রাই বাবু
যাদের কথাবার্তা বা নীরবতা সভ্যসমাজের দৃষ্টিতে অসমীচীন, নিরর্থক, অযৌক্তিক বা হাস্যকর এবং যাদের বাহ্যিক আচরণ স্বভাবসিদ্ধ নয় বা সভ্যসমাজের দৃষ্টিতে বিকৃতমস্তিষ্কের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় অথবা সমাজ ও সভ্যতা যাদের মনের মধ্যে ‘অন্যরকম এক অবস্থা’ সৃষ্টি করেছে কিংবা যাদের প্রকৃতিগত প্রবৃত্তি সমাজের কাছে যুক্তিহীন, কা-জ্ঞানহীন বা ননসেন্সদের মতো, তাদের এসব আচরণ, আত্মভাব ও অঙ্গস্বভাব সম্পর্কে সভ্য মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি কী হতে পারে, তা আমরা সবাই জানি। কারও দৃষ্টিতে এরা মানসিক রোগী, কারও দৃষ্টিতে এরা উন্মাদ, বদ্ধউম্মাদ, বা অবাঞ্ছিত। অপেক্ষাকৃত এরা বেশ বিনয়ী বা ক্ষিপ্ত বলে এদের অযৌক্তিক কথোপকথন বা নীরবতা কিংবা আচরণ শুনতে বা বুঝতে কিংবা গ্রহণ করতে সভ্য মানুষ রাজী নয়। এদের স্থান পাগলাগারদে কিংবা কোনো এক মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের চেম্বারে। মধ্যযুগ থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত এরা এভাবেই সভ্য মানুষের কাছে অবাঞ্ছিত হয়ে আসছে বার বার। কিন্তু কেন? সভ্যসমাজ কেনই-বা এদের এভাবে সমালোচনা করছে যুগ যুগ ধরে। আবার কেন-ই বা এদের কথা বিকৃতভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে? কারণ সমাজ-সভ্যতার কাছে সোজা বাংলায় এরা ‘পাগল’।
হ্যাঁ, পাগল শব্দটা ব্যবহার করে এই রচনাটি লিখতে আমার আপত্তি আছে। কিন্তু আমি শব্দটা ব্যবহার করছি সমাজ- সভ্যতা আমাদের এই শব্দটি দ্বারা এমন একজন মানুষকে চিনতে শিখিয়েছে যার নিকট থেকে দূরে থাকা ভালো; কারণ সে বদ্ধউম্মাদ ও অবাঞ্ছিত। তাই সভ্য মানুষের দৃষ্টিতে অবাঞ্ছিত, অযৌক্তিক, উন্মাদ, কা-জ্ঞানহীন, ননসেন্স, উদাসীন, দিওয়ানা যাই বলা হোক না কেন, আপাতত ‘পাগল’ শব্দটাকে ভিত্তি করেই অলোচনা করা যাক।
কে পাগল? কারা পাগল? কেন এবং কোন স্বার্থে সভ্যসমাজ কাদের পাগল বলে? পাগল সম্পর্কে সমাজ-সভ্যতার দৃষ্টিভঙ্গি কেমন? এর সঙ্গে মানসিক ব্যাধির সম্পর্কই-বা কতটুকু? এ বিষয়ে বৈজ্ঞানিক বা ডাক্তারি ব্যখ্যার ফলাফল কী? আবার তারা যে ব্যখ্যা দিয়ে থাকেন, তা-ই বা কতটুকু সঠিক? অনেকে সমাজ-সভ্যতার বিবর্তন ও ইতিহাসের আলোকে এই বিষয়গুলির উত্তর খুঁজেছেন। ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো (১৯২৬ -১৯৮৪) তাঁদের অন্যতম।
