যতীন সরকার
পারিপার্শ্বিক বস্তু বা সংঘটনের উৎপত্তি, বিকাশ ও ক্রমবিলয়ের কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয়ের ব্যাপারে মানুষ যে সাফল্য অর্জন করেছে ইতিহাসে তা নিতান্ত অর্বাচীনকালের ব্যাপার। এর বহু পূর্ব থেকেই মানুষ তার কল্পনার আয়ুধ প্রয়োগে যতœপর ও সিদ্ধকাম থেকেছে। ভাবানুগামিতা ও বিস্ময়মুগ্ধতাই তার এই যত্ন ও সিদ্ধির চালিকাশক্তি।
মানুষের মুখের ভাষা বিষয়ে এই বিস্ময়মুগ্ধতা থেকেই প্রাচীন ইহুদি শাস্ত্রকারের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল ‘আদিতে বাক্য ছিলেন ও বাক্য ঈশ্বর হইলেন’, ভারতীয় আর্য ঋষির সিদ্ধান্ত; পুরুষস্য বাক্রস : (ভাষা বা বাকই মানুষের সার-ছান্দোগ্য উপনিষদ); অনুরূপ সিদ্ধান্তের প্রেরণা-জাত কল্পনারই সৃষ্টি ঋগে¦দের বাগদেবতা, সেই বাগদেবতার স্পর্ধিত আত্ম-ঘোষণা :
‘আমি রাজ্ঞী। আমার উপাসকদের আমি ধনসমূহ দিয়ে থাকি। পূজনীয়াদের মধ্যে আমি প্রথমা। দেবতারা আমাকে বহুস্থানে প্রবেশ করতে দিয়েছেন। প্রত্যেক মানুষ; যার দৃষ্টি আছে, প্রাণ আছে, শ্রুতি আছে, আমার কাছ থেকেই সে অন্ন গ্রহণ করে। যারা আমাকে জানে না তারা ক্ষীণ হয়ে যায়। আমি স্বয়ং যা বলে থাকি তা দেবতা এবং মানুষদের দ্বারা সেবিত। আমি যাকে কামনা করি তাকে বলবান করি, সৃষ্টিকর্তা করি, ঋষি করি, প্রজ্ঞাবান করি।’
বিস্ময়-মুগ্ধ ভাবোদ্বেল বাক-বিভূতির মাধ্যমে প্রাক-আধুনিক যুগের বিভিন্ন দেশে মনীষীরা যে উপলব্ধির প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন, সেই উদ্বেলতার ফেনপুঞ্জ অপসারিত করে নিয়ে তার যে নির্যাসটুকু অবশিষ্ট থাকে, আধুনিককালের বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তেও তা মোটামুটি অপরিবর্তিত রূপেই সমর্থিত হয়। মানুষ এবং পশুর পার্থক্য নির্ণয়ে, আধুনিক বিজ্ঞানের কাছে ভাষা একটি মুখ্য ও অপরিহার্য উপাদানরূপে চিিহ্নত। সে চিহ্নের স্বরূপ-নির্ধারণে বিজ্ঞানের যে শাখা নিয়োজিত, সেটিকেই বলে ভাষাবিজ্ঞান। কিন্তু কোনো বিজ্ঞানই কোনো বিশেষ শাখা-বন্দী নয়, কিংবা অন্য নিরপেক্ষ স্ব-বিকশিত বৃন্তহীন পুষ্পও নয়। ভাষাবিজ্ঞানও বিভিন্ন বিজ্ঞানের শাখায় শাখায় বিচরণশীল হয়েই তার বিকাশের উপাদান আহরণ করে থাকে। ভাষার প্রকাশ মানুষের মুখে, কিন্তু তার সৃষ্টির উৎস মানুষের মন। মনের অলিতে গলিতে ভ্রমণশীল মনোবিজ্ঞানের দ্বারস্থ হতে ভাষাবিজ্ঞান তাই বাধ্য। আবার মানুষের মন তো মানুষের সমাজের কারখানায়ই নানা আকার-প্রকারে গঠিত, বিতর্কিত বিকশিত ও পরিণত। গঠন, বিবর্তন, বিকাশ ও পরিণতিতে সমাজ আর মন যেমন পরস্পর সাপেক্ষ, ভাষার পক্ষেও সে সাপেক্ষতা একান্ত অনিবার্য এবং ভাষাবিজ্ঞানের সুষ্ঠতা অর্থাৎ বৈজ্ঞানিকতার জন্য সমাজবিজ্ঞানের সহায়তা গ্রহণ নিতান্তই অপরিহার্য। তাই ভাষার স্বরূপ সন্ধানে মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান ও ভাষাবিজ্ঞান এই ত্রয়ীর ঐকত্রিক উপস্থিতি, পারস্পরিক পরামর্শ ও সহযোগিতার আবশ্যকতা স্বীকার না করে পারা যায় না।
এই ত্রয়ীর সহযোগের অপরিহার্যতা স্বীকৃত হয় ভাষার উৎপত্তি প্রসঙ্গে ভাষাবিজ্ঞানী নোয়েরের বক্তব্যে-
‘সামাজিক লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য বংশ বৃদ্ধদের প্রাচীন শ্রম এবং সামাজিক প্রযতœ থেকেই মানুষের ভাষা ও চিন্তার সূত্রপাত।’
নোয়েরের কথায় স্পষ্ট উপলব্ধি হয় যে; শ্রম, চিন্তা ও ভাষা একই মালিকায় সূত্রবদ্ধ তিনটি পদ্মরাগমণি। এর যে কোনো একটির অভাব ঘটলে বা অপসারণ করলে সে মালিকা আর গাঁথা হয়ে ওঠে না।
দুই.
শ্রম, চিন্তা ও ভাষার সম্পর্ক সূত্রটিকে স্পষ্টরূপে অনুধাবন করতে হলে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ তথা মার্কসীয় দর্শনের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া উপায়ান্তর নেই। সন্দেহ নেই, ডারউইনের বিবর্তনবাদ মানুষের উৎপত্তি সম্পর্কে সকল প্রকার ভাববাদী ধারণার উচ্ছেদ ঘটিয়েছে। মার্কস ও এঙ্গেলস ডারউইনের মতবাদের প্রতি দৃঢ় সমর্থন জ্ঞাপন করেছেন। শুধু তাই নয়। এঙ্গেলস তাঁর ‘বানর থেকে মানুষের বিবর্তনে শ্রমের ভূমিকা’ শীর্ষক রচনাটিতে ডারউইনবাদকে সমৃদ্ধতরও করে তুলেছেন এবং এঙ্গেলসের এই রচনাটিতেই মানববিকাশের ধারায় ‘ভাষার’র উৎপত্তি বিষয়েও স্পষ্ট ও সুষ্ঠু বৈজ্ঞানিক ধারণার প্রাঞ্জল অভিব্যক্তি ঘটেছে।
যেমন- এঙ্গেলস দেখিয়েছেন যে, বৃক্ষশাখা থেকে সমতল ভূমিতে অবতীর্ণ ‘মানুষ এমন একটি পর্যায়ে এলো যখন পরস্পরকে কিছু বলার প্রয়োজন তাদের হলো। এই প্রেরণা তার নিজস্ব অঙ্গ সৃষ্টি করলো; স্বরের দোলনা দ্বারা ক্রমাগত উন্নততর স্বরগ্রাম সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বানরের অপরিণত কণ্ঠনালী ধীর অথচ স্থির গতিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। ক্রমে ক্রমে মুখের প্রত্যঙ্গগুলো একটার পর একটা স্পষ্টধ্বনি উচ্চারণ করতে শিখল’। এবং এমনি করে ‘শ্রম থেকে এবং শ্রমের সঙ্গে সঙ্গেই যে ভাষার উৎপত্তি’ এঙ্গেলসের নিবন্ধে বৈজ্ঞানিক যথার্থতা সহকারে সে সত্যই উদ্ঘাটিত। সে সত্যের অনুসিদ্ধান্তরূপে এ সত্যই প্রোজ্জ্বল যে : ভাষা শুধু মানুসের অলস মনোভাবের প্রকাশ মাধ্যমই নয়; হাতিয়ারধারী মানুষের সমষ্টিগত শ্রমের ফলে উৎপন্ন যে ভাষা; সে ভাষার প্রবর্তনাতেই তার হাত ও মাথা (শ্রম শক্তি ও চিন্তা শক্তি) পরিচালিত, জীবনযুদ্ধে সে বিজয়ীর সম্মানে ভূষিত, তারই দাক্ষিণ্যে মানুষ আজ এ গ্রহের অধীশ্বর, জলে-স্থলে ব্যোমে প্রসারিত তার রাজ্যপাট। সমাজ থেকে উৎপন্ন ভাষাই সমাজের পুষ্টি, পরিবর্তন ও বিকাশে মুখ্য সহায়িকা শক্তি।
এঙ্গেলসের বক্তব্যের ব্যাখ্যা করেই জোসেফ স্তালিন বলেন-
‘মানুষ পশুস্তর থেকে সামাজিক ব্যক্তির স্তরে উঠেছে মেহনতের সাহায্যে। মেহনত তার মনকে করেছে সমৃদ্ধ, তার ভাষা ও সংস্কৃতিকে করেছে বিকশিত। মেহনতের মধ্যে জরুরি হয়ে ওঠে সাহচার্য। মেহনতের প্রক্রিয়ার মধ্য থেকে পরস্পর সাহচর্যের মাধ্যম বিকাশ লাভ করে সে মাধ্যম ভাষা। এই ভাষা সমাজ ও মানবীয় চিন্তার বিপ্লবে বিরাট ভূমিকা গ্রহণ করেছে। ভাব বিনিময় ছাড়া পরস্পর সাহচর্য ছাড়া জীবিকা উৎপাদন অসম্ভব, সমাজের অস্তিত্ব অসম্ভব। আবার সমাজ থেকে আলাদা হয়ে ভাষা টিকতে পারে না। সুতরাং ভাষা ও তার বৃদ্ধি সমৃদ্ধির কানুন বোধগম্য হতে পারে সমাজের এবং জনতার ইতিহাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত করে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। সমাজ ও জনতা ভাষার অধিকারী। সমাজ ও জনতা আবার ভাষার সৃষ্টি ও আধার।’
হাতের সাহায্যে হাতিয়ার ধরে সমষ্টিগত শ্রম দিয়েই মানুষের সমাজের সৃষ্টি। কিন্তু হাত স্বয়ংক্রিয় বা স্বয়ংশাসিত নয়। তার নিয়ন্ত্রণ, শাসন ও চালনায় আছে মাথা। অর্থাৎ চিন্তাশক্তির নির্দেশনায় শ্রমশক্তি পরিচালিত। ভাষা এই চিন্তাশক্তি ও শ্রমশক্তির যৌথ প্রয়োজনার সৃষ্টি ও স্রষ্টা দুই-ই। তাই ভাষার বৈজ্ঞানিক উপলব্ধির জন্য শ্রমশক্তি তথা সমাজ-শক্তির নিয়ম প্রণালীর অনুধাবনার মতোই চিন্তা শক্তি তথা মনোজগতের প্রকৃতি ও স্বরূপ সন্ধানও সমান জরুরি। অর্থাৎ এখানেই সুস্পষ্ট ও সুতীব্র হয়ে ওঠে ভাষা বিজ্ঞানের জন্য সমাজবিজ্ঞানের সঙ্গে মনোবিজ্ঞানের মেলবন্ধনের অপরিহার্য আবশ্যকতা। (এবং সে সঙ্গে কিছুটা শরীর-বিজ্ঞানেরও। মনের আধার শরীর, অন্তত ভাষার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট স্বরযন্ত্র ও স্নায়ুতন্ত্র ভাষাবিচারের একান্ত আবশ্যিক উপাত্ত।)
সমাজবিজ্ঞানে যেমন ভাষার সঙ্গে হাতের সম্পর্ক উদ্ঘাটিত, মস্তিষ্কের সঙ্গে ভাষার সম্পর্ক নির্ণয়ও তেমনই মনোবিজ্ঞানের অবদান। কুল্পে, স্টাউট, বিনে প্রমুখ মনোবিজ্ঞানী ‘ভাষা-প্রতিরূপবিহীন চিন্তন সম্ভব বলে যদিও একটা কূটতর্কের অবতারণা করেন। আধুনিক শরীর বিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের জনক পাভলভের পরীক্ষণ ও গবেষণায় সে কূটতর্কের গ্রন্থি ছিন্ন হয়ে গেছে। ভাববাদী দর্শন ও যুক্তিবিদ্যার কুয়াশাজাল ফুৎকারে অপসৃত হয়ে সেখানে এ সত্যই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে যে, চিন্তা আসলে অনুচ্চারিত ভাষারই নামান্তর। অর্থাৎ ভাষা ছাড়া চিন্তা অসম্ভব।
এ সত্যের প্রমাণ ও দৃষ্টান্ত সামান্য একটু আত্ম-সমীক্ষাতেই আমরা পেতে পারি। আমাদের যেকোনো চিন্তা নিয়েই চিন্তা করলে দেখা যাবে ভাষা তার সঙ্গে অনপনেয় সূত্রে গ্রথিত। যেমন- আগামীকাল আমি লিখব, গতকাল আমি সিনেমায় গিয়েছিলাম, আজ আমি বই পড়ছি- ভবিষ্যৎ অতীত বা বর্তমান নিয়ে আমার সব চিন্তাই কতকগুলো কথার মাধ্যমে অভিব্যক্ত হয়। অভিব্যক্তির সেই কথাগুলো বাদ দিয়ে মনে মনেও এসব বিষয়ের ধারণা বা চিন্তা করা একেবারেই অচিন্তনীয়, অর্থাৎ অসম্ভব। চিন্তা করার অর্থ কতকগুলো কথা মনে মনে বিন্যস্ত করা; সে কথাগুলো অপসৃত হলে চেতনার ভা-ারে অবশিষ্ট থাকে না কিছুই তা তখন ‘শূন্য আকাশের মতো একান্ত নির্মল।’
শিশুদের কথা বলা লক্ষ্য করলে দেখা যায়, তারা আপন মনে কথা বলে। ‘আপন মনে কথা বলা’ মানে উচ্চ স্বরে, উচ্চারণ করে করে চিন্তা করা। বয়স্ক লোকের চিন্তা অনুচ্চারিত ভাষা হলেও শিশুর চিন্তা উচ্চারিত। বহির্বাস্তব থেকে প্রাপ্ত বস্তু বা বিষয়ের ধারণা শিশুর কাছে ভাষা-প্রতিরূপের সাহায্যেই আত্মস্থ, তার চিন্তা আর ভাষা একই সঙ্গে অধিগত। এ দু’য়ের পরস্পর সাপেক্ষতাই এর মূলীভূত হেতু।
এরূপ বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও দৃষ্টান্ত সহযোগে এ কথা প্রমাণিত হয়েছে যে, কথা বলা বা ভাষা ব্যবহার মানেই স্বরযন্ত্রের সাহায্যে মনের অনুচ্চারিত ধারণা বা চিন্তার উচ্চারণ তাকে অপরের শ্রুতিগ্রাহ্যকরণ। যেসব প্রাণীর স্বরযন্ত্রের সে ক্ষমতা নেই, ভাষা ব্যবহারেও তারা অক্ষম। তবে সে অক্ষমতার দায়ভাগ শুধু এক স্বরযন্ত্রেরই নয়, এর মুখ্য দায়িত্ব মস্তিষ্কের। বন মানুষের স্বরযন্ত্র ভাষা ব্যবহারের উপযুক্ত, কিন্তু মস্তিষ্ক অপরিণত; কোনো ধারণার বাহন হওয়ার অনুপযুক্ত। তাই বনমানুষ ভাষা সম্পদ থেকে বঞ্চিত আর সুগঠিত স্বরযন্ত্র ও সু-উন্নত মস্তিষ্কের অধিকারী মানুষ সে সম্পদে সম্পন্ন।
এ সঙ্গে আবার হাতের কথাটিও বিবেচ্য। স্নায়ুতন্ত্রের যে কেন্দ্রগুলোর প্রণোদনায় (উৎরাব) মানুষের হাত সক্রিয় আর যেগুলোর সাহায্যে ভাষা উচ্চার্য, তাদের অবস্থান একান্তই সন্নিকৃষ্ট। এতো সন্নিকৃষ্ট যে, দু’কেন্দ্রের কাজ সন্নিবিষ্ট হয়ে অনেক সময়ই হয়ে যায় জড়িত, মিশ্রিত এবং কখনো কখনো তা পরস্পরের সীমানা উল্লঙ্খনও করে ফেলে। এর ইংরেজি নাম ঝঢ়ৎবধফ। শিশুদের কথা বলার সময়কার অঙ্গভঙ্গী, হাতের লিখা অভ্যাসের সময় ওষ্ঠ সঞ্চালন, বয়স্কদেরও বক্তৃতা দেওয়ার সময় হাত ও মুখের নানা মুদ্রা প্রদর্শন- এসবই এর দৃষ্টান্ত। আদিম মানুষের বেলায়ই এ বিষয়টি সুস্পষ্টরূপে দৃষ্টিগ্রাহ্য। সভ্য মানুষের কথা বলার সময়ে হস্ত সঞ্চালন বা অঙ্গভঙ্গির ভূমিকা গৌণ কিন্তু আদিম মানুষের মুখের ভাষার মুখ্যত অঙ্গভঙ্গির উপরই নির্ভরশীল। গ্রে, স্মাইথ, রট্রে প্রমুখ বিজ্ঞানীর বরাত দিয়ে অধ্যাপক জর্জ টম্পসন এ কথাই প্রমাণ করেছেন। এসব সাক্ষ্যের ভিত্তিতে সমাজ মনোবিদ বুশের যা বলেন ত এঙ্গেলসের সিদ্ধান্তেরই সম্প্রসারিত রূপ।
ডক্টর বুশের- এর সিদ্ধান্ত :
‘হাতিয়ার ব্যবহারের দরুণ পেশিগুলিতে যে জোর পড়ে তারই প্রতিবর্তী ক্রিয়া (জবভষবী ধপঃরড়হ) হিসেবে স্বরযন্ত্রের প্রতিক্রিয়াটি থেকেই মানুষের গলায় ভাষা ফুটে উঠেছিল। তারপর হাতের কাজের যতো উন্নতি হয়েছে ততোই উন্নত হয়েছে স্বরযন্ত্র এবং শেষ পর্যন্ত মানুষের চেতনাও উন্নত হতে হতে একটা পর্যায়ে পৌঁছে দেখা গেলো এই প্রতিবর্তী ক্রিয়াটিকেই তারা সচেতনভাবে ভাবের আদান-প্রদান কাজে নিযুক্ত করতে পারছে।’
তিন.
প্রগতিশীল সমাজ-মনোবিদদের অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে মানুষের চেতনার বিকাশে ভাষার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার পরিচয় উদঘাটিত হয়েছে এবং ভাষা ছাড়া যে চেতনার ধারণ, বাহন ও অবস্থিতি অসম্ভব, সে সত্যও প্রমাণিত হয়েছে। তবে সে সঙ্গে একথাও অবশ্যই স্মর্তব্য যে ভাষা আর চিন্তা অভিন্ন নয়।
মানব বিকাশের এক সুউচ্চ পর্যায়ে ভাষার উদ্ভব, উদ্ভবের পর থেকে তার নিজেরই একটি আপেক্ষিক স্বতন্ত্র সত্তাও উদ্ভূত। সে সত্তা এমন কতকগুলো বিশেষ নিয়ম প্রণালির অধীন, চিন্তার নিয়ম থেকে যার স্বাতন্ত্র্য স্পষ্ট। সে স্বাতন্ত্র্যের ভিত্তিতেই ভাষাবিজ্ঞানের আবির্ভাব। তাই ভাষাবিজ্ঞানের নিয়মের অনুসরণ না করে এবং এর সহযোগী শাখাসমূহের অকৃপণ সহায়তা গ্রহণ না করে যে ভাষা বিচারে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগ ঘটানো একেবারেই অসম্ভব- সে কথা আমাদের মেনে নিতে হবে।
কিন্তু এই মেনে নেয়ার বিষয়টি দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদীরাও সব সময় মনে রাখেন না। তার ফলেই ঘটে নানা বিপত্তি। সে বিপত্তির প্রধানটি হলো শ্রম থেকে ভাষার উৎপত্তি সূত্রটির সরলীকরণ ও যান্ত্রিকায়ন। সে রকম সরলীকরণ ও যান্ত্রিকায়নের দৃষ্টান্ত আমরা প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নেও দেখতে পেয়েছি। সোভিয়েত যেহেতু শ্রমিকশ্রেণির রাষ্ট্র, তাই এ রাষ্ট্রের ভাষাও হবে শ্রমিকশ্রেণির কমিউনিস্ট পার্টির অতি উৎসাহী সদস্যরা এমন একটি অনুজ্ঞাই প্রচার করলেন। সে প্রচারে তারা সমর্থন পেলেন সে দেশের একজন বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানীর। এই ভাষা বিজ্ঞানীটির নাম এন ওয়াই মার। পূর্বেকার ভাষা বিজ্ঞানের বদলে এমন এক অভিনব ভাষা বিজ্ঞান মার এবং তাঁর সহযোগীরা সৃষ্টি করতে চাইলেন যাকে মার্কসবাদ সম্মত বলা যায় না কোনো মতেই। এটিকে বিজ্ঞান বলেই মানা যায় না। মার্কস এঙ্গেলস তো ভাষাকে ‘চিন্তার প্রত্যক্ষ বাস্তবতা’ রূপেই দেখেছিলেন। ‘ভাব ভাষা থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকে না’- মার্কস স্পষ্ট ভাষায় এমন কথাও বলেছেন। অথচ মার্কসবাদের পতাকা হাতে নিয়েই ‘মার ভাষাকে চিন্তা থেকে বিযুক্ত বলে প্রচার করলেন। তাঁর মতে ‘মানুষের সাথে মানুষের ভাবসংযোগ ভাষা ছাড়াই সম্পন্ন হতে পারে।’
সুখের বিষয়, এই ভ্রান্তি বেশি দূর বিস্তৃত হতে পারেনি। তাঁর কয়েকটি রচনায় তিনি চিন্তার সঙ্গে ভাষার অনপনেয় সম্পর্কের বিষয়টি স্পষ্ট করে তুললেন। এও জানিয়ে দিলেন যে, সংস্কৃতির শ্রেণি চরিত্র থাকলেও ভাষার কোনো শ্রেণি চরিত্র নেই। অর্থাৎ কোনো বিশেষ ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর ধনী-দরিদ্র বা মালিক-শ্রমিক নির্বিশেষে সকল মানুষেরই ভাষা এক ও অভিন্ন। তাই শ্রমিক শ্রেণির রাষ্ট্রেও শ্রমিক শ্রেণির ভাষা বলে কোনো ভাষা থাকতে পারে না। স্তালিনের প্রণোদনায় শ্রেণিভাষা সম্পর্কীয় ভ্রান্তি অপনোদিত হলেও ভাষা-বিচারের অন্য অনেক ভ্রান্তি থেকে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদীদের অনেকেই এখনো মুক্ত হতে পারেননি।
লেখক: অধ্যাপক ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ।
10.02.2013
শ্রম, চিন্তা ও ভাষার সম্পর্ক
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment