10.02.2013

বিপন্ন কাকতাড়ুয়া এবং আমাদের অস্তিত্ব

এস এম চন্দন

বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের কিছু অতি পরিচিত বিষয় ছিল, যেগুলো এখন একেবারেই হারিয়ে যাওয়ার পথে। তার মধ্যে একটি হল কাকতাড়ুয়া। ফসলের ক্ষেতে পাখির আক্রমণ ঠেকাতে কৃষকরা এই অভিনব পদ্ধতির অনুসরণ করতেন। একটি হাঁড়িতে চোখ-মুখ এঁকে, বাঁশ বা কাঠ দিয়ে একটি কাঠামো তৈরি করে তাকে জামা-কাপড় পরিয়ে ভয়ংকর চেহারা দিয়ে ক্ষেতের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে রাখা হত। পাখি তো বটেই, রাতের বেলা কখনো কখনো মানুষও আঁতকে উঠত এই ভয়ালদর্শন নিরীহ পুতুলটি দেখে।

এই প্রাণহীন প্রাণীটি এখন বিস্মৃতিরও তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। যখন পেশার প্রয়োজনে অথবা কৃষক সমিতির কাজে গ্রামে গ্রামে ঘুরি, কখনো কোন ফসল ক্ষেতেই কাকতাড়ুয়ার কোন চিহ্ন দেখিনা। এর কারণ হল, এখন আর পাখিরা ক্ষেতে সেভাবে হামলা চালাতে আসেনা। কিন্তু তারই বা কারণ কী? পাখিরা কি সবাই ভদ্র হয়ে গেছে? নাকি তারা কৃষকবান্ধব পাখিতে পরিণত হয়েছে? আসল কারণ হল, বর্তমানে ফসলের ক্ষেতে এমন পরিমাণে মারাত্মক সব কীটনাশক ব্যবহার করা হয় যে, পাখিকুল নিজেরাই নিজেদের ওই বিষ থেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখে। অবলা, অবুঝ, অশিক্ষিত পাখিরাও নিজের ভালো বোঝে, বুঝিনা আশরাফুল মখলুকাতরা।

কীটনাশকের ব্যবহারটা নিছক কৃষক বা কৃষির উপকারের জন্য নয়। এর মূল কারণটা পুরোপুরি বাণিজ্যিক। বহুজাতিক এবং দেশিয় কৃষি উপকরণ বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসার স্বার্থেই কৃষকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে এসব নানা ধরনের নামের গুণের সব কীটনাশক। একটা সময়ে গোবর এবং খৈলই সবচেয়ে উপকারী সার হিসেবে বিবেচিত হলেও বর্তমানে রাসায়নিক সার ছাড়া চাষিরা অন্য কিছু ব্যবহার করতে চান না। আমি একবার পঞ্চগড়ের এক কৃষককে দেখেছিলাম যে, বাজারে সার না পেয়ে তিনি তাঁর ক্ষেতে গোবর ছিটিয়েছেন। প্রকৃতির লাঙ্গল কেঁচোদেরও এখন দেখা যায় কম। আবার হাইব্রিড জাতের বিভিন্ন বীজ আর সারা বছর বিরামহীনভাবে নানা ধরনের ফসলের আবাদে বিশ্রামহীন সেবা দিতে দিতে মাটিও হয়ে পড়েছে ক্লান্ত। এখন গ্রামের খুব কম বাড়িতেই হালের বলদ এবং গাভীর দেখা মেলে। পাওয়ার টিলার আর শ্যালো মেশিনের বিকট শব্দে ভার হয়ে থাকে গ্রামের পরিবেশ। ডিজেল আর বিদ্যুতের চড়া দামেও হন্যে হয়ে তার পেছনেই দৌঁড়াতে হয় চাষিদের। পেট্রোলিয়াম উৎপাদক, ট্রাক্টর-পাওয়ার টিলার প্রস্তুতকারী দেশগুলোর চলছে রমরমা বাণিজ্য। রাসায়নিক সার, কীটনাশক ইত্যাদির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় এগুলো তৈরি ও বিক্রির কোম্পানিগুলোরও হয়েছে পোয়াবারো। একদিকে চলছে একচেটিয়া ব্যবসা, আরেক দিকে সরকারি দলের ডিলারশিপের বাণিজ্য। ট্রাক্টর, শ্যালো মেশিন ইত্যাদি আমদানি করে বাজারজাত করার দায়িত্ব পান আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি এবং জামায়াতের নেতারাই। ১৯৯৫ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকারের আমলে সার সংকট সৃষ্টি করে সারের দাবিতে আন্দোলনরত ১৮ জন কৃষককে হত্যার ঘটনা এই নির্লজ্জ পুঁজিবাদী ধারণারই জ্বলন্ত সাক্ষ্য দেয়।

বেশ কয়েক বছর আগে হঠাৎ করে বাংলাদেশের ব্যাঙের খুব কদর বেড়ে গিয়েছিল পৃথিবীর কয়েকটি দেশে। বাংলার গ্রাম এলাকার ডোবা, পুকুর থেকে ব্যাঙ ধরে ধরে বিদেশে রপ্তানি করা হয়েছে বিপুল পরিমাণে। বাংলার কুনো ব্যাঙ, সোনা ব্যাঙের রোস্ট, ফ্রাই, কাবাব, বার্গার, স্যান্ডউইচ সে সময় উন্নত বিশ্বের লোভনীয় খাদ্যে পরিণত হল। তখন এটিকে বাংলাদেশের জন্য লাভজনক আখ্যা দিয়ে প্রচার করা হয়েছে যে, ব্যাঙ রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।

পরিণতিতে যেটা হল, সেটা হচ্ছে, ব্যাঙ কমে যাওয়ায় ক্ষতিকর পোকা-মাকড়ের সংখ্যা বেড়ে গেলো। সাধারণতঃ ফসলের ক্ষেতে ব্যাঙ বিভিন্ন ক্ষতিকর পোকা ধরে খেয়ে ফেলে, যা আদতে কৃষকের জন্য কাজে লাগে। এখন, যেহেতু ব্যাঙ নেই, তাই পোকা-মাকড় ঠেকানোর জন্য কীটনাশকের প্রয়োজন হয়ে পড়লো। এবারে সেই দেশগুলোই কীটনাশকের তত্ত্ব আমাদের দেশে রপ্তানি করল, যারা কয়েক দিন আগে আমাদের দেশের ব্যাঙ আমদানি করেছে। যত টাকা আমরা আয় করেছি ব্যাঙ বিক্রি করে, তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি টাকা প্রতি বছর ঢেলে যাচ্ছি পোকা মারার বিষ কিনতে। শুধু তাই নয়, এখন আমাদের সনাতন ধারার কৃষিও ধ্বংসের মুখে। সাম্রাজ্যবাদী সংস্থাগুলোর আবদার অনুযায়ী বিভিন্ন মডেলের চুক্তি হলে হাইব্রিড জাতের বীজ যেভাবে আমাদের বাজার সয়লাব করে ফেলবে, তাতে দেশি জাতের কোন বীজ আর নিজের অস্তিত্বই ধরে রাখতে পারবেনা। বাংলাদেশের কৃষক যে ধান, আলু, গম আবাদ করেন, তার একটি অংশ বিক্রি করেন, একটি অংশ পরিবারের খাওয়ার জন্য রাখেন, আর আরেকটি অংশ রেখে দেন পরের বছর বীজ হিসেবে আবাদ করার জন্য। ভবিষ্যতে নানা ধরনের এসব চুক্তি কার্যকর হলে আর এভাবে সনাতন প্রক্রিয়ায় বীজ সংরক্ষণ করা সম্ভব হবেনা। প্রতি বছর কৃষককে বীজ কিনে আবাদ করতে হবে। এতে একদিকে যেমন শস্যেও বৈচিত্র্যময়তা সৃষ্টির পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে, তেমনিভাবে কৃষক প্রতি বছর নতুন বীজ কেনার ব্যয়বহুল চক্রপাকে পড়বেন। আর এভাবে একচেটিয়া ব্যবসা করে যাবে আন্তর্জাতিক ও দেশিয় কিছু প্রতিষ্ঠান। এর নামই সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, একচেটিয়া পুঁজি।

লেখার শুরুটা করেছিলাম কাকতাড়ুয়ার প্রসঙ্গ টেনে। কাকতাড়ুয়া বাংলার গ্রামীণ সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলেও সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদের থাবায় বিলীন হওয়ার পথে। এর পাশাপাশি এখন আমাদের জীবন-সংস্কৃতি-মনন-চেতনার সবকিছুই এই লুটেরা গোষ্ঠীর কবলে পড়ে ধীরে ধীরে নিজ চেহারা হারিয়ে নতুন একটি উদ্ভট চেহারা নিচ্ছে। বৈশাখী উৎসবকে আমরা আমাদের প্রাণের উৎসব বলে দাবি করি, তাহলে প্রশ্নটা স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসে যে, সেই প্রাণের উৎসব করতে বিদেশি মোবাইল ফোন অপারেটর প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সহায়তার প্রয়োজন হয় কেন? প্রাণের উৎসব কি প্রাণের উচ্ছ্বাস দিয়েই পালন করা উচিত না? আমাদের শৈক্ষিক-শৈল্পিক-বৌদ্ধিক চেতনার স্তর কি নির্জীব হয়ে পড়ছে? এখন কোন কোন অনুষ্ঠানে দেখি, ‘আসুন, আমরা মজা করি’ বলে ঘোষণা দেয়ার পর সকলে মজা (?) করতে শুরু করেন। মজাটাও এখন ঘোষণানির্ভর। আমি আদিবাসীদের গ্রামে গিয়ে বিস্মিত হয়ে দেখেছি, আদিবাসী ছেলেমেয়েরা তাদের ভাষায় তাদের সমস্যা নিয়ে গান লিখে ঢাকার জনপ্রিয় কোন ব্যান্ডের গানের সুরে সেই গান সাজাচ্ছে। আদিবাসী গানের চিরাচরিত সুরের ধারাটি সেখানে একেবারেই অনুপস্থিত। নবান্ন উৎসব কিংবা বসন্ত বা বর্ষবরণের উৎসব-আয়োজন-আনন্দ এখন নগর জীবনে প্রসারিত হয়েছে, যা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। কিন্তু মুশকিল হল, এই আয়োজনটা নগরকেন্দ্রিক জীবনে একটু সময় কাটানোর দিকে ধাবিত হয় মাঝে মাঝেই। যারা এর আয়োজন করছেন, যারা সাড়া দিচ্ছেন- তাঁরা আন্তরিকভাবেই করছেন, কিন্তু সর্বগ্রাসী সুবিধাবাদ আমাদের সমগ্র জীবন আর চেতনাকে এমনভাবে ঘিরে রেখেছে যে, এখন আমাদের কাছে সবটাই সময় কাটানো, অথবা হাল-ফ্যাশনে পরিণত হচ্ছে। নবান্ন উৎসবের আয়োজনে গান-নাটক-নাচ-কবিতা থাকছে, কিন্তু কৃষক ধানের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে যে ধীরে ধীরে মেরুদ- হারাচ্ছেন, সে প্রসঙ্গে এ উৎসব নীরব থাকছে। এখন পান্তা খাওয়া হয় ইলিশ ভাজার সাথে, যে ইলিশ মাছের দাম বৈশাখ উপলক্ষে হয় কয়েক হাজার টাকা। গার্মেন্টস শ্রমিকের ফ্রাই হওয়া লাশের পাশে দাঁড়িয়ে ১২ হাজার টাকার ইলিশ ফ্রাই করে খাওয়া শুধু অমানবিকই নয়, ধৃষ্টতাও বটে। বাংলা বর্ষবরণকে ঘিরে ইলিশ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের ব্যবসাও জমজমাট, বঞ্চিত শুধু পদ্মা নদীর মাঝি। এই মাছ ধরে আনতে গিয়ে কয়েক মাস আগে বঙ্গোপসাগরে যে ২০ জনের বেশি জেলে নৃশংস হত্যাকা-ের শিকার হলেন, তার খবর কে রাখে বৈশাখের উচ্ছ্বাসে? চাইনিজ রেস্তোরাঁর আলো-আঁধারিময় রোমান্টিক পরিবেশে চিংড়ি মাছ খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে প্রেমিক-প্রেমিকার আবেগ-ভালোবাসার মাঝে হতভাগ্য ওই জেলে পরিবারের অভুক্ত সন্তানদের কথা হয়তো আসেনা একবারও। কেউ জানেওনা, ভাবেওনা যে এই চিংড়ি আসে দক্ষিণের যে ঘের থেকে, সেই ঘেরে কত কৃষকের চোখের পানি আর বুকের রক্ত মিশে আছে।

গ্রামের গরিব মানুষগুলো পান্তা খেতেন কী কারণে? কারণ বারবার রান্না করার মত জ্বালানী তাদের থাকতো না। সকালে ভাতের সাথে ঘি, ডিম ভাজা খাওয়ার সাধ্য তাদের হতোনা। তাই মরিচ-পেঁয়াজ দিয়ে মাখিয়ে পান্তা ভাত খেয়ে কাজে বের হওয়াই ছিল তাঁদের কাছে অনেক সহজ ব্যাপার। এখন এই পান্তা বছরের একটা দিনে ঘটা করে ইলিশ মাছ সহযোগে খাওয়াটা গরিব মানুষের প্রতি এক ধরনের উপহাসও বটে। আমাদের দেশে ফাস্ট ফুড নামক একটি উৎপাত এসে জুটেছে, পৃথিবীর নানান দেশের খাবার বিক্রির দোকান হয়েছে, হরেক কিসিমের মিষ্টি, শরবত, স্যুপ ইত্যাদি সবই বিক্রি করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, কিন্তু আজ পর্যন্ত রাজধানী বা দেশের কোথাও ৩ বেলা পান্তা পাওয়া যায়- এমন কোন দোকান আমার চোখে পড়েনি। কখনো কি কোন দাওয়াতে গিয়ে দেখেছেন যে সেখানে অতিথিদের আপ্যায়ন করা হচ্ছে পান্তা ভাত, পেঁয়াজ আর কাঁচা মরিচ দিয়ে? সেই অচ্ছুৎ-অপাংক্তেয় পান্তা ভাত বছরের ওই একটা দিনেই এতই খাতির পায় যে পাজেরো-প্রাডো গাড়িতে চড়েও কেউ কেউ বৈশাখী মেলায় আসেন এই পঁচা খাবারটি গলাধঃকরণ করতে। যে দেশে একটু ভাত আর একটু ভর্তার যোগান দিতে পরবাসী হয়ে পরবাসেই জীবন হারাতে হয়, সীমানার কাঁটাতারে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঝুলে থাকতে হয় ফেলানীদের, সে দেশে ইলিশ-পান্তার নব্য সংস্কৃতি একটি নির্মম রসিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়।

তার মানে কি আমরা পান্তা খাবো না? বৈশাখে নাচবো না, গাইবো না? বর্ষার প্রথম বৃষ্টিতে শরীর ভেজাবো না? নবান্নের উচ্ছ্বাসে মাতবো না? কুয়াশা ঝরা ভোরে খেজুর রস পান করবো না? বসন্তের পয়লা দিনে ধুতি, শাড়ি পারবো না? অবশ্যই পরবো, এবং অবশ্যই অবশ্যই পরবো। কারণ ওটাই আমার জীবন, আমার সংস্কৃতি, আমার চেতনা, আমার অস্তিত্ব। পয়লা বৈশাখে পান্তা খেতে দোষ নেই, কিন্তু শুধু একটা দিনেই কেন? হাজার টাকার ইলিশ দিয়ে কেন? বাংলার গ্রামীণ জনপদের নারীরা কত পদের ভর্তা তৈরি করতে পারেন, সে খবর আমরা রাখি কি? আলু, কচু, কাঁচা কলা, পটলের খোসা, বাদাম, টমেটো, মরিচ, পোড়া বেগুন, ধনিয়া পাতা, পেঁপে, ওলকপি- আরও কত ধরনের ভর্তা তাঁরা  তৈরি করেন। নবান্ন উৎসবের সময় দিনাজপুরে এক কৃষকের বাড়ি গেলে তিনি আমাদের আপ্যায়িত করেছিলেন নতুন ধানের মুড়ি, মুড়ির মোয়া, মুড়কি ইত্যাদি দিয়ে। ডাবের পানি এত, এত মিষ্টি, সেটার প্রতি আমাদের নজর নেই। ত্রিশ টাকা দিয়ে একটি ডাব কেনার চেয়ে ৬০ টাকা দিয়ে বোতলজাত কোমল পানীয় পান করার দিকে আমাদের আগ্রহ বেশি। ছোটবেলায় দেখতাম, দূরে কোথাও গেলে মা বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় বোতলে পানি ভরে নিতেন, এখন আমাদের কাছে এটি আলসেমি, কারণ ১৫ টাকা খরচ করলেই দোকান থেকে বোতলের পানি পাওয়া যায়, যে পানিতে মাঝে মাঝে শ্যাওলা পাওয়ার অভিযোগও ওঠে। আমরা আমাদের এই পুরনো ধারাগুলোকে অগ্রাহ্য করে নগরকেন্দ্রিক ও পুঁজিতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা শুরু করেছি। তাই এখন নববর্ষ উপলক্ষে তো বটেই, ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষেও ফ্যাশন শো আয়োজন করার মত ধৃষ্টতা দেখায় কোন কোন ফ্যাশন হাউজ। তবু রক্ষা যে, মৃত মানুষের কাফনের কাপড় বা কফিনের ডিজাইন নিয়ে এখনও ফ্যাশন শো বা বিজ্ঞাপন শুরু হয়নি।

কখনোই এটা বলি না যে, পুরনোকে আঁকড়ে ধরতে হবে কোন ভালো-মন্দের বাছ-বিচার না করেই। এখন মাত্র ১ টাকা দিলে মিনি প্যাক শ্যাম্পু পাওয়া যায়। গ্রামের নারীরা আর আগের মত খৈল বা এঁটেল মাটি দিয়ে চুল ঘষে পরিষ্কার করেন না। পুঁজিবাদ এখন অতি সস্তায় ভোগবাদীকে প্রসারিত করেছে গ্রামের কিংবা শহরের সবচেয়ে দরিদ্র মানুষটির পর্ণ কুটিরেও। ঢাকা বা অন্যান্য শহর-নগরের বস্তিতে ঘুরে দেখেছি, এক কক্ষের সংসারেও রঙিন টিভি এবং ফ্রিজ শোভা পাচ্ছে। এটি ইতিবাচকভাবেই নেওয়া উচিৎ। কিন্তু সমস্যাটা হবে তখনই, যখন ভোগবাদ মুখ্য হয়ে উঠবে, পণ্যের ব্যবহার নয়। প্রচ- গরমে রিক্সা চালিয়ে বাসায় ফেরার পর ১২ টাকা দিয়ে একটি জীবাণুনাশক সাবান কেনাটা একজন রিকশাচালকের জন্য কোনোভাবেই বিলাসিতা নয়, এটি তার প্রয়োজন- কিন্তু ৬৫ টাকা দামের বিদেশি সুগন্ধি সাবান কেনার চেষ্টা হবে তাঁর বিলাসিতা। পুঁজিবাদ এখন সে পথেই হাঁটছে দিনে দিনে। ‘যত কথা-তত লাভ’ কিংবা ‘একবার খেলে হয়না-বারবার খেতে হয়’ ধরনের প্রচারগুলো সেই অমিতব্যয়ী-অপব্যয়ী মানসিকতারই প্রচারক। বাসর রাতে মিথ্যা কথা বলে স্বামীর সাথে প্রতারণার মাধ্যমে জীবন শুরু করার শিক্ষাও দেয়া হচ্ছে কিছু বিজ্ঞাপনে। আমাদের দেশের মানুষের সুখময় দাম্পত্য জীবনের যে মডেলটি রয়েছে পশ্চিমা বিশ্বের খরাব ঃড়মবঃযবৎ  নামক চরম জঘন্য রীতির বিপরীতে, সেটিকেও নানান কায়দায় ভেঙ্গে দেয়ার কতই না কায়দা-কৌশল।

আবার কাকতাড়ুয়া দিয়েই শেষ করি। আমরা কাকতাড়ুয়াকে কৃষকের বন্ধু বলে ভাবতাম, ভাবি। তার মানে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি যেটা, সেটা সব সময়েই আমাদের জন্য ইতিবাচক। সেই ইতিবাচক সবকিছুকেই আঁকড়ে ধরতে হবে শক্ত করে। বাংলার সংস্কৃতি, জীবন, কৃষি, লোকজ ধারা- কোনোকিছু কোন পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ আর ধর্মীয় অন্ধত্ববাদনির্ভর অপশক্তির কাছে ছেড়ে দেব না আমরা, কিছুতেই না।

লেখক: কৃষক আন্দোলনের সংগঠক

No comments:

উপরে ফিরে যান