হ্যাঁ! সাম্প্রতিককালে জ্ঞানচর্চায় মিশেল ফুকো এক অনন্য প্রভাব রেখেছেন। পশ্চিমা জ্ঞান ও জ্ঞানচর্চার গ-ি পেড়িয়ে তিনি বুঝতে চেয়েছেন এর অতীত-বর্তমান, খুঁজতে চেয়েছেন এর অন্তঃসারশুন্যতা, আর মাপতে চেয়েছেন এর মেকির পরিমাণ। পাগলামি সম্পর্কিত ধারণা, জ্ঞান বিষয়ক উপলব্ধি, আইন ও শাস্তি বিষয়ক ব্যবহার, যৌনতার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি- এসবকিছুর প্রতি আমাদের মনোভাবের গোড়া নড়বড়ে করে তিনি যাবতীয় চিন্তাভাবনা উপস্থাপন করেছেন প্রচলিত চিন্তাভাবনার প্রায় বিপরীতে দাঁড়িয়ে। তিনি চিহ্নিত করেছেন আমাদের জ্ঞানচর্চার ফাঁক-ফোকর, চ্যুতি-বিচ্যুতি আর নির্মাণ-অনিমার্ণের ব্যাপারগুলোকে। ফুকোর এসব দৃষ্টিভঙ্গি ও সুগভীর বিশ্লেষণ একালের দর্শন, ইতিহাস, মনোবিজ্ঞান, সমাজবিদ্যা থেকে শুরু করে বহু বিষয়েই প্রভাব ফেলেছে, বদলে দিয়েছে চিন্তার ধরন। তিনি মানবসভ্যতার পুনর্বিচার করেছেন। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, স্কুল-হাসপাতাল-কারাগার-পাগলাগারদ হল ক্ষমতার যন্ত্র এবং ক্ষমতার দাসত্ব শেখানোর জায়গা, আর আইন হল ক্ষমতার একটি হাতিয়ার। তিনি আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন পাগলামি সম্পর্কিত সভ্যসমাজের দৃষ্টিভঙ্গি এবং এর সংশোধনযোগ্য উপলব্ধি। এই রচনায় ফুকোর পাগলামি বিষয়ক তাঁর অনবদ্য সৃষ্টিশীলতার আংশিক দিক উপস্থাপনের প্রয়াস করছি মাত্র।
ফুকো কেন এই পাগলদের নিয়ে এত মেতেছিলেন? এটা কি পাগলামি ছিল? হ্যাঁ, সভ্যসমাজের দৃষ্টিকোণ থেকে হয়তো পাগলামি, কিন্তু আধুনিক সভ্যতা যখন পাগলকে যৌক্তিক মানুষের বিপরীতে স্থান দিল তখন ফুকো ওদের রক্ষা করতে ক্ষেপে উঠেছিলেন। পাশ্চাত্য সভ্যতায় বসে সবার মাঝে আলো জ্বালবার প্রয়াস নিয়ে, যারা আলোকিত নয় ফুকো তাদের বানাতে চেয়েছিলেন অলোকলোক, যে আলো স্ব-অভ্যন্তর হতে বিচ্ছুরিত হয়। ফুকোর মতে, ম্যাডনেস বা পাগলামি হতে পারে যৌক্তিকতার বিপরীত, কিন্তু অযৌক্তিকতায় ঘুরপাক খায় না, আর তাই তিনি বলছেন, সধফহবংং সধু ড়ভভবৎ ধ ারধনষব ধষঃবৎহধঃরাব ঃড় ৎবধংড়হ…
ফুকো অনেককিছুই ভেবেছেন ‘পাগলামি’ নিয়ে। লিখেছেন মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েও। যদিও পাগলদের নিয়ে এই সৃষ্টিশীলতাকে অনেক সমালোচক এটাকে ‘পাগল-রোমান্টিসিজম’ বলছেন, কিন্তু তাঁর এই ‘পাগলামি তথা ম্যাডনেস’ ধারণাটি পরবর্তীতে মনোবিজ্ঞানের একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করবে সেটা বোধকরি অনেক সমালোচক বুঝে উঠতে পারেননি। ফুকো মনে করেন, ‘পাগলামি’ আর ‘যৌক্তিকতা’ এই দুটি বিষয় মানবসভ্যতার ইতিহাসে ধীরে ধীরে একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে, আর এটা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে আধুনিক বিশ্বে তথা বর্তমান সময়ে। নির্বুদ্ধিতা-বোকামি-উন্মাদনা বা আতঙ্কিত-উৎকণ্ঠিত-ক্ষিপ্তাবস্থা যা-ই বলা হোক-না কেন, যেটা কি-না বর্তমান সময়ে বৈজ্ঞানিক পন্থায় চিকিৎসা করতে হবে, উপশম ঘটাতে হবে, আর এই বিষয়কে ভিত্তি করেই সাইকোপ্যাথলজি বা অসুস্থতার কথা বলে কৃত্রিমভাবে পৃথকীকরণ করা হয়েছে এইসব বিনয়ী-বোকা বা অপ্রকৃতিস্থ-ক্ষিপ্ত মানুষদের, যাকে ফুকো ধপঃ ড়ভ ংপরংংরড়হ বলেছেন। এই ‘ধপঃ ড়ভ ংপরংংরড়হ’ বিষয়টিকে একটু সহজ করার জন্য কয়েকটি দৃশ্যের অবতারণার মধ্য দিয়ে বোঝার চেষ্টা করি:
১। বঙ্গপুরে বাস করে ফটিক। সে সবকিছুতেই প্রশ্ন খোঁজে। সভ্যমানুষ থেকে একটু আলাদাভাবে সবকিছু চিন্তা করে। একদিন বঙ্গরাজা সিদ্ধান্ত নিলেন, রঙ্গরাজকে এক নৈশভোজের নিমন্ত্রণ করবেন। তাই ঢোল পিটিয়ে প্রজাদের জানানো হল। কিন্তু ফটিকের মনে প্রশ্ন জাগল, ‘কেন বঙ্গরাজা রঙ্গরাজাকে ভোজের নিমন্ত্রণ জানাবে?’ যেখানে প্রজারা অনাহারে মরে, সেখানে রাজ্যের এতোগুলো অর্থ কেন খরচ করবে? তাই ফটিক প্রজাদের সচেতন করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করে। এতে বঙ্গরাজা মুশকিলে পরে। তাই সমাধানের জন্য ফটিককে বিচারে ডাকা হল। বিচারে রায় হল, ‘ফটিক একটা উন্মাদ মানুষ’। সে পাগল হয়ে গেছে। তার নাম রাখা হল- ফটিক পাগলা। তার স্থান হল পাগলাগারদে।
২। একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে এক কন্যা-শিশুর জন্ম হল। শিশুটি বেড়ে ওঠার সাথে সাথে সমাজের পুরুষতান্ত্রিকতা, ধর্মান্ধতা, অধিকার, নিয়মতান্ত্রিকতা, যৌনতা প্রভৃতি বিষয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হল। কেন এমন হল নারীদের জীবন? পুরুষের মত নারীরা কেন এত সুযোগ সুবিধা পেল না? প্রাপ্তবয়সে তার মনের মধ্যে এক ‘অন্যরকম অবস্থার’ সৃষ্টি হল। একটা সময়ে সমাজের প্রচলিত রীতিনীতিকে উপেক্ষা করার চেষ্টা করলো সে। বাবা-মা ও আত্মীয়রা মেয়েটির এই পরিস্থিতি সমাধানের উপায় হিসেবে তাকে বিয়ে দিল। বিয়ের পর স্বামী বিষয়গুলো মেনে নিতে পারল না। স্বামীর অভিযোগ তার স্ত্রী একজন মানসিক রোগী। স্বামীর অভিযোগে অভিযুক্ত মেয়েটিকে অবশেষে যেতে হল মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে। অবশেষে সেই মেয়েটিকে হারাতে হল সামাজিক মর্যাদা, বঞ্চিত হতে হল পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে, এমনকি পরিত্যক্ত হলেন ঘর সংসার থেকে।
৩। বিদ্যালয়ের একজন বাংলা শিক্ষক। তিনি জ্ঞানচর্চায় অনেক বেশি আবেগী। তার এই আবেগটা এমন এক পর্যায়ে ঠেকেছে যা তাঁর মনের মধ্যে ‘অন্যরকম এক অবস্থা’ সৃষ্টি করেছে। ফলে তিনি শিক্ষার্থীদের পাঠদানে আগ্রহ হারিয়ে ফেললেন। শ্রেণিকক্ষে সুযোগ পেলে কিংবা অতিরিক্ত সময় পেলে শিক্ষার্থীদের সাথে ভূগোল ও বিজ্ঞান বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। বিষয়টি প্রধান শিক্ষক জ্ঞাত হয়ে ওই শিক্ষককে পাঠদানে মনোযোগী হতে বললে তাঁকেও (প্রধান শিক্ষক) ভূগোল ও বিজ্ঞান বিষয়ের গুরুত্ব তুলে ধরেন। একটা পর্যায়ে ওই শিক্ষক সবার মাথাব্যথার কারণ হলেন। আখ্যায়িত হলেন উন্মাদ শিক্ষক হিসেবে। সুতরাং তার চিকিৎসা প্রয়োজন। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে মানসিক চিকিৎসালয়ে পাঠালেন। চিকিৎসা শেষে তিনি উপলব্ধি করলেন যে, সমাজ-সভ্যতা মানুষকে যেভাবে চলতে বলে সেভাবে চলাই হল সভ্যতা। পরে যখন শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীরা ওই শিক্ষককে বিজ্ঞান ও ভূগোল বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি উত্তর দিলেন, ‘মানসিক চিকিৎসা নিয়ে আমি-তো এখন সুস্থ আমি আর ভূগোল-বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করব না, আমি তোমাদের বাংলা পড়াব।’
বিষয়গুলোর আলোকে বলতে হয়, সমাজ-সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারাবাহিকতায় প্রচলিত ধ্রুববিশ্বাস, আদবকায়দা, অনুশাসন, নৈরাজ্য, ধর্মান্ধতা, ধ্যানজ্ঞান, প্রেম প্রভৃতির বিপরীতে বা প্রায়-বিপরীতে যখন কোন মানুষের মনোজগতে সন্দেহ, উৎকণ্ঠা, দ্বন্দ¦, আতঙ্ক প্রভৃতির বহিঃপ্রকাশ ঘটে তখন সে হয় পাগল, বদ্ধউন্মাদ বা দিওয়ানা। এসব মানুষের আত্মদর্শন বা অনুসন্ধিৎসু মন অথবা দ্বিধাগ্রস্থতা অবমূল্যায়ন করে তাদের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে উন্মাদ আশ্রম বা মেন্টাল অ্যাসাইলাম তথা পাগলাগারদ। ফুকোর মতে, মধ্যযুগে ইউরোপে যে পাগলামিগুলো ছিল মানব অভিজ্ঞতার এক ‘আধ্যাত্মিক’ অংশ, রেনেসাঁ পরবর্তী সময়ে তথা সভ্যতা অগ্রগতির সাথে সাথে সেই পাগলামিগুলোই যেন হয়ে উঠলো সভ্য মানুষের ঠিক বিপরীত অবস্থা তথা বিশেষ কারণে এক ধরণের ‘বিদ্রুপাত্মক অবস্থা’। আর তাই উন্মোচন ঘটল এই জগতের ননসেন্সগুলোর, যারা সমাজে প্রয়োজনহীনতার মর্যাদা পেল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই ননসেন্সরা হয়ে উঠলো ট্র্যাজিক, আবার কখনও-বা কমিক।
অর্থাৎ যে মানুষগুলো সভ্যসমাজের সাথে শামিল হতে পারে না কিংবা যাদের হতে দেওয়া হয় না, সেই অযৌক্তিক ও সভ্যতা-বঞ্চিত মানুষগুলোর বাতিলীকরণ হয় ‘পাগলামি’ নামে। আলোকপ্রাপ্ত ইউরোপে যুক্তি, বিজ্ঞান ও সভ্যতার আলোকে পৃথিবীব্যাপী ক্ষমতার মতাদর্শের যখন উৎসব চলে, সেই সময়ে ইউরোপে বড়-বড় পাগলাগারদে পাগলেরা ছাড়াও চোর, ডাকাত, বিপ্লবীরাও স্থান পেত। অর্থাৎ সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এইসব পাগল বিষয়ক ধারণা, ওদের আউটলুক, ওদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি তথা প্রতিটি ক্ষেত্রে নতুন সমাজ-সভ্যতার স্বভাবসিদ্ধ মানুষের অবস্থার যে পরিবর্তন হয়েছে, তা-যেন এই পাগলদেরকে ‘ট্র্যাজিক-কমিক’ ও ‘উন্মাদ-অবাঞ্ছিত’ খোলসসমূহে রাখা হয়েছে। সেই সাথে মহাবিশ্বের আইনের সাথে বিরোধিতায় ফেলা হয়েছে। পরবর্তীতে তাদের রাখা হল হাসপাতালের একঘেয়ে বিমর্ষ শয্যায় অথবা উন্মাদ আশ্রমে। বিবর্তনের ধারায় ওরা এখন ‘সাইকিয়াট্রিক প্রবলেম’ খোলসে আবৃত। ফুকো বলছেন, সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীর পাগলাগারদগুলো ঠিক মেডিকেল-আশ্রম ছিল না, ছিল ‘ংবসর-লঁৎরফরপধষ’ প্রতিষ্ঠান। পাগল ছাড়াও বেকার, গরীব, নিঃস্ব, ফকির তথা যারা ছিল মেইনস্ট্রিম সমাজ থেকে বাইরে, তাদের আশ্রয় জুটতো সেখানে।
ফুকোর মতে, মেইনস্ট্রিম সমাজ থেকে বঞ্চিত হয় না- মাতালেরা। এই মাতলরা যদি বদ্ধউন্মাদের মতো বা তার চেয়ে বেশি উন্মাদনায় মেতে থাকে তারপরও তারা মেইনস্ট্রিম সমাজ থেকে বঞ্চিত হয় না। এক্ষেত্রে সমাজের সভ্যমানুষদের যুক্তি হল, তারা ‘মাতলামি করে’, পরদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে মেইনস্ট্রিম সমাজের একটা অংশ হয়ে যাবে, তারা অযৌক্তিক মানুষ না। কিন্তু পাগলরা নেশাগ্রস্থ না হয়েই বদ্ধ উম্মাদের মাতো আচরণ করে বলেই তাদের অবস্থান যুক্তির ঠিক বিপরীত, তাই তারা সমাজ বহির্ভূত, তাদের আচরণ সভ্যসমাজের নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। এটা কোন বিচার?
আমরা যারা সভ্য মানুষ, তারা কী বুঝতে চাই-না যে, নেশাগ্রস্থ না হয়েও কোনো একজন মানুষ রাস্তায় একপাশে দাঁড়িয়ে কিংবা চলতে চলতে ‘বিড়বিড়’ করে কথা বলছে অথবা রাস্তার মাঝে চিৎকার করে আবল-তাবল বকছে? না আমরা তা কখনোই বুঝতে চাই না। কারণ সমাজ তাদের খাস বাংলায় বলে ‘পাগল’। আর পাগল যা করে তা নিছক পাগলামি ছাড়া কিছুই না। আবার এই পাগলামি যখন বাড়াবাড়ি পর্যায়ে যায়, তখন ‘পাগলের মাথাখারাপ হয়েছে’ বলতে একটুও দেরি করি না। কারণ এই সভ্যসমাজ আমাদের এভাবেই শিখিয়েছে। ওরা অযৌক্তিক, ওরা অসম্ভব কল্পনা করে, ওদের কথাবার্তা অর্থহীন ইত্যাদি অভিযোগে অভিযুক্ত এই পাগলেরা এই সমাজ সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে অনেক আগেই। আবার এই সভ্যসমাজে কেউ যদি এই পাগলদের আচরণ বা পাগলামি নিয়ে মাতামাতি করে তাহলে তারও রেহাই নেই। পাগলের খাতায় তারও নাম সংযুক্ত হবে।
কিন্তু যে মানুষটি সমাজের অসংগতি বা পরিবার কর্তৃক আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে কিংবা সমাজের নানা অনৈতিক বা আতংকিত বিষয়ের প্রেক্ষিতে মনের মধ্যে যে ‘অন্যরকম অবস্থার’ বহিঃপ্রকাশ ঘটায় তাকে পাগল বলে আখ্যা না দিলে কি সমাজ-সভ্যতার খুব ক্ষতি হয়ে যেত? নাকি অন্য কিছু বিষয় লুকিয়ে আছে এখানে। যা এই সমাজ বা পরিবারের অপেক্ষাকৃত ক্ষমতাবানরা তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য ওইসব আতংকিত, আঘাতপ্রাপ্ত, অতিমাত্রায় যুক্তিশীল, প্রতিবাদী, বিপ্লবী, অনুসন্ধিৎসু মানুষদের পাগল বলে সমাজ বা পরিবার বিচ্ছিন্ন করার একটা ঐতিহাসিক ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার অংশ। আর এই ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার আর একটি অংশ মানসিক চিকিৎসা যা সমাজে বেশ শক্তপোক্ত অবস্থান করে নিয়েছে। সুতরাং তোমারা যারা পাগল, তারা চিকিৎসা নাও, তারপর যুক্তিবাদী হও। সমাজের যে নোংরা কাজটির কারণে তোমরা যারা আতংকিত হয়ে নিশ্চুপ সারারাত নির্ঘুম থেকে সারাক্ষণ উদাসীন হয়ে থাকো, তারা ভুলে যাও সমাজের ওই নোংরা বিষয়টিকে। আবার যারা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছ তারাও আঘাতের কারণ ভুলে যাও। যে অসামাজিক কাজটির প্রতিবাদ করতে গিয়ে যারা প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে রাস্তার মাঝে চিৎকার-চেঁচামেচি কর, তোমরা সেই অসামাজিক ঘটনাটি ভুলে যাও। এভাবে অতিমাত্রায় যুক্তিশীল যারা, তারা সব প্রশ্ন মন থেকে ভুলে যাও। ঔষধ খাও, চিকিৎসা নাও, তারপর সভ্যসমাজে ফিরে আসো।
কিন্তু যে পাগলটি রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে অদৃশ্য কাউকে উদ্দেশ্য করে কথা বলছে আনমনে, কিংবা রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে অদৃশ্য কোনোকিছুকে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করছে, সে পাগলটির এই অদৃশ্য ব্যক্তি বা বস্তুর রহস্য কী? যাকে বা যা সভ্যসমাজ দেখতে পারে না। না-কি সভ্যসমাজের অনেক অসভ্যতা, নোংরামি, গতানুগতিকতার বাইরে প্রতিটি পাগল তাদের মনের মধ্যে স্বতন্ত্রতা বজায় রেখে এক-একটি জগত তৈরি করেছে যা সাধারণ মানুষের বোধগম্য নয়।
ফুকো তাই উন্মাদ পাগলদের নির্বুদ্ধিতার নীরব ভাষাগুলোর বিজ্ঞানভিত্তিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক উৎস খুঁজেছেন। ফুকোর মতে, ইউরোপের সেইকালের অর্থনৈতিক অবস্থার উঠা-নামায় এই পাগলদের দুই রকম অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়। এক- অর্থনৈতিক মন্দাবস্থায় তাদের আশ্রমে ঠেলেঠুলে ‘বিশ্রামে’ রাখা; এবং দুই- কর্মক্ষম প্রোডাক্টিভ সময়ে তাদের কম পয়সায় কাজে লাগানো। সপ্তদশ শতাব্দীর ইউরোপে ‘অযৌক্তিক’ মানুষদের ‘আশ্রমে’ পুনর্বাসনের এই সময়টিকে ফুকো বলছেন ঞযব এৎবধঃ ঈড়হভরহবসবহঃ।
এই ঞযব এৎবধঃ ঈড়হভরহবসবহঃ এর সময়ই পাগলদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের আরেকটি ধাপ শুরু হয়। শুরু হয় ওদেরকে মানুষ হিসেবে গণ্য না করার পাঁয়তারা। মানবোচিত গুণাবলী হতে বিচ্যুতি ঘটানো। মানবোচিত বৈশিষ্ট্য হরণ। আগে যেটা ছিল মানুষের সহজাত-প্রবৃত্তির একটি দিক মাত্র, এখন সেটি যেন হয়ে উঠলো নিম্নস্তরের বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন জন্তু বিশেষের প্রকৃতি। পশু-প্রকৃতি। এখান থেকেই শুরু হয় প্রাথমিক মনোবিদ্যার একটি ধারা। শুরু হয় শ্রেণিকরণের সূত্রাবলীর। আবেগ-অনুভূতির তীব্র বহিঃপ্রকাশের উপর ভিত্তি করে নামকরণ করা হয় ম্যানিয়া, মেলানকোলিয়া, হিস্টিরিয়া, হাইপোক-্রয়িা ইত্যাদি লেবেলিং-ট্যাগিং। আধুনিকতার সূর্য উঠার সাথে সাথে এই ‘পাগলামি’ ক্রমান্বয়ে পরিণত হয় মনোবিদ্যার একটি অবজেক্ট হিসেবে। সর্বপ্রকার ধর্মীয় আর নৈতিকতার লেবাস ছাড়িয়ে এটাকে এখন পুরোপুরি চিকিৎসাবিদ্যার তত্ত্বাবধানে আনা হয়। ফুকো বলছেন, যেখানে পূর্ববর্তী সময়ে ‘অযৌক্তিকতা’ হয়তো ‘যুক্তিবাদীতা’র একটা ‘বিশেষ’ রূপ হিসেবেই বিদ্যমান ছিল, আধুনিক মনোবিদ্যা এখন পাগলদের নীরবতার উপর দাঁড়িয়ে তাদের জন্য নিবন্ধ রচনা করছে যেন। ফুকো যখন মানসিক অসুখের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিকটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তখন তিনি এটিকে ক্ষমতাসীনদের একটি রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেও ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
ফুকোর মতে, রেনেসাঁর সময় এই ‘পাগল-মানুষ’রাই যেন জগতের মানব-নাট্যশালা-রঙ্গমঞ্চের দুটো দিক তুলে ধরেছিল, একদিকে ছিল ওরা নিজেরা, আর আরেকদিকে ছিল ‘কাক্সিক্ষত’ সেই যুক্তিবাদ; কীভাবে কত সহজে বোঝা যেত, দাঁড়িপাল্লার কোন উৎকৃষ্ট দিকটিতে ‘সভ্য-মানুষ’ আছে? ফলে সভ্যজগতের মূল অর্থহীনতার একটা রূপ তৈরি হল, আর সেটা হল- যারা উন্মাদ তারা অসুস্থ আর আমরা সুস্থ, আমাদের (সভ্যদের) দলে তুমি (উন্মাদ) না, সুতরাং ডাক্তার দেখাও, যুক্তিবাদী হতে শেখো অথবা যুক্তির আলোয় তোমার উন্মাদনা ব্যাখ্যা কর।
ফুকো আরো বলেছেন, পাগলামিকে ইতিহাসের যুক্তিতে ফেলা যায় না। কারণ, তখন আর সেটা পাগলামি থাকে না। আর তাই পাগলামির ইতিহাস রচনা করতে পারবে একমাত্র পাগলই। এরাই পারবে অযৌক্তিক, অসামাজিক এবং ভাষা-বহির্ভূত বিষয়গুলো ধরতে এবং এতে কিছু উপলব্ধি ও অনুভূতি অবশ্যই পাওয়া যাবে।
লেখক: সংস্কৃতি কর্মী
10.02.2013
মিশেল ফুকো’র পাগলবন্দনা
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment