2.21.2008

আমাদের শিক্ষা, শিক্ষার্থী ও সমাজবাস্তবতা

রাশেদুল ইসলাম বাবু

টোল কিংবা মক্তবের বদ্ধযুগ শেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই। তাই হালের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা নিজেদের আধুনিক ভাবতে ভাবতে কখন যে ভ্যাড়ার পাল হয়ে গেছে- তা আর ভাবার সময় পায়নি। কেননা আমাদের নিষ্ঠুর বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থা যখন দেখিয়ে দেয় আমাদের ‘শিক্ষা’ পণ্যের রূপ নিয়েছে, তখন সে পণ্যের উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত এসব মিডলক্লাশ ভ্যাড়াদের রাখালমশাই যে মার্গে চলতে কিংবা যে অচর্ব্য গিলতে বলছে এরা তাই করছে। যদিও দুই একটি অন্বিত মুভমেন্ট শিক্ষার সুপথ্য ও পথের জন্য দাবি করেছে কিংবা করছে- কিন্তু তাতে লাভ কোথায়? সমস্যাটা যখন সবার তখন সবাইতো এই মুভমেন্টে আসছেনা। রাখালমশাইয়ের হাতে লাঠি দেখে ভয় পেলেতো চলবেনা। তাহলে আজীবন ভ্যাড়াই থাকতে হবে। এখানে উল্লেখ্য যে, সুস্থ শিক্ষা সংস্কারের জন্য আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা এ ভ্যাড়ার পালভূক্ত নয়। তার অর্থ এই নয় যে, আন্দোলন করছেনা এরকম সকল শিক্ষার্থীই এ ভ্যাড়ার পালভুক্ত। বিষয়টি নির্ণয় করতে হবে- নৈতিকভাবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কে-কতটুকু গ্রহণ অথবা বর্জন করছে তার উপর। সেক্ষেত্রে শিক্ষার ‘উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য’কে দুভাবে উপস্থাপন করা হলো-

প্রথমত: শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য যদি এমন হয়- শিক্ষার মাধ্যমে অর্থাৎ ছাত্র-শিক্ষকের সরাসরি আদান-প্রদানের মধ্যদিয়ে একজন শিক্ষার্থী ব্যক্তিজ্ঞানের পাশাপাশি কর্মদক্ষতা, যুক্তিনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিক শক্তির বিকাশ ঘটাবে এবং নিজস্ব সংস্কৃতি ও সমাজের প্রতি বিশেষ দায়বোধ গড়ে উঠবে। এভাবে একজন শিক্ষার্থী উন্নত মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।

দ্বিতীয়ত: শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য যদি এমন হয়- একজন শিক্ষার্থী শিক্ষার বিষয়বস্তুকে অর্থাৎ সিলেবাস-কারিকুলামকে সুবিন্যস্তভাবে ধারাবাহিক অধ্যয়নের মাধ্যমে একে একে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক... প্রতিটি পর্যায়ে ভালো ফলাফলের মধ্যদিয়ে শিক্ষা জীবন শেষে একটি ভালো চাকুরী করবে। এভাবে একজন শিক্ষার্থী উন্নত মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।

উভয় ক্ষেত্রে শিক্ষার লক্ষ্য যখন উন্নত মানুষ হওয়া, তখন উন্নত ভ্যাড়া হওয়া কী দরকার? অতঃপর যদি তাই ঘটে তাহলেতো শিক্ষার লক্ষ্য ভ্রষ্ট হয়ে যাবে। তাই উপরে উপস্থাপিত শিক্ষার দুটি ‘উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য’র মধ্যে কোন ‘উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য’কে সামনে রেখে শিক্ষার্থীরা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়? প্রথমটি না দ্বিতীয়টি?-সেটাই বিবেচ্য বিষয়। পর্যবেক্ষণে দেখা যায় দ্বিতীয়টির কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসা শিক্ষার্থীদের সংখ্যা এত বেশি যে প্রথমটির ক্ষেত্রে এর সংখ্যা দাঁড়ায় এক থেকে দেড় শতাংশ। এখন যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিচারে আলোচ্য দুটি শিক্ষার ‘উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য’র মধ্যে দ্বিতীয়টিকেই নিষ্প্রমাদ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়, তাহলে নিম্নাংশে উপস্থাপিত শিক্ষার প্রথম সংজ্ঞাকে বর্জন করে দ্বিতীয় সংজ্ঞাটিকে প্রকৃষ্ট হিসেবে গ্রহণ করা যুক্তিসিদ্ধ কী না?

প্রথম সংজ্ঞা: যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যক্তিজ্ঞান বৃদ্ধি, বৈজ্ঞানিক চেতনা, যুক্তিনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গি, চরিত্র ও মানসিক শক্তির বিকাশ ঘটানো যায় তাই শিক্ষা।

দ্বিতীয় সংজ্ঞা: যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মুখস্তবিদ্যা, তিন ঘন্টার পরীক্ষায় দ্রুত লেখার দক্ষতা অর্জন ও একটি ভালো চাকুরীর জন্য মানসিক প্রস্তুতির বিকাশ ঘটানো যায় তাই শিক্ষা।

এখন যদি দ্বিতীয় সংজ্ঞাটি যথার্থ হিসেবে পরিগৃহীত হয়, তাহলে শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে দেখা দোষ কোথায়? সুন্দরী নারীরা যেভাবে পণ্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে (যেমন লাক্স মিস ফটোজেনিক) অনুরূপভাবে শিক্ষাও পণ্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে নানাভাবে। যেমন পরীক্ষায় পাস করা ও উচ্চতর ডিগ্রী প্রদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে যে দুটি ব্যবসা জমজমাট তাহলো গাইডবই ব্যবসা ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবসা। সাথে কোচিং সেন্টার, কিন্ডারগার্টেন এবং ইংলিশ মিডিয়ামতো আছেই। আর প্রতি বছর নতুন সিলেবাসের আলোকে নতুন বই মুদ্রণের জন্য টেন্ডারবাজির মতো এক ভিন্ন আইটেমের ব্যবসা লেগেই রয়েছে। শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণের চলমান প্রক্রিয়ার আরও একটি উদাহরণ- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; যেখানে দুটি ইনস্টিটিউটে (সমাজ কল্যাণ এবং গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান) বাণিজ্যিকভাবে উচ্চ শিক্ষার ধারণা পরিপন্থী ডাবল সিফট চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সম্প্রতি।

এখন প্রশ্ন হলো, শিক্ষার এই নাজুক ব্যবস্থায় আমাদের সিংহভাগ শিক্ষার্থীদের অবস্থান কিরূপ? মোটা দাগে বলতে হয় যে, আমাদের শিক্ষার্থীরা শুধু সিলেবাসের আলোকে তোতা পাখির মতো পাঠ মুখস্থ করে ডিগ্রী অর্জনের মধ্যদিয়েই নিজেদের সত্যিকারের শিক্ষিত কিংবা সংস্কৃতিমান ভাবছে। বিষয়টা এমন যে, ময়না ও টিয়া পাখিকে বছরের পর বছর ট্রেনিং দিয়ে সিলেবাসের পাঠ মুখস্থ করালে তারাও যেন শিক্ষিত হয়ে যাবে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়। দেখা যায় অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ ভাবনা- পরীক্ষায় ভালো ফলাফল ও ভালো চাকুরী। এসব শিক্ষার্থী পড়াশুনার পাশাপাশি বন্ধু-বান্ধবের সংগে যে আড্ডা দেয় তা হয় কামগন্ধী নতুবা মুখরোচক। তাদের মধ্যে পড়াশুনা বিষয়ক যে বাক্যালাপ হয় তা পরীক্ষা সংক্রান্ত আর অমুক স্যারের হ্যান্ডনোট- তমুক ছাত্রের হ্যান্ডনোটের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সাহিত্য বলতে এরা বোঝে সমসাময়িক জনপ্রিয় লেখকের উপন্যাসের প্রেম, কমেডি আর ডিটেকটিভ কাহিনীর মুখরোচক অংশ। আর সংস্কৃতি বলতে এরা গান-বাজনাকেই বোঝে। মাঝে মাঝে বোম্বে কিংবা হলিউডের নায়কদের নায়কী স্টাইল এবং নায়িকাদের নরম দেহের প্রসঙ্গও এসব শিক্ষার্থীদের আড্ডায় আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

এ পর্যবেক্ষণলব্ধ ফলাফল থেকে যে বিষয়টি উঠে আসে তাহলো শতকরা প্রায় ৯৫ ভাগ শিক্ষার্থীর ব্যক্তিচিন্তার অবস্থান উপরের অনুচ্ছেদের অনুরূপ এবং সবাই রোমান্টিসিজমে ভোগে। পাশাপাশি এদের প্রত্যেকে স্বীয় সম্প্রদায়ের ধর্মীয় প্রভাব অন্যের উপর (বিশেষ করে নারীদের উপর) কার্যকর করতে চায়- যতটা না নিজের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে। এদের মধ্যে ২৫ ভাগ শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে আরও একটি লাইন যুক্ত করতে হয় যে ‘তারা তাদের প্রেমিক/ প্রেমিকার জন্য সময় নষ্ট করে।’ প্রায় ৩-৪ ভাগ শিক্ষার্থী শুধুমাত্র পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত। অবশিষ্ট ১-২ ভাগ শিক্ষার্থীর প্রসঙ্গ পূর্বেই বলা হয়েছে। তাই এ ফলাফল থেকে একথা বলা যায় যে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনার পাশাপাশি নিজেদের সংস্কারের তাগিদ অনুভব করাতে বাধ্য করছেনা। ফলে তারা যা শিখছে (মুখস্থ করছে) তা শুধু পরীক্ষায় পাশের জন্য; ব্যক্তিজ্ঞান সমৃদ্ধের জন্য নয়। এর কারণ, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের সঠিক চেতনাসম্পন্ন, বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী এবং সমাজ সচেতন দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যকে সামনে রেখে পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করা হয়নি। এমনকি সেখানে গণমুখী ও সৃজনশীল শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার কোন অবস্থান নেই। সুতরাং আমরা বলতে পারি যে, সঠিক ‘শিক্ষাদর্শন’কে চরমভাবে অবমূল্যায়ন করে ক্ষমতাশীন রাজনৈতিক দলের ইচ্ছার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা আমাদের শিক্ষানীতি সমাজ-সংস্কৃতি-জীবন ঘনিষ্ঠ শিক্ষানীতি নয়।

শিক্ষার এই দূষিত পরিস্থিতি থেকে বিশুদ্ধ শিক্ষাদর্শনের ভিত্তিতে আমাদের শিক্ষানীতি কী হওয়া উচিত?- এটাই বড় প্রশ্ন। কিন্তু অদ্ভূত ব্যপার হল, এ বিষয়ে আমাদের শিক্ষার্থীরা সঠিকভাবে মন্তব্য করতে পারছেনা। বাহ্যিক বোধ থেকে তারা যে ভাবনাটি ভাবছে তা নিম্নরূপ-
  • পরীক্ষা নকলমুক্ত করতে হবে এবং পরীক্ষা পদ্ধতির রূপান্তর ঘটাতে হবে।
  • শিক্ষাপদ্ধতিকে আরও আধুনিক করতে হবে।
  • ইংরেজি শিক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
  • পর্যাপ্ত পরিমাণ শিক্ষক নিয়োগ ও লাইব্রেরিতে বইয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে।
  • সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, হলদখল, ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করতে হবে।

সংখ্যাগরিষ্ঠতার দিক দিয়ে এগিয়ে থাকা এসব শিক্ষার্থীরা সঠিক শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য উপরিউক্ত যেসব মন্তব্য উপস্থাপন করেছে তা যুক্তিসঙ্গত নয়। তাদের মন্তব্যগুলো একটি শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে সৃষ্ট কিছু সমস্যা সমাধানের উপায় মাত্র- সুস্থ শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য কোনো পদ্ধতি নয়। তাই সুস্থ শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য সার্বজনীন স্বীকৃত একটি বিজ্ঞান সম্মত অর্থাৎ সুস্থ শিক্ষাদর্শনের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা একটি শিক্ষা পদ্ধতির প্রয়োজন। যার মধ্যদিয়ে একজন শিক্ষার্থী সঠিকভাবে ভাবতে ও শিখতে বাধ্য হবে। এখন প্রশ্ন হলো ‘শিক্ষাদর্শন কী?’ মোটা দাগে এ কথায় বলতে হয় ‘দর্শন হলো গভীরভাবে বিশ্লেষণের মাধ্যমে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি চেনার রাস্তা।
আর শিক্ষাদর্শন হল গ্রহণ ও জ্ঞানান্বেষণের মাধ্যমে সত্যের উপলব্ধি হবার দৃষ্টিভঙ্গি বা উপায়।’ সেদিক বিবেচনায়, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষানীতি বলতে কিছু আছে কী নেই- সেটাই ভাবার বিষয়। ড. অজয় রায় ‘বিজ্ঞানচর্চা ও সমকালীন বাংলাদেশ’ গ্রন্থে ‘শিক্ষা-দর্শন ও শিক্ষানীতি এবং বিজ্ঞান শিক্ষা: কিছু অনিয়মিত ভাবনা’ প্রবন্ধে আমাদের শিক্ষাদর্শন ও শিক্ষানীতি সম্পৃক্ত নিচের মন্তব্যটি করেছেন- ‘‘আমাদের কোনো শিক্ষাদর্শন নেই, সুতরাং শিক্ষানীতিও নেই। এ নিয়ে আলোচনার কোনো ভিত্তি নেই। তবে অদ্ভূত হলেও দর্শন ও পলিসি ব্যতিরেকেই আমরা একটা শিক্ষা ব্যবস্থাকে লালন করছি। এই শিক্ষাব্যবস্থাটি কোন দর্শন ও নীতিকে আশ্রয় করে দাঁড়িয়ে আছে আমরা কেউ জানিনা।”

সুতরাং বোঝ যায়, ব্যক্তিগত পড়াশুনা ও উপলব্ধি এবং ব্যক্তিইচ্ছাকে বাদ রেখে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে কেউ শিক্ষার প্রকৃত স্বাদ গ্রহণ করতে পারবেনা। অর্থাৎ সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারবেনা। তাই সুস্থ শিক্ষানীতির জন্য একটি সঠিক পদ্ধতির তাগিদ অনুভব করতে গিয়ে, যেসব শিক্ষার্থী পড়াশুনার পাশাপাশি ব্যক্তিজ্ঞান সমৃদ্ধির লক্ষ্যে সুস্থ সংস্কৃতি, সাহিত্য, দর্শন, রাজনীতি চর্চার মাধ্যমে সঠিক বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হচ্ছে কিংবা হতে চাচ্ছে- একমাত্রতারাই সঠিকভাবে শিক্ষিত হতে পারছে। আর অবশিষ্ট শিক্ষার্থীরা শাসকের নীতিকে আশ্রয় করে সৃষ্ট আমাদের ‘শিক্ষাব্যবস্থা’ কর্তৃক মদদপুষ্ট হয়ে নিরীহ প্রাণীর মতো অবোধ ও অন্তর্মুখী হয়ে পড়ছে। এ যুক্তিকে আশ্রয় করে এসব শিক্ষার্থীদের (৯৫%) ভ্যাড়ার পাল বলে আলাদা করে দেখা দোষের নয়। কেননা ভ্যাড়া একটি অবোধ ও অন্তর্মুখী প্রাণী। তাই আজকের শিক্ষার্থীরা (৯৫%) সালাম-বরকত(৫২’র ভাষা আন্দোলন), আসাদ (৬৯’র গণঅভ্যুত্থান), রাজুর (’৯২ এর ১৩ মার্চে ঢাবি ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসবিরোধী মিছিলে সন্ত্রাসী কর্তৃক গুলিতে নিহত) মতো দেশপ্রেমিক ছাত্রদের অনুসরণ না করে পরীক্ষায় ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করা কোনো এক ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ আমলাকে অনুসরণ করছে। এবং তাদেরকেই আদর্শ হিসেবে দেখছে।

শিক্ষার্থীদের আরও একটি অংশ বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলো বিশুদ্ধ শিক্ষাদর্শনের ভিত্তিতে একটি যথাযথ শিক্ষানীতির দাবি করলেও তাদের আন্দোলনকে চাঙ্গা করতে পারছেনা। এর মূল কারণ, আমাদের সাধারণ শিক্ষার্থীরা; যারা অবোধ-অন্তর্মুখী ও সাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ এক আরামপ্রিয় সাচ্চা মধ্যবিত্ত অথবা নিম্ন মধ্যবিত্ত। এসব শিক্ষার্থীদের যখন কোনো উচ্চাশা জাগে তখন সামান্য ব্যর্থতায় অদৃষ্টের দোহাই দিয়ে নিজেকে গৃহকোণে আবদ্ধ রাখে। সংগ্রামের পথ বেছে নিতে এরা নারাজ। শিক্ষাদর্শনের সঠিক চেতনা এদের নেই; কেননা শিক্ষাদর্শন বলতে এরা বোঝে পরীক্ষায ভালো ফলাফল ও শিক্ষা শেষে ভালো চাকুরী। সেদিক বিবেচনায় ‘শিক্ষাদর্শনের’ সঠিক রূপরেখা সাধারণ শিক্ষার্থীদের সামনে সঠিকভাবে উপস্থাপন করে তাদের শ্রেণী অবস্থান ও শ্রেণীচরিত্রের রূপরেখা সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে হবে। কেননা ওই সব সাধারণ শিক্ষার্থীদের (৯৫%) শ্রেণীচরিত্রের রূপান্তর না ঘটা পর্যন্ত এ প্রকারের শ্রেণীহীন শিক্ষার আন্দোলন কখনই শক্ত ভিত গড়তে পারবেনা। আর এসব ছাত্র সংগঠনগুলোর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

কিন্তু আজকের সমালোচকগণ এসব ছাত্র আন্দোলনকে যৌক্তিক বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে ব্যাখ্যা না করেই এদের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করছে। বিষয়টা এমন যে ছাত্ররাজনীতিকে ব্যবসা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজী, ঠিকাদারী ইত্যাদির মানদণ্ডে মেপে এদের সম্ভাবনাময় আন্দোলনের ভেলোসিটি কমিয়ে দিচ্ছে। তাদের ধারণা আর কখনও বঙ্গবন্ধু কিংবা মহাত্মা গান্ধী জন্মাবে না। কিন্তু মূল বিষয়টা হল, মাথাব্যথায় মাথা কেটে না ফেলে সঠিক ঔষধ প্রয়োগ করাই যদি বিজ্ঞানসম্মত হয় তাহলে ছাত্র আন্দোলনের সম্ভাবনাময় এই দ্বিতীয় ধারাকে সরাসরি নাকচ করে না দিয়ে যৌক্তিকভাবে বিশ্লেষণ করে সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়ে এদের আন্দোলনের পথকে সম্প্রসারিত করাই একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক-প্রগতিশীলের ভূমিকা হতে পারে।

No comments:

উপরে ফিরে যান