান নিয়েছি শত্র“পক্ষের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো সৈনিকের পাশে। নিজের অজান্তেই নিজেকে যুদ্ধক্ষেত্রে আবিষ্কার করে ধন্য মনে হয়েছে নিজেকে। আর এই যে মহান যুদ্ধ, এই যুদ্ধে বিরাট একটি অংশ জুড়ে রয়েছে এদেশের সন্তান। এদেশের কৃষক শ্রমিক। সেই ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবে পলাতক সিপাহীদের আশ্রয় দিয়ে, ব্যারাক থেকে ব্যারাকে, সিপাহীদের মাঝে খবরাখবর পৌঁছে দিয়ে যারা এই বিদ্রোহকে সফল করতে সহায়তা করেছিলন তারাও ছিলেন এদেশের কৃষক। সিপাহীদের সাথে কৃষকদের মিলিত এ বিদ্রোহকে তাই পরবর্তিকালের ঐতিহাসিকগণ স্বাধীনতা যুদ্ধ বলেও অভিহিত করেছেন। যদিও তা বিভিন্ন কারণে সফল হয়নি।

আমাদের ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে এদেশের মানুষ, এদেশের কৃষক শ্রমিকগণ যে ভূমিকা রেখেছিলেন তা স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করেছিল, তারা অস্ত্রহাতে যেমন ছিলেন যুদ্ধের মাঠে, তেমনি দেশের অভ্যন্তরেও প্রতিরোধ ও সশস্ত্র অবরোধে অংশ নিয়েছিলেন ব্যাপকভাবে। এক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই “রক্তে ভেজা একাত্তর” এর লেখক মেজর(অব.) হাফিজ উদ্দিন আহম্মদকে যিনি ৩০ মার্চ যশোহর ক্যান্টনমেন্টে বিদ্রোহ করে তার দল নিয়ে বেড়িয়ে গ্রামে এলে শত শত নারী পুরুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে তাদের অভ্যর্থনা করে। ডাব কেটে দেয়, নাম না জানা একজন দরিদ্র কৃষক রাতে আশ্রয় দেয় লেখককে এবং একটি মাত্র চৌকি ছেড়ে দেয় তাদের ঘুমোবার জন্য। স্বল্প আহার কিন্তু অত্যন্ত যত্নসহকারে তুলে দেয় তাদের মুখে(পৃ. ৩০)। মহেশপুরের চৌরাস্তার ট্রাকটরের ড্রাইভার আলী মিঞা সরকারি গোডাউন থেকে স্থানীয় জনগণের সহায়তায় চাল, ডাল সহ খাদ্য সরবরাহ করেছিল নিজের জীবন বিপন্ন করে এই বাহিনীকে (পৃ. ৩০)।

অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে ৩৫ জনের একটি বাহিনী শ্রীমঙ্গল রেইডের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলে গাইড হিসাবে কাজ করে চা বাগানের কুলি হরি। ঠিক যাত্রার মুহূর্তে খবর আসে হরির আসন্নপ্রসবা স্ত্রী অসুস্থ। হরি চলে যায় স্ত্রীর কাছে। এক ঘন্টা পর খবর আসে হরির স্ত্রী একটি মৃত সন্তান প্রসব করে মারা গেছে। সবাই চিন্তিত হয়ে পড়ে এ অবস্থায় হরিকে কিভাবে কাজে লাগাবে। আর এই মুহূর্তে হরির মতো গাইড ছাড়া চা বাগানের মাঝ দিয়ে রাস্তা চিনে যাওয়াও সম্ভব নয়। কিন্তু চিন্তার অবসান হয় ঠিক আধা ঘন্টা পরই। হরি কাঁদতে কাঁদতে এসে উপস্থিত প্লাটুনের সামনে। ঐ মানসিক অবস্থায়ও তার উপর অর্পিত দায়িত্ব গাইড এর কাজ সম্পন্ন করেই সে নিরুদ্দেশে যাত্রা করেছে। কেউ তার খোঁজ পায়নি আর সেদিন হরির সহায়তা আর অংশগ্রহণ ছাড়া সম্ভব ছিলনা এই অপারেশনের (পৃ. ৯৬)। আটগ্রাম থেকে জাকিগঞ্জ পর্যন্ত শত্র“মুক্ত এলাকায় পলায়নরত পাকসেনাদের পকেটগুলো সরিয়ে মিত্র বাহিনীর সঙ্গে Link up করতে গ্রামবাসীদের যে সহায়তা তা যশোহর ক্যাম্প ছেড়ে আসার দিনের মতই উদ্দীপক (পৃ. ১০৮)।

মুক্তিযুদ্ধের এমনি একজন আরেক যোদ্ধা তাগড়া। ছাব্বিশ বছরের এক যুবক। সমুদ্র উপকুলের চরাঞ্চলে জোতদারদের চরদখলের সৈনিক একাত্তুরে হয়ে গেল দেশমাতার মুক্তির জন্য যোদ্ধা, সৈনিক, গণযোদ্ধাদের একজন। ১৭ নভেম্বর শর্ষিনার পীরের বাড়ীতে শত্র“র আস্তানায় আক্রমণের উদ্দেশ্যে আসার সময় পথে অবরুদ্ধ অবস্থায় একজন পাক সৈন্যের মল্লযুদ্ধের আহ্বানে সাড়া দিতে গেলে পাক বাহিনীর গুলিতে শহীদ হয় এই তাগড়া নামের ছেলেটি-(জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা- লেখক মেজর কামরুল ভুইয়া)। (পৃ. ৩৮)

মদনের কেন্দুয়া এলাকায় পাক সেনাদের মগরা নদী পার হয়ে আসার সময় যারা অস্ত্র হাতে লড়াই করে তাদের অগ্রাভিযান বন্ধ করে দিয়েছিল তারা সোবহান, গাজী, রমজান, আইয়ুব আলী। এরা সবাই এ গাঁয়েরই ছেলে। কৃষক শ্রমিক। (পৃ. ৬২)। জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা। দু’দিন ধরে এগ্রামে যুদ্ধ হয়েছিল। আইয়ুব, রমজান, কুদ্দুস শহীদ হয়েছিল এখানে। ২য় দফায় ৩১ অক্টোবর পাকবাহিনী উক্ত পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে মদন আক্রমণ করেছিল। জনযোদ্ধাদের সহায়তায় মুক্তিবাহিনী ৭ নভেম্বর মুক্ত করে মদনকে। মুক্ত মদনের সাধারণ মানুষ কবর খুঁড়ে মৃত পাক সেনাদের লাশ তুলে নদীতে ফেলে দেয়। ঘৃণা আর আক্রোশে মদনের মানুষ উচ্চারিত করে “জীবিত কিংবা কোনও মৃত পাকিস্তানী রাখব না আমরা মদনে” মোট ৪২টি লাশ কবর খুঁড়ে এবং ৮২টি লাশ বাংকার থেকে উদ্ধার করে গ্রামবাসী (পৃ. ৬৭)। ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে দুই কোম্পানীর মোট তিনশ জন যোদ্ধার মধ্যে মাত্র দশ জন পদাতিক, আট জন ইপিআর ও তিনজন পুলিশ। বাকি সবাই মাত্র সাত দিনের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষ যারা পরবর্তী কালে ময়মনসিংহ সীমান্তে নকশী বিওপিতে পাকিস্তানী প্রতিরক্ষা ব্যুহ আক্রমণ করেছিল। (জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা, পৃ.৭৮) সরাসরি যুদ্ধ না করলেও অন্যরকম একটি যুদ্ধ করেছিল মোকছেদ নামের এক নৌকা চালক। যার কাজই ছিল যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের নদী পাড়াপাড় করা। যুদ্ধ দেখতে দেখতেই মোকছেদ একদিন প্রস্তাব দেয় কুমিল্লা দাউদকান্দি সড়কের উপর খাদখড় এলাকার ব্রিজটি অপারেশনের। নৌকার মাঝি হয়েও সে খুব সুন্দরভাবে এই অপারেশনের পরিকল্পনা শোনায় লেখককে। যা অতিমাত্রায় উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও সাহসী পরিকল্পনা। রণকৌশলগত কারণে সামান্য কিছু পরিবর্তন করে মোকছেদ এর মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী এই ব্রিজ অপারেশন করে সফলতা আনে যোদ্ধারা। এই অপারেশনের মূল প্রণেতা মোকছেদ কোনো অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করেনি। যুদ্ধের সময় শুধু গুলির বাক্স কাঁধে বহন করে নিয়ে গিয়েছিল। অস্ত্র ছাড়াই এক অন্যরকম আশ্চর্য যুদ্ধ করল মোকছেদ এভাবেই। (জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা, পৃ. ৮৭)। এভাবেই আরেকজন জনযোদ্ধার নাম পাওয়া যায় এই বইয়ে। তার নাম আমজাদ। গ্রামের একজন সাধারণ মানুষ। ৯৬ জন ছেলের একটি দল যখন ত্রিপুরার মেলাগড়ে ২ নম্বর সেক্টরের সদর দফতর থেকে কুমিল্লার মুরাদনগরের আসবে তখন রাস্তা পার হবার প্রাক্কালে শত্র“ সৈন্যের আক্রমণের শিকার হয়। রাস্তা পারাপারের কোন সুযোগ নেই। কারণ সেখানে শত্র“ সৈন্যের সারি সারি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। চারিদিকে গুলি শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। এমন সময় এই সাধারণ মানুষটি এসে দাঁড়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে। পূর্বের কোন পরিচয় নেই। শুধুই স্বাধীনতার যোগসুত্র। সেই পরামর্শ দেয় শত্র“সৈন্যের গাড়ির নিচ দিয়েই রাস্তা পারাপারের একমাত্র পথ। যা অত্যন্ত বন্ধুর ও বিপদজনক। কিন্তু অন্য উপায়ও নেই। আমজাদের নির্দেশিত পথ দিয়েই সকল মুক্তিযোদ্ধা নিরাপদে পৌঁছে যায় নদীঘাটে এবং নৌকাও গ্রাম থেকে সেই জোগাড় করে দেয়। এভাবেই এদেশের হাজারো কৃষক শ্রমিক অংশ নেয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধে। (পৃ. ৮৮)

খিলগাও স্কুলে অপারেশন শেষে লেখক যখন ফিরছিলেন তখন নাম না জানা এক সাধারণ স্কুটার চালক লেখকের অস্ত্র তার যাত্রীসিটের নিচে লুকিয়ে রাখে; তাকে নিরাপদে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেয়। (একাত্তুরের গেরিলা পৃ. ১৪২) এমনিভাবেই এদেশের লক্ষ লক্ষ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যদি অনুসন্ধান করা যায় তা হলে দেখা যাবে যে শতকরা আশিভাগ যোদ্ধাই ছিলেন গ্রামের। আর বাকী যারা শহুরে ছিলেন তাদের মধ্যেও অনেকেই গ্রাম থেকেই এসেছেন আর আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একটি বৃহৎ অংশ যারা গেরিলাযোদ্ধা তাদের সমস্ত রকম সফলতার পিছনে কিন্তু জড়িয়ে আছেন আমাদের অতি সাধারণ মানুষ। তারা আশ্রয় না দিলে, সহযোগিতা না করলে তথ্য না দিলে কিন্তু গেরিলা যুদ্ধ কখনো সম্ভব হোতনা। আসতোনা কোন সফলতা, এই যুদ্ধে গাইড হিসাবে যারা কাজ করেছেন, হাইডআউট অর্থাৎ মুক্তিবাহিনীকে যারা গ্রামে গঞ্জে লুকিয়ে থেকে যুদ্ধ করার জন্য আশ্রয় দিয়েছেন সেই আশ্রয় স্থল বা হাইডআউট নির্ধারণ করতে যারা সহায়তা করেছেন তারা সবাই গ্রামের নিরন্ন জনসাধারণ। এক্ষেত্রে মাহবুব আলম রচিত ‘গেরিলা থেকে সম্মুখ যুদ্ধে’ দু’খণ্ডে রচিত বইটি ইতিহাসে কৃষক শ্রমিকদের অবদানের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য উপাদান। যেমন ট্রেনিং সমাপ্ত করে লেখক যখন প্রথম ভেতরগড় বাংলাদেশের একটি গ্রামে ঢুকতে যাচ্ছেন তখন গ্রামের সাধারণ মানুষ তাদের অভ্যর্থনা জানায় সাদরে। যখন জানতে পারে তারা মুক্তিফৌজ। কিছুক্ষণ আগেও গ্রামবাসীরা বস্তিবাসী জাগো বলে গ্রাম পাহারা দিচ্ছিলেন। তারা অপেক্ষা করেই ছিলেন কবে আসবে মুক্তিবাহিনী। তারাই প্রথম গাইড জোগাড় করে দিলেন মুক্তিযোদ্ধাদেরকে।

এই যোদ্ধা ও গ্রামবাসীদের প্রথম মিলনের যে বর্ণনা তা সত্যিই হৃদয়কে স্পর্শ করে যায়। আর মুক্তিযোদ্ধা তো এক নিরলস যোদ্ধা। কুমিল্লার লোক তিনি। জীবনের তাগিদে দিনাজপুরের পঞ্চগড় এলাকায় এই জঙ্গলাকীর্ণ এলাকায় কৃষক হিসাবে বসতি স্থাপন করেন। বিভিন্ন ব্রিজ অপারেশনে মকতুমিঞার ভূমিকা দক্ষতা অপূর্ব। তালম ব্রিজ অপারেশনে তিনি গ্রামের জোনাব আলী, ওমর আলীকেও প্রত্যক্ষ কাজে লাগিয়েছিলেন। (খণ্ড ১ম, পৃ. ৬৭) বিসমনি ব্রিজ অপারেশন ২৭ জুলাই। সমস্ত বাহিনী আশ্রয়নের ধনাদাসের বাড়িতে, সমস্ত কমিউনিটি ও নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এতগুলো মানুষকে হাইডআউট এ আশ্রয় দিয়েও তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না যে তিনিও একজন মুক্তিযোদ্ধা, দেশের জন্য কাজ করেছেন। (খণ্ড ১ম, পৃ. ১৭০) ৩১শে জুলাই হাইডআউট ভাবলা মিঞার বাড়িতে ৪/৫টি ঘরের মধ্যে ২টি ঘরই ছেড়ে দেয় মুক্তিবাহিনীর জন্য। বিসমনি ব্রিজ অপারেশনের পর ১ আগস্ট পাক সৈন্য আসে এখানে। গ্রামের সাধারণ মানুষ মুক্তিসেনাদের অবস্থানের খবর খুব সযতেœ লুকিয়ে রাখে এবং এ বিষয়ে বিস্তারিত খবর দেয় আমানউল্লাহ মিয়া বলে একজন সাধারণ মানুষ। তার দেয়া খবরের উপর নির্ভর করেই গেরিলা যোদ্ধাগণ পরবর্তি অপারেশনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়। (পৃ. ১৯১, খন্ড ১ম) মধুপাড়ার যুদ্ধে শহীদ আক্কাস নিহত হলে গ্রামবাসীরাই তার কাফন ও মিলাদের ব্যবস্থা করে। যেন তাদেরই সন্তান ছিলেন শহীদ আক্কাস। (পৃ. ২১৩, খন্ড ১ম)

করতোয়া পাড়ের হাসান মাঝি। তার পরিবার ভারতের মানিকগঞ্জ শরণার্থী শিবিরে ছিল। তিনি যখন খবর পেলেন যে মুক্তিযোদ্ধাগণ তার বাড়ীতে হাইডআউট স্থাপন করেছেন তখন তিনি ছুটে এসেছেন তাদের সাহায্য করতে। যেন অনেক দিনের ঘনিষ্ঠ স্বজন তার বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। সব ধরণের তদারকিসহ পানিতে ডোবানো নৌকাটিও ইতিমধ্যে তুলে ভাসিয়ে রেখেছেন প্রয়োজনের জন্য। সর্বদা সজাগ, সতর্ক, শুধু একা নয় তার ১৩/১৪ বছরের ছেলেকেও সাথে নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন, ফাইফরমাশ খাটার জন্য গ্রামের নিজস্ব লোক এনে দিয়ে নৌকাপাড়ে বসে পর্যবেক্ষণের কাজটিও করে যাচ্ছেন অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে। যেন জীবনের বৃহৎ উৎসবে মেতে উঠেছেন হাসান মাঝি।

শুধু কি তাই রাজাকারদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া মুক্তিযোদ্ধা মন্টুর পরিবারের সকল নারী পুরুষকে উদ্ধার করে ফেরার পথে আবারও ভরসা, হাসান মাঝি। মারোয়ার দ্বিতীয় আক্রমণের খবরও অত্যন্ত দ্রুত ও নির্ভুল এনে দেয় এবং করতোয়া নদী পাড় করে নিরাপদ স্থানে পৌছে দেয়। এই দলটির সাথে এমনি একজন সাধারণ মানুষ হাসান মাঝির একাত্ম¡তা মুক্তিপাগল বলেই শুধু সম্ভব হয়েছিল। (পৃ. ১০১, পৃ. ১১৩, খন্ড ২য়)

আরেক গাইড জোনাব আলী। যুদ্ধের প্রথমদিকে সহযোদ্ধা। এখন পাক বাহিনীর আক্রমণের মুখে দিশেহারা। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার অপরাধে অনেক ধকল যাচ্ছে তার পরিবার ও গ্রামটির উপর দিয়ে। সীমান্ত এলাকা বলে বি. এস. এফ. দের সাথে অতীতের মতানৈক্যর কারণে ভারতের সীমানাও পাড় হতে পারছেনা। জোনাব আলী রাজাকার আর পাকসেনাদের ভয়ে দিনের বেলা পালিয়ে থাকে শিয়ালের মতো। কিন্তু অত্যন্ত গোপনে তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে সে তার গোপন অবস্থান জানিয়ে রেখেছেন, যদি কখনো কোনো মুক্তিযোদ্ধা আসে। তাদের যদি গাইড বা অন্য কোন সাহায্যের প্রয়োজন হয় তখন তিনি যেন তাদের সাহায্য করতে পারেন। (পৃ. ২৬৮, ২৭০, খন্ড ২য়) এমনি শত শত জোনাব আলী, সোনামিঞা, মতি, নূরুমিঞা, হুজুর ছড়িয়ে আছে যুদ্ধক্ষেত্রে। যাদের সাহায্য ও সহযোগিতা, অংশগ্রহণ মুক্তিযুদ্ধকে এনে দিয়েছে সফলতা।
মুক্তিযুদ্ধের বিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে ১৯৯১ সালে যে বিজয়মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সেই মেলাকে কেন্দ্র করে যে বিস্তৃতি ও পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে গবেষণারত বি আই ডি এস- এর গবেষকগণ মেলাতে যান এবং সমবেত ১৫৯ জন মুক্তিযোদ্ধার সাথে আলাপ আলোচনা, প্রশ্নমালা ব্যবহার করা ছাড়াও তাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলেন, এতে যে ১৫৯ জন মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার তারা গ্রহণ করে তথ্য দিয়েছিলেন তাতে দেখা যায় যে তাদের মধ্যে শতকরা ৭৮ ভাগের বসবাস ছিল গ্রামাঞ্চলে, বাকী ২২ জন থাকতেন শহর অঞ্চলে। কুষ্টিয়া ও ময়মনসিংহে এই সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছিল প্রত্যন্ত অঞ্চলে। যশোর ও কুমিল্লার শহর ও গ্রাম মিলিয়ে শুধুমাত্র চট্টগ্রামে শহরে। তবে চট্টগ্রামে যাদের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছিল তাদের ৫০ ভাগের বসবাস ছিল গ্রামাঞ্চলে- মুক্তিযুদ্ধের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন। (পৃ. ২৫) এই বইটিতে আরো একটি তথ্য দেখা যায় যে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে শতকরা ৬০.৩৭ জন ছাত্র। ১২.৫৮ জন চাকুরিজীবি, ১১.৯৫ জন কৃষক, ৮.১৮ জন ব্যবসায়ী, ১.৮৯ জন শিক্ষক, বেকার ১.২৬ জন। তবে ছাত্রদের বেশির ভাগই ছিলেন কৃষকের সন্তান। এভাবেই দেখা যায় যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের যোদ্ধাদের মধ্যে কৃষকদের সংখ্যাই বেশি। (পৃ.২৫) ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মাঝেও দেখা যায় যে সবাই সাধারণ মানুষ, অভিজাত নাগরিক নয়, সখের বিপ্লবী নয়, বিত্তবান, ভাগ্যবান নয়- সবাই একেবারে সাধারণ মেহনতি মানুষ। যারা সেদিন ঘর ছেড়ে নেমেছিলেন জন্মভূমির ডাকে- (মুক্তিযুদ্ধের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন, লেখক আতিউর রহমান, পৃ. ২)

সুতরাং ইতিহাস রচনায় আজ যদি সেই সমস্ত সাধারণ মানুষ শ্রমিক কৃষকের সঠিক তথ্য সমৃদ্ধ ইতিহাসটুকু ধরে রাখা না যায় লিপিবদ্ধ করে, তাহলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চিরকালই অসম্পূর্ণই রয়ে যাবে। আর এই অসম্পূর্ণ ইতিহাস কোন বিবেকবান জাতি গঠনে নিশ্চয়ই সহায়ক হবেনা। তাই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কৃষক ও শ্রমিকদের বিষয়টি একটি বিরাট গবেষণার বিষয় বলে নিশ্চিত করে তার গতি সৃষ্টিকে উৎসাহিত করার জন্য সমাজের সর্বস্তরের বিবেকবান মানুষের যেমন সাহায্য সহযোগিতার প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা।

No comments:

উপরে ফিরে যান