10.02.2013

'ব্যবচ্ছেদ' পত্রিকা পাঠে আপনাকে আমন্ত্রণ

'ব্যবচ্ছেদ' দ্বিতীয় সংখ্যার প্রচ্ছদ

ব্যবচ্ছেদ দ্বিতীয় সংখ্যার প্রচ্ছদ
'ব্যবচ্ছেদ' দ্বিতীয় সংখ্যার প্রচ্ছদ
'ব্যবচ্ছেদ' দ্বিতীয় সংখ্যার সম্পাদক: রাই বাবু
প্রচ্ছদ শিল্পী: সাম্য রাইয়ান

প্রথম পাতা থেকে শুরু করুন

ব্যবচ্ছেদ। দ্বিতীয় সংখ্যা' এর উচ্চারণ

 সেপ্টেম্বর ২০১৩ ♦

সমাজ-সংস্কৃতি-সময়ের অন্তর্জগত খুঁড়ে দেখার প্রত্যাশায় প্রকাশিত হল ব্যবচ্ছেদের দ্বিতীয় সংখ্যা। সমকালের অন্তর্খনন সহজসাধ্য নয়- এ বোধ আমাদের আছে। তারপরও চেষ্টা করেছি পরিপার্শ্বকে উন্মোচন করার। অতৃপ্তিকে সঙ্গী করে আমাদের পথ চলা অব্যাহত থাকবে। এই প্রচেষ্টায় আমাদের সহায় হয়েছেন অনেকেই। তাদের সকলের প্রতি জানাই আমাদের হার্দ্য কৃতজ্ঞতা। – সম্পাদনা পর্ষদ

শ্রম, চিন্তা ও ভাষার সম্পর্ক


যতীন সরকার

পারিপার্শ্বিক বস্তু বা সংঘটনের উৎপত্তি, বিকাশ ও ক্রমবিলয়ের কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয়ের ব্যাপারে মানুষ যে সাফল্য অর্জন করেছে ইতিহাসে তা নিতান্ত অর্বাচীনকালের ব্যাপার। এর বহু পূর্ব থেকেই মানুষ তার কল্পনার আয়ুধ প্রয়োগে যতœপর ও সিদ্ধকাম থেকেছে। ভাবানুগামিতা ও বিস্ময়মুগ্ধতাই তার এই যত্ন ও সিদ্ধির চালিকাশক্তি।

মানুষের মুখের ভাষা বিষয়ে এই বিস্ময়মুগ্ধতা থেকেই প্রাচীন ইহুদি শাস্ত্রকারের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল ‘আদিতে বাক্য ছিলেন ও বাক্য ঈশ্বর হইলেন’, ভারতীয় আর্য ঋষির সিদ্ধান্ত; পুরুষস্য বাক্রস : (ভাষা বা বাকই মানুষের সার-ছান্দোগ্য উপনিষদ); অনুরূপ সিদ্ধান্তের প্রেরণা-জাত কল্পনারই সৃষ্টি ঋগে¦দের বাগদেবতা, সেই বাগদেবতার স্পর্ধিত আত্ম-ঘোষণা :

‘আমি রাজ্ঞী। আমার উপাসকদের আমি ধনসমূহ দিয়ে থাকি। পূজনীয়াদের মধ্যে আমি প্রথমা। দেবতারা আমাকে বহুস্থানে প্রবেশ করতে দিয়েছেন। প্রত্যেক মানুষ; যার দৃষ্টি আছে, প্রাণ আছে, শ্রুতি আছে, আমার কাছ থেকেই সে অন্ন গ্রহণ করে। যারা আমাকে জানে না তারা ক্ষীণ হয়ে যায়। আমি স্বয়ং যা বলে থাকি তা দেবতা এবং মানুষদের দ্বারা সেবিত। আমি যাকে কামনা করি তাকে বলবান করি, সৃষ্টিকর্তা করি, ঋষি করি, প্রজ্ঞাবান করি।’

বিস্ময়-মুগ্ধ ভাবোদ্বেল বাক-বিভূতির মাধ্যমে প্রাক-আধুনিক যুগের বিভিন্ন দেশে মনীষীরা যে উপলব্ধির প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন, সেই উদ্বেলতার ফেনপুঞ্জ অপসারিত করে নিয়ে তার যে নির্যাসটুকু অবশিষ্ট থাকে, আধুনিককালের বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তেও তা মোটামুটি অপরিবর্তিত রূপেই সমর্থিত হয়। মানুষ এবং পশুর পার্থক্য নির্ণয়ে, আধুনিক বিজ্ঞানের কাছে ভাষা একটি মুখ্য ও অপরিহার্য উপাদানরূপে চি‎িহ্নত। সে চিহ্নের স্বরূপ-নির্ধারণে বিজ্ঞানের যে শাখা নিয়োজিত, সেটিকেই বলে ভাষাবিজ্ঞান। কিন্তু কোনো বিজ্ঞানই কোনো বিশেষ শাখা-বন্দী নয়, কিংবা অন্য নিরপেক্ষ স্ব-বিকশিত বৃন্তহীন পুষ্পও নয়। ভাষাবিজ্ঞানও বিভিন্ন বিজ্ঞানের শাখায় শাখায় বিচরণশীল হয়েই তার বিকাশের উপাদান আহরণ করে থাকে। ভাষার প্রকাশ মানুষের মুখে, কিন্তু তার সৃষ্টির উৎস মানুষের মন। মনের অলিতে গলিতে ভ্রমণশীল মনোবিজ্ঞানের দ্বারস্থ হতে ভাষাবিজ্ঞান তাই বাধ্য। আবার মানুষের মন তো মানুষের সমাজের কারখানায়ই নানা আকার-প্রকারে গঠিত, বিতর্কিত বিকশিত ও পরিণত। গঠন, বিবর্তন, বিকাশ ও পরিণতিতে সমাজ আর মন যেমন পরস্পর সাপেক্ষ, ভাষার পক্ষেও সে সাপেক্ষতা একান্ত অনিবার্য এবং ভাষাবিজ্ঞানের সুষ্ঠতা অর্থাৎ বৈজ্ঞানিকতার জন্য সমাজবিজ্ঞানের সহায়তা গ্রহণ নিতান্তই অপরিহার্য। তাই ভাষার স্বরূপ সন্ধানে মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান ও ভাষাবিজ্ঞান এই ত্রয়ীর ঐকত্রিক উপস্থিতি, পারস্পরিক পরামর্শ ও সহযোগিতার আবশ্যকতা স্বীকার না করে পারা যায় না।

এই ত্রয়ীর সহযোগের অপরিহার্যতা স্বীকৃত হয় ভাষার উৎপত্তি প্রসঙ্গে ভাষাবিজ্ঞানী নোয়েরের বক্তব্যে-

‘সামাজিক লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য বংশ বৃদ্ধদের প্রাচীন শ্রম এবং সামাজিক প্রযতœ থেকেই মানুষের ভাষা ও চিন্তার সূত্রপাত।’

নোয়েরের কথায় স্পষ্ট উপলব্ধি হয় যে; শ্রম, চিন্তা ও ভাষা একই মালিকায় সূত্রবদ্ধ তিনটি পদ্মরাগমণি। এর যে কোনো একটির অভাব ঘটলে বা অপসারণ করলে সে মালিকা আর গাঁথা হয়ে ওঠে না।

দুই.

শ্রম, চিন্তা ও ভাষার সম্পর্ক সূত্রটিকে স্পষ্টরূপে অনুধাবন করতে হলে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ তথা মার্কসীয় দর্শনের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া উপায়ান্তর নেই। সন্দেহ নেই, ডারউইনের বিবর্তনবাদ মানুষের উৎপত্তি সম্পর্কে সকল প্রকার ভাববাদী ধারণার উচ্ছেদ ঘটিয়েছে। মার্কস ও এঙ্গেলস ডারউইনের মতবাদের প্রতি দৃঢ় সমর্থন জ্ঞাপন করেছেন। শুধু তাই নয়। এঙ্গেলস তাঁর ‘বানর থেকে মানুষের বিবর্তনে শ্রমের ভূমিকা’ শীর্ষক রচনাটিতে ডারউইনবাদকে সমৃদ্ধতরও করে তুলেছেন এবং এঙ্গেলসের এই রচনাটিতেই মানববিকাশের ধারায় ‘ভাষার’র উৎপত্তি বিষয়েও স্পষ্ট ও সুষ্ঠু বৈজ্ঞানিক ধারণার প্রাঞ্জল অভিব্যক্তি ঘটেছে।

যেমন- এঙ্গেলস দেখিয়েছেন যে, বৃক্ষশাখা থেকে সমতল ভূমিতে অবতীর্ণ ‘মানুষ এমন একটি পর্যায়ে এলো যখন পরস্পরকে কিছু বলার প্রয়োজন তাদের হলো। এই প্রেরণা তার নিজস্ব অঙ্গ সৃষ্টি করলো; স্বরের দোলনা দ্বারা ক্রমাগত উন্নততর স্বরগ্রাম সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বানরের অপরিণত কণ্ঠনালী ধীর অথচ স্থির গতিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। ক্রমে ক্রমে মুখের প্রত্যঙ্গগুলো একটার পর একটা স্পষ্টধ্বনি উচ্চারণ করতে শিখল’। এবং এমনি করে ‘শ্রম থেকে এবং শ্রমের সঙ্গে সঙ্গেই যে ভাষার উৎপত্তি’ এঙ্গেলসের নিবন্ধে বৈজ্ঞানিক যথার্থতা সহকারে সে সত্যই উদ্ঘাটিত। সে সত্যের অনুসিদ্ধান্তরূপে এ সত্যই প্রোজ্জ্বল যে : ভাষা শুধু মানুসের অলস মনোভাবের প্রকাশ মাধ্যমই নয়; হাতিয়ারধারী মানুষের সমষ্টিগত শ্রমের ফলে উৎপন্ন যে ভাষা; সে ভাষার প্রবর্তনাতেই তার হাত ও মাথা (শ্রম শক্তি ও চিন্তা শক্তি) পরিচালিত, জীবনযুদ্ধে সে বিজয়ীর সম্মানে ভূষিত, তারই দাক্ষিণ্যে মানুষ আজ এ গ্রহের অধীশ্বর, জলে-স্থলে ব্যোমে প্রসারিত তার রাজ্যপাট। সমাজ থেকে উৎপন্ন ভাষাই সমাজের পুষ্টি, পরিবর্তন ও বিকাশে মুখ্য সহায়িকা শক্তি।

এঙ্গেলসের বক্তব্যের ব্যাখ্যা করেই জোসেফ স্তালিন বলেন-

‘মানুষ পশুস্তর থেকে সামাজিক ব্যক্তির স্তরে উঠেছে মেহনতের সাহায্যে। মেহনত তার মনকে করেছে সমৃদ্ধ, তার ভাষা ও সংস্কৃতিকে করেছে বিকশিত। মেহনতের মধ্যে জরুরি হয়ে ওঠে সাহচার্য। মেহনতের প্রক্রিয়ার মধ্য থেকে পরস্পর সাহচর্যের মাধ্যম বিকাশ লাভ করে সে মাধ্যম ভাষা। এই ভাষা সমাজ ও মানবীয় চিন্তার বিপ্লবে বিরাট ভূমিকা গ্রহণ করেছে। ভাব বিনিময় ছাড়া পরস্পর সাহচর্য ছাড়া জীবিকা উৎপাদন অসম্ভব, সমাজের অস্তিত্ব অসম্ভব। আবার সমাজ থেকে আলাদা হয়ে ভাষা টিকতে পারে না। সুতরাং ভাষা ও তার বৃদ্ধি সমৃদ্ধির কানুন বোধগম্য হতে পারে সমাজের এবং জনতার ইতিহাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত করে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। সমাজ ও জনতা ভাষার অধিকারী। সমাজ ও জনতা আবার ভাষার সৃষ্টি ও আধার।’

হাতের সাহায্যে হাতিয়ার ধরে সমষ্টিগত শ্রম দিয়েই মানুষের সমাজের সৃষ্টি। কিন্তু হাত স্বয়ংক্রিয় বা স্বয়ংশাসিত নয়। তার নিয়ন্ত্রণ, শাসন ও চালনায় আছে মাথা। অর্থাৎ চিন্তাশক্তির নির্দেশনায় শ্রমশক্তি পরিচালিত। ভাষা এই চিন্তাশক্তি ও শ্রমশক্তির যৌথ প্রয়োজনার সৃষ্টি ও স্রষ্টা দুই-ই। তাই ভাষার বৈজ্ঞানিক উপলব্ধির জন্য শ্রমশক্তি তথা সমাজ-শক্তির নিয়ম প্রণালীর অনুধাবনার মতোই চিন্তা শক্তি তথা মনোজগতের প্রকৃতি ও স্বরূপ সন্ধানও সমান জরুরি। অর্থাৎ এখানেই সুস্পষ্ট ও সুতীব্র হয়ে ওঠে ভাষা বিজ্ঞানের জন্য সমাজবিজ্ঞানের সঙ্গে মনোবিজ্ঞানের মেলবন্ধনের অপরিহার্য আবশ্যকতা। (এবং সে সঙ্গে কিছুটা শরীর-বিজ্ঞানেরও। মনের আধার শরীর, অন্তত ভাষার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট স্বরযন্ত্র ও স্নায়ুতন্ত্র ভাষাবিচারের একান্ত আবশ্যিক উপাত্ত।)

সমাজবিজ্ঞানে যেমন ভাষার সঙ্গে হাতের সম্পর্ক উদ্ঘাটিত, মস্তিষ্কের সঙ্গে ভাষার সম্পর্ক নির্ণয়ও তেমনই মনোবিজ্ঞানের অবদান। কুল্পে, স্টাউট, বিনে প্রমুখ মনোবিজ্ঞানী ‘ভাষা-প্রতিরূপবিহীন চিন্তন সম্ভব বলে যদিও একটা কূটতর্কের অবতারণা করেন। আধুনিক শরীর বিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের জনক পাভলভের পরীক্ষণ ও গবেষণায় সে কূটতর্কের গ্রন্থি ছিন্ন হয়ে গেছে। ভাববাদী দর্শন ও যুক্তিবিদ্যার কুয়াশাজাল ফুৎকারে অপসৃত হয়ে সেখানে এ সত্যই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে যে, চিন্তা আসলে অনুচ্চারিত ভাষারই নামান্তর। অর্থাৎ ভাষা ছাড়া চিন্তা অসম্ভব।

এ সত্যের প্রমাণ ও দৃষ্টান্ত সামান্য একটু আত্ম-সমীক্ষাতেই আমরা পেতে পারি। আমাদের যেকোনো চিন্তা নিয়েই চিন্তা করলে দেখা যাবে ভাষা তার সঙ্গে অনপনেয় সূত্রে গ্রথিত। যেমন- আগামীকাল আমি লিখব, গতকাল আমি সিনেমায় গিয়েছিলাম, আজ আমি বই পড়ছি- ভবিষ্যৎ অতীত বা বর্তমান নিয়ে আমার সব চিন্তাই কতকগুলো কথার মাধ্যমে অভিব্যক্ত হয়। অভিব্যক্তির সেই কথাগুলো বাদ দিয়ে মনে মনেও এসব বিষয়ের ধারণা বা চিন্তা করা একেবারেই অচিন্তনীয়, অর্থাৎ অসম্ভব। চিন্তা করার অর্থ কতকগুলো কথা মনে মনে বিন্যস্ত করা; সে কথাগুলো অপসৃত হলে চেতনার ভা-ারে অবশিষ্ট থাকে না কিছুই তা তখন ‘শূন্য আকাশের মতো একান্ত নির্মল।’

শিশুদের কথা বলা লক্ষ্য করলে দেখা যায়, তারা আপন মনে কথা বলে। ‘আপন মনে কথা বলা’ মানে উচ্চ স্বরে, উচ্চারণ করে করে চিন্তা করা। বয়স্ক লোকের চিন্তা অনুচ্চারিত ভাষা হলেও শিশুর চিন্তা উচ্চারিত। বহির্বাস্তব থেকে প্রাপ্ত বস্তু বা বিষয়ের ধারণা শিশুর কাছে ভাষা-প্রতিরূপের সাহায্যেই আত্মস্থ, তার চিন্তা আর ভাষা একই সঙ্গে অধিগত। এ দু’য়ের পরস্পর সাপেক্ষতাই এর মূলীভূত হেতু।

এরূপ বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও দৃষ্টান্ত সহযোগে এ কথা প্রমাণিত হয়েছে যে, কথা বলা বা ভাষা ব্যবহার মানেই স্বরযন্ত্রের সাহায্যে মনের অনুচ্চারিত ধারণা বা চিন্তার উচ্চারণ তাকে অপরের শ্রুতিগ্রাহ্যকরণ। যেসব প্রাণীর স্বরযন্ত্রের সে ক্ষমতা নেই, ভাষা ব্যবহারেও তারা অক্ষম। তবে সে অক্ষমতার দায়ভাগ শুধু এক স্বরযন্ত্রেরই নয়, এর মুখ্য দায়িত্ব মস্তিষ্কের। বন মানুষের স্বরযন্ত্র ভাষা ব্যবহারের উপযুক্ত, কিন্তু মস্তিষ্ক অপরিণত; কোনো ধারণার বাহন হওয়ার অনুপযুক্ত। তাই বনমানুষ ভাষা সম্পদ থেকে বঞ্চিত আর সুগঠিত স্বরযন্ত্র ও সু-উন্নত মস্তিষ্কের অধিকারী মানুষ সে সম্পদে সম্পন্ন।

এ সঙ্গে আবার হাতের কথাটিও বিবেচ্য। স্নায়ুতন্ত্রের যে কেন্দ্রগুলোর প্রণোদনায় (উৎরাব) মানুষের হাত সক্রিয় আর যেগুলোর সাহায্যে ভাষা উচ্চার্য, তাদের অবস্থান একান্তই সন্নিকৃষ্ট। এতো সন্নিকৃষ্ট যে, দু’কেন্দ্রের কাজ সন্নিবিষ্ট হয়ে অনেক সময়ই হয়ে যায় জড়িত, মিশ্রিত এবং কখনো কখনো তা পরস্পরের সীমানা উল্লঙ্খনও করে ফেলে। এর ইংরেজি নাম ঝঢ়ৎবধফ। শিশুদের কথা বলার সময়কার অঙ্গভঙ্গী, হাতের লিখা অভ্যাসের সময় ওষ্ঠ সঞ্চালন, বয়স্কদেরও বক্তৃতা দেওয়ার সময় হাত ও মুখের নানা মুদ্রা প্রদর্শন- এসবই এর দৃষ্টান্ত। আদিম মানুষের বেলায়ই এ বিষয়টি সুস্পষ্টরূপে দৃষ্টিগ্রাহ্য। সভ্য মানুষের কথা বলার সময়ে হস্ত সঞ্চালন বা অঙ্গভঙ্গির ভূমিকা গৌণ কিন্তু আদিম মানুষের মুখের ভাষার মুখ্যত অঙ্গভঙ্গির উপরই নির্ভরশীল। গ্রে, স্মাইথ, রট্রে প্রমুখ বিজ্ঞানীর বরাত দিয়ে অধ্যাপক জর্জ টম্পসন এ কথাই প্রমাণ করেছেন। এসব সাক্ষ্যের ভিত্তিতে সমাজ মনোবিদ বুশের যা বলেন ত এঙ্গেলসের সিদ্ধান্তেরই সম্প্রসারিত রূপ।

ডক্টর বুশের- এর সিদ্ধান্ত :

‘হাতিয়ার ব্যবহারের দরুণ পেশিগুলিতে যে জোর পড়ে তারই প্রতিবর্তী ক্রিয়া (জবভষবী ধপঃরড়হ) হিসেবে স্বরযন্ত্রের প্রতিক্রিয়াটি থেকেই মানুষের গলায় ভাষা ফুটে উঠেছিল। তারপর হাতের কাজের যতো উন্নতি হয়েছে ততোই উন্নত হয়েছে স্বরযন্ত্র এবং শেষ পর্যন্ত মানুষের চেতনাও উন্নত হতে হতে একটা পর্যায়ে পৌঁছে দেখা গেলো এই প্রতিবর্তী ক্রিয়াটিকেই তারা সচেতনভাবে ভাবের আদান-প্রদান কাজে নিযুক্ত করতে পারছে।’

তিন.

প্রগতিশীল সমাজ-মনোবিদদের অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে মানুষের চেতনার বিকাশে ভাষার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার পরিচয় উদঘাটিত হয়েছে এবং ভাষা ছাড়া যে চেতনার ধারণ, বাহন ও অবস্থিতি অসম্ভব, সে সত্যও প্রমাণিত হয়েছে। তবে সে সঙ্গে একথাও অবশ্যই স্মর্তব্য যে ভাষা আর চিন্তা অভিন্ন নয়।

মানব বিকাশের এক সুউচ্চ পর্যায়ে ভাষার উদ্ভব, উদ্ভবের পর থেকে তার নিজেরই একটি আপেক্ষিক স্বতন্ত্র সত্তাও উদ্ভূত। সে সত্তা এমন কতকগুলো বিশেষ নিয়ম প্রণালির অধীন, চিন্তার নিয়ম থেকে যার স্বাতন্ত্র্য স্পষ্ট। সে স্বাতন্ত্র্যের ভিত্তিতেই ভাষাবিজ্ঞানের আবির্ভাব। তাই ভাষাবিজ্ঞানের নিয়মের অনুসরণ না করে এবং এর সহযোগী শাখাসমূহের অকৃপণ সহায়তা গ্রহণ না করে যে ভাষা বিচারে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগ ঘটানো একেবারেই অসম্ভব- সে কথা আমাদের মেনে নিতে হবে।

কিন্তু এই মেনে নেয়ার বিষয়টি দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদীরাও সব সময় মনে রাখেন না। তার ফলেই ঘটে নানা বিপত্তি। সে বিপত্তির প্রধানটি হলো শ্রম থেকে ভাষার উৎপত্তি সূত্রটির সরলীকরণ ও যান্ত্রিকায়ন। সে রকম সরলীকরণ ও যান্ত্রিকায়নের দৃষ্টান্ত আমরা প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নেও দেখতে পেয়েছি। সোভিয়েত যেহেতু শ্রমিকশ্রেণির রাষ্ট্র, তাই এ রাষ্ট্রের ভাষাও হবে শ্রমিকশ্রেণির কমিউনিস্ট পার্টির অতি উৎসাহী সদস্যরা এমন একটি অনুজ্ঞাই প্রচার করলেন। সে প্রচারে তারা সমর্থন পেলেন সে দেশের একজন বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানীর। এই ভাষা বিজ্ঞানীটির নাম এন ওয়াই মার। পূর্বেকার ভাষা বিজ্ঞানের বদলে এমন এক অভিনব ভাষা বিজ্ঞান মার এবং তাঁর সহযোগীরা সৃষ্টি করতে চাইলেন যাকে মার্কসবাদ সম্মত বলা যায় না কোনো মতেই। এটিকে বিজ্ঞান বলেই মানা যায় না। মার্কস এঙ্গেলস তো ভাষাকে ‘চিন্তার প্রত্যক্ষ বাস্তবতা’ রূপেই দেখেছিলেন। ‘ভাব ভাষা থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকে না’- মার্কস স্পষ্ট ভাষায় এমন কথাও বলেছেন। অথচ মার্কসবাদের পতাকা হাতে নিয়েই ‘মার ভাষাকে চিন্তা থেকে বিযুক্ত বলে প্রচার করলেন। তাঁর মতে ‘মানুষের সাথে মানুষের ভাবসংযোগ ভাষা ছাড়াই সম্পন্ন হতে পারে।’

সুখের বিষয়, এই ভ্রান্তি বেশি দূর বিস্তৃত হতে পারেনি। তাঁর কয়েকটি রচনায় তিনি চিন্তার সঙ্গে ভাষার অনপনেয় সম্পর্কের বিষয়টি স্পষ্ট করে তুললেন। এও জানিয়ে দিলেন যে, সংস্কৃতির শ্রেণি চরিত্র থাকলেও ভাষার কোনো শ্রেণি চরিত্র নেই। অর্থাৎ কোনো বিশেষ ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর ধনী-দরিদ্র বা মালিক-শ্রমিক নির্বিশেষে সকল মানুষেরই ভাষা এক ও অভিন্ন। তাই শ্রমিক শ্রেণির রাষ্ট্রেও শ্রমিক শ্রেণির ভাষা বলে কোনো ভাষা থাকতে পারে না। স্তালিনের প্রণোদনায় শ্রেণিভাষা সম্পর্কীয় ভ্রান্তি অপনোদিত হলেও ভাষা-বিচারের অন্য অনেক ভ্রান্তি থেকে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদীদের অনেকেই এখনো মুক্ত হতে পারেননি।

লেখক: অধ্যাপক ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ।

অরুনোকোর সেই প্রতিবাদ

তপন কুমার রুদ্র

কখনো কখনো মনে হয় অরুনোকো একটি কল্পিত প্রতিবাদের নাম। আবার তাকে নিয়ে একটু ভাবলে মনে হতে পারে যে অরুনোকো যথার্থই একটি বাস্তব অভিজ্ঞতার স্ফুরণ। আফ্রিকার একটি রাষ্ট্র সুরিনাম। সেখানেই অরুনোকোর জন্ম। তার দাদু ছিলেন সেখানকার এক উপজাতি সম্প্রদায়ের রাজা। ওরা ছিল নিগ্রো, আফ্রিকার ঘন অন্ধকারের মতোই ওরা কালো। তবে অরুনোকো কালো হলেও অতোটা ঘন কুচকুচে কাল ছিল না, ওর নাকটাও ছিল বেশ খাড়া, শরীরটাও ছিল বেশ পেটানো, সুগঠনে চমৎকার ও সুন্দর। যৌবনের আহ্বানে তারও মনে জেগেছিল গভীর প্রেম। ভালোবেসে ফেলেছিল ইমোইন্ডা নামের এক কৃষ্ণকলি নিগ্রো যুবতীকে। গোপনে ওদের বিয়েও সম্পাদন হয়েছিল রীতি-মোতাবেক। কিন্তু ওদের রাজা মানে অরুনোকোর দাদু তা মেনে নেবেন কেন? তিনি তো রাজা; তাই যা কিছু সুন্দর, যা কিছু মনোহর, যা কিছু লোভনীয়, তা-তো অন্য কারুর দখলে যেতে পারে না। তাই অনেক ক’জন স্ত্রী ও অনেক ক’জন সেবিকা থাকা সত্ত্বে বুড়ো রাজা ইমোইন্ডাকে জোর করে দখল করলো; তাকেও একজন সেবিকা বানাল। কিন্তু ইমোইন্ডা-অরুনোকো’র একে অপরের প্রতি ভালোবাসার বন্ধন এতই দৃঢ় ছিল যে তাদের সম্পর্কে কোন ভাটা পড়লো না। রাক্ষুসে স্বভাব অতিবৃদ্ধ রাজাকে ফাঁকি দিয়ে ইমোইন্ডা অরুনোকোর সাথে মাঝেমাঝেই দেখা করতো, অভিসারে লিপ্ত হতো। কিন্তু নিয়তির ফল কে খ-াবে? একদিন রাজার রক্ষীদের কাছে ওরা হাতেনাতে ধরা পরে গেল। মিলনরত অবস্থায় ওদেরকে ধরতে পেরে রক্ষীরা উল্লাসে ফেটে পরে এবং কামুক রাজাকে সবকিছু জানিয়ে দেয়। শারীরিকভাবে অথর্ব হলেও রাজা তার স্বভাব অনুযায়ী ক্রোধ ও অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করে। পরিশেষে শাস্তি স্বরূপ ইমোইন্ডাকে ক্রীতদাসী হিসেবে বিক্রি করে সুরিনামের এক গহীন বনে, আর তার নাতী অরুনোকোকেও কঠিন নির্যাতন করে এবং পরবর্তীতে ক্রীতদাস বনিয়ে দাস ব্যবসায়ীদের হাতে ছেড়ে দেয়। ভাগ্যের কী পরিহাস! দেশান্তরী হয়ে নানা হাত ঘুরে অবশেষে অরুনোকো সুরিনামের সেই গহীন অরণ্যেই নির্বাসিত হয়, যেখানে ইতোমধ্যেই ইমোইন্ডা তার করুণ দাসী-জীবনের ঘৃণিত পেশা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। ঠিক যেন স্বর্গচ্যুত এডাম ও ইভ এর দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর আবার তারা একে অপরকে বহুকাল পরে খুঁজে পেল।

মিলন দৃশ্যটা কী অপূর্বই না হয়েছিল! বর্বর সামন্ত প্রথার সেই অতি অন্ধকার যুগে ক্রীতদাস ও ক্রীতদাসীরা কি অতো-সহজে মুক্তি পেতে পারতো? দুর্ভাগ্য সেখানেও তাদের ত্যাগ করেনি। সুরিনামের বর্ণিত সেই বনে যেসব শ্বেতাঙ্গ দাস মালিকরা তাদের নিয়ন্ত্রণ করত তারা তাদের আসল নাম বদলে দিয়ে নতুন নাম দিয়েছিল। অরুনোকোর নতুন নাম হল সিজার আর ইমোইন্ডার হল ক্লিমেন। অবশ্য আকস্মিকভাবে এই যুগের পুনর্মিলনের পর থেকে তাদের মধ্যে নিয়মিত সম্পর্ক ও যোগাযোগ অবাধেই গড়িয়ে যেতে থাকে। ইমোইন্ডা গর্ভবতীও হয়। কিন্তু যখনই অরুনোকো ইমোইন্ডার নিরাপদ প্রসব নিশ্চিত করার জন্য নিজ দেশে ফিরে যাবার অনুমতি প্রার্থনা করল তখনই গোল বাঁধল প্রচ- রকমে। অরুনোকোর আবেদন কোনোভাবেই ব্রিটিশ দাস মালিক ট্রেফরি ও ডেপুটি গভর্নর বিয়ামের মন গলাতে পারল না। এতে অরুনোকো যারপরনাই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং অন্যান্য ক্রীতদাসদের সঙ্গে নিয়ে এক লড়াকু ঐক্য গড়ে তোলে। তারপর শুরু হয়ে যায় মালিক গোষ্ঠীর মিলিটারি বাহিনী আর মুক্তি পাগল ক্রীতদাস বাহিনীর মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ। যুদ্ধে ক্রীতদাস বাহিনী পরাস্ত হতে বাধ্য হল। ইংরেজ ডেপুটি গভর্নর বিয়াম নিজেদের বিরাট স্বার্থে ক্রীতদাসদের ক্ষমা করার প্রতিশ্রুতি দিলেও শেষ পর্যন্ত অরুনোকোর ব্যক্তিত্বের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে তাকে ক্ষমা না করে তার সর্বাঙ্গে শত-শত চাবুকের ঘা বসিয়ে তাকে একেবারে রক্তাক্ত করে ছাড়ল। সেখানেই শেষ নয়। সর্বাঙ্গ রক্তাক্ত ও পুরোপুরি অচেতন করার পর তার অসংখ্য ক্ষত স্থানে বিষাক্ত মলম লেপন করে অসহ্য যন্ত্রণায় তাকে পাগল করে ফেলার নিষ্ঠুর কাজটি করল।

প্রতারিত, অপমানিত ও নির্যাতিত অরুনোকো বিয়ামের ওপর সর্বোচ্চ প্রতিশোধের জন্য পাগল হয়ে উঠল। সর্বাত্মক বিদ্রোহের আগুন তখন তাকে যুদ্ধের জন্য প্ররোচিত করতে লাগলো। সে জানতো এই যুদ্ধে তাকে প্রাণ উৎসর্গ করতে হতে পারে। কিন্তু তাঁর যদি মৃত্যু হয় তাহলে তার প্রিয়তমা স্ত্রী ইমোইন্ডার লাঞ্ছনা ও অপমানের কোন শেষ থাকবে না। তাই সে ইমোইন্ডার সাথে বিষয়টি গভীর আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নিলো যে পুনরায় সংঘর্ষের আগেই অরুনোকো নিজ হাতে ইমোইন্ডাকে হত্যা করবে এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ অরুনোকো সেই সিদ্ধান্তেরই বাস্তবায়ন করলো। সে এক মহাকাব্যিক উপায়ে প্রিয়তমা ইমোইন্ডার জীবনাবসান ঘটাল। ইমোইন্ডার লম্বা ঘন চুলের বেণী পেঁচিয়ে তার শ্বাস রোধ করল অরুনোকো।

নিজ প্রতিজ্ঞায় উজ্জীবিত হয়ে অরুনোকো তার অনুচরদের সঙ্গে নিয়ে ডিপুটি গভর্নর বিয়াম ও তার জল্লাদদের হত্যা করার চেষ্টায় পুরোপুরি সফল হতে পারলো না। সে আবার ধরা পরল। প্রথমে তাকে চাবুক মেরে রক্তাক্ত করা হল, তারপর নাক, কান, হাত ইত্যাদি সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে কেটে তাকে টুকরো টুকরো করে সর্দারদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া হল। তাতে কি অরুনোকোর বিদ্রোহের আগুন নিভে গেল?

উল্লেখিত খ-ের ভিত্তিতেই সপ্তদশ শতকের ব্রিটিশ লেখিকা আফরা বেন (অঢ়যৎধ ইবযহ) রচনা করেন তাঁর সাড়া জাগানো উপন্যাস অরুনোকো (ঙৎড়ড়হড়শড়)। স্বল্প দৈর্ঘ্যরে এই উপন্যাসটি লেখা হয়েছিল লেখিকার মাতৃভাষা ইংরেজিতেই। তবে এর জনপ্রিয়তার কারণে বিশ্বের বহু ভাষায় তা অনূদিত হয়। ১৬৮৮ সালে লেখিকা আফরা বেনের মৃত্যুর মাত্র এক বছর আগে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল।

যিশু খ্রিস্টের জন্মের পূর্বে রোমে সংগঠিত ইতিহাসখ্যাত প্রথম দাস-বিদ্রোহের সংগঠক ও কিংবদন্তি নেতা স্পার্টাকাস (ঝঢ়ধৎঃধপঁং) যেসব উল্লেখযোগ্য কারণে আজ অবধি বীরত্বের মহিমায় প্রাসঙ্গিক ও স্মরণীয়, লেখিকা আফরা বেন বর্ণীত যোদ্ধা অরুনোকোও মহান এক প্রতিবাদ বিদ্রোহ ও সংগ্রামের অম্লান প্রতীক বলে এখনও পূজনীয়। নানা বিশ্বস্ত সূত্রমতে আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে, অরুনোকোর জীবনী ও তার জীবনে প্রতারণা, নির্যাতন, দৃষ্টান্ততুল্য প্রেমকাহিনী, তার জীবনকালের সামন্তবাদের শোষণ-বর্বরতা নিছক কোনো কল্পিত গল্প নয়, এটি একটি সত্যিকার ইতিহাস। আদি যুগ তথা স্পার্টাকাস আমলের রোমান দাস ব্যবস্থায় যত নিষ্ঠুরতা-শোষণ-কুপ্রথা চালু ছিল; সপ্তদশ শতাব্দীর আফ্রিকা মহাদেশের নানা স্থানে তার ধারাবাহিকতা প্রবল দাপটেই দরিদ্র কালো নিগ্রোদের জীবন প্রবাহে জ্বালাময় বিষ ছড়িয়ে দিয়েছিল। এক্ষেত্রে ইয়োরোপীয় বণিকরা বিশেষত রোমান-ব্রিটিশ-আমেরিকান শোষকগোষ্ঠী কালো আফ্রিকানদেরকে নিছক পণ্য হিসেবে গণ্য করে তাদের উপর শোষণ-শাসন চাপিয়ে রাখতো। সেই সাথে তাদের চাপিয়ে দেয়া কুপ্রথা-কুপ্রবণতার ধারক হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটেছিলো কালো নিগ্রোদের সর্দার, গোত্রপতি, সামন্ত প্রভু, ছোট-ছোট রাজা-জমিদারদের চরিত্রেও। এভাবেই কুপ্রথা, শোষণমূলক প্রবণতা, নির্যাতনের কূটকৌশল ইত্যাদি বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত হয়ে থাকে। ইতিহাস-তো তাই বলে।

রোমান শ্বেতাঙ্গ স্পার্টাকাস যুগের কথা বলি কিংবা আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ অরুনোকো যুগের কথাই যদি বলি, ক্রীতদাসরা কখনোই মানুষ বলে গণ্য হয়নি। স্পার্টাকাস জন্মসূত্রে ক্রীতদাস হলেও অরুনোকো অবস্থার বিপাকে পরে পর্যায়ক্রমে ক্রীতদাসে পরিণত হয়েছিল। তবে অরুনোকোর জীবন পরিণতিই প্রমাণ করে, ক্রীতদাস শ্রেণি শোষক ও শাসক শ্রেণির নিষ্ঠুরতা আর কূটকৌশলের ফাঁদে পরে খেটে খাওয়া মানুষের অজ্ঞতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার প্রীতি ও বিভেদের বীজ ছিটিয়ে প্রকৃত অর্থেই মানুষকে মানুষের পণ্য বানিয়ে সেই প্রভুত্ব প্রথা সৃষ্টি করে তা বহাল রাখার নতুন নতুন কৌশল অনুসরণ করা হয়েছে যুগে যুগে। ভারত উপমহাদেশের শাসক শোষকরাই বা এতে কম কিসে।

ইতিহাস অবশ্যই তার পথে হেঁটেই চলেছে। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে আর যাচ্ছে। শোষণের হীনকৌশলও বসে থাকে না। বর্তমানের মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রবল আক্রমণে আজকের বাংলাদেশের শ্রমনির্ভর খেটে খাওয়া মানুষ কি ভোগের পণ্য হতে বাধ্য হচ্ছে না? একথা সত্য যে পুরাকালের দাস প্রথা পুরনো চরিত্রে আজ আর বহাল নেই। সামন্ত ভূস্বামী, রাজা-জমিদারদের অবস্থানও খুব সীমিত পরিসরে ধিকধিক করে মারা যেতে বসেছে। তবে সামন্ত যুগীয় ধর্মীয় অন্ধত্ব, ঠকনির্ভরশীলতা, ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণে অভ্যাস প্রবণতা আর তার সাথে অর্থহীন অহংকারবোধ দারুণভাবে আজ অবধি সমাজকে দুর্বল করেই চলেছে। তবে যদি সরাসরি মানুষ মানুষকে পণ্য বানিয়ে ব্যবহার করার যে রীতি দাস প্রথার যুগে স্বীকৃত সংস্কৃতি ছিল, তা কিন্তু ভিন্ন রূপে ও ভিন্ন-ভিন্ন অবস্থানে মারাত্মকভাবেই সৃষ্টি হচ্ছে এবং ছড়িয়ে পরছে। সম্রাট-রাজা-জমিদারদের জায়গায় মানবপ্রভুরা যেসব নামে শোষণ, নির্যাতন ও ভোগবিলাস বহাল রেখেছে তারা হল শোষক রাজনৈতিক নেতা, ক্ষমতাশীন আমলা শ্রেণি, কালো টাকার মালিক, পুঁজিপতি, শিল্প-মালিক, শিল্প-উদ্যোক্তা, বিদেশিদের দালাল, এনজিও ব্যবসায়ী, মুনাফা ভিত্তিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিক, গোষ্ঠী ইত্যাদি।

বিশ্বব্যাপী শোষণকেন্দ্রিক অর্থনীতির জোয়ার বইছে। দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে ধনিক পরাশক্তির দেশগুলো যেভাবে অবাধ বাজার সৃষ্টি ও বাজার-নিয়ন্ত্রণ করতে লেগেছে তাতে করে ঘৃণ্য দালালগোষ্ঠীর-তো পোয়া বারো। মানবতা কি এভাবেই অপমানিত হবে? কর্মীশ্রেণির শ্রম ও সম্ভ্রম কি এভাবেই লুণ্ঠন হতে থাকবে? বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রজন্মরা সবাই কি নতজানু হয়ে থাকবে? গণতন্ত্রের নামে গণমানুষেরা কি শোষকচক্রের ভৃত্য হয়ে বাঁচবে? না, তা কিন্তু হবে না।

অরুনোকো অতৃপ্ত অবস্থায় মরে যেতে বাধ্য হলেও বিদ্রোহের আগুনটা জ্বেলে রেখে গেছে। মুক্তি-পাগল এমন বিদ্রোহী-আগুনের অনেক নমুনা ইতিহাস ধরে রেখেছে, সমুন্নত রেখেছে। আজকের দিনে এরকম কোন আশাবাদ পোষণ না করা যথার্থ হবে না। মেহনতি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানবশ্রেণির জীবন-জীবিকা ও সংস্কৃতি রক্ষার স্বার্থে প্রণীত রাজনৈতিক মতবাদের আদর্শিক প্রয়োগ ও তাকে বিকশিত করার লক্ষ্যে নিবেদিত সংগঠন ও শক্তিগুলোকে এক কাতারে আসতে হবেই। মানবমুক্তি আদায়ের জন্য আনুষ্ঠানিক শপথ নেয়াটাই যথেষ্ট নয়, একটা চলমান প্রক্রিয়ায় এসব অমানবিক সামাজিক নীতি-নৈতিকতার বিরুদ্ধচারী হতেই হবে।

লেখক: অধ্যাপক ও  প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি বিভাগ, সরকারি বেগম রোকেয়া কলেজ, রংপুর।

চৌমাথায় বাংলাদেশ

এম এম আকাশ

বাংলাদেশ এখন ক্রস রোডে দাঁড়িয়ে। এখানে রয়েছে পরস্পর বিরোধী চারটি রোড বা রাস্তা। প্রথম দুটির একটি হচ্ছে গণতন্ত্র অব্যাহত রাখার রাস্তা। অপরটি হচ্ছে কোন না কোন ধরনের অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উত্থান এবং সেটি কতদিন থাকবে সে বিষয়ে এখনই নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। ক্রস রোডের অন্য দুটি রাস্তার একটি হচ্ছে, বাংলাদেশে মিনি পাকিস্তান ধাঁচের ভাবাদর্শের শাসন কায়েম। দ্বিতীয়টি হচ্ছে গণতান্ত্রিক শাসন বহাল এবং ক্ষীণ ধারা ও আপসকামী হলেও মুক্তিযুদ্ধের ধারার শাসন অব্যাহত থাকা। এই ক্রস রোডগুলিকে একটি সহজ দুই বাই দুই (২দ্ধ২) ছকের মাধ্যমে নীচে তুলে ধরা হল।

                                        গণতন্ত্র                   গণতন্ত্র না

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা                 ক                          খ

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা না            গ                           ঘ

এই ছক অনুসারে বর্তমান ক্রস রোডের চার রকম ভবিষ্যৎ পরিণতি সম্ভব। ‘ক’ পরিণতির অর্থ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্র উভয়ই অব্যাহত থাকবে। ‘খ’ পরিণতির অর্থ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অব্যাহত থাকবে কিন্তু গণতন্ত্র থাকবে না। পক্ষান্তরে ‘গ’ পরিণতির অর্থ গণতন্ত্র অব্যাহত থাকবে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থাকবে না। সর্বশেষে ‘ঘ’ পরিণতির অর্থ হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্র উভয়ই ব্যাহত হবে।

জনগণের মনে তাই প্রশ্ন- সবচেয়ে কাম্য ক্রস রোডটি কী? আমার বিচারে গণতান্ত্রিক শাসন অব্যাহত রেখে যত ক্ষীণই হোক মুক্তিযুদ্ধের ধারাকে অব্যাহত রাখা গেলেই তা বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার সহায়ক হবে। কিন্তু সম্প্রতি বাংলাদেশের মানুষের সাধারণভাবে ধারণা হয়েছে, এই দুইয়ের যুগপৎ বিজয় অসম্ভব। অনেকেই একান্ত আলোচনায় বলছেন, যদি মোটামুটি গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাহলে পাকিস্তানপন্থিরাই ক্ষমতায় আসবেন। এখানে পাকিস্তানপন্থী বলতে তারা বোঝাচ্ছেন জামায়াতে ইসলামি-বিএনপি সমন্বয়ে গঠিত ১৮ দলীয় জোটের ক্ষমতা গ্রহণকে। তাদের সঙ্গে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে হেফাজতে ইসলাম। একথা ঠিক যে সম্প্রতি যে কয়েকটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে সেগুলো মোটামুটি গণতান্ত্রিকভাবে হয়েছে বলেই সাধারণ মানুষ মনে করে। যদিও প্রতিটি নির্বাচনেই কিছু মাত্রায় কারচুপি হয়েছে বলে ১৮ দলীয় জোটের নেতারা দাবি করছেন। তবে সহজেই আমরা ধারণা করতে পারি যে তারা এটা করছে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুটি চাঙ্গা রাখার জন্য। ১৮ দলীয় জোটের নেতারা বিশ্বাস করেন যে সঠিকভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কারণেই তাদের এ বিপুল জয় এসেছে। অর্থাৎ বিগত ৫ বছরে মহাজোটের শাসনামলে নানা রকম বৃহৎ দুর্নীতির (শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের সহায়তা প্রত্যাহার, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, ডেসটিনি গ্রুপের লাখ লাখ মানুষের অর্থ আত্মসাৎ প্রভৃতি) কারণে মহাজোট সরকারের ভাবমূর্তি তলানিতে এসে ঠেকেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তৃণমূল পর্যায়ে দলীয় কোন্দল, দলের ভেতরে সুবিধাবঞ্চিতদের ঈর্ষা, তৃণমূলে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নিয়ে নানা রকম নয়-ছয়, টেন্ডারবাজি এবং ‘ছাত্রলীগ-যুবলীগের’ মাস্তানদের দৌড়াত্ম। এগুলো সবই মানুষের মন বিষিয়ে দিয়েছে। তবে এজন্য নয় যে তারা ভেবেছিল, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার কোন দুর্নীতিই করবে না বা আওয়ামী লীগ এবার ধোয়া তুলসী পাতার মতো সহজসরল জীবন যাপন করবে। বরং তারা ভেবেছিল যে বাংলাদেশে স্বাভাবিক যে দুর্নীতির মাত্রা, সেটা এবারও থাকবে তবে এবার তা মাত্রাতিরিক্ত হবে না। কারণ শেখ হাসিনা তার মন্ত্রীসভা গঠন করার সময় সে ধরনেরই একটা সংকেত দিয়েছিলেন। আমার ধারণা, এবার শেখ হাসিনার সরকারের মন্ত্রীসভা সদস্যদের মাধ্যমে যত না দুর্নীতি হয়েছে তার চেয়ে লুটেরা ব্যবসায়ী এবং তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের দুর্নীতির প্রকোপ ছিল অনেক বেশি। কয়েকজন মন্ত্রীর কথা বলতে পারি, যাদের সম্পর্কে এখন পর্যন্ত দুর্নীতির অভিযোগ কোন মহল থেকেই ওঠেনি। এখানে নাম উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। একথাও স্বীকার্য যে, বিগত বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলে তারেক জিয়ার নেতৃত্বে যে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে সে ধরনের একটি অভিযোগ শেখ হাসিনার পরিবারকে ঘিরে প্রতিষ্ঠার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করেও এখন পর্যন্ত বিএনপি পুরোপুরি সফল হয়নি। কিন্তু যাই বলি না কেন, মহাজোট সরকারের প্রতি জনগণের প্রত্যাশা ছিল এবার অনেক বেশি।

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার যারা লিখেছিলেন, তারা কল্যাণ-ধনতন্ত্র কায়েম করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এই ধনতন্ত্রের মূল কথা হচ্ছে ব্যক্তি খাতের বৃহৎ ধনীদের কাছ থেকে আয়ের ৪০-৫০ শতাংশ আয়কর হিসেবে আদায় করা এবং তা স্বচ্ছ ও দুর্নীতিশূন্যভাবে দেশের নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলো (যেমন- অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও নিরাপত্তা) পূরণে ব্যয় করা। লেখকরা ইশতেহারের শিরোনাম দেন ‘দিন বদলের সনদ- ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণের হৃদকল্প’। যেহেতু দিন বদল হল না এবং এনালগ বাংলাদেশ রয়ে গেল, সেজন্য মানুষের মনে রয়েছে তীব্র আশাভঙ্গের বেদনা।

সবশেষে, সামগ্রিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলটি যে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল- যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করবে এবং ধর্মনিরপেক্ষ-সেক্যুলার বাংলাদেশ কায়েম করবে, সেই দলই যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু করল অনেক দ্বিধা-দুর্বলতাসহ শাসন মেয়াদের অন্তিমলগ্নে এসে। সংবিধান যথোপযুক্তভাবে বদলানোর সুযোগটিও হেলায়-ফেলায় হারিয়ে গেল। এ কথাও আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব বুঝল না যে, ইসলামি কার্ড খেলে এই দলটি কখনই বিএনপির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় জিততে পারবে না। আওয়ামী লীগকে পরিষ্কারভাবে মুক্তিযুদ্ধের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ ও ভাষাভিত্তিক সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের পক্ষে বলিষ্ঠ অবস্থান নিয়েই অগ্রসর হতে হবে। মুসলিম আওয়ামী লীগ থেকে আওয়ামী লীগ হয়ে পুনরায় মুসলিম আওয়ামী লীগ হওয়ার সুযোগ আওয়ামী লীগের নেই। আওয়ামী লীগকে যদি এগুতে হয় তাহলে সামনের দিকেই এগুতে হবে। যেভাবে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের প্রথম দিকে আওয়ামী লীগকে ত্রুটিপূর্ণভাবে হলেও বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বানাতে চেয়েছিলেন সেইভাবেই আজও ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে অতীত ত্রুটিগুলি  থেকে মুক্ত হয়ে কৃষক-শ্রমিক অভিমুখেই হাঁটতে হবে আওয়ামী লীগকে। মর্মগতভাবে আওয়ামী লীগ যদি সাধারণ মানুষের সঙ্গে থাকতে চায় এবং গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়ে দেশ শাসন করতে চায় তাহলে শ্রমিক কৃষক ও দুঃখী মানুষের বাস্তব অবস্থার উন্নতি ঘটিয়েই তা অর্জন করতে হবে। লুটেরাদের প্রশ্রয় দিয়ে, দুর্নীতিবাজদের আশ্রয় দিয়ে, দলের ক্যাডারদের টুপাইস কামানোর ব্যবস্থা করে গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতায় থাকা যায় না। দুর্ভাগ্য আমাদের, আজ যখন নির্বাচন সামনে এসেছে তখন সবাই বলছে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলটি তার কৃতকর্মের কারণে অনিবার্যভাবে পরাজিত হবে। সেজন্যই ক্রসরোডে দাঁড়িয়ে মানুষের ধারণা, সবচেয়ে কাম্য যে কম্বিনেশন গণতান্ত্রিক শাসন অব্যাহত এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ক্ষমতায় থাকা, এ দুটি বিষয় একসঙ্গে এবারে ঘটবে না। সত্যিকার গণতান্ত্রিক নির্বাচন হলে বিএনপি-জামাত-হেফাজত জোট এবার ক্ষমতায় আসবে বলেই অধিকাংশ মানুষ মনে করেন।

তাহলে কি বাংলাদেশে মিসরের মুর্সির মতই একটা ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে? কেউ কেউ ভাবেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত যেহেতু আওয়ামী লীগের পক্ষে অবস্থান নিয়ে আছে এবং সামরিক বাহিনী যেহেতু ওই সব আন্তর্জাতিক শক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত, সুতরাং বাংলাদেশে মুর্সি ভ্যারিয়ান্ট চালু হতে যাচ্ছে। কিন্তু এই ভ্যারিয়ান্ট চালুর আগে-তো একটা নির্বাচনের মাধ্যমে ১৮ দলীয় জোটকে বিজয় অর্জন করে ক্ষমতায় আসতে হবে এবং এরপর তাদের অন্যতম পার্টনার মৌলবাদী-জঙ্গিবাদী শক্তির নবজাগ্রত উত্থান এবং আক্রমণের শিকার হতে হবে বাংলাদেশকে। বিএনপি নেতৃত্বের সবার কাছে এ বিষয়টি সমানভাবে গ্রহণযোগ্য হবে কি? যদি এ ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল ভবিষ্যতের কথা ভেবে বিএনপির মধ্যে নতুন মেরুকরণ ঘটে এবং মৌলবাদী জঙ্গি শক্তি শেষ পর্যন্ত বিএনপি কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়ে একঘরে হয়ে যায় তাহলে কী ঘটবে সেটা বলা মুশকিল। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন এমন এক মাত্রায় পৌঁছে গেছে যেখানে নারীদের ঘরে আটকে রাখা বা তালেবানি কায়দায় দেশ চালানো আদৌ আর সম্ভব নয়। সুতরাং মৌলবাদের ওপর ভর করে বিএনপি ক্ষমতায় আসলেও মৌলবাদী ধারার রাজনীতি ও অর্থনীতি সাজাতে গেলে বিএনপি ডুবতে বাধ্য হবে। কিন্তু বিএনপির কাঁধে ভর করে মৌলবাদের সাময়িক উত্থান এবং সাময়িক ধ্বংসলীলা খুবই বাস্তব একটি সম্ভাবনা হিসেবে বিরাজমান। সুতরাং অধিকাংশ বিশ্লেষকই শেষ পর্যন্ত ‘খ’ অথবা ‘গ’ এই দুই পরিণতির কথাই ভাবছেন বলে দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ গণতন্ত্র রাখতে গেলে মৌলবাদকে মেনে নিতে হবে অথবা মুক্তিযুদ্ধকে রাখতে হলে গণতন্ত্রকে বিসর্জন দিতে হবে।

 তবে অনেক কিছুই নির্ভর করে যাকে আমরা বলি ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’ বা ‘লস মিনিমাইজেশন’- সেই ধারায় কতটুকু দৃঢ়তা ও ধৈর্য নিয়ে আওয়ামী লীগ এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রগতিশীল মিত্ররা এগুতে পারবেন তার ওপর। আত্মসমালোচনায় বিশ্বাসী এ ধারার কোনো কোনো আওয়ামী নেতা আমাকে বলেছেন, তারা প্রায় অর্ধেক দুর্নীতি পরায়ণ ব্যক্তিকে পুনরায় মনোনয়ন প্রদান করবেন না বলে স্থির করেছেন এবং তাদের স্থানে নতুন সৎ, যোগ্য ও জনপ্রিয় প্রার্থীদের এবার মনোনয়ন দেয়া হবে। তারা এটাও বলছেন, মুক্তিযুদ্ধের ধারায় দেশকে পরিচালনার জন্য যাবতীয় দোদুল্যমানতা পরিহার কওে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজকেও দৃঢ়ভাবে এগিয়ে নেয়া হবে। এভাবে দেশব্যাপী একটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি করা হবে। জানি না, এটা কথার কথা কী না। যদি এটা হয় তাহলে আওয়ামী লীগের জন্য ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি হলেও হতে পারে । এ কথাও কেউ কেউ বলেন, এবার আওয়ামী লীগের শাসনামলে শিল্প ও শহরাঞ্চলে যতখানি অগ্রগতি হয়েছে সেই তুলনায় গ্রামাঞ্চলে উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির মাত্রা ছিল বেশি। সেজন্য তারা বলতে চান যে সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনী সূচক আর পল্লী এলাকায় ভোটের সূচক এক হবে না। সম্ভবত সেই ধরনেরই কোন জরীপ থেকে প্রধানমন্ত্রী পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় আওয়ামী লীগের পক্ষে এক ধরনের বিজয়ের ইঙ্গিত দিয়েছেন। কিন্তু আমি যেই দুই ধরনের নতুন পদক্ষেপ গ্রহণের কথা উল্লেখ করলাম সেটি ছাড়া শুধু নিছক তথ্য-জরিপ নিয়ে আত্মসন্তুষ্ট হয়ে বসে থাকলে পরিস্থিতি সামান্যই সামাল দেওয়া যাবে বলে আমার মনে হয়।

আরেকটা দিক হচ্ছে, সামরিক বাহিনী ও সুশীল সমাজ ২০০৭ সালের ১/১১-এর আগে যে রকম তৎপর ছিল, সে ধরনের তৎপরতা এবারে দেখাচ্ছে না। এমতাবস্থায় সাধারণ নির্বাচনে নিশ্চিত জয়ের প্রত্যাশায় থাকা বিএনপি অনেকখানি ছাড় দিয়ে হলেও নির্বাচনে আসতে রাজী হয়ে যেতে পারেন। আর এটাও আমরা জানি, আগের মতো এখন মিডিয়া ক্যু ও ভোট চুরি করা সম্ভব নয়। একটি মোটামুটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলেও হতে পারে এবং এতে থাকতে পারে সব পক্ষের অংশগ্রহণ। তখন গণতন্ত্র অব্যাহত থাকবে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে- কে তখন জয়ী হবেন এবং তারপর কী হবে। আবার যদি শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বচনে অংশগ্রহণে সম্মত না হয় এবং আওয়ামীলীগ এক তরফা নির্বাচন করে ক্ষমতাসীন হয়, তাহলে তখন অবস্থাটি কী দাঁড়াবে? এই বিশ্লেষণ থেকে দেখা যাচ্ছে যে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি যে-ই আগামী নির্বাচনে জিতুক না কেন সামগ্রিকভাবে পরিস্থিতি ‘খ’ অথবা ‘গ’-র মধ্যেই আটকে থাকবে। ‘খ’ এবং ‘গ’ যেহেতু টহংঃধনষব ঊয়ঁরষরনৎরঁস ঝরঃঁধঃরড়হ, কারও জন্যই সর্বোচ্চ কাম্য পরিস্থিতি নয়, সেহেতু এ অবস্থাও হবে ক্ষণস্থায়ী। তবে কি আমরা শেষ পর্যন্ত ধাবিত হব সবচেয়ে খারাপ ‘ঘ’ পরিণতির দিকে যেখানে গণতন্ত্রও অনুপস্থিত মুক্তিযুদ্ধও অনুপস্থিত?

এই সর্বশেষ ভয়ংকর পরিণতির বিরুদ্ধে আমাদের সকলকেই সর্বশক্তি নিয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে। সব জটিলতা সত্ত্বেও আমাদের সবচেয়ে কাম্য যে ফল- গণতন্ত্র অব্যাহত থাকবে এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি এগিয়ে যাবে, যত কঠিনই তা হোক না কেন, সেজন্যই আমাদের লড়তে হবে। যদিও স্বল্প মেয়াদে এই দুয়ের যুগপৎ উপস্থিতি কার্যত অসম্ভব বলেই এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে। কিন্তু অসম্ভবকে সম্ভব করতে পেরেছিলাম বলেই আমরা একাত্তরে প্রবল শক্তিধরকে হারিয়ে বিজয় অর্জন করতে পেরেছিলাম।

লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

রংপুরের লোকজ সংস্কৃতি ও মেলা

এস এম আব্রাহাম লিংকন

কত শতাব্দী আগে রংপুর অঞ্চলে মেলার প্রবর্তন হয়েছিল তা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। তবে কৃষি ও কুটিরশিল্প বিস্তারের সাথে সাথে মেলা সংস্কৃতির বিকাশ হয়েছে- এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না। মেলা শুধু পণ্যের সমাহার নয়, নয় শুধু বিনোদনের পশরা, এটা সৌহার্দের প্রতীক- সম্প্রীতির প্রতীক। মেলাকে ঘিরে সংস্কৃতির নানাবিধ বিনোদন ছাড়াও আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকা- জড়িত। মেলায় যেমন চিত্তবিনোদনের আয়োজন থাকে তেমনি থাকে রকমারি দ্রব্যাদির সমাবেশ। এ জনপদে (রংপুর) বহুপ্রকার মেলার বিপুল আয়োজন ছিল, যার কোন কোনটি এখনও আয়োজিত হয়। অতীতে রংপুর জেলায় যেসব স্থানে মেলা বসতো এবং কোথাও কোথাও এখনও বসে, সেসব মেলার মধ্যে বৈশাখী মেলা অন্যতম। ইদানিং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় কৃষি মেলা ও বৃক্ষ মেলা’র আয়োজনও চোখে পরার মতো। রংপুর অঞ্চলের প্রায় সব বড় বড় শহরে এ ধরনের মেলার আয়োজন লক্ষ্য করা যায়। তবে অত্র অঞ্চলের ঐতিহ্যগত কিছু মেলার অবস্থান সম্পর্কে একটু আলোচনা করা যাক।

বৈশাখী মেলা: বৈশাখী মেলা জেলা শহরেতো বটেই, গ্রামাঞ্চলেও এর ঐতিহ্যগত আয়োজন আজও মুগ্ধ করে। যেমন- রংপুর শহরের বাইরে নিসবেৎগঞ্জ, পীরগঞ্জের কালসাভারা, পীরগাছার চণ্ডীপুর, লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা, খেজমতপুর, ধাপেরহাটের তেলাস, কুড়িগ্রামে প্রচ্ছদের বৈশাখী মেলা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এ মেলাগুলোর দু-একটি মাসব্যাপী হয়। অষ্টমী ও বারুনীর মেলা: কুড়িগ্রামের চিলমারিতে ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে অষ্টমীর স্নানের দিনে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। রংপুর বিভাগের সবচেয়ে বড় মেলা এটি। এ মেলায় কয়েক লক্ষ পূণ্যার্থীর সমাবেশ হয়। একই দিনে কুড়িগ্রামের গওহর পার্ক মাঠেও (মজিদা কলেজ মাঠ) একটি মেলা বসে। মেলাটিতে ব্যাপক শিশুর সমাবেশ হয় বলে একে চেংড়ার মেলা নামে অভিহিত করা হয়। এ মেলায় মূলত কৃষকরা রসুন বিক্রি করে। তাই এ মেলাকে স্থানীয়ভাবে রসুনের মেলা নামেও অভিহিত করা হয়। অষ্টমীর ¯œান উপলক্ষে বদরগঞ্জের ট্যাক্সের হাটের করতোয়া মেলা, দামোদরপুরের শেকেরহাট মেলা, রংপুর সদরের খটখটিয়ার মেলা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও রংপুরের চব্বিশ হাজারী, পীরগঞ্জের জাফরপাড়া, পাটগ্রামের বড়বিল, হরিণসিংগার দিঘি প্রভৃতি এলাকার মেলাগুলো বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এদিকে রাজারহাটের বৈদ্যবাজার এলাকায় মাসাম কুড়ার মেলা বেশ ঐতিহ্য বহন করছে এখনও। কুড়িগ্রামের রাজারহাট ও লালমনিরহাট থানার সীমান্তে একটি বিরাট পুকুরের পারে অনুষ্ঠিত সিন্দুরমতির মেলা ও যশোহারার মেলা বিশেষ উল্লেখ্য। যশোহারার মেলায় প্রচুর পরিমাণে খেজুর বিক্রি হয় বলে একে খেজুরের মেলাও বলা হয়, এ মেলায় প্রচুর পাখিও কেনা-বেচা হয়। এদিকে জলঢাকার ডিমলার টটুয়ায় বারুণীর মেলা আজও তার প্রাচীন ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। চৈত্র সংক্রান্তির মেলা: রংপুরের হাজিরহাট, গঙ্গাচড়ার ধামুর, পীরগাছার কান্দিরহাট ও অন্নদানগরের যাদুলস্করে চৈত্র সংক্রান্তিতে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। মহরমের মেলা: রংপুর মিঠাপুকুরের ছড়ানের হাট, শুকুরের হাট, শঠিবাড়ির হাট, মিঠাপুকুর বাজার, বড়দরগাহ্র হাট, মোসলেম বাজার, গংগাাচরার মহীপুর, কুড়িগ্রামের খলিলগঞ্জ, চওড়া হাট, বালার হাট, ফকিরের হাট প্রভৃতি স্থানে মহরম উপলক্ষে মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এদের মধ্যে কুড়িগ্রামের খলিলগঞ্জ’র মেলাটি তাজিয়ার মেলা নামে পরিচিত। চড়ক মেলা: রংপুর বুড়িরহাটের চব্বিশ হাজারী, লাহিড়ীর হাট, গংগাচরার চন্দনহাট, তারাগঞ্জের চড়ক ডাংগা, মিঠাপুকুরের হাছিয়াহাট, নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের বড়ভিটায় চরক মেলা বসে। রাস মেলা: পীরগঞ্জের তাম্বলপুরহাট ও ভোলানাথেরহাটে অগ্রহায়ণ মাসের শেষ সপ্তাহে ১০১টি মূর্তির মেলা হয়। এ মেলা রাস মেলা নামে পরিচিত। মনসার মেলা: পীরগঞ্জের বিষ্ণুপুরের কচুবাড়িতে মনসা পূঁজা উপলক্ষে এ মেলা হয়। নানকার মেলা: এ মেলা মিঠাপুকুরের নানকার বাজারে রাসপূর্ণিমা উপলক্ষে আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের দিন অনুষ্ঠিত হয়। মাঘী পূর্ণিমার মেলা: রংপুর পীরগঞ্জের এ মেলাকে মাদারগঞ্জের মেলাও বলা হয়। এ মেলা মাঘী পূর্ণিমা উপলক্ষে দু’সপ্তাহ জুড়ে হয়। পৌষ সংক্রান্তি মেলা:  পীরগঞ্জের চৌধুরী মেলা ও ভেন্ডাবাড়ির মেলা পৌষ সংক্রান্তিতে অনুষ্ঠিত হয়।  বৃহত্তর রংপুর জেলার অন্যান্য জেলাগুলোতেও এ মেলা লক্ষ করা যায়। ঈদ মেলা: এ অঞ্চলে ঈদের দিনে অনেক স্থানে মেলা বসে। তারাগঞ্জের চৌপথী মেলা, কাউনিয়া ও তিস্তার মেলা, ডাংগীরির হাটের মেনা নগর, দামোদরপুর নারাবাড়ী প্রভৃতি স্থানে ঈদ মেলা উল্লেখযোগ্য। ওরশ মেলা: এ মেলা স্থানীয় পীর মাশায়েখদের মাজার কেন্দ্রীক আয়োজন হয়। রংপুর অঞ্চলে এ মেলার আয়োজন লক্ষনীয়, গংগাচড়ার পাকুরিয়ার কছিমুদ্দিন পীরের বাৎসরিক ওরসের সময় এ মেলা হয়। মাঘ মাসের ৫-৬ তারিখে কোলকন্দের আলী পীরের ওরস অনুষ্ঠিত হয়। এ মেলাকে পীরের হাটের ওরস মেলা বলা হয়। এছাড়া দোয়ালী পাড়া, তকেয়া শরীফ ও তারাগঞ্জে ওরস উপলক্ষে মেলা আয়োজন করা হয়। বউ মেলা:  মহারাজা তাজহাট এ মেলার প্রবর্তন করেছেন বলে প্রচার আছে। এলাকার নারীদের বিনোদনের জন্য এ মেলা পহেলা বৈশাখে অনুষ্ঠিত হয়। পশুর মেলা: এ মেলা নীলফামারীর দাড়োয়ানীর মেলা, ডোমারের পাঙ্গার মেলা হিসেবে পরিচিত। মাসব্যাপি এ দু’টি মেলায় প্রচুর গবাদি পশু ক্রয়-বিক্রয় হয় বলে একে পশুর মেলা বলা হয়ে থাকে। দূর্গা পূজার মেলা: রংপুরের সমগ্র অঞ্চলে এ মেলা হয়। মূলতঃ ষষ্টি থেকে শুরু হয়ে বিজয়ার দিন পর্যন্ত এ মেলাগুলো চলে। অতীতে এ মেলা হত রাজা ও জমিদারদের দূর্গামন্ডপের নিকটবর্তী। এখন যেখানেই দূর্গামন্ডপ সেখানেই এ মেলার অস্তিত্ব লক্ষনীয়। কালীর মেলা: কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীর মাদাই খালের কালী মন্ডপকে ঘিরে কালী পূঁজার সময় এ মেলা হয়। এ মেলাটি মাদাইখালের মেলা নামে পরিচিত। এ মেলাকে উপলক্ষ্য করে ভাওয়াইয়া যুবরাজ কছিমুদ্দিন লিখেছিলেন অমর গান “সবাই মিলি বুদ্ধি করি ১২ হাত বানাইছে কালী, কালীর মেলা মাদাইখেলোতেু। কালীর মেলা নীলফামারীর কালীগঞ্জে, লালমনিরহাটের কুলাঘাটে এবং কুড়িগ্রামের দাসের হাটে ব্যাপক ভাবে আয়োজন করা হয়। দাসেরহাটের কালী মূর্তিটি উভয় বঙ্গের মধ্যে বড়। রোকেয়া মেলা: প্রতি বছর ৯ ডিসেম্বর পায়রাবন্দে রোকেয়া মেলা অনুষ্ঠিত হয়। মহিয়সী বেগম রোকেয়া সাখাওয়াতের জন্ম ও মৃত্যু দিবসকে কেন্দ্র করে সরকারি ও স্থানীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এ মেলাটি পরিচালিত হয়। এদিকে কুড়িগ্রামের কৃতীকন্যা প্রয়াত নারী নেত্রী শামসুন নাহান চৌধুরী সানু’র জন্ম দিন ১৬ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় সানু মেলা। এছাড়াও হালের কারুশিল্প মেলা, বই মেলা, পিঠা মেলা, শিল্পমেলা, বিজয় মেলা (বিজয় দিবসে হয়), পর্যটন মেলা, আবাসন মেলা, ব্যাংকগুলোর ঋণ মেলা, সঞ্চয় মেলা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। যুগের চাহিদার সাথে মিল রেখে আগামী দিনে হয়তো নানা ধরনের মেলার জন্ম হবে আবার অনেকগুলো হারিয়ে যাবে কালের গহ্বরে। সেগুলোকে হয়তো খুঁজতে হবে ইতিহাসের পাতায়। আমাদের লোক সংস্কৃতির চিরায়ত এ ধারা আধুনিক ও যান্ত্রিক সভ্যতার আঘাতে আজ অনেকটাই বিপর্যস্ত। তবুও এ সকল মেলা অতীত ঐতিহ্যের স্মারক ছাড়াও এ অঞ্চলের মানুষের স্বতন্ত্র সত্তার পরিচয় বহন করে। মেলাগুলো সংশ্লিষ্ট এলাকার নিজস্ব সংস্কৃতির অংশ। মেলাগুলোকে আর্কষণীয় করার জন্য কোথাও কোথাও খেলাধূলার আয়োজন করা হয়ে থাকে। আবার কোথাও কোথাও খেলার আয়োজনকে কেন্দ্র করে একদল মানুষ পণ্যের পশরা নিয়ে বসে যা মেলার রূপ ধারণ করে। যেমন নৌকা বাইচের সময় নদীর পাড়গুলি মেলার রূপ পরিগ্রহ করে।

মেলা এবং মেলার বাইরে যে খেলাগুলো এ অঞ্চলের সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার সাথে জড়িয়ে আছে সেগুলোর অন্যতম হল- হাডুডু, কাবাডি (কাপাটি), লাঠি খেলা, দাঁড়িয়া বান্ধা, গোল্লাছুট, এক্কা-দোক্কা, বউ-ছুট, লুকোচুরি, চেংকুডারা বা চেংগু-পেন্টি (বলা যায় বর্তমান ক্রিকেটের এ দেশীয় আদিরূপ), তরবারি খেলা, পাতা খেলা, গুড্ডি বা ঘুড়ি উড়ানো খেলা, কেরাম খেলা, নৌকাবাইচ, ঘোড়দৌড়, ফুটবল, আটকোটা, উরূণ-গাইন, লুডু, পিংপং, পিন্টু-পিন্টু, লুকোচুরি প্রভৃতি। নিজস্ব ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এই খেলাগুলো এ অঞ্চলের মানুষের একদা শরীর চর্চা ও আনন্দ বিনোদনের মাধ্যম ছিল। অবশ্য এখন আধুনিক খেলাধুলার মধ্যে প্রচলিত ফুটবল, ব্যাডমিন্টন, ভলিবল, টেনিস, ক্রিকেট, মার্শাল আর্ট প্রভৃতির চর্চাই বেড়েছে অনেক বেশি। এগুলোর অধিকাংশই শহর কেন্দ্রিক। এ জনপদে অধিকাংশ মেলায় জুয়া খেলার অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। জুয়া নির্দিষ্ট একটি খেলার নাম নয়, যে খেলাটি বাজি ধরে খেলা হয় এবং বিনিময়ে আর্থিক সুবিধা লাভ করা যায় তাকেই বাজী যা স্থানীয়ভাবে জুয়া খেলা বলা হয়। এ খেলাটি মেলার সময় ব্যাপক রূপ পায়। সাধারণত যে বিষয়গুলি আমাদের কাছে আদিকাল থেকে জুয়া হিসেবে দৃশ্যমান সেগুলো হচ্ছে তাসখেলা, চুড়ি খেলা, ডাব্বু খেলা, পাশা খেলা, হালের হাউজি খেলা প্রভৃতি। এ খেলাগুলো বিনোদন অপেক্ষা পারিবারিক ও অর্থনৈতিক বৈকল্য সৃজনে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছে।

মেলায় খেলাধূলা ছাড়াও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে যারমধ্যে লোক নৃত্য, ভাওয়াইয়া, আধূনিক, রবীন্দ্র নজরুল সঙ্গীত প্রভৃতি লক্ষ করা যায়। এখানে জারি গান, পুঁথি, যাত্রা, পালাগান, কুশানগান, সার্কাস, পুতুলনাচ প্রভৃতি দৃশ্যমান।

মেলাগুলোতে যে সকল পণ্য ও শিল্প-সম্ভার পাওয়া যেত তার অধিকাংশই রংপুরজাত। যেমন- চারুকারু শিল্প: এ জনপদে গড়ে উঠেছিল বেশ কিছু কুটির শিল্প। লোকায়ত শিল্পদ্রব্যগুলোর মধ্যে ছিল রেশম, তাঁত, সতরঞ্জি, পাট, মৃৎশিল্প, কাঁসা, পিতল ইত্যাদি। এছাড়াও কর্মকার, স্বর্ণকার, বয়নকার, দর্জ্জি ইত্যাদি পেশার মানুষ সুন্দর সুন্দর জিনিস তৈরি করত। বাঁশ-বেত: রংপুর অঞ্চলের বাঁশ ও বেতজাতদ্রব্য স্থানীয় চাহিদা পূরণ করেও অন্যত্র রপ্তানী করা হতো একটা সময়। বাঁশ-বেত ও কাঠজাত দ্রব্য তথা- ফুলদানী, কলমদানী, ছাইদানী বাঁশের ডাড়কী, বানা, খলই, জনগা, পলো, ভোরং, ডারকি, হেংগা, কবুতরের বাসা, ঘোরপা, ডালি, কুলা, চাটাই, চালুন, খাচা, চাঙ্গারী, টোপা প্রভৃতি ব্যবহারের অপরিহার্য সামগ্রী প্রচলিত বাজার ছাড়াও মেলায় পাওয়া যেত। তাঁত: এটি বেশ প্রাচীন শিল্প। অতি প্রাচীনকাল হতেই রংপুরে তাঁত শিল্পের কার্যক্রম ছিল। তাঁতীদের উপর এ অঞ্চলের মানুষ তাদের পোশাকের জন্য নির্ভরশীল ছিল। মাহিগঞ্জ, বদরগঞ্জ, কালিগঞ্জ, গোবিন্দগঞ্জ, সৈয়দপুরে এ শিল্পে বেশ সক্রিয় ছিল। সৈয়দপুরের শিল্প আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমাদৃতও ছিল। বর্তমানে রৌমারীর তাঁত শিল্প আন্তর্জাতিক প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। এ পণ্যগুলো আমাদের মেলায় পণ্য তালিকায় দেখা যায়। শতরঞ্জি: অতীতের মতো এখনও শতরঞ্জি তৈরি হয় এবং বিদেশে রপ্তানী হয়। নিসবেতগঞ্জ এবং রংপুর জেলখানায় আগে থেকেই এ শিল্প ছিল। পাট: রংপুরে পাট দিয়ে যেমন থলে, বস্তা, কার্পেট তৈরি হয় তেমনি গ্রামীণ মেয়েরা পাট দিয়ে সুন্দর সুন্দর শিকা তৈরি করে। রেশম: রংপুরের রেশম শিল্পের বিপুল খ্যাতি ছিল। ইতিহাসে দেখা যায় ১৭৩৩ খ্রিস্টাব্দে রংপুর হতে ইউরোপে রেশম রপ্তানি হয়েছিল। মৃৎ শিল্প: মাটির হাঁড়ি-পাতিল, খোরা, মটকা, কলসী, সানকী, বদনা, ঘটি ইত্যাদি ছিল রংপুরের গ্রামীণ জীবনে প্রাত্যহিক ব্যবহার্য দ্রব্য। মাটির পাট দিয়ে কুয়া নির্মাণ ও টালি দিয়ে ঘর নির্মাণ করা হয় এখনও। বিভিন্ন উৎসব ও মেলায় মাটির তৈরি পুতুল, নৌকা, হাতি, ঘোড়া ইত্যাদি পুতুল জনপ্রিয় ছিল। কাসা, পিতল ও লোহা: রংপুর অঞ্চলের কাসা, পিতল ও লোহার তৈজস ও অন্যান্য শিল্পজাত দ্রব্য জনপ্রিয় ছিল। কামার নির্মিত দা, কুড়াল, কোদাল, বাইশ, ছুরি, বটি, কাটারি, বর্শা, বল্লম, কাস্তে, শাবল, পাসুন প্রভৃতি মানুষের সাংসারিক কাজকর্মে এবং আত্মরক্ষায় বহুল ব্যবহৃত। নকশী কাঁথা: এক সময় রংপুরে নকশী কাঁথার বিপুল প্রচলন ছিল। গ্রামীণ সমাজে এ শিল্পের বিকাশ হলেও শহর জীবনে এগুলোর ব্যাপক ব্যবহার ছিল। কাঠ শিল্প: কাঠ শিল্পের নিদর্শন এ অঞ্চলের বাড়ি-ঘরের জানালা দরজায় সুন্দর সুন্দর চিত্রকর্মর দ্বারা প্রকাশিত। চৌকি, মাইপোষ, খাট, পালকী, টেবিল, চেয়ার, আলনা, সিন্ধুক, আলমারি ইত্যাদি তৈরিতে কারুশিল্পের নিদর্শন লক্ষনীয়। এ সকল দ্রব্য মেলায় সহজলভ্য। তামাক শিল্প: রংপুরের উৎপাদিত তামাক উন্নতমানের সিগারেট, চুরুট এর কাঁচামাল হিসেবে বিদেশে রপ্তানী হতো। হারাগাছ অঞ্চলে এই তামাক নিয়ে গড়ে উঠেছে বিড়ি শিল্প। বিড়ি শিল্পের পাশাপাশি তামাকজাত দ্রব্য দিয়ে গুল ও জর্দা প্রস্তুত হয়। মেলায় তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় ছাড়াও ডাব্বা- হুকার প্রচুর বিক্রয ছিল একটা সময়। ঢেঁকি শিল্প:  রংপুরের গ্রামীণ জীবনে ব্যবহৃত ঢেঁকি- জাতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ। একটা সময় এই ঢেঁকিই ছিল গ্রামীণ মানুষের জীবিকার অন্যতম যন্ত্র। ঢেঁকিছাঁটা চালের কদর এখনও আছে। যদিও যান্ত্রিক সুবিধার যুগে ঢেঁকি শিল্প বিপন্ন। বস্ত্রাভ্যাস: এখানে স্থানীয় পুরুষরা আংগা (শার্ট বা জামা), নেংটি (লজ্জা নিরবারনের স্বল্প বসন), তহবন (তবন বা লুঙ্গি), গামছা, গেঞ্জি, ধুতি ,শীতের দিনে কাঁথা, গজি (চাঁদর) পরিধান করে। মেয়েরা খাড়ি (শাড়ি), ফোতা ছেওটা, ব্লাউজ ইত্যাদি পরিধান করে। ঐ সকল বস্ত্রের অনেকগুলিই স্থানীয়ভাবে প্রস্তুত ও বুনন হতো। যেগুলো মেলায় পশরা ধরে উৎপাদনকারীরা বিক্রি করতো এবং এখনও তা বিভিন্ন হাট-বাজারে বিক্রি হয়। খাওয়া দ্রব্যাদি: মুড়ি, মলা (মোয়া), খই, জলপান (মুড়কি), গজা, খোরমা, কটকটি, গুলগুলিয়া, তেল পিঠা (তেলুয়া পিঠা), চিতই, গরগড়িয়া, চাউল ভাজা, চালের গুড়া, গমের গুড়া, ভাত, পান্তাভাত, কড়কড়া ভাত, পিঁয়াজ, মরিচ, ভর্তা, শাক, সুকতানি, মাছ, মাংস, ডাল, শুটকি, শেদল, প্যালকা, শোলকা, হালের রুটি, পুড়ি, পরাটা, মিষ্টি, মাখন, পাউরুটি, সিঙ্গারা, খাজা, লবঙ্গ, বালুসাই, নিমকি, জিলাপি, গজা ইত্যাদি খাবার রংপুর অঞ্চলের সংস্কৃতির সঙ্গে আজও টিকে আছে এবং সারা বছর জুড়েই এ গুলো আমাদের জীবনের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। তবে অধিকাংশ পিঠা ও মিষ্টি জাতীয় সকল খাদ্যদ্রব্যই মেলার মূল পশরার অন্যতম।

লেখক: পাবলিক প্রসিকিউটর, কুড়িগ্রাম এবং সদস্য, সুপ্রিম কোর্ট বার ও কলাম লেখক।

উপরে ফিরে যান