2.21.2008

নাসরীন জাহান : তাঁর পরাবাস্তববাদী গল্প

চঞ্চল বোস

নাসরীন জাহান মানবজীবনের আভ্যন্তর-বাস্তবতার (Inner Reality) শিল্পী। মানবচৈতন্যের নিগূঢ় অস্তিত্ববাদী বোধ, ফ্রয়েডীয় মনোবিকলনবাদী চিন্তা এবং ব্যক্তি-মানুষের অস্তিত্বকেন্দ্রিক জীবনাভিজ্ঞতা, তার ভয়, উৎকণ্ঠা, মনস্তাপ নাসরীন জাহানের গল্পে শিল্পস্বাতন্ত্র্য লাভ করেছে। নিরন্তর দ্বন্দ্বক্ষত ব্যক্তি-মানসের পুনরাবৃত্তিময় চেতনা, ক্লেদ, ক্ষয় ও বিবমিষা নাসরীন জাহানের গল্পে মানব-অস্তিত্বের স্বতন্ত্র মাত্রা নির্ধারণ করেছে। মানবচৈতন্যের নিগূঢ় অন্তর্বাস্তবতা উন্মোচনে তাঁর গল্পে প্রবল হয়ে উঠেছে নারীবাদী আদর্শের তীব্র প্রভাব। সামন্ত মূল্যবোধশাসিত সমাজে নারীর স্বাবলম্ব সত্তার শনাক্তকরণে (Identification) গল্পকার নারীবাদী দৃষ্টিকোণকে জোরালোভাবে উপস্থাপন করেছেন গল্পে; পরিণামে এই নারীবাদী চেতনা মূলত মানবতাবাদী জীবনজিজ্ঞাসারই সমার্থক হয়ে উঠেছে।

নাসরীন জাহানের গল্প ব্যক্তির সূক্ষ্ম মনোচৈতন্যের শব্দরূপ। ব্যক্তি-অস্তিত্বের নিগূঢ় প্রণোদনা ও মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা তাঁর গল্পে যেমন মনোবিকলনের রূপ নিয়েছে তেমনি ফ্রয়েডীয় যৌনবোধে তাড়িত নরনারীর অবচেতন কামনা পরাবাস্তবের জগতে মুক্তি লাভ করেছে। আশির দশকে প্রকাশিত নাসরীন জাহানের ‘বিচূর্ণ ছায়া’(১৯৮৮) ‘পথ, হে পথ’ (১৯৮৯), ‘সূর্য তামসী’ (১৯৮৯) এবং নব্বইয়ের দশকে প্রকাশিত ‘সারারাত বিড়ালের শব্দ’ (১৯৯১), ‘পুরুষ রাজকুমারী’ (১৯৯৬), ‘সম্ভ্রম যখন অশ্লীল হয়ে ওঠে’ (১৯৯৭), 'কাঠপেঁচা’ (১৯৯৯) প্রভৃতি গ্রন্থে গল্পকার বিষয়-উৎস সন্ধানে বৈচিত্র-অভিনিবেশী; প্রকরণ-পরিচর্যার ক্ষেত্রেও নাসরীন জাহান ক্রমাগত আত্মরূপান্তরশীল, অন্তর্ভেদী ও নিরীক্ষা-সতর্ক। প্রথাগত কাহিনী-প্রধান গল্পরচনায় নাসরীন জাহান বর্ণনাত্মক পরিচর্যারীতির পাশাপাশি মনোবিকলনধর্মী কাহিনীবিন্যাসে বিশ্লেষণাত্মক পরিচর্যারীতির আশ্রয় নিয়েছেন।

প্রথাগত বর্ণনাপ্রধান আঙ্গিকঃ
আশির দশকে প্রকাশিত ‘বিচূর্ণ ছায়া’ (১৯৮৮), ‘পথ, হে পথ’ (১৯৮৯), ‘সূর্য তামসী’ (১৯৮৯) গ্রন্থে নাসরীন জাহানের প্রকরণ-নিরীক্ষা ও আঙ্গিক সচেতনতার পাশাপাশি গল্পকার প্রথাগত আঙ্গিকেও জীবনসঙ্কটের বিচিত্র রূপ উন্মোচন করেছেন। ‘অভ্যাস’, ‘দাহ’ (বিচূর্ণ ছায়া), ‘পাখিওয়ালা’, ‘পথ, হে পথ’ (পথ, হে পথ), ‘বিলীয়মান হলুদ নীল স্বপ্নগুলো,’ ‘কাঁটাতার’, ‘প্রেতাত্মা’, ‘খোলস’, ‘নিশাচর’ (সূর্যতামসী) প্রভৃতি গল্পে বর্ননাত্মক পরিচর্যারীতি ও বিশ্লেষনের মিশ্রণে নাসরীন জাহানের প্রকরণ-স্বাতন্ত্র্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রথাগত এ-গল্পগুলো কাহিনীনির্ভর হলেও সে কাহিনীবর্ণনায় গল্পকার সীমিত মনস্তাত্ত্বিকতার স্পর্শ এনেছেন; ফলে বর্ণনাত্মক পরিচর্যার সঙ্গে বিশ্লেষণাত্মক রূপটিও স্পষ্টত উপলব্ধি করা যায়। সর্বজ্ঞ দৃষ্টিকোণ থেকে অধিকাং গল্প রচিত হয়েছে। ঘটনা-উপকরণ সংগ্রহে গ্রামীণ ও নাগরিক অনুষঙ্গই মুখ্য। ছোট ছোট সাবলীল বাক্যের যোজনায় নাসরীন জাহান যে কাহিনীর স্ট্রাকচার দাঁড় করিয়েছেন, সময়ের সরল ব্যবহারই তার বৈশিষ্ট্য।

পরাবাস্তববাদী গল্পঃ আধুনিক শিল্পরীতি:
নাসরীন জাহানের ছোটগাল্পিক শিল্পজিজ্ঞাসার অন্যতম মৌল লক্ষণ মানুষের আভ্যন্তর ক্ষয়, ক্লেদ, বিকার ও তার মনস্তাত্ত্বিক আলোড়নের স্বরূপ সন্ধান। জীবনসঙ্কটের জটিল বৃত্তে ঘূর্ণ্যমান ব্যক্তির স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা, সম্পর্কের টানাপোড়েনে ক্ষতবিক্ষত মানুষের দ্বন্দ্বময় অস্তিত্ব, তার আদিম যৌন কামনা ও মনোবিকলনের পরাবাস্তববাদী রূপ তাঁর গল্পে অন্যতম শিল্পলক্ষণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। ‘বিচূর্ণ ছায়া’ গ্রন্থের ‘সুন্দর লাশ’, ‘কুকুর’, ‘বিকার’, ‘সূর্য তামসী’ গ্রন্থের ‘ল্যাম্পপোস্টের নীচে’, ‘সারারাত বিড়ালের শব্দ’, ‘অস্পষ্ট আলোর ছবি’ প্রভৃতি গল্পে ব্যক্তির মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা, বিকলন, প্রবৃত্তিগত সংঘাত-সংঘর্ষের প্রতিফলন ঘটেছে আলো-আঁধার, বাস্তব ও পরাবাস্তবের মিশ্র আবহে।

‘সুন্দর লাশ’ গল্পের ঘটনাবৃত্ত বর্ণনায় নাসরীন জাহান নির্মাণ করেছেন এক রহস্যঘেরা স্বপ্ন-বাস্তবময় পরিবেশ। বহুকৌণিক দৃষ্টিকোণ (Multiple angle of vision) থেকে গল্পের কাহিনী উপস্থাপিত হয়েছে। অজ্ঞাত যুবকদের দ্বারা আক্রান্ত ও পরে নিহত যুবকটির আতঙ্কিত উচ্চারণের মধ্য দিয়ে গল্পের সূচনা হয়েছে ‘আকাশের মুখোমুখি’ অংশে। গল্পের কেন্দ্রীয় সঙ্কটের বীজ উপ্ত হয়েছে এই অংশে। অতঃপর লেখকের সর্বজ্ঞ দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনাংশ বিধৃত হলেও গল্পের মৌল জটিলতা উন্মোচনে লেখক ব্যবহার করেছেন গল্পের মূল চরিত্র সুশান্ত ও জিনাতের দৃষ্টিকোণ। গল্পের কেন্দ্রীয় সঙ্কটের মূলে রয়েছে সুশান্তর অস্বাভাবিক যৌনমনস্তত্ত্ব। জিনাতের ‘পুরুষালী বলিষ্ঠতা আছে’ বলেই সুশান্ত তাকে বিয়ে করে কিন্তু ক্রমেই জিনাত উপলব্ধি করে ‘একটা মহিলার চেয়ে একটা সুন্দর পুরুষের সান্নিধ্য ওকে অনেক বেশী আন্দোলিত করে।’ মৃত যুবকটিকে কেন্দ্র করেই সুশান্তর অদ্ভুত যৌন মনস্তত্ত্বের প্রকাশ ঘটে। শহরের বাইরে জ্যোৎস্নারাতে যুবকের মৃতদেহটিকে ফেলে মনে হয় তার ভালোলাগা পুরুষ অমিয়র মতো। সুশান্ত এই মৃত দেহকে রেখে গৃহে প্রত্যাবর্তনে অস্বীকৃতি জানায়। ক্ষুব্ধ জিনাত গাড়িতে উঠে ফিরে আসার মুহূর্তে তার দৃষ্টির সম্মুখে উন্মোচিত হয় পরাবাস্তবের জগৎ:
“জিনাত দেখলো সুশান্তর মুখটা হুবহু সেই মৃত যুবকের মুখ হয়ে গেছে, দুচোখে আগুন জ্বলছে। দু’লাফে জিনাত জিপের মধ্যে এসে বসে। তারপর দ্রুত হাতে গাড়ীতে স্টার্ট দিয়ে ঘোর-লাগা চোখে দেখে জ্যোৎস্না রাতের উজ্জ্বল আলোয় মৃত যুবকটি উঠে দাঁড়িয়েছে। আর সুশান্ত তাকে জড়িয়ে ধরে ছোট ছেলের মতো আদর করছে। (পৃ. ৩৭)

পরাবাস্তববাদী শিল্পপরিচর্যার ক্ষেত্রে গল্পকার চরিত্রপাত্রের বিকার-বিকৃতি, মানসিক ক্লেদ-বৈকল্য ও মনস্তত্ত্বের অন্ধকারাচ্ছন্ন স্তরকে উন্মোচন করেছেন। মনোজগতের এবং অবচেতন স্তরের এই গুহায়িত প্রবৃত্তি-প্রতিক্রিয়ার রূপায়ণে গল্পকার স্বভাবতই গ্রহণ করেছেন বিশ্লেষণাত্মক পরিচর্যারীতি। লেখকের সর্বজ্ঞ দৃষ্টিকোণ থেকে এই বিশ্লেষণাত্মক প্রকরণ-কৌশলের ব্যবহার হলেও চরিত্রের প্রেক্ষণ বিন্দু থেকেও বহির্বাস্তবের স্তম্ভিত বিকৃত রূপ অঙ্কিত হয়েছে। লেখকের সীমিত সর্বজ্ঞতার (Limited Omniscience) মধ্যে প্রধান হয়ে উঠেছে চরিত্রের বিশেষ অন্তর্ময় প্রেক্ষণবিন্দু। ‘বিকার’ গল্পে মতির মস্তিষ্ককোষে ক্রিয়াশীল শৈশবের মৃত লোকটির রক্তাক্ত স্মৃতি এবং তারই সাইকেলের আঘাতে নিহত বৃদ্ধাটির বীভৎস দৃশ্য মতিকে নিক্ষেপ করে ভীতিকর আতঙ্ক-স্তম্ভিত তীব্র টানাপোড়েনে। মতির এই শিহরিত দৃষ্টিকোণ-উৎসারিত বহির্বাস্তবের রূপায়ণে লেখকের শিল্পপরিচর্যা এক্সপ্রেশনিস্ট:
“মাথা ঝিমঝিম করছে মতির। সে এক দৃষ্টে বউয়ের পা দুটো দেখতে থাকে। এক সময় তা’ হলদে দেখায়। নড়াচড়া করে পাশ ফিরে বউ। ওর একটা পা আয়েশে শাড়ীর নীচে গুটিয়ে যায়। এতে আরেকটা পা আরো বেশী উদোম দেখা যায়। ক্রমশ মতির কাছে মনে হয় পা-টা খয়েরী হতে হতে কালো হয়ে যাচ্ছে। মতির মাথা চক্কর খেতে থাকে, সবশেষে মনে হয় পা-টা সবুজ। সতেজ বাঁশের মতো সবুজ। আবার পা-টা নড়ে উঠতেই মতি কাঁপতে থাকে। পা-টা যেন সেই খুনী লোকটার হাতের বাঁশ। এবং মতির মাথায় তাহেরা সেটা সজোরে বসিয়ে দিচ্ছে। তাহেরার পা-টা প্রাণপণে চেপে ধ'রে চিৎকার ক'রে উঠে মতি।” (পৃ. ৪৩)

মতির অস্থির উত্তুঙ্গ প্রেক্ষণবিন্দু-উৎসারিত এক্সপ্রেশনিস্ট বহির্বাস্তব তার অন্তর্ময় তীব্র টান ও টেনশনে পরাবাস্তববাদী রূপ লাভ করেছে:
“মতি বিস্ফারিত চোখে দেখলো বউয়ের চিৎকার দিয়ে উঠা মুখ জোসনার চিলতে আলোয় বুড়ীর বিকৃত মুখে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে সেই রহস্যময় রাতের স্তব্ধতা ছিন্ন ক'রে তাহেরা চিৎকার ক'রে ওঠে-কে আছো গো। পাগল হয়া গেছ। পাগল।” (পৃ. ৪৬)

‘বিবসনা’ গল্পে হোসেন আলীর ধর্মীয় চেতনা ও জৈবিক সত্তার দ্বন্দ্ব রূপায়ণে কিংবা ‘রজ্জু’ গল্পে চিরকুমার চাঁদউদ্দিনের নিঃসঙ্গ জীবনের নিরুদ্ধ কামনা, শৈশবে তার পিতাকে খুন করার দৃশ্য, গাড়ির নিচে চাপাপড়া মহিলার বীভৎস রক্তাক্ত অনুষঙ্গ প্রভৃতির চিত্রণে লেখক বিশ্লেষণাত্মক পরিচর্যাতেই সুস্থির থেকেছেন।

ঘটনাবিন্যাসে নাসরীন জাহানের গল্পে স্বপ্নদৃশ্য, স্মৃতিময়তা ও চরিত্রের অতীতমগ্নতা বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে বিচলিত, ভয় ও আতঙ্কশিহরিত চরিত্রেরমনোবাস্তবতা যেন স্বপ্নের জগতে মুক্তি পেয়েছে। ব্যক্তির অপূর্ণ আকাক্সক্ষার রূপায়নেও স্বপ্ন বিশেষ শিল্পমোটিফ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ‘বিবসনা’ গল্পে হোসেন আলীর স্বপ্নদর্শন; স্বপ্নে ‘যৌবনবতী নারীর’ এগিয়ে আসা, ‘রজ্জু’ গল্পে নিঃসঙ্গ চাঁদউদ্দিনের স্বপ্নে অদ্ভুত ছায়ামূর্তি দর্শন, ‘দাহ’ গল্পে ভূমিহীন হাফিজের স্বপ্নে তার স্ত্রীর ‘রোদ ঝলমল করা উঠোনে পা দিয়ে গোল ক'রে ধান শুকোতে’ দেয়ার দৃশ্য প্রভৃতি স্বপ্ন-অনুষঙ্গ চরিত্রের অবচেতন মনস্তত্ত্ব-উত্থিত এবং অধিকাংশক্ষেত্রে চরিত্রের অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষার রূপায়ণে লেখক স্বপ্নদৃশ্যকে শৈল্পিক মোটিফ বা ঘটনাগত উপাদান হিসেবে ব্যবহার করেছেন।

‘বিচূর্ণ ছায়া’, ‘পথ, হে পথ’, ‘সূর্য তামসী’ গ্রন্থের গল্পগুলিতে লেখকের চরিত্রায়ণরীতি তাঁর শৈল্পিক জীবনাগ্রহের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। ব্যক্তির বিকারগ্রস্ত মনস্তত্ত্ব ও আতঙ্কশিহরিত অস্তিত্বের সূক্ষ্ম ব্যবচ্ছেদই তাঁর এ পর্যায়ের গল্পগুলোর প্রধান লক্ষণ। আত্মজগতে সক্রিয় ও মনোজগতে ক্রিয়াশীল চরিত্ররা মুখোমুখি হয় আত্মচৈতন্যের। ভয় আতঙ্ক, মনস্তাপ, ভীতি ও অন্ধকারের কালো স্রোতে নিমজ্জিত চরিত্ররা নিজেকে উন্মোচন করে মনোকথনে। ‘বিবসনা’ গল্পে (বিচূর্ণ ছায়া) হোসেন আলীর ধর্মানুভূতি ও জৈবানুভূতির তীব্র দ্বন্দ্ব রূপায়ণে লেখকের সীমিত সর্বজ্ঞতার সঙ্গে চরিত্রের স্বগতকথনরীতি প্রযুক্ত হয়েছে:
“হোসেন আলী বনের ভেতর বারবার চক্কর খায়। ভেতরের সবচেয়ে কঠিন প্রতিবাদী দ্বন্দ্ব হোসেন আলীকে সতর্ক করে দেয়-কেন এসেছো এখানে? তুমি কি তোমার পরিণতি নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবিত নও?
ছুটে বন থেকে বেরিয়ে আসে হোসেন আলী। সামনে সবুজ ক্ষেত। ক্ষেতের আলে সে বার বার হোঁচট খায়। সূর্যের আলোর ভেতর দিয়ে একটা দেহ ছুটতে ছুটতে নদীর কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। ভাবে আমার এইটা কি হইলো? আমি ধর্মকর্ম ভুইলা কিসের পিছনে ছুটতাছি? একজন রমণীরে দেখছি তো কি হইছে? কিন্তু ব্যাপারটা সেইখানে শেষ হইল না কেন?” (পৃ. ৫৩)

‘রজ্জু’ গল্পে নিঃসঙ্গ চাঁদউদ্দিনের ভীতসন্ত্রস্ত মনস্তত্ত্বের উন্মোচনেও চরিত্রের মনোলগ ব্যবহৃত হয়েছে।

‘কুকুর’ গল্পটির ফর্ম পরাবাস্তববাদী। সমগ্র গল্পটিই বিন্যস্ত হয়েছে এক রহস্যময় আলো-অন্ধকারাচ্ছন্ন নির্জন রাতের নৈঃশব্দে। শৈশবের কুকুরভীতিতাড়িত বালিকাটি নির্জন রাস্তায় প্রত্যক্ষ করে ভীতিকর ছায়া, ল্যাম্পপোস্টের আলোয় প্রত্যক্ষ করে বিচিত্র দৃশ্য। মেয়েটির আতঙ্কিত দৃষ্টিকোণ-প্রসূত রাতের পরিবেশটি স্বপ্নবাস্তবময় পরাবাস্তবধর্মী:
“মেয়েটি ধূসর চোখে দেখলো-সুন্দর ফুলগুলি, এতক্ষণ যারা নৃত্য করছিল, তারা বিস্ময়ে চেয়ে আছে। এবং তার স্বপ্নের পায়রা-বাড়ীটি শুভ্র ডানা মেলে শূন্যের উপর উঠে পড়েছে। মেয়েটি ধূসর চোখে দেখলো-অসংখ্য কুকুরের ঘেউ ঘেউ, অসংখ্য রাত্রির অন্ধকার আক্রমণ এবং অসংখ্য মশার গুনগুনের মধ্য দিয়ে তার কোঁকড়ানো চুল ও ক্ষতের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে।” (পৃ. ৮৬)

‘সূর্যতামসী’(১৯৮৯) গ্রন্থের ‘ল্যাম্পপোস্টের নীচে’ গল্পের কাহিনীবিন্যাসে আধুনিক শিল্পনিরীক্ষার প্রকাশ ঘটেছে। জনৈক দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারী কর্মকর্তা মুশতাক আহমেদের তরুণ ছেলে পাপ্পু জণ্ডিসে মারা যায়। মুশতাক সাহেবের অস্বাভাবিক বিকৃত মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে গল্পের পরিবেশ ও বহির্বাস্তব চিত্রিত হয়েছে। সমগ্র গল্পে পরাবাস্তবধর্মী ও অ্যাবসার্ড কতগুলো দৃশ্যচিত্রের সন্নিবেশ ঘটেছে। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র মুশতাকের আত্মবিশ্লিষ্ট চৈতন্যই যেন বিচিত্র পরাবাস্তববাদী রূপ লাভ করেছে। গল্পের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পরাবাস্তবের যে-জগৎ নির্মিত হয়েছে তা’ বীভৎস রসব্যঞ্জক:
“জল তৃষ্ণা পাচ্ছে প্রাণীটির। টিনের জং ধরা কৌটোটা ময়লা খুঁড়ে বের করলো। দূরে ট্রাফিক জ্যাম। সেদিকে উদাস চোখে তাকিয়ে ওয়াক ওয়াক করে কিছু থুতু সেটিতে জমা করলো। মজে যাওয়া আনারসের টুকরো চিপে তার সাথে মেশালো। তারপর সেই পানীয় ঢকঢক করে গিলে দেখলো কুকুরটি দাঁড়িয়ে আছে।”
মুশতাক আহমেদের মৃতপুত্র পাপ্পুর পুনর্জীবন লাভের ঘটনা অ্যাবসার্ড শিল্পলক্ষণের দৃষ্টান্ত। পুনর্জীবিত পাপ্পুর আচরণ বাস্তবপ্রতীতি-অতিক্রান্ত, বীভৎস রসনির্দেশী:
“বমির বেগ পেতেই জীবিত হয়ে উঠলো পাপ্পু। জীবিত হয়ে দেখলো ওপরে ঝাড়বাতি নড়ছে। চারপাশে সবুজ ডিসটেম্পার। বিছানায় উঠে বসতেই বমির স্রোতে চাদর ভেসে গেলো। এতক্ষণে কি একটা গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসছিলো তার। চেয়ে দেখলো আগরবাতি জ্বলছে। বাঁচিয়ে তোলার জন্য কিছু একটা খাওয়ানো হয়েছে তাকে। সেটা খেয়ে মৃত্যুর শীতলতায় গভীরভাবে তলিয়ে যাচ্ছিলো সে। বমি চলে আসায় বেঁচে গেছে। বিছানার বমির দিকে চেয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো চোখ। হামাগুড়ি দিয়ে লেজওয়ালা প্রাণীর মতো বিছানার সমস্ত বমি চেটে চেটে খেয়ে ঢেকুর তুললো সে।” (পৃ. ১৫)

নব্বইয়ের দশকে প্রকাশিত ‘সারারাত বিড়ালের শব্দ’ (১৯৯১) গ্রন্থের গল্পগুলিতে নাসরীন জাহানের আধুনিক শিল্পরীতির নিপুণ প্রয়োগ ঘটেছে। ‘অস্পষ্ট আলোর ছবি’, ‘শাদা ভাস্কর্য’, ‘টবের অশ্বত্থ’, ‘একগুচ্ছ অন্ধকার’, ‘আলো পাথরের টান’ প্রভৃতি গল্পে মনোবিকলন ও মানসিক বৈকল্যের বিশ্লেষণাত্মক রূপ চিত্রিত হয়েছে।

‘অস্পষ্ট আলোর ছবি’ গল্পে নীলিমা নামক এক চিত্রশিল্পীর মনোবিকার ও অদ্ভুত মনস্তত্ত্বের বিশ্লেষণাত্মক ডিটেইলস পাওয়া যায়। নীলিমা প্রেতাত্মাকে আহ্বান ক'রে আনে, অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখে এবং তার উদ্ভট মনোবিকলনধর্মী চিন্তা রঙে ও রেখায় তার ক্যানভাসে ছবি হয়ে ওঠে। নীলিমার অঙ্কিত ছবিগুলো তার অসুস্থ মনস্তত্ত্বেরই প্রতিরূপক। সমগ্র গল্পে এক স্বপ্ন-বাস্তবময় পরিবেশ নির্মিত হয়েছে; সে পরিবেশ রহস্যময়, ভৌতিক, অচেনা। ‘একগুচ্ছ অন্ধকার’ গল্পের পরিবেশ নির্মাণে ও ঘটনাবিন্যাসে আধুনিক শিল্পনিরীক্ষার উজ্জ্বল প্রকাশ ঘটেছে। দীর্ঘ দুই বছর পরে গৃহে প্রত্যাবর্তনের পর সদ্যাগত লোকটির দৃষ্টিকোণ থেকে উন্মোচিত হয় বিচিত্র দৃশ্যগুচ্ছ। সাতটি অনুচ্ছেদে বিভক্ত এ-গল্পে প্রথাগত কোনো কাহিনী নেই। অন্ধকার, ভয়ভীতি, আতঙ্ক, বিকার, রক্তপাত প্রভৃতি অস্তিত্ববিনাশী বিচিত্র অনুষঙ্গ ঘটনাবৃত্ত তৈরি করেছে। একগুচ্ছ অন্ধকারের ইমেজে এ-গল্পে সৃষ্টি হয়েছে এক অচেনা দুর্জ্ঞেয় পরিবেশ। রাতের মৃদু আলোয় গৃহ-প্রত্যাগত লোকটির ছায়া এক্সপ্রেশনিস্ট রূপ নিয়ে আবির্ভুত:
“এ রকম ভাবনার পর সে খাড়া হয়। ঘরের ঝাপসা আলোয় তার ক্ষুদ্র দেহটা দেয়ালে প্রকট আকার ধারণ করে। এ-কি! ছায়াটি কি ভয়ংকর ভঙ্গিতে দুলছে। রক্তাক্ত ভীত চোখে তাকায় লোকটি। পেছন হটতে থাকে। ছায়াটা এগিয়ে আসছে, আশ্চর্য। তার নিজের ছায়ার এ কি ভয়ানক আকৃতি।” (পৃ. ২১৩)

‘বিচূর্ণ ছায়া’, ‘পথ, হে পথ’, ‘সূর্য তামসী’, ‘সারারাত বিড়ালের শব্দ’ গ্রন্থের অধিকাংশ গল্পে ফ্রয়েডীয় মনোবিকলন এবং ব্যক্তির ক্ষয়, বিকার ও বৈকল্যের বিশ্লেষণাত্মক রূপ অঙ্কিত হওয়ায় এ-গল্পগুলিতে অধিকাংশক্ষেত্রে প্রথাগত কোনো কাহিনী নেই। ব্যক্তির প্রতিক্রিয়া, আচরণ, মনোভাব ও মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার চিত্রণে এবং চরিত্রের অবচেতন স্তরের সূক্ষ্ম উন্মোচনে লেখকের সর্বজ্ঞ দৃষ্টিকোণের সঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছে চরিত্রের মনোকথন। ব্যক্তির অন্তর্বাস্তবতাই এ-পর্যায়ের গল্পের প্রধান লক্ষণ হওয়ায় ঘটনাংশ সীমিত; ঘটনা মুখ্য হয়ে উঠেছে চরিত্রের অবলোকনবিন্দু।

নব্বইয়ের দশকে প্রকাশিত ‘পুরুষ রাজকুমারী’ (১৯৯৬), ‘সম্ভ্রম যখন অশ্লীল হয়ে ওঠে’ (১৯৯৭) এবং ‘কাঠপেঁচা’ (১৯৯৯) গ্রন্থে নাসরীন জাহানের ছোটগাল্পিক শিল্পরীতি ভিন্ন বাঁক নিয়েছে। আশির দশকে রচিত গল্পে পরাবাস্তববাদী আবহ প্রধান শিল্পলক্ষণ হয়ে ওঠে, ফলে অনেক ক্ষেত্রেই গল্পে কাহিনী ছিল না। এক অসুস্থ মনোবিকার এবং মৃত্যুর মতো আত্মদ্বন্দ্ব তাঁর গল্পের মৌল উপজীব্য হওয়ায় বিশ্লেষণ ও মনোলগই হয়ে ওঠে প্রধান পরিচর্যারীতি। ভাষা তির্যক ও আবেগবর্জিত হওয়ায় গল্পবস্তু ধারণে তা’ সুপ্রযুক্ত হয়েছে। নব্বইয়ের দশকে রচিত গল্পে নাসরীন জাহান তাঁর মৌল জীবনবীক্ষায় অর্থাৎ এ্যান্টিরোমান্টিকতা, আত্মপীড়ন, নারীবাদী চিন্তা প্রভৃতিতে স্থিত থেকেও তাঁর গল্পে এসেছে নিটোল কাহিনী। এক অদ্ভুত ফ্যান্টাসীর জীবন অতিক্রম ক'রে গল্পকার নিজের স্থান খুঁজে পেয়েছেন। ‘পুরুষ রাজকুমারী’, সম্ভ্রম যখন অশ্লিল হয়ে ওঠে’ এবং ‘কাঠপেঁচা’ গ্রন্থের গল্পগুলিতে লেখকের নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে নিটোল কাহিনীপ্রধান বেশকিছু গল্প রচিত হয়েছে। ‘পুরুষ রাজকুমারী’ গ্রন্থের ‘রূপকথার পাখি’, ‘আমাকে আসলে কেমন দেখায়’, ‘আলো বালিকা’, ‘সন্দেহ অথবা তার সত্যিকার বোধ’, ‘প্রিয় তর্জনী’, ‘সম্ভ্রম যখন অশ্লীল হয়ে ওঠে’ গ্রন্থের নাম-গল্প, ‘পূর্বপুরুষ আর সোনার মাকড়সার গল্প’, ‘দ্বিতীয় কবর’, ‘আমার জন্ম’ প্রভৃতি নারীবাদী গল্পে কাহিনীই প্রধান হয়ে উঠেছে। ‘কাঠপেঁচা’ গ্রন্থের স্বল্পায়তন গল্পগুলোতেও জীবন ও সমাজসত্যের নানাপ্রান্ত অনবদ্য কাহিনীতে বিধৃত হয়েছে। এ-পর্যায়ের গল্পে চরিত্র নয়, কাহিনীই মুখ্য। কাহিনীমুখ্য গল্পগুলিতে সহজ ভাষার মধ্য দিয়ে ক্লেদজ, কখনো বর্ণাঢ্য, কখনো কর্কশ জটিল জীবনকে গভীরভাবে উপস্থাপন করার প্রয়াস পেয়েছেন গল্পকার।

গ্রন্থপঞ্জীঃ
১। বিচূর্ণ ছায়া, ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮, রুপম প্রকাশনী, ঢাকা।
২। পথ, হে পথ, ফেব্রুয়ারি ১৯৮৯, অনিন্দ্য প্রকাশন, ঢাকা।
৩। সূর্য তামসী, ফেব্রুয়ারি ১৯৮৯, পল্লব পাবলিশার্স, ঢাকা।
৪। সারারাত বিড়ালের শব্দ, ১৯৯১।
৫। আশ্চর্য দেবশিশু, ১৯৯৫।
৬। পুরুষ রাজকুমারী, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬, অনন্যা, ঢাকা।
৭। সম্ভ্রম যখন অশ্লীল হয়ে ওঠে, জানুয়ারি ১৯৯৭, অন্যপ্রকাশ, ঢাকা।
৮। গল্পসমগ্র (১), বইমেলা ১৯৯৮, অন্যপ্রকাশ, ঢাকা।
৯। কাঠপেঁচা, একুশে বইমেলা ১৯৯৯, অন্যপ্রকাশ, ঢাকা।

No comments:

উপরে ফিরে যান