10.02.2013

বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল সমস্যা

নিবেদিতা রায়

বইপত্রের সংজ্ঞা মতে, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, স্থায়ী জনসমষ্টি, সরকার ও সার্বভৌমত্ব- এই চারটি উপাদানের সমন্বয়ে রাষ্ট্র পরিচিতি পায়। কিন্তু রাষ্ট্রের পথপরিক্রমায় বা বিবর্তনের ইতিহাসে যদি কখনো ‘ক’ রাষ্ট্রের কিছু অংশ মানচিত্রের বাইরে অন্য কোন ‘খ’ রাষ্ট্রের মাধ্যে থেকে যায়, তবে বিক্ষিপ্তভাবে ‘ক’ রাষ্ট্রের ঐ ক্ষুদ্র অংশের পরিস্থিতি কী হবে? বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের প্রায় চারটি জেলায় রয়ে গেছে এরকম ভারতের ১১১টি ক্ষুদ্র অংশ, আর ভারতের ভূখণ্ডে রয়েছে বাংলাদেশের ৫১টি ক্ষুদ্র অংশ; যা ছিটমহল নামে পরিচিত। ছিটমহলের আভিধানিক অর্থ দ্বীপায়নিক রাজ্য। কিন্তু ভারত-বাংলাদেশের ছিটমহলগুলো সমতল ভূমির উপর অবস্থিত হওয়ায় এ ধরনের ছিটমহলের ক্ষেত্রে যা বোঝায় তা হচ্ছে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের ভূখণ্ড পার্শ্ববর্তী দেশের ভূমি পরিবেষ্টিত।

 জানা যায়, ষোড়শ শতাব্দীতে মোঘল সেনাপতি মীরজুমলা কোচবিহার রাজ্য আক্রমণ করেছিলেন। এ সময় কোচ রাজা মোঘলদের বশ্যতা স্বীকার করে ‘কারদ’ রাজ্যে পরিণত হয়। সে সময় মোঘল অধিকৃত ১১১টি এলাকার অধিবাসী কোচ রাজার বশ্যতা স্বীকার করে তার রাজ্যে প্রজা হিসেবে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করে তার রাজ্যভুক্ত হয়। তখন তাদের বলা হতো রাজগির। তখন থেকে ঐ এলাকার অধিবাসীগণ রাজগির নামে পরিচিতি লাভ করে।

 অনুরূপভাবে কোচ রাজ্যভুক্ত ৫৩টি (বর্তমান দহগ্রাম আঙ্গুরপোতাসহ) এলাকার অধিবাসী মোঘলদের বশ্যতা শিকার করে তাদের অধিকৃত অঞ্চলে সম্পৃক্ত থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করলে তারাও ঐ রাজ্যভুক্ত থেকে যায়। তখন থেকে তারা মোঘলাই নামে পরিচিতি লাভ করে। এভাবেই তারা শতাব্দীর পর শতাব্দী থেকে যায়। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত ১১১টি ছিটমহল ভারতীয় ছিটমহল হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। একইভাবে ভারতের অভ্যন্তরে ৫৩টি ছিটমহল বাংলাদেশী ছিটমহল হিসাবে পরিচিতি লাভ করে।

 সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ১৯৪৭ সালে বাংলা পাঞ্জাবের সীমারেখা টানার পরিকল্পনা করেন লর্ড মাউন্টবেটন। তার পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্রিটিশ আইনজীবী সিরিল রেডক্লিফকে প্রধান করে সে বছরই গঠন করা হয় সীমানা নির্বাচনের কমিশন। ১৯৪৭ সালের ৮ জুলাই লন্ডন থেকে ভারতে আসেন রেডক্লিফ। মাত্র ছয় সপ্তাহের মাথায় ১৩ আগস্ট তিনি সীমানা নির্ধারণের চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন। এর তিন দিন পর ১৬ আগস্ট জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয় সীমানার মানচিত্র। কোনরকম সুবিবেচনা ছাড়াই হুট করে এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ায় সীমানা নির্ধারণের বিষয়টি যথাযথভাবে হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, কমিশনের সদস্যদের নিষ্ক্রিয়তা আর জমিদার নবাব, স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও চা বাগানের মালিকেরা নিজেদের স্বার্থে দেশ ভাগের সীমারেখা নির্ধারণে প্রভাব ফেলেছে। আর উত্তরাধিকার সূত্রেই উপমহাদেশের বিভক্তির এই সমস্যা বয়ে বেড়চ্ছে দুই দেশ।

 ১৯৫৮ সালের নেহেরু-নুন্ চুক্তি অনুযায়ী বেরুবাড়ির উত্তর দিকের অর্ধেক অংশ ভারত এবং দক্ষিণ দিকের অর্ধেক অংশ ও এর সংলগ্ন এলাকা পাবে বাংলাদেশ। চুক্তি অনুযায়ী বেরুবাড়ির সীমানা নির্ধারণের উদ্যোগ নেওয়া হলেও ভারতের অসহযোগিতায় তা মুখ থুবড়ে পড়ে। ফলে বেরুবাড়ির দক্ষিণ দিকের অর্ধেক অংশর ছিটমহলের সুরাহা হয়নি। কারণ, চুক্তিতে ছিটমহল বিনিময়ের উল্লেখ থাকলেও এ ব্যাপারে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সে দেশের সংবিধানের ১৪৩ ধারা সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের মতামত চান। তখন আদালতের পক্ষ থেকে বলা হয়, সংবিধানের সংশোধনীর মাধ্যমে বিষয়টির নিষ্পত্তি করতে হবে। পরে ভারতের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে সংবিধান সংশোধনী আর জনগণনার অজুহাতে বিলম্বিত হয়েছে ছিটমহল বিনিময়।

 সীমান্তের অমীমাংসিত সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৪৭ সালের ১৬ মে দিল্লিতে স্থল সীমানা চিহ্নিতকরণ-সংক্রান্ত এক চুক্তি সই করেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ভূমি হস্তান্তরের বিষয়ে চুক্তির তৃতীয় ধারায় বলা হয়েছে, ভূমি বিনিময়ের সময় লোকজন কোথায় থাকতে চান, সে ব্যাপারে তাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। ভূমি বিনিময় হলে বাড়তি ১০ হাজার একর জমি বাংলাদেশের পাওয়ার কথা। চুক্তির পর দুই দেশ ছিটমহলের আলাদা আলাদাভাবে তালিকা তৈরির কাজ শুরু করে। কিন্তু দুই পক্ষের তালিকায় দেখা যায় গরমিল। পরে ১৯৯৭ সালের ৯ এপ্রিল চূড়ান্ত হয় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ১১১টি ও ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল রয়েছে।

দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকে ২০০০ সালের ডিসেম্বরে যৌথ সীমান্ত কার্যদল (জয়েন্ট বাউন্ডারি ওয়ার্কিং গ্রুপ জেবি ডব্লিউ জি) গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। এরপর এ পর্যন্ত ছয়টি বৈঠক করে কমিটি। ২০১০ খ্রিস্টাব্দের  দুই পক্ষ দিল্লিতে সর্বশেষ বৈঠক করে ১৯৪৭ সালের চুক্তির আলোকে বিষয়গুলো সুরাহার সিদ্ধান্ত নেয়। এক্ষেত্রে ভারতের পক্ষ থেকে সমন্বিতভাবে বলা হয়েছিল, সাড়ে ছয় কিলোমিটার সীমান্ত চিহ্নিত করা, চুয়াত্তরের চুক্তির অনুসমর্থন, ছিটমহল এবং অপদখলীয় জমি হস্তান্তর এই ধারাবাহিকতায় বিষয়গুলো সমাধান করা হবে। ২০০৭ সালে ছিটমহল ও অপদখলীয় জমিগুলোতে যৌথ সফরের পর বাংলাদেশও ধাপে ধাপে বিষয়গুলো সুরাহার প্রস্তাব দেয়। ভারতের পক্ষ থেকে  বিষয়গুলো সমাধানের আশ্বাস আসে। তবে এরপরে কেটে গেছে পাঁচটি বছর কিন্তু ছিটমহল সমস্যার সমাধান আলোর মুখ দেখে নাই। মাঝখানে একটি প্রটোকল, দহগ্রাম-আঙ্গুরপোতা দুটি ছিটমহলের সমস্যার কিছুটা অগ্রগতি ছাড়া সীমান্তের অন্যান্য সমস্যাগুলি রয়ে গেছে।

 সরকারি তালিকা অনুযায়ী বাংলাদেশ ও ভারতের ছিটমহলের আয়তন দাঁড়ায় ২৪ হাজার ২৬৮ দশমিক ০৭ একর। তালিকা অনুযায়ী বাংলাদেশের মধ্যে ভারতের ছিটমহলগুলো লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জেলার অন্তর্গত হলেও এগুলো অবস্থান করছে ভারতের কুচবিহার জেলায়। বেসরকারি তথ্য মতে, এসব ছিটমহলের মোট জনসংখ্যা প্রায় ৭০ হাজার। বাংলাদেশের চতুর্থ আদমশুমারি ২০০১ সালের প্রতিবেদন ছিটমহলের জনসংখ্যার কোন হিসাব পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের অবস্থান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে। ৪৭টি কুচবিহার এবং চারটি জলপাইগুড়ি জেলায়। আবার এমনও আছে, বাংলাদেশের ভেতরে ভারত, তার ভেতরে আবার বাংলাদেশ। যেমন: কুড়িগ্রামে ভারতের ছিটমহল দাসিয়ারছড়া আর দাসিয়ারছড়ার ভেতরেই আছে চন্দ্রখানা নামের বাংলাদেশের একটি ছিটমহল। কেন এমন হল? একটু পেছনের দিকে ফিরে তাকানো যাক।

 ইতিহাসের বিবর্তনে উপমহাদেশের বিভক্তি ঘটে। ভারত ও পাকিস্তানের (পূর্ব ও পশ্চিম) মানচিত্র তৈরি হয়। ভারত ও পাকিস্তানের দু’টি অংশের সীমানা চিহ্নিত করার প্রাক্কালে অমীমাংসিত অঞ্চলের বাসিন্দারা অনেকেই জানে না ইতিহাসের সবখানি। শুধু জানে তাদের পরিচয় বড্ড অদ্ভুত, সরকার আছে, রাষ্ট্রীয় নামও আছে তবে সেসব ধরা ছোঁয়ার বাইরে। পরাধীন নয় তবে স্বাধীনভাবে বাঁচার জন্য মৌলিক অধিকার তাদের নেই। প্রশাসনের অভাবে নাগরিকত্বহীন জনগোষ্ঠী যে জীবন-যাপন করছে তা সুদীর্ঘ ৬৫ বছর যাবৎ সমাধানের অপেক্ষায় আছে। তাই এপার বাংলা আর ওপার বাংলার ছিটমহলবাসীরা মাঝে মাঝে সোচ্চার হয়ে উঠে নিজেদের নাগরিকত্বের প্রশ্নে। ভারত স্বাধীন হলেও ছিটমহলের ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত না হওয়ার বিষয়টি ঝুলে থাকে। সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ সরকার ভারতের সঙ্গে তিনটি চুক্তি করলেও সেই চুক্তি বাস্তবায়ন হয়নি।

 ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীন হলেও কোচবিহার ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়নি। কোচবিহার ছিল রাজ্যশাসিত পৃথক রাজ্য। ১৯৪৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর কোচবিহারের রাজা জগদ্বীপেন্দ্র নারায়ণ কোচবিহারকে ভারত রাষ্ট্রের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করার এক চুক্তিতে আবদ্ধ হন। এরপর ১৯৫০ সালের ১লা জানুয়ারি কোচবিহারকে পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। দেরিতে যুক্ত হওয়ায় দেখা গেল কোচ রাজ্যের জমিদারির একাংশ রয়ে গেছে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ)। আবার বিপরীত ঘটনাও দেখা গেল। পূর্ব পাকিস্তানের কিছু জমিদারের ভূসম্পত্তির একটা অংশ রয়ে গিয়েছিল কুচবিহারে এই অংশগুলো নিয়েই তৈরি হল ছিট। এই ধরনের দুটো ছিট চন্দ্রখানা ও দাসিয়ারছড়া, একটির মালিক বাংলাদেশ আরেকটি ভারত। কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ি উপজেলার অন্তর্গত দাসিয়ারছড়া ভারতের ছিটমহল। ভারতীয় সীমান্ত থেকে ২ কিলোমিটার বাংলাদেশের জমিন পেরোলে দাসিয়ারছড়া। ভারতীয় এই ছিটের ভেতরে রয়েছে বাংলাদেশের ছোট এক বসতি। নাম ছিট চন্দ্রখানা। লোকসংখ্যা প্রায় ৪৫০।

 স্বদেশে পরবাসী যে জনগোষ্ঠী কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ি উপজেলার সদর ইউনিয়নের তাদের বসবাস। ব্রিটিশ শাসনের অভিনব সীমানা চিহ্নিতকরণের কারণে মাত্র ১০০ মিটারের ব্যবধানে চন্দ্রখানা ছিটমহলটি অবস্থান করছে ভারতের দাসিয়ারছড়া নামক অপর একটি ছিটের মধ্যে। মাত্র কিছুদিন আগে স্বচক্ষে দেখে আসা এই ছিটমহল দু’টি নিয়ে যে অভিজ্ঞতা তা অন্যান্য ১৬০টি ছিটমহলের সমস্যাকেই প্রতিনিধিত্ব করে।

 লেখক: শিক্ষক, রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments:

উপরে ফিরে যান