তপন কুমার রুদ্র
কখনো কখনো মনে হয় অরুনোকো একটি কল্পিত প্রতিবাদের নাম। আবার তাকে নিয়ে একটু ভাবলে মনে হতে পারে যে অরুনোকো যথার্থই একটি বাস্তব অভিজ্ঞতার স্ফুরণ। আফ্রিকার একটি রাষ্ট্র সুরিনাম। সেখানেই অরুনোকোর জন্ম। তার দাদু ছিলেন সেখানকার এক উপজাতি সম্প্রদায়ের রাজা। ওরা ছিল নিগ্রো, আফ্রিকার ঘন অন্ধকারের মতোই ওরা কালো। তবে অরুনোকো কালো হলেও অতোটা ঘন কুচকুচে কাল ছিল না, ওর নাকটাও ছিল বেশ খাড়া, শরীরটাও ছিল বেশ পেটানো, সুগঠনে চমৎকার ও সুন্দর। যৌবনের আহ্বানে তারও মনে জেগেছিল গভীর প্রেম। ভালোবেসে ফেলেছিল ইমোইন্ডা নামের এক কৃষ্ণকলি নিগ্রো যুবতীকে। গোপনে ওদের বিয়েও সম্পাদন হয়েছিল রীতি-মোতাবেক। কিন্তু ওদের রাজা মানে অরুনোকোর দাদু তা মেনে নেবেন কেন? তিনি তো রাজা; তাই যা কিছু সুন্দর, যা কিছু মনোহর, যা কিছু লোভনীয়, তা-তো অন্য কারুর দখলে যেতে পারে না। তাই অনেক ক’জন স্ত্রী ও অনেক ক’জন সেবিকা থাকা সত্ত্বে বুড়ো রাজা ইমোইন্ডাকে জোর করে দখল করলো; তাকেও একজন সেবিকা বানাল। কিন্তু ইমোইন্ডা-অরুনোকো’র একে অপরের প্রতি ভালোবাসার বন্ধন এতই দৃঢ় ছিল যে তাদের সম্পর্কে কোন ভাটা পড়লো না। রাক্ষুসে স্বভাব অতিবৃদ্ধ রাজাকে ফাঁকি দিয়ে ইমোইন্ডা অরুনোকোর সাথে মাঝেমাঝেই দেখা করতো, অভিসারে লিপ্ত হতো। কিন্তু নিয়তির ফল কে খ-াবে? একদিন রাজার রক্ষীদের কাছে ওরা হাতেনাতে ধরা পরে গেল। মিলনরত অবস্থায় ওদেরকে ধরতে পেরে রক্ষীরা উল্লাসে ফেটে পরে এবং কামুক রাজাকে সবকিছু জানিয়ে দেয়। শারীরিকভাবে অথর্ব হলেও রাজা তার স্বভাব অনুযায়ী ক্রোধ ও অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করে। পরিশেষে শাস্তি স্বরূপ ইমোইন্ডাকে ক্রীতদাসী হিসেবে বিক্রি করে সুরিনামের এক গহীন বনে, আর তার নাতী অরুনোকোকেও কঠিন নির্যাতন করে এবং পরবর্তীতে ক্রীতদাস বনিয়ে দাস ব্যবসায়ীদের হাতে ছেড়ে দেয়। ভাগ্যের কী পরিহাস! দেশান্তরী হয়ে নানা হাত ঘুরে অবশেষে অরুনোকো সুরিনামের সেই গহীন অরণ্যেই নির্বাসিত হয়, যেখানে ইতোমধ্যেই ইমোইন্ডা তার করুণ দাসী-জীবনের ঘৃণিত পেশা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। ঠিক যেন স্বর্গচ্যুত এডাম ও ইভ এর দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর আবার তারা একে অপরকে বহুকাল পরে খুঁজে পেল।
মিলন দৃশ্যটা কী অপূর্বই না হয়েছিল! বর্বর সামন্ত প্রথার সেই অতি অন্ধকার যুগে ক্রীতদাস ও ক্রীতদাসীরা কি অতো-সহজে মুক্তি পেতে পারতো? দুর্ভাগ্য সেখানেও তাদের ত্যাগ করেনি। সুরিনামের বর্ণিত সেই বনে যেসব শ্বেতাঙ্গ দাস মালিকরা তাদের নিয়ন্ত্রণ করত তারা তাদের আসল নাম বদলে দিয়ে নতুন নাম দিয়েছিল। অরুনোকোর নতুন নাম হল সিজার আর ইমোইন্ডার হল ক্লিমেন। অবশ্য আকস্মিকভাবে এই যুগের পুনর্মিলনের পর থেকে তাদের মধ্যে নিয়মিত সম্পর্ক ও যোগাযোগ অবাধেই গড়িয়ে যেতে থাকে। ইমোইন্ডা গর্ভবতীও হয়। কিন্তু যখনই অরুনোকো ইমোইন্ডার নিরাপদ প্রসব নিশ্চিত করার জন্য নিজ দেশে ফিরে যাবার অনুমতি প্রার্থনা করল তখনই গোল বাঁধল প্রচ- রকমে। অরুনোকোর আবেদন কোনোভাবেই ব্রিটিশ দাস মালিক ট্রেফরি ও ডেপুটি গভর্নর বিয়ামের মন গলাতে পারল না। এতে অরুনোকো যারপরনাই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং অন্যান্য ক্রীতদাসদের সঙ্গে নিয়ে এক লড়াকু ঐক্য গড়ে তোলে। তারপর শুরু হয়ে যায় মালিক গোষ্ঠীর মিলিটারি বাহিনী আর মুক্তি পাগল ক্রীতদাস বাহিনীর মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ। যুদ্ধে ক্রীতদাস বাহিনী পরাস্ত হতে বাধ্য হল। ইংরেজ ডেপুটি গভর্নর বিয়াম নিজেদের বিরাট স্বার্থে ক্রীতদাসদের ক্ষমা করার প্রতিশ্রুতি দিলেও শেষ পর্যন্ত অরুনোকোর ব্যক্তিত্বের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে তাকে ক্ষমা না করে তার সর্বাঙ্গে শত-শত চাবুকের ঘা বসিয়ে তাকে একেবারে রক্তাক্ত করে ছাড়ল। সেখানেই শেষ নয়। সর্বাঙ্গ রক্তাক্ত ও পুরোপুরি অচেতন করার পর তার অসংখ্য ক্ষত স্থানে বিষাক্ত মলম লেপন করে অসহ্য যন্ত্রণায় তাকে পাগল করে ফেলার নিষ্ঠুর কাজটি করল।
প্রতারিত, অপমানিত ও নির্যাতিত অরুনোকো বিয়ামের ওপর সর্বোচ্চ প্রতিশোধের জন্য পাগল হয়ে উঠল। সর্বাত্মক বিদ্রোহের আগুন তখন তাকে যুদ্ধের জন্য প্ররোচিত করতে লাগলো। সে জানতো এই যুদ্ধে তাকে প্রাণ উৎসর্গ করতে হতে পারে। কিন্তু তাঁর যদি মৃত্যু হয় তাহলে তার প্রিয়তমা স্ত্রী ইমোইন্ডার লাঞ্ছনা ও অপমানের কোন শেষ থাকবে না। তাই সে ইমোইন্ডার সাথে বিষয়টি গভীর আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নিলো যে পুনরায় সংঘর্ষের আগেই অরুনোকো নিজ হাতে ইমোইন্ডাকে হত্যা করবে এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ অরুনোকো সেই সিদ্ধান্তেরই বাস্তবায়ন করলো। সে এক মহাকাব্যিক উপায়ে প্রিয়তমা ইমোইন্ডার জীবনাবসান ঘটাল। ইমোইন্ডার লম্বা ঘন চুলের বেণী পেঁচিয়ে তার শ্বাস রোধ করল অরুনোকো।
নিজ প্রতিজ্ঞায় উজ্জীবিত হয়ে অরুনোকো তার অনুচরদের সঙ্গে নিয়ে ডিপুটি গভর্নর বিয়াম ও তার জল্লাদদের হত্যা করার চেষ্টায় পুরোপুরি সফল হতে পারলো না। সে আবার ধরা পরল। প্রথমে তাকে চাবুক মেরে রক্তাক্ত করা হল, তারপর নাক, কান, হাত ইত্যাদি সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে কেটে তাকে টুকরো টুকরো করে সর্দারদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া হল। তাতে কি অরুনোকোর বিদ্রোহের আগুন নিভে গেল?
উল্লেখিত খ-ের ভিত্তিতেই সপ্তদশ শতকের ব্রিটিশ লেখিকা আফরা বেন (অঢ়যৎধ ইবযহ) রচনা করেন তাঁর সাড়া জাগানো উপন্যাস অরুনোকো (ঙৎড়ড়হড়শড়)। স্বল্প দৈর্ঘ্যরে এই উপন্যাসটি লেখা হয়েছিল লেখিকার মাতৃভাষা ইংরেজিতেই। তবে এর জনপ্রিয়তার কারণে বিশ্বের বহু ভাষায় তা অনূদিত হয়। ১৬৮৮ সালে লেখিকা আফরা বেনের মৃত্যুর মাত্র এক বছর আগে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল।
যিশু খ্রিস্টের জন্মের পূর্বে রোমে সংগঠিত ইতিহাসখ্যাত প্রথম দাস-বিদ্রোহের সংগঠক ও কিংবদন্তি নেতা স্পার্টাকাস (ঝঢ়ধৎঃধপঁং) যেসব উল্লেখযোগ্য কারণে আজ অবধি বীরত্বের মহিমায় প্রাসঙ্গিক ও স্মরণীয়, লেখিকা আফরা বেন বর্ণীত যোদ্ধা অরুনোকোও মহান এক প্রতিবাদ বিদ্রোহ ও সংগ্রামের অম্লান প্রতীক বলে এখনও পূজনীয়। নানা বিশ্বস্ত সূত্রমতে আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে, অরুনোকোর জীবনী ও তার জীবনে প্রতারণা, নির্যাতন, দৃষ্টান্ততুল্য প্রেমকাহিনী, তার জীবনকালের সামন্তবাদের শোষণ-বর্বরতা নিছক কোনো কল্পিত গল্প নয়, এটি একটি সত্যিকার ইতিহাস। আদি যুগ তথা স্পার্টাকাস আমলের রোমান দাস ব্যবস্থায় যত নিষ্ঠুরতা-শোষণ-কুপ্রথা চালু ছিল; সপ্তদশ শতাব্দীর আফ্রিকা মহাদেশের নানা স্থানে তার ধারাবাহিকতা প্রবল দাপটেই দরিদ্র কালো নিগ্রোদের জীবন প্রবাহে জ্বালাময় বিষ ছড়িয়ে দিয়েছিল। এক্ষেত্রে ইয়োরোপীয় বণিকরা বিশেষত রোমান-ব্রিটিশ-আমেরিকান শোষকগোষ্ঠী কালো আফ্রিকানদেরকে নিছক পণ্য হিসেবে গণ্য করে তাদের উপর শোষণ-শাসন চাপিয়ে রাখতো। সেই সাথে তাদের চাপিয়ে দেয়া কুপ্রথা-কুপ্রবণতার ধারক হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটেছিলো কালো নিগ্রোদের সর্দার, গোত্রপতি, সামন্ত প্রভু, ছোট-ছোট রাজা-জমিদারদের চরিত্রেও। এভাবেই কুপ্রথা, শোষণমূলক প্রবণতা, নির্যাতনের কূটকৌশল ইত্যাদি বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত হয়ে থাকে। ইতিহাস-তো তাই বলে।
রোমান শ্বেতাঙ্গ স্পার্টাকাস যুগের কথা বলি কিংবা আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ অরুনোকো যুগের কথাই যদি বলি, ক্রীতদাসরা কখনোই মানুষ বলে গণ্য হয়নি। স্পার্টাকাস জন্মসূত্রে ক্রীতদাস হলেও অরুনোকো অবস্থার বিপাকে পরে পর্যায়ক্রমে ক্রীতদাসে পরিণত হয়েছিল। তবে অরুনোকোর জীবন পরিণতিই প্রমাণ করে, ক্রীতদাস শ্রেণি শোষক ও শাসক শ্রেণির নিষ্ঠুরতা আর কূটকৌশলের ফাঁদে পরে খেটে খাওয়া মানুষের অজ্ঞতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার প্রীতি ও বিভেদের বীজ ছিটিয়ে প্রকৃত অর্থেই মানুষকে মানুষের পণ্য বানিয়ে সেই প্রভুত্ব প্রথা সৃষ্টি করে তা বহাল রাখার নতুন নতুন কৌশল অনুসরণ করা হয়েছে যুগে যুগে। ভারত উপমহাদেশের শাসক শোষকরাই বা এতে কম কিসে।
ইতিহাস অবশ্যই তার পথে হেঁটেই চলেছে। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে আর যাচ্ছে। শোষণের হীনকৌশলও বসে থাকে না। বর্তমানের মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রবল আক্রমণে আজকের বাংলাদেশের শ্রমনির্ভর খেটে খাওয়া মানুষ কি ভোগের পণ্য হতে বাধ্য হচ্ছে না? একথা সত্য যে পুরাকালের দাস প্রথা পুরনো চরিত্রে আজ আর বহাল নেই। সামন্ত ভূস্বামী, রাজা-জমিদারদের অবস্থানও খুব সীমিত পরিসরে ধিকধিক করে মারা যেতে বসেছে। তবে সামন্ত যুগীয় ধর্মীয় অন্ধত্ব, ঠকনির্ভরশীলতা, ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণে অভ্যাস প্রবণতা আর তার সাথে অর্থহীন অহংকারবোধ দারুণভাবে আজ অবধি সমাজকে দুর্বল করেই চলেছে। তবে যদি সরাসরি মানুষ মানুষকে পণ্য বানিয়ে ব্যবহার করার যে রীতি দাস প্রথার যুগে স্বীকৃত সংস্কৃতি ছিল, তা কিন্তু ভিন্ন রূপে ও ভিন্ন-ভিন্ন অবস্থানে মারাত্মকভাবেই সৃষ্টি হচ্ছে এবং ছড়িয়ে পরছে। সম্রাট-রাজা-জমিদারদের জায়গায় মানবপ্রভুরা যেসব নামে শোষণ, নির্যাতন ও ভোগবিলাস বহাল রেখেছে তারা হল শোষক রাজনৈতিক নেতা, ক্ষমতাশীন আমলা শ্রেণি, কালো টাকার মালিক, পুঁজিপতি, শিল্প-মালিক, শিল্প-উদ্যোক্তা, বিদেশিদের দালাল, এনজিও ব্যবসায়ী, মুনাফা ভিত্তিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিক, গোষ্ঠী ইত্যাদি।
বিশ্বব্যাপী শোষণকেন্দ্রিক অর্থনীতির জোয়ার বইছে। দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে ধনিক পরাশক্তির দেশগুলো যেভাবে অবাধ বাজার সৃষ্টি ও বাজার-নিয়ন্ত্রণ করতে লেগেছে তাতে করে ঘৃণ্য দালালগোষ্ঠীর-তো পোয়া বারো। মানবতা কি এভাবেই অপমানিত হবে? কর্মীশ্রেণির শ্রম ও সম্ভ্রম কি এভাবেই লুণ্ঠন হতে থাকবে? বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রজন্মরা সবাই কি নতজানু হয়ে থাকবে? গণতন্ত্রের নামে গণমানুষেরা কি শোষকচক্রের ভৃত্য হয়ে বাঁচবে? না, তা কিন্তু হবে না।
অরুনোকো অতৃপ্ত অবস্থায় মরে যেতে বাধ্য হলেও বিদ্রোহের আগুনটা জ্বেলে রেখে গেছে। মুক্তি-পাগল এমন বিদ্রোহী-আগুনের অনেক নমুনা ইতিহাস ধরে রেখেছে, সমুন্নত রেখেছে। আজকের দিনে এরকম কোন আশাবাদ পোষণ না করা যথার্থ হবে না। মেহনতি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানবশ্রেণির জীবন-জীবিকা ও সংস্কৃতি রক্ষার স্বার্থে প্রণীত রাজনৈতিক মতবাদের আদর্শিক প্রয়োগ ও তাকে বিকশিত করার লক্ষ্যে নিবেদিত সংগঠন ও শক্তিগুলোকে এক কাতারে আসতে হবেই। মানবমুক্তি আদায়ের জন্য আনুষ্ঠানিক শপথ নেয়াটাই যথেষ্ট নয়, একটা চলমান প্রক্রিয়ায় এসব অমানবিক সামাজিক নীতি-নৈতিকতার বিরুদ্ধচারী হতেই হবে।
লেখক: অধ্যাপক ও প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি বিভাগ, সরকারি বেগম রোকেয়া কলেজ, রংপুর।
10.02.2013
অরুনোকোর সেই প্রতিবাদ
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment