সিমোন দ্যা বুভোয়ার ♦ভাষান্তর: সুশান্ত বর্মন♦
দ্যা সেকেন্ড সেক্স বইটির প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল জুন মাসে। ’Woman’s Sexual Initiation’ এর উপরে লেখা চ্যাপ্টারটি Les temps Modernes পত্রিকায় প্রিন্ট হয় মে মাসে, জুন-জুলাই ইস্যুতে ধারাবাহিকভাবে ’The Lesbian’ এবং ’Maternity’ প্রকাশিত হয়। এর দ্বিতীয় খণ্ড Gallirnard প্রকাশ করে।
কীভাবে প্রথম বইটির জন্ম হল সেকথা আমি আগেই বলেছি। আসলে হঠাৎ করে হয়ে গেছে। নিজের সম্পর্কে বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বুঝতে পারলাম যে, এর আগে সাধারণভাবে নারীদের অবস্থা বর্ণনা করা দরকার। প্রথমে পুরুষরা তাদের জ্যোতির্বিদ্যা, ধর্ম, কুসংস্কার, বিভিন্ন ধারণা এবং সাহিত্যে নারীদের সম্পর্কে যা বলেছে সেই পৌরাণিক ধারণাগুলোকে নিয়েছি। যে বিষয়গুলো আমার কাছে একেবারে অস্পষ্ট ঠেকেছে, সেগুলোর এক ধারাবাহিক চিত্র তৈরির চেষ্টা করেছি। প্রত্যেক বিষয়ে পুরুষরা নিজেকে Subject হিসেবে সামনে রেখেছে আর মেয়েদেরকে object হিসেবে বিবেচনা করেছে। এই অনুমানটি অবশ্যই ঐতিহাসিক অবস্থার প্রেক্ষিতে ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। সার্ত্রে অবশ্য কিছু বাস্তব অবস্থাকে চিহ্নিত করার কথা আগেই বলেছিল। Ramatuelle তে যখন ছিলাম আমরা তখন সারাক্ষণ কথা বলছিলাম। আমি দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলাম, এত বড় কাজের সাথে যুক্ত থাকার কথা আমি কখনও কল্পনাও করিনি। কিন্তু এটাই সত্যি যে, সেইসব পৌরাণিক কাহিনীগুলো যা আড়াল করতে চাইতো, তার বাস্তব রূপ যদি জনগণ না জানতো তাহলে প্রচলিত গল্পকাহিনী বিষয়ে আমার পড়াশোনা মধ্য আকাশেই ঝুলে থাকত। এরপর আমি শরীরতত্ত্ব ও ইতিহাসের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আমি কোন তালিকা তৈরি করিনি, উভয় লিঙ্গের বিজ্ঞানীদের মধ্যে তুলনা করতে চাইনা, কিন্তু তাদেরকেও পুরুষতান্ত্রিক কুসংস্কার দ্বারা অনুপ্রাণিত থাকতে দেখেছিলাম। তাই আমি তাদের অনুবাদের তলানিতে যে সত্য লুকিয়ে আছে, তা খুঁড়ে দেখার চেষ্টা করেছি। ইতিহাসের পথ ভ্রমণ শেষে আমি খুব সামান্য কিছু আইডিয়া নিয়ে ফিরে এসেছি। এই আইডিয়াগুলো প্রকাশ্যে কখনও দেখিনি। আমি নারীর ইতিহাসকে এই বংশগতির সাথে সংযুক্ত করেছি। আমার কাছে এটাকে পুরুষের পৃথিবীর অর্থনৈতিক বিপ্লবের সহ-উৎপাদন হিসেবে মনে হয়েছে।
আমি নারীদের দিকে নতুন চোখে তাকাতে শুরু করলাম। আমার জন্য অপেক্ষারত বিস্ময়পুঞ্জগুলোকে খুঁজে পেলাম। হঠাৎ আবিষ্কারের উৎসাহ ও বৈচিত্র্য এতে আছে। ৪০ এর পরে অভাবনীয় পৃথিবী চোখেমুখে মিটমিট করে জ্বলতেছিল। আমার বইটা সম্পর্কে মানুষ সবচাইতে ভুল বুঝেছে যে আমি বোধহয় নারী-পুরুষের মধ্যে যে পার্থক্য সেটাকে অস্বীকার করেছি। অথচ এই বইটি লিখতে গিয়ে যে বিষয়টি নারী-পুরুষকে আলাদা করেছে, সে বিষয়ে আমি সচেতন হয়েছিলাম। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, এই অমিলগুলোর বেশিরভাগ সাংস্কৃতিক, প্রাকৃতিক নয়। শৈশব থেকে বৃদ্ধ হওয়া পর্যন্ত বিষয়গুলি কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে তা আমি নিয়মতাত্ত্বিকভাবে বিশ্লেষণ করা শুরু করলাম। এই পৃথিবী নারীদেরকে যে সম্ভাবনাগুলো উপহার দেয়, আমি তাদেরকে বিশ্লেষণ করেছিলাম। এগুলোকে যারা প্রত্যাখ্যান করে তাদেরকে, নারীদের জন্য বরাদ্দ সম্ভাবনাগুলোকে, তাদের সীমাবদ্ধতাকে, তাদের সৌভাগ্য এবং দুর্ভাগ্য, তাদের উপেক্ষা পদ্ধতি এবং তাদের অর্জন, সবকিছুকে আমি পরীক্ষা করে দেখেছি। এর সবগুলোকে আমি L’Expérience vécue এর দ্বিতীয় খণ্ডে রেখেছি।
আমি মাত্র দুই বৎসর এই কাজের জন্য ব্যয় করেছি [১] । এরমধ্যে সমাজবিজ্ঞান এবং মনোবিজ্ঞান সম্পর্কে সামান্য কিছু জ্ঞান অর্জন করেছি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া প্রশিক্ষণকে ধন্যবাদ। কার্যকরভাবে কাজ করা আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। কীভাবে বই সাজাতে হয়, কীভাবে সারবস্তু সংগ্রহ করতে হয়, কীভাবে কল্পচিত্রকে ঝেড়ে ফেলতে হয় তা আমি জেনেছিলাম। বিষয় সম্পর্কে ইংলিশ এবং ফ্রেঞ্চ ভাষাতে যা ছিল, তার একটি আকর্ষণীয় তালিকা আমি তৈরি করেছি। এই বিষয়টি প্রচুর সাহিত্যকর্মের জন্ম দিয়েছে, কিন্তু সাধারণ ঘটনা হল, এই বিশাল পাঠযজ্ঞের খুব অল্প পরিমাণই গুরুত্বপূর্ণ। যখন দ্বিতীয় ভল্যুমটির কাজ চলছিল, তখন সার্ত্রে এবং আমার নিরবচ্ছিন্ন কৌতূহল থেকে খুব উপকার পাচ্ছিলাম। আমরা অনেক বৎসর ধরে সব ধরণের মানুষ সম্পর্কে কৌতূহল বোধ করেছিলাম। আমার স্মৃতিশক্তিও আমাকে অনেক বেশি তথ্য দিয়েছে।
প্রথম ভল্যুমটি ভালোভাবেই গৃহীত হয়েছিল। ২২ হাজার কপি প্রথম সপ্তাহে বিক্রি হয়ে গেছে। দ্বিতীয়টাও ভাল বিক্রি হয়েছে, কিন্তু এটা মানুষকে নাড়া দিয়েছে। যখন বই থেকে নেয়া কিছু অংশ Les Temps Modernes পত্রিকায় প্রকাশিত হল, তখন যে পরিমাণ অনাবশ্যক ও বাড়াবাড়ি রকমের ক্রুতার সৃষ্টি হয়েছিল তা দেখে আমি হতচকিত হয়ে গিয়েছিলাম। জুলিয়ান গ্রেক এক নিবন্ধে রীতিমত উল্লেখ করেছিলেন। তিনি আমার মনোবলের জন্য আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তিনি অবশ্য সমাধি নিয়ে কথা বলার জন্য আমাকে দার্শনিক গণিতবিদ Poincare এর সাথে তুলনাও করেছেন। এই ধরণের ফ্রান্সীয় অশালীনতার কোন প্রতিশোধ নিতে আমি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছি। শব্দটি যেভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, তা আমাকে প্রথমবারের মত হতবাক করেছে। করুণায় ভরা শ্রদ্ধা মিশিয়ে Claudine Chonez আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি কি আত্মবিশ্বাসী?’ আমি বলেছিলাম, ‘আত্মবিশ্বাসী!’ তারপর তিনি আবার বললেন, ‘তুমি অনেক বন্ধু হারাতে যাচ্ছ।’ আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, আমি চিন্তা করলাম, যদি আমি তাদেরকে হারাই, তাহলে তারা আমার বন্ধু নয়।’ আমি যেভাবে লিখতে চেয়েছি, যে কোন মূল্যে ঠিক সেভাবেই বইটি লিখেছি। কিন্তু কখনও হিরো হবার কোন বাসনা আমার ছিল না। যাদের আমি ভালো চিনি, সেই মানুষগুলো, সার্ত্রে, Bost, Merleau-Ponty, Leiris, Giacometti এবং Les Temps Modernes পত্রিকার কর্মীরা ঠিক এই বিষয়ে অন্যদের চাইতে অনেক বেশি গণতান্ত্রিক। যদি আমি তাদের জন্য লিখতে থাকতাম, তাহলে হয়তো একটি খোলা দরজা ভেঙে ফেলার বিপদে পড়ে যেতাম। যে কোন উপায়েই হোক না কেন আমাকে ঠিক সেই দোষেই দোষী করা হচ্ছিল। নানা কিছু আবিষ্কার, ব্যঙ্গ করা, বকবক করা সবকিছু চলছিল। আমাকে অনেক বিষয়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে, সবকিছু সম্পর্কে। প্রথমত: এর সবগুলোই অশালীন, জুন জুলাই এবং আগস্ট সংখ্যার Les Temps Modernes হটকেকের মতো বিক্রি হয়েছে। সেগুলো কিন্তু পড়া হয়েছে, যেভাবে ছিল, ঘোলাটে চোখে। কেউ হয়তো বিশ্বাস করতে পারে যে ফ্রয়েড এবং মনোবিশ্লেষকদের কখনও কোন অস্তিত্ব ছিল না। আমার কারণে আমাকে আঘাত করার জন্য লিখিত রচনাগুলো মূলত অশ্লীল আচরণের নগ্ন উৎসব মাত্র। সেই পুরনো মনোভঙ্গি অতিদ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল। আমি স্বনামে বেনামে লেখা বেশ কিছু শ্লেষাত্মক কবিতা, ব্যঙ্গকৌতুক, পরামর্শ এবং উপদেশ দেয়া চিঠি পেয়েছি। উদাহরণস্বরূপ প্রথম লিঙ্গের একজন সক্রিয় সদস্য অতৃপ্ত, কামশীতলময় মহিলা, Priapic যৌন তাড়িত নারী, সমকামী, শতবার বাতিল হওয়া, আমি সবকিছু এমনকি অবিবাহিত মাতা। মানুষ আমার কামশীতলতা দূর করে দেয়ার অথবা আমার যৌনক্ষুধাকে আরও বেশি জাগিয়ে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। গুপ্ততথ্য ফাঁস করে দেয়ার জন্য আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম। এক অমার্জিত, স্থূল পদ্ধতিতে, কিন্তু সত্য, ভালো এবং সৌন্দর্যের নামে, সুস্বাস্থ্যের নামে এমনকি কবিতার নামেও। সব মূল্যহীন জিনিসগুলোকে আমি পায়ের তলে পিষে ফেলেছি। এসব আসলে টয়লেটের দেয়ালের একঘেয়ে লেখাগুলোর মত। আমি বুঝতে পারি যে যৌনবাতিকগ্রস্থরা বৈচিত্র্যের জন্য তাদের কীর্তিকে আমার কাছেই পাঠাতে চায়। কিন্তু আমি Mauriac এর কাজে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। Les Temps Modernes পত্রিকার জনৈক কর্মীর কাছে তিনি লিখেছিলেন: আমার কাছে আপনার কর্মচারীর যৌনঅঙ্গাবলীর আর কোন গোপনীয়তা নেই। এ থেকে বোঝা যায় যে ব্যক্তিগত জীবনেও শব্দ নিয়ে তিনি সতর্ক নন। যখন তিনি শব্দগুলো মুদ্রিত দেখলেন, তখন এত বেশি উত্তেজিত হলেন যে Le Figaro litteraire পত্রিকায় সাধারণভাবে পর্নোগ্রাফি এবং বিশেষ করে আমার প্রবন্ধগুলোকে দোষ দেয়ার জন্য ফ্রান্সের যুবসমাজকে প্রায়ই পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। এর সাফল্য কম ছিল। Pauillon এবং Cau আমাকে রক্ষার জন্য উড়ে এসেছিল। তাদের প্রত্যুত্তরগুলি দমননীতির শিকার হয়েছিল এবং সম্ভবত এরকম আরো অনেকের ক্ষেত্রেও হয়েছিল। আমার স্বপক্ষ ছিল। অন্যদের মধ্যে Domenach খ্রিষ্টানদের কুপিত হওয়া খুবই মার্জিত ছিল এবং সামগ্রিকভাবে বললে তরুণরা আমার অতিরিক্ত বাক্যগুলোকে খুব একটা অবাঞ্ছিত ভাবেনি। ঠিক তখন তিনি তার ধারাবাহিক রচনা বন্ধ করতে যাচ্ছিলেন। তখন এক অপ্সরীর মত রূপবতী এক নারী তাকে একটি চিঠি দিল। তার (Domenach) প্রত্যেকটি আকাক্সক্ষাকে তিনি এত নিখুঁতভাবে বিশ্লেষণ করে স্বীকৃতি দিয়েছেন যে আমরা অনেকে এই ঘটনায় খুব আমোদিত হয়েছিলাম। Maurine সত্যিই একটি ভাল জিনিস পেয়েছেন। তা সত্ত্বেও রেস্টুরেন্ট এবং ক্যাফেতে- যা আমি Algren এর জন্য বেশি বেশি যাই- জনগণ আমার দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে অথবা সরাসরি আমাকে দেখিয়ে ব্যাঙ্গের হাসি হাসত। Boulevard Montparnasse এর Nos এলাকায় একদিন রাতের খাবারের সময় কাছের টেবিলের লোকজন আমাকে দেখে হাসাহাসি শুরু করল। আমি টানাহেঁচড়া পছন্দ করি না, Algren ঘটনার সময় সাথে ছিল, যখন চলে আসার সময়, আমার মনের এক টুকরো তাদেরকে দিয়ে এলাম।
হিংস্রতার তীব্রতা এবং প্রতিক্রিয়ার মাত্রা দেখে আমি হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিলাম। ল্যাটিন মানুষদের মধ্যে ক্যাথলিক মতবাদ পুরুষালী নিষ্ঠুরতাকে উৎসাহিত করে এবং এমনকি ধর্ষকামীতার দিকে ঠেলে দেয়। ইটালির মানুষদের মধ্যে এর সাথে রূঢ়তাকে যোগ করার প্রবণতা আছে এবং স্প্যানিয়ার্ডরা যোগ করে ঔদ্ধত্য। কিন্তু এই ধরণের নোংরা মানসিকতা ফ্রেঞ্চদের একেবারে নিজস্ব। কেন? নারীবাদী প্রতিযোগিতাকে ফ্রান্সের একজন পুরুষ প্রাথমিকভাবে অর্থনৈতিক হুমকি বলে মনে করে অথবা রাষ্ট্রীয় আইনের মাধ্যমে নিশ্চয়তা দেয়া হয়না এমন এক শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখা জাহির করে। নোংরা কথা বলার প্রথা বিভিন্ন প্রবচন, প্রতিচিত্র, ক্ষুদ্র কাহিনী এবং শব্দভাণ্ডারেও রয়েছে। এই জাতীয় প্রথা নারীদের যৌনবস্তু মনে করার ধারণায় অনেক রসদ যোগায়। অবশ্য যৌনপ্রবৃত্তির ক্ষেত্রে ফ্রেন্স শ্রেষ্ঠত্বের বংশানুক্রমিক ধারণাটিও হুমকির মুখে পড়েছিল। ইদানীং ফ্রেঞ্চ পুরুষের চাইতে ইটালির পুরুষদেরকেই আদর্শ প্রেমিক মনে করা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত মুক্ত নারীকে সমালোচনার উদ্দেশ্য তাদের সঙ্গীকে আঘাত অথবা ক্লান্ত করে, এটা তাদেরকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। এই অর্থহীনতা হল শুধু ফ্রান্সের পুরনো কামজ্বরে আক্রান্ত হওয়া মানসিক আঘাত দিতে ও থু থু ছিটাতে সক্ষম পুরুষ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হওয়া। [২]
গত নভেম্বরে তরবারিগুলো আবার একবার কোষমুক্ত হয়েছিল। সমালোচনা পাশবিকতায় পরিণত হয়েছিল। মহিলারা সবসময় পুরুষের সমান ছিল, তাদেরকে চিরকালের জন্য হীনমন্যতার আড়ালে ঠেলে দেয়া হয়েছিল, আমি যা কিছু বলেছি সবই সাধারণ জ্ঞান- এই বিষয়ে মতভেদের কোন অবকাশ নেই, সমস্ত বইতে একটাও সত্যি কথা নেই। Liberte’ de l’esprit -এ Boideffre এবং Nimier দুজনই ঘৃণা প্রকাশে আরো সাফল্য প্রকাশ করেছিল। আমি অসহায় মানসিক রোগী, আমি অবদমিত, হতাশ এবং জীবন দ্বারা প্রতারিত, খান্ডারনি, এমন এক মহিলা যে ঠিকমতো ভালোবাসতে পারেনি, পরশ্রীকাতর, তিক্ততাপূর্ণ এবং পুরুষদের সম্মানের প্রেক্ষিতে হীনমন্যতাবোধে ফেটে পড়ছিলাম; পুরুষদের প্রতি আমার বিদ্বেষ এত বেশি যে আমি যেন নিজের মাংস নিজে কামড়াচ্ছিলাম। [৩] খুব খ্রিস্টানি করুণা নিয়ে Jean Guitton লিখেছেন যে, দ্যা সেকেন্ড সেক্স তাকে খুব বেদনার সাথে আঘাত করেছে কারণ যে কেউ আমার দুঃখের জীবন নামক অংশটির ভিতর দিয়ে সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পাবে। Armand Hoog নিজেকে আরো ভালোভাবে মেলে ধরেছেন- মেয়ে হওয়ার জন্য অবদমিত হওয়া, পুরুষের চোখে মেয়ে হিসেবে তার বন্দীদশার জন্য সচেতন সন্তাপ, তিনি (সিমোঁ দা বুভোয়ার) পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং নিজের অবস্থা দুটোকেই প্রত্যাখ্যান করেছেন।
আমাকে অবমাননা করার এই নতুন রীতি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সমালোচকের দ্বারা সাদরে গৃহীত হল; নিজেদের পুরুষালি আত্মঅহংকার দ্বারা তারা এত বেশি সরাসরি অনুপ্রাণিত ছিল যে আমার অবস্থা আমার কাছে যে কখনও গুরুভার ছিল না তা তারা কল্পনাও করতে পারতো না। অন্যদের উপরে যাদের স্থান দিয়েছি, সেই পুরুষরা কখনও আমাকে পুরুষের চাইতে হীন কিছু ভাবেনি। আমার অনেক পুরুষবন্ধু আছে যাদের দৃষ্টিভঙ্গি সীমানার মাঝে আমাকে বন্দী করার মনোভঙ্গি থেকে অনেক দূরে, মানুষ হিসেবে আমার নিজের অধিকারগুলোকে স্বীকার করে। এই ধরণের সৌভাগ্য আমাকে সব অপমান ও তিক্ততা থেকে রক্ষা করে; আমার পাঠকরা জানবেন যে শৈশব কিংবা কৈশোরে আমি কখনও এই ধরণের অনুভূতি দ্বারা আক্রান্ত হইনি। [৪] ভিন্নধারার (Subalter) পাঠকরা যখন নারীদের সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার ভান করছিল, তখন তারা আমাকে Misogynist আখ্যা দিয়ে উপসংহার টেনেছিল, আমি তাদের নিন্দা করেছিলাম; একথা সত্যি নয়। আমি তাদেরকে আকাশে তুলে ধরতে পারিনা এবং তাদের অবস্থার দ্বারা সৃষ্ট সব সমস্যার ব্যবচ্ছেদ আমি করেছি, কিন্তু আমি তাদের মেধা ও ভালো গুণগুলোই দেখিয়েছিলাম। নিজেকে সম্মানীয় পুরুষ হিসেবে বিবেচনা করার মাধ্যমে আমি তাদেরকে প্রতারিত করার জন্য অনেক বেশি মহিলাকে পথনির্দেশ ও প্রণোদনা দিয়েছিলাম; তাদের দেয়া উপহার আমাকে কখনও কোন আঘাতও দেয়নি। আসলে দ্যা সেকেন্ড সেক্স এর আগে আমি কখনো শ্লেষোক্তির লক্ষ্যবস্তু হিসেবে চিহ্নিত ছিলাম না; এর আগে মানুষরা হয় দয়ালু অথবা ভিন্নরকম ছিল। শেষের দিকে আমি প্রায়ই নারী হিসেবে আক্রমণের শিকার হতাম, কারণ আমার আক্রমণকারীরা মনে করতো এটাই আমার প্রধান দুর্বলতা। কিন্তু আমি ভালো জানি যে, এই সব অযৌক্তিক স্থবিরতার লক্ষ্য আমার নৈতিক ও সমাজ কথিত দোষসমূহ। না; আমার নারীত্ব সম্পর্কিত ভোগান্তি থেকে অনেক দূরে; ভিন্নভাবে বললে বলা যায় বিশ বছর বয়স থেকেই দুই লিঙ্গের সুবিধাগুলো জানা ছিল; L’Invitee এর পরে, আমার চারপাশের সবকিছু, আমাকে এই পুরুষের পৃথিবীতে তাদের সমকক্ষ, একজন লেখক হিসেবে, এবং মহিলা হিসেবে মনে করা শুরু করল, এই বিষয়টা আমেরিকাতে নির্দিষ্টভাবে লক্ষ্য করা গেছে। এক পার্টিতে আমি গিয়েছিলাম। গিন্নীরা সকলে একসঙ্গে ছিল এবং আমি যখন পুরুষদের সাথে কথা বলছিলাম তখনও তারা নিজেদের মধ্যেই বাক্যালাপ সারছিল। তারা নিজের লিঙ্গের সদস্যদের প্রতি যতটা আন্তরিক ছিল, ততোটা কৃতজ্ঞতাসুলভ আচরণ আমার সাথে করছিল না। এই ধরণের বিশেষ অধিকারভোগী অবস্থানের কারণে আমি মহার্ঘরূপে দ্যা সেকেন্ড সেক্স লিখতে উৎসাহিত হয়েছিলাম। আমি প্রশান্তির সাথে নিজেকে মেলে ধরেছিলাম। তাদের প্রস্তাবসমূহের বিরোধিতা করা, এটাই নির্দিষ্টভাবে সেই নির্বিকারত্ব যা আমার পুরুষ পাঠকদেরকে উত্তেজিত করে তুলেছিল। যখন আমার প্রতিবাদ, আপত্তিকে তারা ক্ষমা করতে পারতো না, একে অবিশ্বাসের ভান করতো তখন তারা নিজেদের উচ্চাসন থেকে নেমে আসার সহƒদয়তা এবং অবস্থানগত পরিবর্তনকে প্রকাশ করতে পারতো। কিন্তু প্রকাশিত হল এক দুর্বার ক্রোধের হুংকার এবং ক্ষতবিক্ষত হƒদয়ের প্রতিবাদ। প্রথম লিঙ্গের ঔদ্ধত্যকে উপযুক্তভাবে চিত্রিত করেছে এমন একটি শব্দবন্ধ আমি Claude Mauriac এর থেকে উদাহরণরূপে নেব। সে আমার বিরুদ্ধে কী খুঁজে পেয়েছে?”- সে জানতে চেয়েছিল। কিছুই না; যা আমি উল্লেখ করে যাচ্ছি শুধুমাত্র সেই শব্দগুলি ছাড়া কোনকিছুর বিরুদ্ধে আমার কিছু নেই। এটা অবাক ব্যাপার যে অনেক পণ্ডিত বুদ্ধিবৃত্তিক শখ বিষয়টিকে বিশ্বাস করেন না। [৫]
আমি এমনকি কয়েকজন পুরুষ বন্ধুর মাঝেও ঝড় তুলে দিয়েছি। তাদের মধ্যে এক অগ্রসর একাডেমিক, আমার বই পড়া বন্ধ করে দিলেন এবং রুমের একপাশে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। কামুরা, একজন ফ্রেঞ্চ পুরুষকে হাস্যস্পদ করে তোলার জন্য গোমড়া মুখে আমাকে অভিযুক্ত করেছিল। স্প্যানীয় সংস্কৃতি নিয়ে গর্বিত এক ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের মানুষের কথা বলি- তিনি নারীকে সমান অধিকার দেবেন, যদি তারা নিজের মধ্যেই এক অন্য কল্পরাজ্যে সীমাবদ্ধ থাকেন, এবং জর্জ অরওয়েল যেমন দুইজনের মধ্যে অধিক সমতার কথা বলতেন, তিনি আসলে সেরকম বোঝাতেন। তিনি হাসিমুখে একবার আমার কাছে স্বীকার করেছেন যে তিনি নির্দিষ্ট মাপমতো হওয়া এবং মহিলাদের দ্বারা বিচার্য হওয়া পছন্দ করেন না; নারীরা হল বিষয় এবং পুরুষরা হল দৃষ্টি এবং সচেতনতা। সে এটা নিয়ে খুব হাসাহাসি করছিল, কিন্তু পারস্পরিকতাকে সমর্থন করেনি। সবশেষে হঠাৎ আবেগপ্রবণ হয়ে সে বলল- শুধু একটি যুক্তিকে তোমার গুরুত্ব দেয়া উচিত; পুরুষ নিজে মহিলাদের মধ্যে সত্যিকারের সাহচর্য খুঁজে পাওয়ার অভাবে ভুগছে। সমতার জন্য তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা আছে। সে নিরেট যুক্তিবিন্যাসের চাইতে হৃদয়দিয়ে আর্তনাদ করতে চেয়েছিল এবং আরও যা আছে তা হল পুরুষের জন্য কান্না। আমি নারীদের কামশীতলতা নিয়ে যে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছি, তাকে বেশিরভাগ পুরুষ ব্যক্তিগত বিদ্রূপ বলে গ্রহণ করেছে। তারা (পুরুষরা) কল্পনাও করতে চায় যে, যখন খুশি যে কাউকে তারা তৃপ্ত করতে পারে; এই ধরণের সামর্থ্যকে সন্দেহ করা তাদেরকে নপুংসকরণের মত।
যে অধিকারকে রোম স্বাভাবিক হিসেবে কালো তালিকাভুক্ত করেছে, শুধু তার জন্য আমার বইকে ঘৃণা করা যেতে পারে। চরম বামপন্থীরা একে ভালোভাবে গ্রহণ করবে বলে আমি আশা করেছিলাম। কমিউনিস্টদের সাথে আমাদের সম্পর্ক খারাপের দিকে যেতে পারে না; সবাই সমান; আমার গবেষণা মার্ক্সিয় মতবাদকে এত বেশি বহন করে এবং তাকে এক বিশেষ সমর্থনসূচক আলোতে আলোকিত করেছে যে, আমি সামান্য কিছু পক্ষপাতহীনতা তাদের কাছে আশা করেছিলাম। দ্যা সেকেন্ড সেক্স বইটি Billancourt এর কারখানাকর্মী মেয়েদেরকে হয়তো হাসাতে পারবে বলে Les Lettres francaises পত্রিকায় Marie-Louise Barron – নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করেছেন। এটা Colette Audry এর কারখানার নারী শ্রমিকদেরকে খাটো চোখে দেখার সামিল বলে Colette Audry এক সমালোচনার পুনর্বিবেচনাতে মন্তব্য করেছেন। অমার্জিত, স্থূল, আবেগে দৃঢ়ভাবে আলিঙ্গনাবদ্ধ এক মহিলার ছবি স্পষ্টভাবে চিত্রিত হয়েছে এমন এক বেনামা নিম্নরুচির প্রবন্ধের সাথে এই মহিলা সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।
অস্টালিনীয় মার্ক্সবাদীরা বড়জোর একটু বেশি স্বস্তিদায়ক। আমি Ecole Emancipee -তে দেয়া একটি বক্তৃতায় বলেছিলাম যে যখন বিপ্লব একেবারে সম্পন্ন হবে, তখন নারীদের সমস্যা আর থাকবে না। দারুণ, আমি তাই বলেছিলাম; কিন্তু এরপর? এখন এটা পরিষ্কার যে, তাদের জন্য আমার আর কোন আগ্রহ অবশিষ্ট নেই।
আমার বইয়ের আলোচ্য বিষয়গুলো সম্পর্কে আমার প্রতিপক্ষ অসংখ্য ভুল ব্যাখ্যা তৈরি এবং লালন করেছে। সবগুলোর মধ্যে মাতৃত্ব নামক চ্যাপ্টারটির জন্য আমি বেশি আক্রমণের মুখোমুখি হয়েছি। সন্তান জন্ম দেইনি বলে নারী বিষয়ে কোন আলোচনা করার অধিকার নেই বলে বেশিরভাগ পুরুষ ঘোষণা করেছে; এবং তারা? [৬] তবুও তারা আমার বিরুদ্ধে ভিন্ন ধারণা প্রকাশ করে যাচ্ছিল। এমন বলা হচ্ছিল যে আমি মাতৃত্বের সহজাত প্রবৃত্তি ভালোবাসার প্রতি কোনরকম মূল্যবোধ মানতে অস্বীকার করেছি। বিষয়টা এরকম নয়। যেহেতু মেয়েরা নিজেকে ক্ষমা ও করুণাপ্রার্থী হিসেবে ব্যবহার করে সেহেতু আমি তাদেরকে শুধু নিজেকে স্বাধীনভাবে এবং সত্যি করে অনুভব করতে বলেছি; যখন আবেগগুলো হƒদয়ের মধ্যে শুকিয়ে যায় তখন যেন নিজেকে প্রাপ্ত আশ্রয়ে বন্দী মনে না করে। নির্বিচার যৌনতার প্রচারক হিসেবে আমাকে অভিযুক্ত করা হয়; কিন্তু কোন পয়েন্টে কখনো আমি কাউকে কি যে কারো সাথে যে কোন সময় বিছানায় যাবার উপদেশ দিয়েছি? এই বিষয়ে আমার মতামত হল যে পছন্দ, আস্থা এবং প্রত্যাখ্যান সবকিছু হতে হবে প্রতিষ্ঠান, সংগঠন এবং আত্মগৌরব প্রবণতা ইত্যাদির প্রভাব থেকে মুক্ত থেকে। এর কারণ যদি আচরণের সাথে সমান্তরাল না থাকে তাহলে পরিশেষে থাকবে মিথ্যা, বিকৃতি এবং পঙ্গুত্ব। গর্ভপাতের সমস্যা নিয়ে একটি চ্যাপ্টার আমি লিখেছি; সার্ত্রে বিষয়টি নিয়ে The Age of Reason নিবন্ধে এর মধ্যে লিখে ফেলেছে এবং আমি নিজে The Blood and Others এ লিখেছি। Les Temps Modernes এর অফিস সেক্রেটারি মাদাম সারবেটস এর কাছে লোকজন প্রায়ই ঠিকানার জন্য ছুটে আসতো। সে এত বেশি বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল যে একদিন নিজেই একটা পোস্টারের ডিজাইন করে ফেলল:
"আমরা এটা প্রাঙ্গণেই করি, শুধু নিজেদের"
একদিন সকালে আমি ঘুমন্ত ছিলাম, এই সময় এক তরুণ দরজায় নক করা শুরু করল। সে উত্তেজিতভাবে বলছিল- আমার স্ত্রী গর্ভবতী, আমাকে একটি ঠিকানা দিন, তাকে বললাম যে- আমি কোন ঠিকানা জানিনা। কেউ কাউকে সাহায্য করে না- বলে আমাকে বকা দিতে দিতে সে চলে গেল। আমি কোন ঠিকানা জানতাম না। আমার বড়জোর জন্মগতভাবে আত্মনিয়ন্ত্রণহীন আগন্তুকের সামনে আত্মবিশ্বাসী থাকার মতো বিনয়ী হওয়া উচিত। এই সমাজ মহিলা ও দম্পতিদেরকে গোপনীয়তার আড়ালে ঠেলে দিচ্ছে। যদি আমি তাদেরকে কোনভাবে সাহায্য করতে পারি, তাহলে তা করতে আমি বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করবোনা। কিন্তু নিজেকে পেশাদার দূতিয়ালি হিসেবে মনে করে আমি কোন স্বস্তি পাইনি। কিছু পুরুষ যেমন: Francis Jeanson, Nadeau, Mounier প্রমুখ দ্যা সেকেন্ড সেক্স এর পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। এটা জনগণের মতান্তর ও বক্তৃতাবাজীকে উসকে দিয়েছিল। ভুলপাঠ এবং ভুলবোঝা দুটোই মানুষের মনের মধ্যে সমস্যা সৃষ্টি করে। যখন সবকিছু বলা এবং করা হয়ে যাবে, তখন আমি যা কিছু লিখেছি তার মধ্যে এই বইটি আমাকে অশেষ তৃপ্তি দেবে। যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, আজকে আপনি এটা নিয়ে কি ভাবছেন, তাহলে উত্তর দিতে আমার দ্বিধাবোধ হবে না; আমার সবকিছু এর জন্য।
ওহ আমি স্বীকার করি, যে কেউ রচনাশৈলী ও সাজানোর ধরণ নিয়ে সমালোচনা করতে পারে। আমি পিছিয়ে গিয়ে নতুন করে আরও পরিমার্জনা করতে পারতাম। কিন্তু এ সময়ে আমি আমার যে আইডিয়াগুলোকে ব্যাখ্যা করেছি সেগুলো উদ্ভাবন করছিলাম, এটাই আমি ভাল করতে পারতাম। এখন মনে হয় প্রথম খ-ে থাকা উপাদানের জন্য এখন আমার আরও বেশি বস্তুবাদী অবস্থান গ্রহণ করা উচিত। নারীধারণার স্বাতন্ত্র এবং মণিবাদী বিতর্ককে (Manichaean argument)- যা শুধু একটি আদর্শবাদী এবং ধর্মনেতা প্রভাবিত সচেতনতার জন্য চাপিয়ে দেয়া লড়াই তা নয়, চাহিদা এবং যোগানের সাথেও সম্পর্কিত- আমার ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা উচিত। যখন আমি প্রাচীন চীনে মেয়েদের অবদমন বিষয়ে The Long March পত্রিকায় লিখছিলাম তখন একই সমস্যাকে এই পদ্ধতিতে প্রতিরোধ করেছিলাম। আমার যুক্তিবিন্যাসের উন্নয়নে এই সংশোধন ততোটা প্রয়োজনীয় হবে না। সামগ্রিকভাবে আমি যা বলেছি, তার স্বপক্ষে এখনও আমি আছি। নারীদের অবস্থা পরিবর্তনের কোন অতিকল্পনা আমি গোপনে লালন করি না। এটা ভবিষ্যতের পৃথিবীতে শ্রমের উপর নির্ভর করবে। শুধুমাত্র বিপুল উৎপাদনের মূল্যের উপর নির্ভর করে এর বিশেষ পরিবর্তন ঘটবে। এজন্য নারীবাদ এর ফাঁদে পড়ে যাওয়াটা আমি এড়িয়ে চলি। যেমন বর্ণনা করেছি তেমন কোন নির্দিষ্ট সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান আমি প্রস্তাব করিনা। কিন্তু আমি অন্তত আমার সময় এবং প্রজন্মের নারীদেরকে তাদের আত্মবোধ এবং নিজের সমস্যা সম্পর্কে সচেতন হতে সাহায্য করেছি। অবশ্যই এদের মধ্যে অনেকে আমার বইয়ের বক্তব্যকে মেনে নেননি। আমি তাদেরকে বিরক্ত করেছি অথবা বিরোধীতা করেছি অথবা তাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটিয়েছি অথবা তাদেরকে আতংকিত করেছি। কিন্তু আরও অনেকে আছেন যারা আমার সেবা পেয়েছেন। বিশেষ করে যে চিঠিগুলো বারো বৎসর পরেও এখন পর্যন্ত পেয়ে আসছি সেগুলোর অসংখ্য অভিনন্দন থেকে আমি এই বিষয়ে জেনেছি। যে রূপকথা তাদেরকে ছিন্নভিন্ন করে, নিজেদের যে প্রতিচিত্র নিজের মনে ঘৃণার সঞ্চার করে তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এই মহিলারা আমার কাজকে সহায়ক হিসেবে পেয়েছে। তারা বুঝতে পেরেছে যে, সমস্যাগুলো শুধুমাত্র তাদের একক অপমান নয় এই অবস্থা সাধারণভাবে সবার। এই আবিষ্কার আত্ম-অবজ্ঞার ভুলকে পরিহার করতে তাদের সাহায্য করেছে এবং এদের মধ্যে অনেকে পরিস্থিতির বিরুদ্ধে লড়াই করবার শক্তি বইটিতে খুঁজে পেয়েছেন। আত্মজ্ঞান সুখানুভূতির নিশ্চয়তা দেয়না, কিন্তু এটা সুখানুভূতির পক্ষে থাকে এবং এর জন্য লড়াই করার প্রেরণা যোগায়। মনোবিজ্ঞানীরা আমাকে বলেছেন যে তারা তাদের নারী রোগীদেরকে দ্যা সেকেন্ড সেক্স বইটা পড়ার জন্য দিয়েছেন। শুধু বুদ্ধিজীবী নারীদেরকে নয়, নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নারী, অফিস কর্মী, কারখানা শ্রমিক সবাইকে একই পরামর্শ দিয়েছেন। তোমার বই আমাকে বিরাট সাহায্য করেছে, তোমার বই আমাকে বাঁচিয়েছে এই ধরণের বাক্য আমি জীবনের সকল স্তরের সকল বয়সের নারীদের লেখা চিঠিতে পেয়েছি।
যদি আমার বই মহিলাদেরকে সাহায্য করে থাকে, তাহলে এর কারণ হল এটা তাদেরকে উন্মোচিত করেছে। তারা তাদের পক্ষ থেকে বইটিকে এর স্বীকৃতি দিয়েছে। তাদেরকে ধন্যবাদ, দুর্নাম এবং সতর্কতার বিষয় এটা আর নয়। গত দশ বছরে পুরুষদের তৈরি উপকথা ভেঙে পড়েছে। অনেক নারী লেখক আমাকে পেরিয়ে এত দূর চলে গেছে যা আমার সাহসে কুলায়নি। আমার মতে তাদের অনেকে যৌনতাকে তাদের প্রধান বিষয় হিসেবে নিয়েছে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত যখন এই বিষয়ে লিখেছে, তখন তারা নিজেদেরকে দৃষ্টিমান, আলোচ্য, সচেতন এবং মুক্ত হিসেবে উপস্থাপন করেছে।
আমি বিস্মিত এবং এমনকি বিরক্ত হতে পারতাম, যখন ৩০ বৎসর বয়সে কোন একজন আমাকে বলেছিল যে আমার মেয়েলি সমস্যাগুলো নিয়ে চিন্তা করা উচিত এবং আমার প্রকাশ্য পরিচিতি থাকা উচিত নারী প্রসঙ্গেই। এমন হবার কারণে আমি অনুতপ্ত হব না। পৃথিবীতে মেয়েরা বিভক্ত, জর্জরিত; ফলে তারা অনগ্রসরতার জালে বন্দি। মেয়েদেরকে আরও অনেক বিজয় জিততে হবে, আরও অনেক পুরস্কার অর্জন করতে হবে, পুরুষদের যত আছে, তার চেয়েও বেশি পরাজয় মেনে নিতে হবে। আমার এতে আগ্রহ আছে এবং এর মধ্য দিয়ে পৃথিবীজুড়ে সীমিত কিন্তু বাস্তব প্রভাব ফেলে আমি সার্বজনীনতায় উত্তীর্ণ হতে চাই।
ফুটনোট:
১। এটা ১৯৪৬ এর অক্টোবরে শুরু হয়ে শেষ হয়েছিল ১৯৪৯ সালের জুন মাসে। কিন্তু আমি ১৯৪৭ এ আমেরিকাতে চার মাস কাটিয়েছিলাম, আর "America Day by Day " বইটি আমাকে আরও ছয় মাস ব্যস্ত রেখেছিল।
২। আমেরিকান পুরুষদের মধ্যে নারীদের প্রতি এক ঘৃণা ছিল। কিন্তু এমনকি সবচাইতে বিষাক্ত লেখা যেমন Philip Wylie এর A Generation of Vipers অশ্লীলতার মাত্রায় নামেনি; তাদের দৃষ্টিভঙ্গি নারীর যৌনতাকে খাটো করে দেখার মতো নয়।
৩। যখন Christiane Rochefort Gi Warrior’s Rest দশ বৎসর বাদে প্রকাশিত হল, তখন কম স্ক্যান্ডাল ছড়িয়েছিল, কিন্তু সেই পুরনো গান: সে (She) একজন কুৎসিত এবং হতাশাগ্রস্ত নারী গাওয়ার জন্য অনেক পুরুষালি নিন্দা প্রস্তুত ছিল।
৪। আমি বিভিন্নরকম নোংরা অসভ্য ক্রোধ, তাচ্ছিল্য এবং অন্য যত নিন্দামূলক আবেগের মুখোমুখি হয়েছিলাম। তারা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত দিয়ে প্রায়ই বিচার করত এবং কেউ কেউ বিশেষভাবে মনে করতো যে সেইসব ঘটনার অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে আমি কিছু কিছু জিনিস পাইনি। আমাকে তারা যেভাবে চিহ্নিত করেছে তা আমি প্রত্যাখ্যান করি কারণ আমার প্রত্যাশা দ্যা সেকেন্ড সেক্স লেখার সময়ে আমি যে উদ্দীপনা বোধ করেছি ঠিক সেভাবে তা অনুধাবন করা হোক।
৫। একজন ডানপন্থী লিফলেট বিলিকারক উপন্যাসিক Les Temps Modernes পত্রিকায় Bost এর দ্বারা সুক্ষ¥ আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু এত ঘৃণা কেন? – এটাকে খুবই আঘাতজনক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছিল। অথচ তিনি আমাকে চেনেনও না।
৬। তারা বাইরে গেল এবং মায়েদেরকে জিজ্ঞাসা করতে লাগল; কিন্তু আমি এটাও করেছিলাম।
[অস্তিত্ববাদী দার্শনিক, নারীবাদী তাত্তি¦ক, বিখ্যাত লেখক সীমন দ্যা বুভোয়ার এর আত্মজীবনী ‘Force of Circumstance’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে। ইংলিশে অনুবাদ করেন রিচার্ড হাওয়ার্ড, প্রকাশ করে পেঙ্গুইন প্রকাশনী ১৯৬৮ সালে। বাংলায় ভাষান্তরিত অংশটি এই বইয়ের তৃতীয় খ-ের অন্তর্ভুক্ত। সেকেন্ড সেক্স প্রকাশকালে (On the publication of The Second Sex ) নামে এই অংশটি প্রকাশিত হয় http://www.marxists.org/reference/subject/ethics/de-beauvoir/1963/interview.htm এই ওয়েবলিংকে।]
লেখক: সংস্কৃতি কর্মী।
No comments:
Post a Comment