tag:blogger.com,1999:blog-74237332374857161912024-02-19T16:53:51.708+06:00ব্যবচ্ছেদসুশান্ত বর্মনhttp://www.blogger.com/profile/02304984470756506973noreply@blogger.comBlogger22125tag:blogger.com,1999:blog-7423733237485716191.post-33658740659979101722013-10-02T22:38:00.000+06:002018-03-07T13:49:15.664+06:00'ব্যবচ্ছেদ' পত্রিকা পাঠে আপনাকে আমন্ত্রণ<div style="text-align: center;">
<h2>
<b>'ব্যবচ্ছেদ' দ্বিতীয় সংখ্যার প্রচ্ছদ</b></h2>
</div>
<table align="center" cellpadding="0" cellspacing="0" class="tr-caption-container" style="margin-left: auto; margin-right: auto; text-align: center;"><tbody>
<tr><td style="text-align: center;"><a href="https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEg8gtfq2ZmDSV0N2070UTd1gfNCXQi2hlzQukOA_qnWCfZEkYUogxkesMwhTRXvMoaNMfoex3xhXDT34Q4csWSy_C4zfO_3saN_3bSzC_rnCLunCG1hML1ifiDrIUUPibRPCCkJRQKxwxw/s1600/baybachched-2.jpg" imageanchor="1" style="margin-left: auto; margin-right: auto;"><img alt="ব্যবচ্ছেদ দ্বিতীয় সংখ্যার প্রচ্ছদ" border="0" data-original-height="1350" data-original-width="900" height="400" src="https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEg8gtfq2ZmDSV0N2070UTd1gfNCXQi2hlzQukOA_qnWCfZEkYUogxkesMwhTRXvMoaNMfoex3xhXDT34Q4csWSy_C4zfO_3saN_3bSzC_rnCLunCG1hML1ifiDrIUUPibRPCCkJRQKxwxw/s400/baybachched-2.jpg" title="ব্যবচ্ছেদ দ্বিতীয় সংখ্যার প্রচ্ছদ" width="266" /></a></td></tr>
<tr><td class="tr-caption" style="text-align: center;">'ব্যবচ্ছেদ' দ্বিতীয় সংখ্যার প্রচ্ছদ</td></tr>
</tbody></table>
<div style="text-align: center;">
<b>'ব্যবচ্ছেদ' দ্বিতীয় সংখ্যার সম্পাদক: রাই বাবু</b><br />
<b>প্রচ্ছদ শিল্পী: সাম্য রাইয়ান</b><br />
<b><br /></b>
<b><span style="font-size: x-large;"><a href="https://baybachched.blogspot.com/index.html">প্রথম পাতা</a> থেকে শুরু করুন</span></b></div>
সুশান্ত বর্মনhttp://www.blogger.com/profile/02304984470756506973noreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-7423733237485716191.post-56901401684550020732013-10-02T22:32:00.000+06:002018-03-07T13:49:15.857+06:00ব্যবচ্ছেদ। দ্বিতীয় সংখ্যা' এর উচ্চারণ সেপ্টেম্বর ২০১৩ ♦<br />
<br />
সমাজ-সংস্কৃতি-সময়ের অন্তর্জগত খুঁড়ে দেখার প্রত্যাশায় প্রকাশিত হল ব্যবচ্ছেদের দ্বিতীয় সংখ্যা। সমকালের অন্তর্খনন সহজসাধ্য নয়- এ বোধ আমাদের আছে। তারপরও চেষ্টা করেছি পরিপার্শ্বকে উন্মোচন করার। অতৃপ্তিকে সঙ্গী করে আমাদের পথ চলা অব্যাহত থাকবে। এই প্রচেষ্টায় আমাদের সহায় হয়েছেন অনেকেই। তাদের সকলের প্রতি জানাই আমাদের হার্দ্য কৃতজ্ঞতা। – সম্পাদনা পর্ষদসুশান্ত বর্মনhttp://www.blogger.com/profile/02304984470756506973noreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-7423733237485716191.post-44679748334485381512013-10-02T22:28:00.000+06:002018-03-07T13:51:04.305+06:00শ্রম, চিন্তা ও ভাষার সম্পর্ক<br />
যতীন সরকার<br />
<br />
পারিপার্শ্বিক বস্তু বা সংঘটনের উৎপত্তি, বিকাশ ও ক্রমবিলয়ের কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয়ের ব্যাপারে মানুষ যে সাফল্য অর্জন করেছে ইতিহাসে তা নিতান্ত অর্বাচীনকালের ব্যাপার। এর বহু পূর্ব থেকেই মানুষ তার কল্পনার আয়ুধ প্রয়োগে যতœপর ও সিদ্ধকাম থেকেছে। ভাবানুগামিতা ও বিস্ময়মুগ্ধতাই তার এই যত্ন ও সিদ্ধির চালিকাশক্তি।<br />
<br />
মানুষের মুখের ভাষা বিষয়ে এই বিস্ময়মুগ্ধতা থেকেই প্রাচীন ইহুদি শাস্ত্রকারের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল ‘আদিতে বাক্য ছিলেন ও বাক্য ঈশ্বর হইলেন’, ভারতীয় আর্য ঋষির সিদ্ধান্ত; পুরুষস্য বাক্রস : (ভাষা বা বাকই মানুষের সার-ছান্দোগ্য উপনিষদ); অনুরূপ সিদ্ধান্তের প্রেরণা-জাত কল্পনারই সৃষ্টি ঋগে¦দের বাগদেবতা, সেই বাগদেবতার স্পর্ধিত আত্ম-ঘোষণা :<br />
<br />
‘আমি রাজ্ঞী। আমার উপাসকদের আমি ধনসমূহ দিয়ে থাকি। পূজনীয়াদের মধ্যে আমি প্রথমা। দেবতারা আমাকে বহুস্থানে প্রবেশ করতে দিয়েছেন। প্রত্যেক মানুষ; যার দৃষ্টি আছে, প্রাণ আছে, শ্রুতি আছে, আমার কাছ থেকেই সে অন্ন গ্রহণ করে। যারা আমাকে জানে না তারা ক্ষীণ হয়ে যায়। আমি স্বয়ং যা বলে থাকি তা দেবতা এবং মানুষদের দ্বারা সেবিত। আমি যাকে কামনা করি তাকে বলবান করি, সৃষ্টিকর্তা করি, ঋষি করি, প্রজ্ঞাবান করি।’<br />
<br />
বিস্ময়-মুগ্ধ ভাবোদ্বেল বাক-বিভূতির মাধ্যমে প্রাক-আধুনিক যুগের বিভিন্ন দেশে মনীষীরা যে উপলব্ধির প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন, সেই উদ্বেলতার ফেনপুঞ্জ অপসারিত করে নিয়ে তার যে নির্যাসটুকু অবশিষ্ট থাকে, আধুনিককালের বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তেও তা মোটামুটি অপরিবর্তিত রূপেই সমর্থিত হয়। মানুষ এবং পশুর পার্থক্য নির্ণয়ে, আধুনিক বিজ্ঞানের কাছে ভাষা একটি মুখ্য ও অপরিহার্য উপাদানরূপে চিিহ্নত। সে চিহ্নের স্বরূপ-নির্ধারণে বিজ্ঞানের যে শাখা নিয়োজিত, সেটিকেই বলে ভাষাবিজ্ঞান। কিন্তু কোনো বিজ্ঞানই কোনো বিশেষ শাখা-বন্দী নয়, কিংবা অন্য নিরপেক্ষ স্ব-বিকশিত বৃন্তহীন পুষ্পও নয়। ভাষাবিজ্ঞানও বিভিন্ন বিজ্ঞানের শাখায় শাখায় বিচরণশীল হয়েই তার বিকাশের উপাদান আহরণ করে থাকে। ভাষার প্রকাশ মানুষের মুখে, কিন্তু তার সৃষ্টির উৎস মানুষের মন। মনের অলিতে গলিতে ভ্রমণশীল মনোবিজ্ঞানের দ্বারস্থ হতে ভাষাবিজ্ঞান তাই বাধ্য। আবার মানুষের মন তো মানুষের সমাজের কারখানায়ই নানা আকার-প্রকারে গঠিত, বিতর্কিত বিকশিত ও পরিণত। গঠন, বিবর্তন, বিকাশ ও পরিণতিতে সমাজ আর মন যেমন পরস্পর সাপেক্ষ, ভাষার পক্ষেও সে সাপেক্ষতা একান্ত অনিবার্য এবং ভাষাবিজ্ঞানের সুষ্ঠতা অর্থাৎ বৈজ্ঞানিকতার জন্য সমাজবিজ্ঞানের সহায়তা গ্রহণ নিতান্তই অপরিহার্য। তাই ভাষার স্বরূপ সন্ধানে মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান ও ভাষাবিজ্ঞান এই ত্রয়ীর ঐকত্রিক উপস্থিতি, পারস্পরিক পরামর্শ ও সহযোগিতার আবশ্যকতা স্বীকার না করে পারা যায় না।<br />
<br />
এই ত্রয়ীর সহযোগের অপরিহার্যতা স্বীকৃত হয় ভাষার উৎপত্তি প্রসঙ্গে ভাষাবিজ্ঞানী নোয়েরের বক্তব্যে-<br />
<br />
‘সামাজিক লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য বংশ বৃদ্ধদের প্রাচীন শ্রম এবং সামাজিক প্রযতœ থেকেই মানুষের ভাষা ও চিন্তার সূত্রপাত।’<br />
<br />
নোয়েরের কথায় স্পষ্ট উপলব্ধি হয় যে; শ্রম, চিন্তা ও ভাষা একই মালিকায় সূত্রবদ্ধ তিনটি পদ্মরাগমণি। এর যে কোনো একটির অভাব ঘটলে বা অপসারণ করলে সে মালিকা আর গাঁথা হয়ে ওঠে না।<br />
<br />
দুই.<br />
<br />
শ্রম, চিন্তা ও ভাষার সম্পর্ক সূত্রটিকে স্পষ্টরূপে অনুধাবন করতে হলে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ তথা মার্কসীয় দর্শনের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া উপায়ান্তর নেই। সন্দেহ নেই, ডারউইনের বিবর্তনবাদ মানুষের উৎপত্তি সম্পর্কে সকল প্রকার ভাববাদী ধারণার উচ্ছেদ ঘটিয়েছে। মার্কস ও এঙ্গেলস ডারউইনের মতবাদের প্রতি দৃঢ় সমর্থন জ্ঞাপন করেছেন। শুধু তাই নয়। এঙ্গেলস তাঁর ‘বানর থেকে মানুষের বিবর্তনে শ্রমের ভূমিকা’ শীর্ষক রচনাটিতে ডারউইনবাদকে সমৃদ্ধতরও করে তুলেছেন এবং এঙ্গেলসের এই রচনাটিতেই মানববিকাশের ধারায় ‘ভাষার’র উৎপত্তি বিষয়েও স্পষ্ট ও সুষ্ঠু বৈজ্ঞানিক ধারণার প্রাঞ্জল অভিব্যক্তি ঘটেছে।<br />
<br />
যেমন- এঙ্গেলস দেখিয়েছেন যে, বৃক্ষশাখা থেকে সমতল ভূমিতে অবতীর্ণ ‘মানুষ এমন একটি পর্যায়ে এলো যখন পরস্পরকে কিছু বলার প্রয়োজন তাদের হলো। এই প্রেরণা তার নিজস্ব অঙ্গ সৃষ্টি করলো; স্বরের দোলনা দ্বারা ক্রমাগত উন্নততর স্বরগ্রাম সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বানরের অপরিণত কণ্ঠনালী ধীর অথচ স্থির গতিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। ক্রমে ক্রমে মুখের প্রত্যঙ্গগুলো একটার পর একটা স্পষ্টধ্বনি উচ্চারণ করতে শিখল’। এবং এমনি করে ‘শ্রম থেকে এবং শ্রমের সঙ্গে সঙ্গেই যে ভাষার উৎপত্তি’ এঙ্গেলসের নিবন্ধে বৈজ্ঞানিক যথার্থতা সহকারে সে সত্যই উদ্ঘাটিত। সে সত্যের অনুসিদ্ধান্তরূপে এ সত্যই প্রোজ্জ্বল যে : ভাষা শুধু মানুসের অলস মনোভাবের প্রকাশ মাধ্যমই নয়; হাতিয়ারধারী মানুষের সমষ্টিগত শ্রমের ফলে উৎপন্ন যে ভাষা; সে ভাষার প্রবর্তনাতেই তার হাত ও মাথা (শ্রম শক্তি ও চিন্তা শক্তি) পরিচালিত, জীবনযুদ্ধে সে বিজয়ীর সম্মানে ভূষিত, তারই দাক্ষিণ্যে মানুষ আজ এ গ্রহের অধীশ্বর, জলে-স্থলে ব্যোমে প্রসারিত তার রাজ্যপাট। সমাজ থেকে উৎপন্ন ভাষাই সমাজের পুষ্টি, পরিবর্তন ও বিকাশে মুখ্য সহায়িকা শক্তি।<br />
<br />
এঙ্গেলসের বক্তব্যের ব্যাখ্যা করেই জোসেফ স্তালিন বলেন-<br />
<br />
‘মানুষ পশুস্তর থেকে সামাজিক ব্যক্তির স্তরে উঠেছে মেহনতের সাহায্যে। মেহনত তার মনকে করেছে সমৃদ্ধ, তার ভাষা ও সংস্কৃতিকে করেছে বিকশিত। মেহনতের মধ্যে জরুরি হয়ে ওঠে সাহচার্য। মেহনতের প্রক্রিয়ার মধ্য থেকে পরস্পর সাহচর্যের মাধ্যম বিকাশ লাভ করে সে মাধ্যম ভাষা। এই ভাষা সমাজ ও মানবীয় চিন্তার বিপ্লবে বিরাট ভূমিকা গ্রহণ করেছে। ভাব বিনিময় ছাড়া পরস্পর সাহচর্য ছাড়া জীবিকা উৎপাদন অসম্ভব, সমাজের অস্তিত্ব অসম্ভব। আবার সমাজ থেকে আলাদা হয়ে ভাষা টিকতে পারে না। সুতরাং ভাষা ও তার বৃদ্ধি সমৃদ্ধির কানুন বোধগম্য হতে পারে সমাজের এবং জনতার ইতিহাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত করে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। সমাজ ও জনতা ভাষার অধিকারী। সমাজ ও জনতা আবার ভাষার সৃষ্টি ও আধার।’<br />
<br />
হাতের সাহায্যে হাতিয়ার ধরে সমষ্টিগত শ্রম দিয়েই মানুষের সমাজের সৃষ্টি। কিন্তু হাত স্বয়ংক্রিয় বা স্বয়ংশাসিত নয়। তার নিয়ন্ত্রণ, শাসন ও চালনায় আছে মাথা। অর্থাৎ চিন্তাশক্তির নির্দেশনায় শ্রমশক্তি পরিচালিত। ভাষা এই চিন্তাশক্তি ও শ্রমশক্তির যৌথ প্রয়োজনার সৃষ্টি ও স্রষ্টা দুই-ই। তাই ভাষার বৈজ্ঞানিক উপলব্ধির জন্য শ্রমশক্তি তথা সমাজ-শক্তির নিয়ম প্রণালীর অনুধাবনার মতোই চিন্তা শক্তি তথা মনোজগতের প্রকৃতি ও স্বরূপ সন্ধানও সমান জরুরি। অর্থাৎ এখানেই সুস্পষ্ট ও সুতীব্র হয়ে ওঠে ভাষা বিজ্ঞানের জন্য সমাজবিজ্ঞানের সঙ্গে মনোবিজ্ঞানের মেলবন্ধনের অপরিহার্য আবশ্যকতা। (এবং সে সঙ্গে কিছুটা শরীর-বিজ্ঞানেরও। মনের আধার শরীর, অন্তত ভাষার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট স্বরযন্ত্র ও স্নায়ুতন্ত্র ভাষাবিচারের একান্ত আবশ্যিক উপাত্ত।)<br />
<br />
সমাজবিজ্ঞানে যেমন ভাষার সঙ্গে হাতের সম্পর্ক উদ্ঘাটিত, মস্তিষ্কের সঙ্গে ভাষার সম্পর্ক নির্ণয়ও তেমনই মনোবিজ্ঞানের অবদান। কুল্পে, স্টাউট, বিনে প্রমুখ মনোবিজ্ঞানী ‘ভাষা-প্রতিরূপবিহীন চিন্তন সম্ভব বলে যদিও একটা কূটতর্কের অবতারণা করেন। আধুনিক শরীর বিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের জনক পাভলভের পরীক্ষণ ও গবেষণায় সে কূটতর্কের গ্রন্থি ছিন্ন হয়ে গেছে। ভাববাদী দর্শন ও যুক্তিবিদ্যার কুয়াশাজাল ফুৎকারে অপসৃত হয়ে সেখানে এ সত্যই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে যে, চিন্তা আসলে অনুচ্চারিত ভাষারই নামান্তর। অর্থাৎ ভাষা ছাড়া চিন্তা অসম্ভব।<br />
<br />
এ সত্যের প্রমাণ ও দৃষ্টান্ত সামান্য একটু আত্ম-সমীক্ষাতেই আমরা পেতে পারি। আমাদের যেকোনো চিন্তা নিয়েই চিন্তা করলে দেখা যাবে ভাষা তার সঙ্গে অনপনেয় সূত্রে গ্রথিত। যেমন- আগামীকাল আমি লিখব, গতকাল আমি সিনেমায় গিয়েছিলাম, আজ আমি বই পড়ছি- ভবিষ্যৎ অতীত বা বর্তমান নিয়ে আমার সব চিন্তাই কতকগুলো কথার মাধ্যমে অভিব্যক্ত হয়। অভিব্যক্তির সেই কথাগুলো বাদ দিয়ে মনে মনেও এসব বিষয়ের ধারণা বা চিন্তা করা একেবারেই অচিন্তনীয়, অর্থাৎ অসম্ভব। চিন্তা করার অর্থ কতকগুলো কথা মনে মনে বিন্যস্ত করা; সে কথাগুলো অপসৃত হলে চেতনার ভা-ারে অবশিষ্ট থাকে না কিছুই তা তখন ‘শূন্য আকাশের মতো একান্ত নির্মল।’<br />
<br />
শিশুদের কথা বলা লক্ষ্য করলে দেখা যায়, তারা আপন মনে কথা বলে। ‘আপন মনে কথা বলা’ মানে উচ্চ স্বরে, উচ্চারণ করে করে চিন্তা করা। বয়স্ক লোকের চিন্তা অনুচ্চারিত ভাষা হলেও শিশুর চিন্তা উচ্চারিত। বহির্বাস্তব থেকে প্রাপ্ত বস্তু বা বিষয়ের ধারণা শিশুর কাছে ভাষা-প্রতিরূপের সাহায্যেই আত্মস্থ, তার চিন্তা আর ভাষা একই সঙ্গে অধিগত। এ দু’য়ের পরস্পর সাপেক্ষতাই এর মূলীভূত হেতু।<br />
<br />
এরূপ বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও দৃষ্টান্ত সহযোগে এ কথা প্রমাণিত হয়েছে যে, কথা বলা বা ভাষা ব্যবহার মানেই স্বরযন্ত্রের সাহায্যে মনের অনুচ্চারিত ধারণা বা চিন্তার উচ্চারণ তাকে অপরের শ্রুতিগ্রাহ্যকরণ। যেসব প্রাণীর স্বরযন্ত্রের সে ক্ষমতা নেই, ভাষা ব্যবহারেও তারা অক্ষম। তবে সে অক্ষমতার দায়ভাগ শুধু এক স্বরযন্ত্রেরই নয়, এর মুখ্য দায়িত্ব মস্তিষ্কের। বন মানুষের স্বরযন্ত্র ভাষা ব্যবহারের উপযুক্ত, কিন্তু মস্তিষ্ক অপরিণত; কোনো ধারণার বাহন হওয়ার অনুপযুক্ত। তাই বনমানুষ ভাষা সম্পদ থেকে বঞ্চিত আর সুগঠিত স্বরযন্ত্র ও সু-উন্নত মস্তিষ্কের অধিকারী মানুষ সে সম্পদে সম্পন্ন।<br />
<br />
এ সঙ্গে আবার হাতের কথাটিও বিবেচ্য। স্নায়ুতন্ত্রের যে কেন্দ্রগুলোর প্রণোদনায় (উৎরাব) মানুষের হাত সক্রিয় আর যেগুলোর সাহায্যে ভাষা উচ্চার্য, তাদের অবস্থান একান্তই সন্নিকৃষ্ট। এতো সন্নিকৃষ্ট যে, দু’কেন্দ্রের কাজ সন্নিবিষ্ট হয়ে অনেক সময়ই হয়ে যায় জড়িত, মিশ্রিত এবং কখনো কখনো তা পরস্পরের সীমানা উল্লঙ্খনও করে ফেলে। এর ইংরেজি নাম ঝঢ়ৎবধফ। শিশুদের কথা বলার সময়কার অঙ্গভঙ্গী, হাতের লিখা অভ্যাসের সময় ওষ্ঠ সঞ্চালন, বয়স্কদেরও বক্তৃতা দেওয়ার সময় হাত ও মুখের নানা মুদ্রা প্রদর্শন- এসবই এর দৃষ্টান্ত। আদিম মানুষের বেলায়ই এ বিষয়টি সুস্পষ্টরূপে দৃষ্টিগ্রাহ্য। সভ্য মানুষের কথা বলার সময়ে হস্ত সঞ্চালন বা অঙ্গভঙ্গির ভূমিকা গৌণ কিন্তু আদিম মানুষের মুখের ভাষার মুখ্যত অঙ্গভঙ্গির উপরই নির্ভরশীল। গ্রে, স্মাইথ, রট্রে প্রমুখ বিজ্ঞানীর বরাত দিয়ে অধ্যাপক জর্জ টম্পসন এ কথাই প্রমাণ করেছেন। এসব সাক্ষ্যের ভিত্তিতে সমাজ মনোবিদ বুশের যা বলেন ত এঙ্গেলসের সিদ্ধান্তেরই সম্প্রসারিত রূপ।<br />
<br />
ডক্টর বুশের- এর সিদ্ধান্ত :<br />
<br />
‘হাতিয়ার ব্যবহারের দরুণ পেশিগুলিতে যে জোর পড়ে তারই প্রতিবর্তী ক্রিয়া (জবভষবী ধপঃরড়হ) হিসেবে স্বরযন্ত্রের প্রতিক্রিয়াটি থেকেই মানুষের গলায় ভাষা ফুটে উঠেছিল। তারপর হাতের কাজের যতো উন্নতি হয়েছে ততোই উন্নত হয়েছে স্বরযন্ত্র এবং শেষ পর্যন্ত মানুষের চেতনাও উন্নত হতে হতে একটা পর্যায়ে পৌঁছে দেখা গেলো এই প্রতিবর্তী ক্রিয়াটিকেই তারা সচেতনভাবে ভাবের আদান-প্রদান কাজে নিযুক্ত করতে পারছে।’<br />
<br />
তিন.<br />
<br />
প্রগতিশীল সমাজ-মনোবিদদের অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে মানুষের চেতনার বিকাশে ভাষার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার পরিচয় উদঘাটিত হয়েছে এবং ভাষা ছাড়া যে চেতনার ধারণ, বাহন ও অবস্থিতি অসম্ভব, সে সত্যও প্রমাণিত হয়েছে। তবে সে সঙ্গে একথাও অবশ্যই স্মর্তব্য যে ভাষা আর চিন্তা অভিন্ন নয়।<br />
<br />
মানব বিকাশের এক সুউচ্চ পর্যায়ে ভাষার উদ্ভব, উদ্ভবের পর থেকে তার নিজেরই একটি আপেক্ষিক স্বতন্ত্র সত্তাও উদ্ভূত। সে সত্তা এমন কতকগুলো বিশেষ নিয়ম প্রণালির অধীন, চিন্তার নিয়ম থেকে যার স্বাতন্ত্র্য স্পষ্ট। সে স্বাতন্ত্র্যের ভিত্তিতেই ভাষাবিজ্ঞানের আবির্ভাব। তাই ভাষাবিজ্ঞানের নিয়মের অনুসরণ না করে এবং এর সহযোগী শাখাসমূহের অকৃপণ সহায়তা গ্রহণ না করে যে ভাষা বিচারে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগ ঘটানো একেবারেই অসম্ভব- সে কথা আমাদের মেনে নিতে হবে।<br />
<br />
কিন্তু এই মেনে নেয়ার বিষয়টি দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদীরাও সব সময় মনে রাখেন না। তার ফলেই ঘটে নানা বিপত্তি। সে বিপত্তির প্রধানটি হলো শ্রম থেকে ভাষার উৎপত্তি সূত্রটির সরলীকরণ ও যান্ত্রিকায়ন। সে রকম সরলীকরণ ও যান্ত্রিকায়নের দৃষ্টান্ত আমরা প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নেও দেখতে পেয়েছি। সোভিয়েত যেহেতু শ্রমিকশ্রেণির রাষ্ট্র, তাই এ রাষ্ট্রের ভাষাও হবে শ্রমিকশ্রেণির কমিউনিস্ট পার্টির অতি উৎসাহী সদস্যরা এমন একটি অনুজ্ঞাই প্রচার করলেন। সে প্রচারে তারা সমর্থন পেলেন সে দেশের একজন বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানীর। এই ভাষা বিজ্ঞানীটির নাম এন ওয়াই মার। পূর্বেকার ভাষা বিজ্ঞানের বদলে এমন এক অভিনব ভাষা বিজ্ঞান মার এবং তাঁর সহযোগীরা সৃষ্টি করতে চাইলেন যাকে মার্কসবাদ সম্মত বলা যায় না কোনো মতেই। এটিকে বিজ্ঞান বলেই মানা যায় না। মার্কস এঙ্গেলস তো ভাষাকে ‘চিন্তার প্রত্যক্ষ বাস্তবতা’ রূপেই দেখেছিলেন। ‘ভাব ভাষা থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকে না’- মার্কস স্পষ্ট ভাষায় এমন কথাও বলেছেন। অথচ মার্কসবাদের পতাকা হাতে নিয়েই ‘মার ভাষাকে চিন্তা থেকে বিযুক্ত বলে প্রচার করলেন। তাঁর মতে ‘মানুষের সাথে মানুষের ভাবসংযোগ ভাষা ছাড়াই সম্পন্ন হতে পারে।’<br />
<br />
সুখের বিষয়, এই ভ্রান্তি বেশি দূর বিস্তৃত হতে পারেনি। তাঁর কয়েকটি রচনায় তিনি চিন্তার সঙ্গে ভাষার অনপনেয় সম্পর্কের বিষয়টি স্পষ্ট করে তুললেন। এও জানিয়ে দিলেন যে, সংস্কৃতির শ্রেণি চরিত্র থাকলেও ভাষার কোনো শ্রেণি চরিত্র নেই। অর্থাৎ কোনো বিশেষ ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর ধনী-দরিদ্র বা মালিক-শ্রমিক নির্বিশেষে সকল মানুষেরই ভাষা এক ও অভিন্ন। তাই শ্রমিক শ্রেণির রাষ্ট্রেও শ্রমিক শ্রেণির ভাষা বলে কোনো ভাষা থাকতে পারে না। স্তালিনের প্রণোদনায় শ্রেণিভাষা সম্পর্কীয় ভ্রান্তি অপনোদিত হলেও ভাষা-বিচারের অন্য অনেক ভ্রান্তি থেকে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদীদের অনেকেই এখনো মুক্ত হতে পারেননি।<br />
<br />
লেখক: অধ্যাপক ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ।সুশান্ত বর্মনhttp://www.blogger.com/profile/02304984470756506973noreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-7423733237485716191.post-16501955782318642192013-10-02T22:27:00.000+06:002018-03-07T13:51:18.583+06:00অরুনোকোর সেই প্রতিবাদতপন কুমার রুদ্র<br />
<br />
কখনো কখনো মনে হয় অরুনোকো একটি কল্পিত প্রতিবাদের নাম। আবার তাকে নিয়ে একটু ভাবলে মনে হতে পারে যে অরুনোকো যথার্থই একটি বাস্তব অভিজ্ঞতার স্ফুরণ। আফ্রিকার একটি রাষ্ট্র সুরিনাম। সেখানেই অরুনোকোর জন্ম। তার দাদু ছিলেন সেখানকার এক উপজাতি সম্প্রদায়ের রাজা। ওরা ছিল নিগ্রো, আফ্রিকার ঘন অন্ধকারের মতোই ওরা কালো। তবে অরুনোকো কালো হলেও অতোটা ঘন কুচকুচে কাল ছিল না, ওর নাকটাও ছিল বেশ খাড়া, শরীরটাও ছিল বেশ পেটানো, সুগঠনে চমৎকার ও সুন্দর। যৌবনের আহ্বানে তারও মনে জেগেছিল গভীর প্রেম। ভালোবেসে ফেলেছিল ইমোইন্ডা নামের এক কৃষ্ণকলি নিগ্রো যুবতীকে। গোপনে ওদের বিয়েও সম্পাদন হয়েছিল রীতি-মোতাবেক। কিন্তু ওদের রাজা মানে অরুনোকোর দাদু তা মেনে নেবেন কেন? তিনি তো রাজা; তাই যা কিছু সুন্দর, যা কিছু মনোহর, যা কিছু লোভনীয়, তা-তো অন্য কারুর দখলে যেতে পারে না। তাই অনেক ক’জন স্ত্রী ও অনেক ক’জন সেবিকা থাকা সত্ত্বে বুড়ো রাজা ইমোইন্ডাকে জোর করে দখল করলো; তাকেও একজন সেবিকা বানাল। কিন্তু ইমোইন্ডা-অরুনোকো’র একে অপরের প্রতি ভালোবাসার বন্ধন এতই দৃঢ় ছিল যে তাদের সম্পর্কে কোন ভাটা পড়লো না। রাক্ষুসে স্বভাব অতিবৃদ্ধ রাজাকে ফাঁকি দিয়ে ইমোইন্ডা অরুনোকোর সাথে মাঝেমাঝেই দেখা করতো, অভিসারে লিপ্ত হতো। কিন্তু নিয়তির ফল কে খ-াবে? একদিন রাজার রক্ষীদের কাছে ওরা হাতেনাতে ধরা পরে গেল। মিলনরত অবস্থায় ওদেরকে ধরতে পেরে রক্ষীরা উল্লাসে ফেটে পরে এবং কামুক রাজাকে সবকিছু জানিয়ে দেয়। শারীরিকভাবে অথর্ব হলেও রাজা তার স্বভাব অনুযায়ী ক্রোধ ও অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করে। পরিশেষে শাস্তি স্বরূপ ইমোইন্ডাকে ক্রীতদাসী হিসেবে বিক্রি করে সুরিনামের এক গহীন বনে, আর তার নাতী অরুনোকোকেও কঠিন নির্যাতন করে এবং পরবর্তীতে ক্রীতদাস বনিয়ে দাস ব্যবসায়ীদের হাতে ছেড়ে দেয়। ভাগ্যের কী পরিহাস! দেশান্তরী হয়ে নানা হাত ঘুরে অবশেষে অরুনোকো সুরিনামের সেই গহীন অরণ্যেই নির্বাসিত হয়, যেখানে ইতোমধ্যেই ইমোইন্ডা তার করুণ দাসী-জীবনের ঘৃণিত পেশা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। ঠিক যেন স্বর্গচ্যুত এডাম ও ইভ এর দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর আবার তারা একে অপরকে বহুকাল পরে খুঁজে পেল।<br />
<br />
মিলন দৃশ্যটা কী অপূর্বই না হয়েছিল! বর্বর সামন্ত প্রথার সেই অতি অন্ধকার যুগে ক্রীতদাস ও ক্রীতদাসীরা কি অতো-সহজে মুক্তি পেতে পারতো? দুর্ভাগ্য সেখানেও তাদের ত্যাগ করেনি। সুরিনামের বর্ণিত সেই বনে যেসব শ্বেতাঙ্গ দাস মালিকরা তাদের নিয়ন্ত্রণ করত তারা তাদের আসল নাম বদলে দিয়ে নতুন নাম দিয়েছিল। অরুনোকোর নতুন নাম হল সিজার আর ইমোইন্ডার হল ক্লিমেন। অবশ্য আকস্মিকভাবে এই যুগের পুনর্মিলনের পর থেকে তাদের মধ্যে নিয়মিত সম্পর্ক ও যোগাযোগ অবাধেই গড়িয়ে যেতে থাকে। ইমোইন্ডা গর্ভবতীও হয়। কিন্তু যখনই অরুনোকো ইমোইন্ডার নিরাপদ প্রসব নিশ্চিত করার জন্য নিজ দেশে ফিরে যাবার অনুমতি প্রার্থনা করল তখনই গোল বাঁধল প্রচ- রকমে। অরুনোকোর আবেদন কোনোভাবেই ব্রিটিশ দাস মালিক ট্রেফরি ও ডেপুটি গভর্নর বিয়ামের মন গলাতে পারল না। এতে অরুনোকো যারপরনাই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং অন্যান্য ক্রীতদাসদের সঙ্গে নিয়ে এক লড়াকু ঐক্য গড়ে তোলে। তারপর শুরু হয়ে যায় মালিক গোষ্ঠীর মিলিটারি বাহিনী আর মুক্তি পাগল ক্রীতদাস বাহিনীর মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ। যুদ্ধে ক্রীতদাস বাহিনী পরাস্ত হতে বাধ্য হল। ইংরেজ ডেপুটি গভর্নর বিয়াম নিজেদের বিরাট স্বার্থে ক্রীতদাসদের ক্ষমা করার প্রতিশ্রুতি দিলেও শেষ পর্যন্ত অরুনোকোর ব্যক্তিত্বের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে তাকে ক্ষমা না করে তার সর্বাঙ্গে শত-শত চাবুকের ঘা বসিয়ে তাকে একেবারে রক্তাক্ত করে ছাড়ল। সেখানেই শেষ নয়। সর্বাঙ্গ রক্তাক্ত ও পুরোপুরি অচেতন করার পর তার অসংখ্য ক্ষত স্থানে বিষাক্ত মলম লেপন করে অসহ্য যন্ত্রণায় তাকে পাগল করে ফেলার নিষ্ঠুর কাজটি করল।<br />
<br />
প্রতারিত, অপমানিত ও নির্যাতিত অরুনোকো বিয়ামের ওপর সর্বোচ্চ প্রতিশোধের জন্য পাগল হয়ে উঠল। সর্বাত্মক বিদ্রোহের আগুন তখন তাকে যুদ্ধের জন্য প্ররোচিত করতে লাগলো। সে জানতো এই যুদ্ধে তাকে প্রাণ উৎসর্গ করতে হতে পারে। কিন্তু তাঁর যদি মৃত্যু হয় তাহলে তার প্রিয়তমা স্ত্রী ইমোইন্ডার লাঞ্ছনা ও অপমানের কোন শেষ থাকবে না। তাই সে ইমোইন্ডার সাথে বিষয়টি গভীর আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নিলো যে পুনরায় সংঘর্ষের আগেই অরুনোকো নিজ হাতে ইমোইন্ডাকে হত্যা করবে এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ অরুনোকো সেই সিদ্ধান্তেরই বাস্তবায়ন করলো। সে এক মহাকাব্যিক উপায়ে প্রিয়তমা ইমোইন্ডার জীবনাবসান ঘটাল। ইমোইন্ডার লম্বা ঘন চুলের বেণী পেঁচিয়ে তার শ্বাস রোধ করল অরুনোকো।<br />
<br />
নিজ প্রতিজ্ঞায় উজ্জীবিত হয়ে অরুনোকো তার অনুচরদের সঙ্গে নিয়ে ডিপুটি গভর্নর বিয়াম ও তার জল্লাদদের হত্যা করার চেষ্টায় পুরোপুরি সফল হতে পারলো না। সে আবার ধরা পরল। প্রথমে তাকে চাবুক মেরে রক্তাক্ত করা হল, তারপর নাক, কান, হাত ইত্যাদি সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে কেটে তাকে টুকরো টুকরো করে সর্দারদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া হল। তাতে কি অরুনোকোর বিদ্রোহের আগুন নিভে গেল?<br />
<br />
উল্লেখিত খ-ের ভিত্তিতেই সপ্তদশ শতকের ব্রিটিশ লেখিকা আফরা বেন (অঢ়যৎধ ইবযহ) রচনা করেন তাঁর সাড়া জাগানো উপন্যাস অরুনোকো (ঙৎড়ড়হড়শড়)। স্বল্প দৈর্ঘ্যরে এই উপন্যাসটি লেখা হয়েছিল লেখিকার মাতৃভাষা ইংরেজিতেই। তবে এর জনপ্রিয়তার কারণে বিশ্বের বহু ভাষায় তা অনূদিত হয়। ১৬৮৮ সালে লেখিকা আফরা বেনের মৃত্যুর মাত্র এক বছর আগে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল।<br />
<br />
যিশু খ্রিস্টের জন্মের পূর্বে রোমে সংগঠিত ইতিহাসখ্যাত প্রথম দাস-বিদ্রোহের সংগঠক ও কিংবদন্তি নেতা স্পার্টাকাস (ঝঢ়ধৎঃধপঁং) যেসব উল্লেখযোগ্য কারণে আজ অবধি বীরত্বের মহিমায় প্রাসঙ্গিক ও স্মরণীয়, লেখিকা আফরা বেন বর্ণীত যোদ্ধা অরুনোকোও মহান এক প্রতিবাদ বিদ্রোহ ও সংগ্রামের অম্লান প্রতীক বলে এখনও পূজনীয়। নানা বিশ্বস্ত সূত্রমতে আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে, অরুনোকোর জীবনী ও তার জীবনে প্রতারণা, নির্যাতন, দৃষ্টান্ততুল্য প্রেমকাহিনী, তার জীবনকালের সামন্তবাদের শোষণ-বর্বরতা নিছক কোনো কল্পিত গল্প নয়, এটি একটি সত্যিকার ইতিহাস। আদি যুগ তথা স্পার্টাকাস আমলের রোমান দাস ব্যবস্থায় যত নিষ্ঠুরতা-শোষণ-কুপ্রথা চালু ছিল; সপ্তদশ শতাব্দীর আফ্রিকা মহাদেশের নানা স্থানে তার ধারাবাহিকতা প্রবল দাপটেই দরিদ্র কালো নিগ্রোদের জীবন প্রবাহে জ্বালাময় বিষ ছড়িয়ে দিয়েছিল। এক্ষেত্রে ইয়োরোপীয় বণিকরা বিশেষত রোমান-ব্রিটিশ-আমেরিকান শোষকগোষ্ঠী কালো আফ্রিকানদেরকে নিছক পণ্য হিসেবে গণ্য করে তাদের উপর শোষণ-শাসন চাপিয়ে রাখতো। সেই সাথে তাদের চাপিয়ে দেয়া কুপ্রথা-কুপ্রবণতার ধারক হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটেছিলো কালো নিগ্রোদের সর্দার, গোত্রপতি, সামন্ত প্রভু, ছোট-ছোট রাজা-জমিদারদের চরিত্রেও। এভাবেই কুপ্রথা, শোষণমূলক প্রবণতা, নির্যাতনের কূটকৌশল ইত্যাদি বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত হয়ে থাকে। ইতিহাস-তো তাই বলে।<br />
<br />
রোমান শ্বেতাঙ্গ স্পার্টাকাস যুগের কথা বলি কিংবা আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ অরুনোকো যুগের কথাই যদি বলি, ক্রীতদাসরা কখনোই মানুষ বলে গণ্য হয়নি। স্পার্টাকাস জন্মসূত্রে ক্রীতদাস হলেও অরুনোকো অবস্থার বিপাকে পরে পর্যায়ক্রমে ক্রীতদাসে পরিণত হয়েছিল। তবে অরুনোকোর জীবন পরিণতিই প্রমাণ করে, ক্রীতদাস শ্রেণি শোষক ও শাসক শ্রেণির নিষ্ঠুরতা আর কূটকৌশলের ফাঁদে পরে খেটে খাওয়া মানুষের অজ্ঞতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার প্রীতি ও বিভেদের বীজ ছিটিয়ে প্রকৃত অর্থেই মানুষকে মানুষের পণ্য বানিয়ে সেই প্রভুত্ব প্রথা সৃষ্টি করে তা বহাল রাখার নতুন নতুন কৌশল অনুসরণ করা হয়েছে যুগে যুগে। ভারত উপমহাদেশের শাসক শোষকরাই বা এতে কম কিসে।<br />
<br />
ইতিহাস অবশ্যই তার পথে হেঁটেই চলেছে। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে আর যাচ্ছে। শোষণের হীনকৌশলও বসে থাকে না। বর্তমানের মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রবল আক্রমণে আজকের বাংলাদেশের শ্রমনির্ভর খেটে খাওয়া মানুষ কি ভোগের পণ্য হতে বাধ্য হচ্ছে না? একথা সত্য যে পুরাকালের দাস প্রথা পুরনো চরিত্রে আজ আর বহাল নেই। সামন্ত ভূস্বামী, রাজা-জমিদারদের অবস্থানও খুব সীমিত পরিসরে ধিকধিক করে মারা যেতে বসেছে। তবে সামন্ত যুগীয় ধর্মীয় অন্ধত্ব, ঠকনির্ভরশীলতা, ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণে অভ্যাস প্রবণতা আর তার সাথে অর্থহীন অহংকারবোধ দারুণভাবে আজ অবধি সমাজকে দুর্বল করেই চলেছে। তবে যদি সরাসরি মানুষ মানুষকে পণ্য বানিয়ে ব্যবহার করার যে রীতি দাস প্রথার যুগে স্বীকৃত সংস্কৃতি ছিল, তা কিন্তু ভিন্ন রূপে ও ভিন্ন-ভিন্ন অবস্থানে মারাত্মকভাবেই সৃষ্টি হচ্ছে এবং ছড়িয়ে পরছে। সম্রাট-রাজা-জমিদারদের জায়গায় মানবপ্রভুরা যেসব নামে শোষণ, নির্যাতন ও ভোগবিলাস বহাল রেখেছে তারা হল শোষক রাজনৈতিক নেতা, ক্ষমতাশীন আমলা শ্রেণি, কালো টাকার মালিক, পুঁজিপতি, শিল্প-মালিক, শিল্প-উদ্যোক্তা, বিদেশিদের দালাল, এনজিও ব্যবসায়ী, মুনাফা ভিত্তিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিক, গোষ্ঠী ইত্যাদি।<br />
<br />
বিশ্বব্যাপী শোষণকেন্দ্রিক অর্থনীতির জোয়ার বইছে। দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে ধনিক পরাশক্তির দেশগুলো যেভাবে অবাধ বাজার সৃষ্টি ও বাজার-নিয়ন্ত্রণ করতে লেগেছে তাতে করে ঘৃণ্য দালালগোষ্ঠীর-তো পোয়া বারো। মানবতা কি এভাবেই অপমানিত হবে? কর্মীশ্রেণির শ্রম ও সম্ভ্রম কি এভাবেই লুণ্ঠন হতে থাকবে? বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রজন্মরা সবাই কি নতজানু হয়ে থাকবে? গণতন্ত্রের নামে গণমানুষেরা কি শোষকচক্রের ভৃত্য হয়ে বাঁচবে? না, তা কিন্তু হবে না।<br />
<br />
অরুনোকো অতৃপ্ত অবস্থায় মরে যেতে বাধ্য হলেও বিদ্রোহের আগুনটা জ্বেলে রেখে গেছে। মুক্তি-পাগল এমন বিদ্রোহী-আগুনের অনেক নমুনা ইতিহাস ধরে রেখেছে, সমুন্নত রেখেছে। আজকের দিনে এরকম কোন আশাবাদ পোষণ না করা যথার্থ হবে না। মেহনতি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানবশ্রেণির জীবন-জীবিকা ও সংস্কৃতি রক্ষার স্বার্থে প্রণীত রাজনৈতিক মতবাদের আদর্শিক প্রয়োগ ও তাকে বিকশিত করার লক্ষ্যে নিবেদিত সংগঠন ও শক্তিগুলোকে এক কাতারে আসতে হবেই। মানবমুক্তি আদায়ের জন্য আনুষ্ঠানিক শপথ নেয়াটাই যথেষ্ট নয়, একটা চলমান প্রক্রিয়ায় এসব অমানবিক সামাজিক নীতি-নৈতিকতার বিরুদ্ধচারী হতেই হবে।<br />
<br />
লেখক: অধ্যাপক ও প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি বিভাগ, সরকারি বেগম রোকেয়া কলেজ, রংপুর।সুশান্ত বর্মনhttp://www.blogger.com/profile/02304984470756506973noreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-7423733237485716191.post-64974693489591910252013-10-02T22:25:00.000+06:002018-03-07T13:51:38.329+06:00চৌমাথায় বাংলাদেশএম এম আকাশ<br />
<br />
বাংলাদেশ এখন ক্রস রোডে দাঁড়িয়ে। এখানে রয়েছে পরস্পর বিরোধী চারটি রোড বা রাস্তা। প্রথম দুটির একটি হচ্ছে গণতন্ত্র অব্যাহত রাখার রাস্তা। অপরটি হচ্ছে কোন না কোন ধরনের অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উত্থান এবং সেটি কতদিন থাকবে সে বিষয়ে এখনই নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। ক্রস রোডের অন্য দুটি রাস্তার একটি হচ্ছে, বাংলাদেশে মিনি পাকিস্তান ধাঁচের ভাবাদর্শের শাসন কায়েম। দ্বিতীয়টি হচ্ছে গণতান্ত্রিক শাসন বহাল এবং ক্ষীণ ধারা ও আপসকামী হলেও মুক্তিযুদ্ধের ধারার শাসন অব্যাহত থাকা। এই ক্রস রোডগুলিকে একটি সহজ দুই বাই দুই (২দ্ধ২) ছকের মাধ্যমে নীচে তুলে ধরা হল।<br />
<br />
গণতন্ত্র গণতন্ত্র না<br />
<br />
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ক খ<br />
<br />
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা না গ ঘ<br />
<br />
এই ছক অনুসারে বর্তমান ক্রস রোডের চার রকম ভবিষ্যৎ পরিণতি সম্ভব। ‘ক’ পরিণতির অর্থ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্র উভয়ই অব্যাহত থাকবে। ‘খ’ পরিণতির অর্থ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অব্যাহত থাকবে কিন্তু গণতন্ত্র থাকবে না। পক্ষান্তরে ‘গ’ পরিণতির অর্থ গণতন্ত্র অব্যাহত থাকবে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থাকবে না। সর্বশেষে ‘ঘ’ পরিণতির অর্থ হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্র উভয়ই ব্যাহত হবে।<br />
<br />
জনগণের মনে তাই প্রশ্ন- সবচেয়ে কাম্য ক্রস রোডটি কী? আমার বিচারে গণতান্ত্রিক শাসন অব্যাহত রেখে যত ক্ষীণই হোক মুক্তিযুদ্ধের ধারাকে অব্যাহত রাখা গেলেই তা বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার সহায়ক হবে। কিন্তু সম্প্রতি বাংলাদেশের মানুষের সাধারণভাবে ধারণা হয়েছে, এই দুইয়ের যুগপৎ বিজয় অসম্ভব। অনেকেই একান্ত আলোচনায় বলছেন, যদি মোটামুটি গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাহলে পাকিস্তানপন্থিরাই ক্ষমতায় আসবেন। এখানে পাকিস্তানপন্থী বলতে তারা বোঝাচ্ছেন জামায়াতে ইসলামি-বিএনপি সমন্বয়ে গঠিত ১৮ দলীয় জোটের ক্ষমতা গ্রহণকে। তাদের সঙ্গে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে হেফাজতে ইসলাম। একথা ঠিক যে সম্প্রতি যে কয়েকটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে সেগুলো মোটামুটি গণতান্ত্রিকভাবে হয়েছে বলেই সাধারণ মানুষ মনে করে। যদিও প্রতিটি নির্বাচনেই কিছু মাত্রায় কারচুপি হয়েছে বলে ১৮ দলীয় জোটের নেতারা দাবি করছেন। তবে সহজেই আমরা ধারণা করতে পারি যে তারা এটা করছে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুটি চাঙ্গা রাখার জন্য। ১৮ দলীয় জোটের নেতারা বিশ্বাস করেন যে সঠিকভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কারণেই তাদের এ বিপুল জয় এসেছে। অর্থাৎ বিগত ৫ বছরে মহাজোটের শাসনামলে নানা রকম বৃহৎ দুর্নীতির (শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের সহায়তা প্রত্যাহার, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, ডেসটিনি গ্রুপের লাখ লাখ মানুষের অর্থ আত্মসাৎ প্রভৃতি) কারণে মহাজোট সরকারের ভাবমূর্তি তলানিতে এসে ঠেকেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তৃণমূল পর্যায়ে দলীয় কোন্দল, দলের ভেতরে সুবিধাবঞ্চিতদের ঈর্ষা, তৃণমূলে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নিয়ে নানা রকম নয়-ছয়, টেন্ডারবাজি এবং ‘ছাত্রলীগ-যুবলীগের’ মাস্তানদের দৌড়াত্ম। এগুলো সবই মানুষের মন বিষিয়ে দিয়েছে। তবে এজন্য নয় যে তারা ভেবেছিল, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার কোন দুর্নীতিই করবে না বা আওয়ামী লীগ এবার ধোয়া তুলসী পাতার মতো সহজসরল জীবন যাপন করবে। বরং তারা ভেবেছিল যে বাংলাদেশে স্বাভাবিক যে দুর্নীতির মাত্রা, সেটা এবারও থাকবে তবে এবার তা মাত্রাতিরিক্ত হবে না। কারণ শেখ হাসিনা তার মন্ত্রীসভা গঠন করার সময় সে ধরনেরই একটা সংকেত দিয়েছিলেন। আমার ধারণা, এবার শেখ হাসিনার সরকারের মন্ত্রীসভা সদস্যদের মাধ্যমে যত না দুর্নীতি হয়েছে তার চেয়ে লুটেরা ব্যবসায়ী এবং তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের দুর্নীতির প্রকোপ ছিল অনেক বেশি। কয়েকজন মন্ত্রীর কথা বলতে পারি, যাদের সম্পর্কে এখন পর্যন্ত দুর্নীতির অভিযোগ কোন মহল থেকেই ওঠেনি। এখানে নাম উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। একথাও স্বীকার্য যে, বিগত বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলে তারেক জিয়ার নেতৃত্বে যে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে সে ধরনের একটি অভিযোগ শেখ হাসিনার পরিবারকে ঘিরে প্রতিষ্ঠার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করেও এখন পর্যন্ত বিএনপি পুরোপুরি সফল হয়নি। কিন্তু যাই বলি না কেন, মহাজোট সরকারের প্রতি জনগণের প্রত্যাশা ছিল এবার অনেক বেশি।<br />
<br />
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার যারা লিখেছিলেন, তারা কল্যাণ-ধনতন্ত্র কায়েম করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এই ধনতন্ত্রের মূল কথা হচ্ছে ব্যক্তি খাতের বৃহৎ ধনীদের কাছ থেকে আয়ের ৪০-৫০ শতাংশ আয়কর হিসেবে আদায় করা এবং তা স্বচ্ছ ও দুর্নীতিশূন্যভাবে দেশের নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলো (যেমন- অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও নিরাপত্তা) পূরণে ব্যয় করা। লেখকরা ইশতেহারের শিরোনাম দেন ‘দিন বদলের সনদ- ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণের হৃদকল্প’। যেহেতু দিন বদল হল না এবং এনালগ বাংলাদেশ রয়ে গেল, সেজন্য মানুষের মনে রয়েছে তীব্র আশাভঙ্গের বেদনা।<br />
<br />
সবশেষে, সামগ্রিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলটি যে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল- যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করবে এবং ধর্মনিরপেক্ষ-সেক্যুলার বাংলাদেশ কায়েম করবে, সেই দলই যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু করল অনেক দ্বিধা-দুর্বলতাসহ শাসন মেয়াদের অন্তিমলগ্নে এসে। সংবিধান যথোপযুক্তভাবে বদলানোর সুযোগটিও হেলায়-ফেলায় হারিয়ে গেল। এ কথাও আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব বুঝল না যে, ইসলামি কার্ড খেলে এই দলটি কখনই বিএনপির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় জিততে পারবে না। আওয়ামী লীগকে পরিষ্কারভাবে মুক্তিযুদ্ধের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ ও ভাষাভিত্তিক সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের পক্ষে বলিষ্ঠ অবস্থান নিয়েই অগ্রসর হতে হবে। মুসলিম আওয়ামী লীগ থেকে আওয়ামী লীগ হয়ে পুনরায় মুসলিম আওয়ামী লীগ হওয়ার সুযোগ আওয়ামী লীগের নেই। আওয়ামী লীগকে যদি এগুতে হয় তাহলে সামনের দিকেই এগুতে হবে। যেভাবে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের প্রথম দিকে আওয়ামী লীগকে ত্রুটিপূর্ণভাবে হলেও বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বানাতে চেয়েছিলেন সেইভাবেই আজও ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে অতীত ত্রুটিগুলি থেকে মুক্ত হয়ে কৃষক-শ্রমিক অভিমুখেই হাঁটতে হবে আওয়ামী লীগকে। মর্মগতভাবে আওয়ামী লীগ যদি সাধারণ মানুষের সঙ্গে থাকতে চায় এবং গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়ে দেশ শাসন করতে চায় তাহলে শ্রমিক কৃষক ও দুঃখী মানুষের বাস্তব অবস্থার উন্নতি ঘটিয়েই তা অর্জন করতে হবে। লুটেরাদের প্রশ্রয় দিয়ে, দুর্নীতিবাজদের আশ্রয় দিয়ে, দলের ক্যাডারদের টুপাইস কামানোর ব্যবস্থা করে গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতায় থাকা যায় না। দুর্ভাগ্য আমাদের, আজ যখন নির্বাচন সামনে এসেছে তখন সবাই বলছে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলটি তার কৃতকর্মের কারণে অনিবার্যভাবে পরাজিত হবে। সেজন্যই ক্রসরোডে দাঁড়িয়ে মানুষের ধারণা, সবচেয়ে কাম্য যে কম্বিনেশন গণতান্ত্রিক শাসন অব্যাহত এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ক্ষমতায় থাকা, এ দুটি বিষয় একসঙ্গে এবারে ঘটবে না। সত্যিকার গণতান্ত্রিক নির্বাচন হলে বিএনপি-জামাত-হেফাজত জোট এবার ক্ষমতায় আসবে বলেই অধিকাংশ মানুষ মনে করেন।<br />
<br />
তাহলে কি বাংলাদেশে মিসরের মুর্সির মতই একটা ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে? কেউ কেউ ভাবেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত যেহেতু আওয়ামী লীগের পক্ষে অবস্থান নিয়ে আছে এবং সামরিক বাহিনী যেহেতু ওই সব আন্তর্জাতিক শক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত, সুতরাং বাংলাদেশে মুর্সি ভ্যারিয়ান্ট চালু হতে যাচ্ছে। কিন্তু এই ভ্যারিয়ান্ট চালুর আগে-তো একটা নির্বাচনের মাধ্যমে ১৮ দলীয় জোটকে বিজয় অর্জন করে ক্ষমতায় আসতে হবে এবং এরপর তাদের অন্যতম পার্টনার মৌলবাদী-জঙ্গিবাদী শক্তির নবজাগ্রত উত্থান এবং আক্রমণের শিকার হতে হবে বাংলাদেশকে। বিএনপি নেতৃত্বের সবার কাছে এ বিষয়টি সমানভাবে গ্রহণযোগ্য হবে কি? যদি এ ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল ভবিষ্যতের কথা ভেবে বিএনপির মধ্যে নতুন মেরুকরণ ঘটে এবং মৌলবাদী জঙ্গি শক্তি শেষ পর্যন্ত বিএনপি কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়ে একঘরে হয়ে যায় তাহলে কী ঘটবে সেটা বলা মুশকিল। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন এমন এক মাত্রায় পৌঁছে গেছে যেখানে নারীদের ঘরে আটকে রাখা বা তালেবানি কায়দায় দেশ চালানো আদৌ আর সম্ভব নয়। সুতরাং মৌলবাদের ওপর ভর করে বিএনপি ক্ষমতায় আসলেও মৌলবাদী ধারার রাজনীতি ও অর্থনীতি সাজাতে গেলে বিএনপি ডুবতে বাধ্য হবে। কিন্তু বিএনপির কাঁধে ভর করে মৌলবাদের সাময়িক উত্থান এবং সাময়িক ধ্বংসলীলা খুবই বাস্তব একটি সম্ভাবনা হিসেবে বিরাজমান। সুতরাং অধিকাংশ বিশ্লেষকই শেষ পর্যন্ত ‘খ’ অথবা ‘গ’ এই দুই পরিণতির কথাই ভাবছেন বলে দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ গণতন্ত্র রাখতে গেলে মৌলবাদকে মেনে নিতে হবে অথবা মুক্তিযুদ্ধকে রাখতে হলে গণতন্ত্রকে বিসর্জন দিতে হবে।<br />
<br />
তবে অনেক কিছুই নির্ভর করে যাকে আমরা বলি ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’ বা ‘লস মিনিমাইজেশন’- সেই ধারায় কতটুকু দৃঢ়তা ও ধৈর্য নিয়ে আওয়ামী লীগ এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রগতিশীল মিত্ররা এগুতে পারবেন তার ওপর। আত্মসমালোচনায় বিশ্বাসী এ ধারার কোনো কোনো আওয়ামী নেতা আমাকে বলেছেন, তারা প্রায় অর্ধেক দুর্নীতি পরায়ণ ব্যক্তিকে পুনরায় মনোনয়ন প্রদান করবেন না বলে স্থির করেছেন এবং তাদের স্থানে নতুন সৎ, যোগ্য ও জনপ্রিয় প্রার্থীদের এবার মনোনয়ন দেয়া হবে। তারা এটাও বলছেন, মুক্তিযুদ্ধের ধারায় দেশকে পরিচালনার জন্য যাবতীয় দোদুল্যমানতা পরিহার কওে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজকেও দৃঢ়ভাবে এগিয়ে নেয়া হবে। এভাবে দেশব্যাপী একটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি করা হবে। জানি না, এটা কথার কথা কী না। যদি এটা হয় তাহলে আওয়ামী লীগের জন্য ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি হলেও হতে পারে । এ কথাও কেউ কেউ বলেন, এবার আওয়ামী লীগের শাসনামলে শিল্প ও শহরাঞ্চলে যতখানি অগ্রগতি হয়েছে সেই তুলনায় গ্রামাঞ্চলে উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির মাত্রা ছিল বেশি। সেজন্য তারা বলতে চান যে সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনী সূচক আর পল্লী এলাকায় ভোটের সূচক এক হবে না। সম্ভবত সেই ধরনেরই কোন জরীপ থেকে প্রধানমন্ত্রী পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় আওয়ামী লীগের পক্ষে এক ধরনের বিজয়ের ইঙ্গিত দিয়েছেন। কিন্তু আমি যেই দুই ধরনের নতুন পদক্ষেপ গ্রহণের কথা উল্লেখ করলাম সেটি ছাড়া শুধু নিছক তথ্য-জরিপ নিয়ে আত্মসন্তুষ্ট হয়ে বসে থাকলে পরিস্থিতি সামান্যই সামাল দেওয়া যাবে বলে আমার মনে হয়।<br />
<br />
আরেকটা দিক হচ্ছে, সামরিক বাহিনী ও সুশীল সমাজ ২০০৭ সালের ১/১১-এর আগে যে রকম তৎপর ছিল, সে ধরনের তৎপরতা এবারে দেখাচ্ছে না। এমতাবস্থায় সাধারণ নির্বাচনে নিশ্চিত জয়ের প্রত্যাশায় থাকা বিএনপি অনেকখানি ছাড় দিয়ে হলেও নির্বাচনে আসতে রাজী হয়ে যেতে পারেন। আর এটাও আমরা জানি, আগের মতো এখন মিডিয়া ক্যু ও ভোট চুরি করা সম্ভব নয়। একটি মোটামুটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলেও হতে পারে এবং এতে থাকতে পারে সব পক্ষের অংশগ্রহণ। তখন গণতন্ত্র অব্যাহত থাকবে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে- কে তখন জয়ী হবেন এবং তারপর কী হবে। আবার যদি শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বচনে অংশগ্রহণে সম্মত না হয় এবং আওয়ামীলীগ এক তরফা নির্বাচন করে ক্ষমতাসীন হয়, তাহলে তখন অবস্থাটি কী দাঁড়াবে? এই বিশ্লেষণ থেকে দেখা যাচ্ছে যে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি যে-ই আগামী নির্বাচনে জিতুক না কেন সামগ্রিকভাবে পরিস্থিতি ‘খ’ অথবা ‘গ’-র মধ্যেই আটকে থাকবে। ‘খ’ এবং ‘গ’ যেহেতু টহংঃধনষব ঊয়ঁরষরনৎরঁস ঝরঃঁধঃরড়হ, কারও জন্যই সর্বোচ্চ কাম্য পরিস্থিতি নয়, সেহেতু এ অবস্থাও হবে ক্ষণস্থায়ী। তবে কি আমরা শেষ পর্যন্ত ধাবিত হব সবচেয়ে খারাপ ‘ঘ’ পরিণতির দিকে যেখানে গণতন্ত্রও অনুপস্থিত মুক্তিযুদ্ধও অনুপস্থিত?<br />
<br />
এই সর্বশেষ ভয়ংকর পরিণতির বিরুদ্ধে আমাদের সকলকেই সর্বশক্তি নিয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে। সব জটিলতা সত্ত্বেও আমাদের সবচেয়ে কাম্য যে ফল- গণতন্ত্র অব্যাহত থাকবে এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি এগিয়ে যাবে, যত কঠিনই তা হোক না কেন, সেজন্যই আমাদের লড়তে হবে। যদিও স্বল্প মেয়াদে এই দুয়ের যুগপৎ উপস্থিতি কার্যত অসম্ভব বলেই এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে। কিন্তু অসম্ভবকে সম্ভব করতে পেরেছিলাম বলেই আমরা একাত্তরে প্রবল শক্তিধরকে হারিয়ে বিজয় অর্জন করতে পেরেছিলাম।<br />
<br />
লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।সুশান্ত বর্মনhttp://www.blogger.com/profile/02304984470756506973noreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-7423733237485716191.post-9357536362677012692013-10-02T22:20:00.000+06:002018-03-07T13:51:56.555+06:00রংপুরের লোকজ সংস্কৃতি ও মেলাএস এম আব্রাহাম লিংকন<br />
<br />
কত শতাব্দী আগে রংপুর অঞ্চলে মেলার প্রবর্তন হয়েছিল তা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। তবে কৃষি ও কুটিরশিল্প বিস্তারের সাথে সাথে মেলা সংস্কৃতির বিকাশ হয়েছে- এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না। মেলা শুধু পণ্যের সমাহার নয়, নয় শুধু বিনোদনের পশরা, এটা সৌহার্দের প্রতীক- সম্প্রীতির প্রতীক। মেলাকে ঘিরে সংস্কৃতির নানাবিধ বিনোদন ছাড়াও আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকা- জড়িত। মেলায় যেমন চিত্তবিনোদনের আয়োজন থাকে তেমনি থাকে রকমারি দ্রব্যাদির সমাবেশ। এ জনপদে (রংপুর) বহুপ্রকার মেলার বিপুল আয়োজন ছিল, যার কোন কোনটি এখনও আয়োজিত হয়। অতীতে রংপুর জেলায় যেসব স্থানে মেলা বসতো এবং কোথাও কোথাও এখনও বসে, সেসব মেলার মধ্যে বৈশাখী মেলা অন্যতম। ইদানিং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় কৃষি মেলা ও বৃক্ষ মেলা’র আয়োজনও চোখে পরার মতো। রংপুর অঞ্চলের প্রায় সব বড় বড় শহরে এ ধরনের মেলার আয়োজন লক্ষ্য করা যায়। তবে অত্র অঞ্চলের ঐতিহ্যগত কিছু মেলার অবস্থান সম্পর্কে একটু আলোচনা করা যাক।<br />
<br />
বৈশাখী মেলা: বৈশাখী মেলা জেলা শহরেতো বটেই, গ্রামাঞ্চলেও এর ঐতিহ্যগত আয়োজন আজও মুগ্ধ করে। যেমন- রংপুর শহরের বাইরে নিসবেৎগঞ্জ, পীরগঞ্জের কালসাভারা, পীরগাছার চণ্ডীপুর, লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা, খেজমতপুর, ধাপেরহাটের তেলাস, কুড়িগ্রামে প্রচ্ছদের বৈশাখী মেলা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এ মেলাগুলোর দু-একটি মাসব্যাপী হয়। অষ্টমী ও বারুনীর মেলা: কুড়িগ্রামের চিলমারিতে ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে অষ্টমীর স্নানের দিনে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। রংপুর বিভাগের সবচেয়ে বড় মেলা এটি। এ মেলায় কয়েক লক্ষ পূণ্যার্থীর সমাবেশ হয়। একই দিনে কুড়িগ্রামের গওহর পার্ক মাঠেও (মজিদা কলেজ মাঠ) একটি মেলা বসে। মেলাটিতে ব্যাপক শিশুর সমাবেশ হয় বলে একে চেংড়ার মেলা নামে অভিহিত করা হয়। এ মেলায় মূলত কৃষকরা রসুন বিক্রি করে। তাই এ মেলাকে স্থানীয়ভাবে রসুনের মেলা নামেও অভিহিত করা হয়। অষ্টমীর ¯œান উপলক্ষে বদরগঞ্জের ট্যাক্সের হাটের করতোয়া মেলা, দামোদরপুরের শেকেরহাট মেলা, রংপুর সদরের খটখটিয়ার মেলা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও রংপুরের চব্বিশ হাজারী, পীরগঞ্জের জাফরপাড়া, পাটগ্রামের বড়বিল, হরিণসিংগার দিঘি প্রভৃতি এলাকার মেলাগুলো বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এদিকে রাজারহাটের বৈদ্যবাজার এলাকায় মাসাম কুড়ার মেলা বেশ ঐতিহ্য বহন করছে এখনও। কুড়িগ্রামের রাজারহাট ও লালমনিরহাট থানার সীমান্তে একটি বিরাট পুকুরের পারে অনুষ্ঠিত সিন্দুরমতির মেলা ও যশোহারার মেলা বিশেষ উল্লেখ্য। যশোহারার মেলায় প্রচুর পরিমাণে খেজুর বিক্রি হয় বলে একে খেজুরের মেলাও বলা হয়, এ মেলায় প্রচুর পাখিও কেনা-বেচা হয়। এদিকে জলঢাকার ডিমলার টটুয়ায় বারুণীর মেলা আজও তার প্রাচীন ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। চৈত্র সংক্রান্তির মেলা: রংপুরের হাজিরহাট, গঙ্গাচড়ার ধামুর, পীরগাছার কান্দিরহাট ও অন্নদানগরের যাদুলস্করে চৈত্র সংক্রান্তিতে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। মহরমের মেলা: রংপুর মিঠাপুকুরের ছড়ানের হাট, শুকুরের হাট, শঠিবাড়ির হাট, মিঠাপুকুর বাজার, বড়দরগাহ্র হাট, মোসলেম বাজার, গংগাাচরার মহীপুর, কুড়িগ্রামের খলিলগঞ্জ, চওড়া হাট, বালার হাট, ফকিরের হাট প্রভৃতি স্থানে মহরম উপলক্ষে মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এদের মধ্যে কুড়িগ্রামের খলিলগঞ্জ’র মেলাটি তাজিয়ার মেলা নামে পরিচিত। চড়ক মেলা: রংপুর বুড়িরহাটের চব্বিশ হাজারী, লাহিড়ীর হাট, গংগাচরার চন্দনহাট, তারাগঞ্জের চড়ক ডাংগা, মিঠাপুকুরের হাছিয়াহাট, নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের বড়ভিটায় চরক মেলা বসে। রাস মেলা: পীরগঞ্জের তাম্বলপুরহাট ও ভোলানাথেরহাটে অগ্রহায়ণ মাসের শেষ সপ্তাহে ১০১টি মূর্তির মেলা হয়। এ মেলা রাস মেলা নামে পরিচিত। মনসার মেলা: পীরগঞ্জের বিষ্ণুপুরের কচুবাড়িতে মনসা পূঁজা উপলক্ষে এ মেলা হয়। নানকার মেলা: এ মেলা মিঠাপুকুরের নানকার বাজারে রাসপূর্ণিমা উপলক্ষে আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের দিন অনুষ্ঠিত হয়। মাঘী পূর্ণিমার মেলা: রংপুর পীরগঞ্জের এ মেলাকে মাদারগঞ্জের মেলাও বলা হয়। এ মেলা মাঘী পূর্ণিমা উপলক্ষে দু’সপ্তাহ জুড়ে হয়। পৌষ সংক্রান্তি মেলা: পীরগঞ্জের চৌধুরী মেলা ও ভেন্ডাবাড়ির মেলা পৌষ সংক্রান্তিতে অনুষ্ঠিত হয়। বৃহত্তর রংপুর জেলার অন্যান্য জেলাগুলোতেও এ মেলা লক্ষ করা যায়। ঈদ মেলা: এ অঞ্চলে ঈদের দিনে অনেক স্থানে মেলা বসে। তারাগঞ্জের চৌপথী মেলা, কাউনিয়া ও তিস্তার মেলা, ডাংগীরির হাটের মেনা নগর, দামোদরপুর নারাবাড়ী প্রভৃতি স্থানে ঈদ মেলা উল্লেখযোগ্য। ওরশ মেলা: এ মেলা স্থানীয় পীর মাশায়েখদের মাজার কেন্দ্রীক আয়োজন হয়। রংপুর অঞ্চলে এ মেলার আয়োজন লক্ষনীয়, গংগাচড়ার পাকুরিয়ার কছিমুদ্দিন পীরের বাৎসরিক ওরসের সময় এ মেলা হয়। মাঘ মাসের ৫-৬ তারিখে কোলকন্দের আলী পীরের ওরস অনুষ্ঠিত হয়। এ মেলাকে পীরের হাটের ওরস মেলা বলা হয়। এছাড়া দোয়ালী পাড়া, তকেয়া শরীফ ও তারাগঞ্জে ওরস উপলক্ষে মেলা আয়োজন করা হয়। বউ মেলা: মহারাজা তাজহাট এ মেলার প্রবর্তন করেছেন বলে প্রচার আছে। এলাকার নারীদের বিনোদনের জন্য এ মেলা পহেলা বৈশাখে অনুষ্ঠিত হয়। পশুর মেলা: এ মেলা নীলফামারীর দাড়োয়ানীর মেলা, ডোমারের পাঙ্গার মেলা হিসেবে পরিচিত। মাসব্যাপি এ দু’টি মেলায় প্রচুর গবাদি পশু ক্রয়-বিক্রয় হয় বলে একে পশুর মেলা বলা হয়ে থাকে। দূর্গা পূজার মেলা: রংপুরের সমগ্র অঞ্চলে এ মেলা হয়। মূলতঃ ষষ্টি থেকে শুরু হয়ে বিজয়ার দিন পর্যন্ত এ মেলাগুলো চলে। অতীতে এ মেলা হত রাজা ও জমিদারদের দূর্গামন্ডপের নিকটবর্তী। এখন যেখানেই দূর্গামন্ডপ সেখানেই এ মেলার অস্তিত্ব লক্ষনীয়। কালীর মেলা: কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীর মাদাই খালের কালী মন্ডপকে ঘিরে কালী পূঁজার সময় এ মেলা হয়। এ মেলাটি মাদাইখালের মেলা নামে পরিচিত। এ মেলাকে উপলক্ষ্য করে ভাওয়াইয়া যুবরাজ কছিমুদ্দিন লিখেছিলেন অমর গান “সবাই মিলি বুদ্ধি করি ১২ হাত বানাইছে কালী, কালীর মেলা মাদাইখেলোতেু। কালীর মেলা নীলফামারীর কালীগঞ্জে, লালমনিরহাটের কুলাঘাটে এবং কুড়িগ্রামের দাসের হাটে ব্যাপক ভাবে আয়োজন করা হয়। দাসেরহাটের কালী মূর্তিটি উভয় বঙ্গের মধ্যে বড়। রোকেয়া মেলা: প্রতি বছর ৯ ডিসেম্বর পায়রাবন্দে রোকেয়া মেলা অনুষ্ঠিত হয়। মহিয়সী বেগম রোকেয়া সাখাওয়াতের জন্ম ও মৃত্যু দিবসকে কেন্দ্র করে সরকারি ও স্থানীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এ মেলাটি পরিচালিত হয়। এদিকে কুড়িগ্রামের কৃতীকন্যা প্রয়াত নারী নেত্রী শামসুন নাহান চৌধুরী সানু’র জন্ম দিন ১৬ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় সানু মেলা। এছাড়াও হালের কারুশিল্প মেলা, বই মেলা, পিঠা মেলা, শিল্পমেলা, বিজয় মেলা (বিজয় দিবসে হয়), পর্যটন মেলা, আবাসন মেলা, ব্যাংকগুলোর ঋণ মেলা, সঞ্চয় মেলা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। যুগের চাহিদার সাথে মিল রেখে আগামী দিনে হয়তো নানা ধরনের মেলার জন্ম হবে আবার অনেকগুলো হারিয়ে যাবে কালের গহ্বরে। সেগুলোকে হয়তো খুঁজতে হবে ইতিহাসের পাতায়। আমাদের লোক সংস্কৃতির চিরায়ত এ ধারা আধুনিক ও যান্ত্রিক সভ্যতার আঘাতে আজ অনেকটাই বিপর্যস্ত। তবুও এ সকল মেলা অতীত ঐতিহ্যের স্মারক ছাড়াও এ অঞ্চলের মানুষের স্বতন্ত্র সত্তার পরিচয় বহন করে। মেলাগুলো সংশ্লিষ্ট এলাকার নিজস্ব সংস্কৃতির অংশ। মেলাগুলোকে আর্কষণীয় করার জন্য কোথাও কোথাও খেলাধূলার আয়োজন করা হয়ে থাকে। আবার কোথাও কোথাও খেলার আয়োজনকে কেন্দ্র করে একদল মানুষ পণ্যের পশরা নিয়ে বসে যা মেলার রূপ ধারণ করে। যেমন নৌকা বাইচের সময় নদীর পাড়গুলি মেলার রূপ পরিগ্রহ করে।<br />
<br />
মেলা এবং মেলার বাইরে যে খেলাগুলো এ অঞ্চলের সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার সাথে জড়িয়ে আছে সেগুলোর অন্যতম হল- হাডুডু, কাবাডি (কাপাটি), লাঠি খেলা, দাঁড়িয়া বান্ধা, গোল্লাছুট, এক্কা-দোক্কা, বউ-ছুট, লুকোচুরি, চেংকুডারা বা চেংগু-পেন্টি (বলা যায় বর্তমান ক্রিকেটের এ দেশীয় আদিরূপ), তরবারি খেলা, পাতা খেলা, গুড্ডি বা ঘুড়ি উড়ানো খেলা, কেরাম খেলা, নৌকাবাইচ, ঘোড়দৌড়, ফুটবল, আটকোটা, উরূণ-গাইন, লুডু, পিংপং, পিন্টু-পিন্টু, লুকোচুরি প্রভৃতি। নিজস্ব ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এই খেলাগুলো এ অঞ্চলের মানুষের একদা শরীর চর্চা ও আনন্দ বিনোদনের মাধ্যম ছিল। অবশ্য এখন আধুনিক খেলাধুলার মধ্যে প্রচলিত ফুটবল, ব্যাডমিন্টন, ভলিবল, টেনিস, ক্রিকেট, মার্শাল আর্ট প্রভৃতির চর্চাই বেড়েছে অনেক বেশি। এগুলোর অধিকাংশই শহর কেন্দ্রিক। এ জনপদে অধিকাংশ মেলায় জুয়া খেলার অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। জুয়া নির্দিষ্ট একটি খেলার নাম নয়, যে খেলাটি বাজি ধরে খেলা হয় এবং বিনিময়ে আর্থিক সুবিধা লাভ করা যায় তাকেই বাজী যা স্থানীয়ভাবে জুয়া খেলা বলা হয়। এ খেলাটি মেলার সময় ব্যাপক রূপ পায়। সাধারণত যে বিষয়গুলি আমাদের কাছে আদিকাল থেকে জুয়া হিসেবে দৃশ্যমান সেগুলো হচ্ছে তাসখেলা, চুড়ি খেলা, ডাব্বু খেলা, পাশা খেলা, হালের হাউজি খেলা প্রভৃতি। এ খেলাগুলো বিনোদন অপেক্ষা পারিবারিক ও অর্থনৈতিক বৈকল্য সৃজনে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছে।<br />
<br />
মেলায় খেলাধূলা ছাড়াও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে যারমধ্যে লোক নৃত্য, ভাওয়াইয়া, আধূনিক, রবীন্দ্র নজরুল সঙ্গীত প্রভৃতি লক্ষ করা যায়। এখানে জারি গান, পুঁথি, যাত্রা, পালাগান, কুশানগান, সার্কাস, পুতুলনাচ প্রভৃতি দৃশ্যমান।<br />
<br />
মেলাগুলোতে যে সকল পণ্য ও শিল্প-সম্ভার পাওয়া যেত তার অধিকাংশই রংপুরজাত। যেমন- চারুকারু শিল্প: এ জনপদে গড়ে উঠেছিল বেশ কিছু কুটির শিল্প। লোকায়ত শিল্পদ্রব্যগুলোর মধ্যে ছিল রেশম, তাঁত, সতরঞ্জি, পাট, মৃৎশিল্প, কাঁসা, পিতল ইত্যাদি। এছাড়াও কর্মকার, স্বর্ণকার, বয়নকার, দর্জ্জি ইত্যাদি পেশার মানুষ সুন্দর সুন্দর জিনিস তৈরি করত। বাঁশ-বেত: রংপুর অঞ্চলের বাঁশ ও বেতজাতদ্রব্য স্থানীয় চাহিদা পূরণ করেও অন্যত্র রপ্তানী করা হতো একটা সময়। বাঁশ-বেত ও কাঠজাত দ্রব্য তথা- ফুলদানী, কলমদানী, ছাইদানী বাঁশের ডাড়কী, বানা, খলই, জনগা, পলো, ভোরং, ডারকি, হেংগা, কবুতরের বাসা, ঘোরপা, ডালি, কুলা, চাটাই, চালুন, খাচা, চাঙ্গারী, টোপা প্রভৃতি ব্যবহারের অপরিহার্য সামগ্রী প্রচলিত বাজার ছাড়াও মেলায় পাওয়া যেত। তাঁত: এটি বেশ প্রাচীন শিল্প। অতি প্রাচীনকাল হতেই রংপুরে তাঁত শিল্পের কার্যক্রম ছিল। তাঁতীদের উপর এ অঞ্চলের মানুষ তাদের পোশাকের জন্য নির্ভরশীল ছিল। মাহিগঞ্জ, বদরগঞ্জ, কালিগঞ্জ, গোবিন্দগঞ্জ, সৈয়দপুরে এ শিল্পে বেশ সক্রিয় ছিল। সৈয়দপুরের শিল্প আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমাদৃতও ছিল। বর্তমানে রৌমারীর তাঁত শিল্প আন্তর্জাতিক প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। এ পণ্যগুলো আমাদের মেলায় পণ্য তালিকায় দেখা যায়। শতরঞ্জি: অতীতের মতো এখনও শতরঞ্জি তৈরি হয় এবং বিদেশে রপ্তানী হয়। নিসবেতগঞ্জ এবং রংপুর জেলখানায় আগে থেকেই এ শিল্প ছিল। পাট: রংপুরে পাট দিয়ে যেমন থলে, বস্তা, কার্পেট তৈরি হয় তেমনি গ্রামীণ মেয়েরা পাট দিয়ে সুন্দর সুন্দর শিকা তৈরি করে। রেশম: রংপুরের রেশম শিল্পের বিপুল খ্যাতি ছিল। ইতিহাসে দেখা যায় ১৭৩৩ খ্রিস্টাব্দে রংপুর হতে ইউরোপে রেশম রপ্তানি হয়েছিল। মৃৎ শিল্প: মাটির হাঁড়ি-পাতিল, খোরা, মটকা, কলসী, সানকী, বদনা, ঘটি ইত্যাদি ছিল রংপুরের গ্রামীণ জীবনে প্রাত্যহিক ব্যবহার্য দ্রব্য। মাটির পাট দিয়ে কুয়া নির্মাণ ও টালি দিয়ে ঘর নির্মাণ করা হয় এখনও। বিভিন্ন উৎসব ও মেলায় মাটির তৈরি পুতুল, নৌকা, হাতি, ঘোড়া ইত্যাদি পুতুল জনপ্রিয় ছিল। কাসা, পিতল ও লোহা: রংপুর অঞ্চলের কাসা, পিতল ও লোহার তৈজস ও অন্যান্য শিল্পজাত দ্রব্য জনপ্রিয় ছিল। কামার নির্মিত দা, কুড়াল, কোদাল, বাইশ, ছুরি, বটি, কাটারি, বর্শা, বল্লম, কাস্তে, শাবল, পাসুন প্রভৃতি মানুষের সাংসারিক কাজকর্মে এবং আত্মরক্ষায় বহুল ব্যবহৃত। নকশী কাঁথা: এক সময় রংপুরে নকশী কাঁথার বিপুল প্রচলন ছিল। গ্রামীণ সমাজে এ শিল্পের বিকাশ হলেও শহর জীবনে এগুলোর ব্যাপক ব্যবহার ছিল। কাঠ শিল্প: কাঠ শিল্পের নিদর্শন এ অঞ্চলের বাড়ি-ঘরের জানালা দরজায় সুন্দর সুন্দর চিত্রকর্মর দ্বারা প্রকাশিত। চৌকি, মাইপোষ, খাট, পালকী, টেবিল, চেয়ার, আলনা, সিন্ধুক, আলমারি ইত্যাদি তৈরিতে কারুশিল্পের নিদর্শন লক্ষনীয়। এ সকল দ্রব্য মেলায় সহজলভ্য। তামাক শিল্প: রংপুরের উৎপাদিত তামাক উন্নতমানের সিগারেট, চুরুট এর কাঁচামাল হিসেবে বিদেশে রপ্তানী হতো। হারাগাছ অঞ্চলে এই তামাক নিয়ে গড়ে উঠেছে বিড়ি শিল্প। বিড়ি শিল্পের পাশাপাশি তামাকজাত দ্রব্য দিয়ে গুল ও জর্দা প্রস্তুত হয়। মেলায় তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় ছাড়াও ডাব্বা- হুকার প্রচুর বিক্রয ছিল একটা সময়। ঢেঁকি শিল্প: রংপুরের গ্রামীণ জীবনে ব্যবহৃত ঢেঁকি- জাতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ। একটা সময় এই ঢেঁকিই ছিল গ্রামীণ মানুষের জীবিকার অন্যতম যন্ত্র। ঢেঁকিছাঁটা চালের কদর এখনও আছে। যদিও যান্ত্রিক সুবিধার যুগে ঢেঁকি শিল্প বিপন্ন। বস্ত্রাভ্যাস: এখানে স্থানীয় পুরুষরা আংগা (শার্ট বা জামা), নেংটি (লজ্জা নিরবারনের স্বল্প বসন), তহবন (তবন বা লুঙ্গি), গামছা, গেঞ্জি, ধুতি ,শীতের দিনে কাঁথা, গজি (চাঁদর) পরিধান করে। মেয়েরা খাড়ি (শাড়ি), ফোতা ছেওটা, ব্লাউজ ইত্যাদি পরিধান করে। ঐ সকল বস্ত্রের অনেকগুলিই স্থানীয়ভাবে প্রস্তুত ও বুনন হতো। যেগুলো মেলায় পশরা ধরে উৎপাদনকারীরা বিক্রি করতো এবং এখনও তা বিভিন্ন হাট-বাজারে বিক্রি হয়। খাওয়া দ্রব্যাদি: মুড়ি, মলা (মোয়া), খই, জলপান (মুড়কি), গজা, খোরমা, কটকটি, গুলগুলিয়া, তেল পিঠা (তেলুয়া পিঠা), চিতই, গরগড়িয়া, চাউল ভাজা, চালের গুড়া, গমের গুড়া, ভাত, পান্তাভাত, কড়কড়া ভাত, পিঁয়াজ, মরিচ, ভর্তা, শাক, সুকতানি, মাছ, মাংস, ডাল, শুটকি, শেদল, প্যালকা, শোলকা, হালের রুটি, পুড়ি, পরাটা, মিষ্টি, মাখন, পাউরুটি, সিঙ্গারা, খাজা, লবঙ্গ, বালুসাই, নিমকি, জিলাপি, গজা ইত্যাদি খাবার রংপুর অঞ্চলের সংস্কৃতির সঙ্গে আজও টিকে আছে এবং সারা বছর জুড়েই এ গুলো আমাদের জীবনের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। তবে অধিকাংশ পিঠা ও মিষ্টি জাতীয় সকল খাদ্যদ্রব্যই মেলার মূল পশরার অন্যতম।<br />
<br />
লেখক: পাবলিক প্রসিকিউটর, কুড়িগ্রাম এবং সদস্য, সুপ্রিম কোর্ট বার ও কলাম লেখক।সুশান্ত বর্মনhttp://www.blogger.com/profile/02304984470756506973noreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-7423733237485716191.post-39933033193231876142013-10-02T22:15:00.000+06:002018-03-07T13:51:56.509+06:00নারীদের দিকে নতুন চোখে তাকাতে শুরু করলামসিমোন দ্যা বুভোয়ার ♦ভাষান্তর: সুশান্ত বর্মন♦<br />
<br />
দ্যা সেকেন্ড সেক্স বইটির প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল জুন মাসে। ’Woman’s Sexual Initiation’ এর উপরে লেখা চ্যাপ্টারটি Les temps Modernes পত্রিকায় প্রিন্ট হয় মে মাসে, জুন-জুলাই ইস্যুতে ধারাবাহিকভাবে ’The Lesbian’ এবং ’Maternity’ প্রকাশিত হয়। এর দ্বিতীয় খণ্ড Gallirnard প্রকাশ করে।<br />
<br />
কীভাবে প্রথম বইটির জন্ম হল সেকথা আমি আগেই বলেছি। আসলে হঠাৎ করে হয়ে গেছে। নিজের সম্পর্কে বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বুঝতে পারলাম যে, এর আগে সাধারণভাবে নারীদের অবস্থা বর্ণনা করা দরকার। প্রথমে পুরুষরা তাদের জ্যোতির্বিদ্যা, ধর্ম, কুসংস্কার, বিভিন্ন ধারণা এবং সাহিত্যে নারীদের সম্পর্কে যা বলেছে সেই পৌরাণিক ধারণাগুলোকে নিয়েছি। যে বিষয়গুলো আমার কাছে একেবারে অস্পষ্ট ঠেকেছে, সেগুলোর এক ধারাবাহিক চিত্র তৈরির চেষ্টা করেছি। প্রত্যেক বিষয়ে পুরুষরা নিজেকে Subject হিসেবে সামনে রেখেছে আর মেয়েদেরকে object হিসেবে বিবেচনা করেছে। এই অনুমানটি অবশ্যই ঐতিহাসিক অবস্থার প্রেক্ষিতে ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। সার্ত্রে অবশ্য কিছু বাস্তব অবস্থাকে চিহ্নিত করার কথা আগেই বলেছিল। Ramatuelle তে যখন ছিলাম আমরা তখন সারাক্ষণ কথা বলছিলাম। আমি দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলাম, এত বড় কাজের সাথে যুক্ত থাকার কথা আমি কখনও কল্পনাও করিনি। কিন্তু এটাই সত্যি যে, সেইসব পৌরাণিক কাহিনীগুলো যা আড়াল করতে চাইতো, তার বাস্তব রূপ যদি জনগণ না জানতো তাহলে প্রচলিত গল্পকাহিনী বিষয়ে আমার পড়াশোনা মধ্য আকাশেই ঝুলে থাকত। এরপর আমি শরীরতত্ত্ব ও ইতিহাসের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আমি কোন তালিকা তৈরি করিনি, উভয় লিঙ্গের বিজ্ঞানীদের মধ্যে তুলনা করতে চাইনা, কিন্তু তাদেরকেও পুরুষতান্ত্রিক কুসংস্কার দ্বারা অনুপ্রাণিত থাকতে দেখেছিলাম। তাই আমি তাদের অনুবাদের তলানিতে যে সত্য লুকিয়ে আছে, তা খুঁড়ে দেখার চেষ্টা করেছি। ইতিহাসের পথ ভ্রমণ শেষে আমি খুব সামান্য কিছু আইডিয়া নিয়ে ফিরে এসেছি। এই আইডিয়াগুলো প্রকাশ্যে কখনও দেখিনি। আমি নারীর ইতিহাসকে এই বংশগতির সাথে সংযুক্ত করেছি। আমার কাছে এটাকে পুরুষের পৃথিবীর অর্থনৈতিক বিপ্লবের সহ-উৎপাদন হিসেবে মনে হয়েছে।<br />
<br />
আমি নারীদের দিকে নতুন চোখে তাকাতে শুরু করলাম। আমার জন্য অপেক্ষারত বিস্ময়পুঞ্জগুলোকে খুঁজে পেলাম। হঠাৎ আবিষ্কারের উৎসাহ ও বৈচিত্র্য এতে আছে। ৪০ এর পরে অভাবনীয় পৃথিবী চোখেমুখে মিটমিট করে জ্বলতেছিল। আমার বইটা সম্পর্কে মানুষ সবচাইতে ভুল বুঝেছে যে আমি বোধহয় নারী-পুরুষের মধ্যে যে পার্থক্য সেটাকে অস্বীকার করেছি। অথচ এই বইটি লিখতে গিয়ে যে বিষয়টি নারী-পুরুষকে আলাদা করেছে, সে বিষয়ে আমি সচেতন হয়েছিলাম। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, এই অমিলগুলোর বেশিরভাগ সাংস্কৃতিক, প্রাকৃতিক নয়। শৈশব থেকে বৃদ্ধ হওয়া পর্যন্ত বিষয়গুলি কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে তা আমি নিয়মতাত্ত্বিকভাবে বিশ্লেষণ করা শুরু করলাম। এই পৃথিবী নারীদেরকে যে সম্ভাবনাগুলো উপহার দেয়, আমি তাদেরকে বিশ্লেষণ করেছিলাম। এগুলোকে যারা প্রত্যাখ্যান করে তাদেরকে, নারীদের জন্য বরাদ্দ সম্ভাবনাগুলোকে, তাদের সীমাবদ্ধতাকে, তাদের সৌভাগ্য এবং দুর্ভাগ্য, তাদের উপেক্ষা পদ্ধতি এবং তাদের অর্জন, সবকিছুকে আমি পরীক্ষা করে দেখেছি। এর সবগুলোকে আমি L’Expérience vécue এর দ্বিতীয় খণ্ডে রেখেছি।<br />
<br />
আমি মাত্র দুই বৎসর এই কাজের জন্য ব্যয় করেছি [১] । এরমধ্যে সমাজবিজ্ঞান এবং মনোবিজ্ঞান সম্পর্কে সামান্য কিছু জ্ঞান অর্জন করেছি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া প্রশিক্ষণকে ধন্যবাদ। কার্যকরভাবে কাজ করা আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। কীভাবে বই সাজাতে হয়, কীভাবে সারবস্তু সংগ্রহ করতে হয়, কীভাবে কল্পচিত্রকে ঝেড়ে ফেলতে হয় তা আমি জেনেছিলাম। বিষয় সম্পর্কে ইংলিশ এবং ফ্রেঞ্চ ভাষাতে যা ছিল, তার একটি আকর্ষণীয় তালিকা আমি তৈরি করেছি। এই বিষয়টি প্রচুর সাহিত্যকর্মের জন্ম দিয়েছে, কিন্তু সাধারণ ঘটনা হল, এই বিশাল পাঠযজ্ঞের খুব অল্প পরিমাণই গুরুত্বপূর্ণ। যখন দ্বিতীয় ভল্যুমটির কাজ চলছিল, তখন সার্ত্রে এবং আমার নিরবচ্ছিন্ন কৌতূহল থেকে খুব উপকার পাচ্ছিলাম। আমরা অনেক বৎসর ধরে সব ধরণের মানুষ সম্পর্কে কৌতূহল বোধ করেছিলাম। আমার স্মৃতিশক্তিও আমাকে অনেক বেশি তথ্য দিয়েছে।<br />
<br />
প্রথম ভল্যুমটি ভালোভাবেই গৃহীত হয়েছিল। ২২ হাজার কপি প্রথম সপ্তাহে বিক্রি হয়ে গেছে। দ্বিতীয়টাও ভাল বিক্রি হয়েছে, কিন্তু এটা মানুষকে নাড়া দিয়েছে। যখন বই থেকে নেয়া কিছু অংশ Les Temps Modernes পত্রিকায় প্রকাশিত হল, তখন যে পরিমাণ অনাবশ্যক ও বাড়াবাড়ি রকমের ক্রুতার সৃষ্টি হয়েছিল তা দেখে আমি হতচকিত হয়ে গিয়েছিলাম। জুলিয়ান গ্রেক এক নিবন্ধে রীতিমত উল্লেখ করেছিলেন। তিনি আমার মনোবলের জন্য আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তিনি অবশ্য সমাধি নিয়ে কথা বলার জন্য আমাকে দার্শনিক গণিতবিদ Poincare এর সাথে তুলনাও করেছেন। এই ধরণের ফ্রান্সীয় অশালীনতার কোন প্রতিশোধ নিতে আমি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছি। শব্দটি যেভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, তা আমাকে প্রথমবারের মত হতবাক করেছে। করুণায় ভরা শ্রদ্ধা মিশিয়ে Claudine Chonez আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি কি আত্মবিশ্বাসী?’ আমি বলেছিলাম, ‘আত্মবিশ্বাসী!’ তারপর তিনি আবার বললেন, ‘তুমি অনেক বন্ধু হারাতে যাচ্ছ।’ আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, আমি চিন্তা করলাম, যদি আমি তাদেরকে হারাই, তাহলে তারা আমার বন্ধু নয়।’ আমি যেভাবে লিখতে চেয়েছি, যে কোন মূল্যে ঠিক সেভাবেই বইটি লিখেছি। কিন্তু কখনও হিরো হবার কোন বাসনা আমার ছিল না। যাদের আমি ভালো চিনি, সেই মানুষগুলো, সার্ত্রে, Bost, Merleau-Ponty, Leiris, Giacometti এবং Les Temps Modernes পত্রিকার কর্মীরা ঠিক এই বিষয়ে অন্যদের চাইতে অনেক বেশি গণতান্ত্রিক। যদি আমি তাদের জন্য লিখতে থাকতাম, তাহলে হয়তো একটি খোলা দরজা ভেঙে ফেলার বিপদে পড়ে যেতাম। যে কোন উপায়েই হোক না কেন আমাকে ঠিক সেই দোষেই দোষী করা হচ্ছিল। নানা কিছু আবিষ্কার, ব্যঙ্গ করা, বকবক করা সবকিছু চলছিল। আমাকে অনেক বিষয়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে, সবকিছু সম্পর্কে। প্রথমত: এর সবগুলোই অশালীন, জুন জুলাই এবং আগস্ট সংখ্যার Les Temps Modernes হটকেকের মতো বিক্রি হয়েছে। সেগুলো কিন্তু পড়া হয়েছে, যেভাবে ছিল, ঘোলাটে চোখে। কেউ হয়তো বিশ্বাস করতে পারে যে ফ্রয়েড এবং মনোবিশ্লেষকদের কখনও কোন অস্তিত্ব ছিল না। আমার কারণে আমাকে আঘাত করার জন্য লিখিত রচনাগুলো মূলত অশ্লীল আচরণের নগ্ন উৎসব মাত্র। সেই পুরনো মনোভঙ্গি অতিদ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল। আমি স্বনামে বেনামে লেখা বেশ কিছু শ্লেষাত্মক কবিতা, ব্যঙ্গকৌতুক, পরামর্শ এবং উপদেশ দেয়া চিঠি পেয়েছি। উদাহরণস্বরূপ প্রথম লিঙ্গের একজন সক্রিয় সদস্য অতৃপ্ত, কামশীতলময় মহিলা, Priapic যৌন তাড়িত নারী, সমকামী, শতবার বাতিল হওয়া, আমি সবকিছু এমনকি অবিবাহিত মাতা। মানুষ আমার কামশীতলতা দূর করে দেয়ার অথবা আমার যৌনক্ষুধাকে আরও বেশি জাগিয়ে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। গুপ্ততথ্য ফাঁস করে দেয়ার জন্য আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম। এক অমার্জিত, স্থূল পদ্ধতিতে, কিন্তু সত্য, ভালো এবং সৌন্দর্যের নামে, সুস্বাস্থ্যের নামে এমনকি কবিতার নামেও। সব মূল্যহীন জিনিসগুলোকে আমি পায়ের তলে পিষে ফেলেছি। এসব আসলে টয়লেটের দেয়ালের একঘেয়ে লেখাগুলোর মত। আমি বুঝতে পারি যে যৌনবাতিকগ্রস্থরা বৈচিত্র্যের জন্য তাদের কীর্তিকে আমার কাছেই পাঠাতে চায়। কিন্তু আমি Mauriac এর কাজে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। Les Temps Modernes পত্রিকার জনৈক কর্মীর কাছে তিনি লিখেছিলেন: আমার কাছে আপনার কর্মচারীর যৌনঅঙ্গাবলীর আর কোন গোপনীয়তা নেই। এ থেকে বোঝা যায় যে ব্যক্তিগত জীবনেও শব্দ নিয়ে তিনি সতর্ক নন। যখন তিনি শব্দগুলো মুদ্রিত দেখলেন, তখন এত বেশি উত্তেজিত হলেন যে Le Figaro litteraire পত্রিকায় সাধারণভাবে পর্নোগ্রাফি এবং বিশেষ করে আমার প্রবন্ধগুলোকে দোষ দেয়ার জন্য ফ্রান্সের যুবসমাজকে প্রায়ই পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। এর সাফল্য কম ছিল। Pauillon এবং Cau আমাকে রক্ষার জন্য উড়ে এসেছিল। তাদের প্রত্যুত্তরগুলি দমননীতির শিকার হয়েছিল এবং সম্ভবত এরকম আরো অনেকের ক্ষেত্রেও হয়েছিল। আমার স্বপক্ষ ছিল। অন্যদের মধ্যে Domenach খ্রিষ্টানদের কুপিত হওয়া খুবই মার্জিত ছিল এবং সামগ্রিকভাবে বললে তরুণরা আমার অতিরিক্ত বাক্যগুলোকে খুব একটা অবাঞ্ছিত ভাবেনি। ঠিক তখন তিনি তার ধারাবাহিক রচনা বন্ধ করতে যাচ্ছিলেন। তখন এক অপ্সরীর মত রূপবতী এক নারী তাকে একটি চিঠি দিল। তার (Domenach) প্রত্যেকটি আকাক্সক্ষাকে তিনি এত নিখুঁতভাবে বিশ্লেষণ করে স্বীকৃতি দিয়েছেন যে আমরা অনেকে এই ঘটনায় খুব আমোদিত হয়েছিলাম। Maurine সত্যিই একটি ভাল জিনিস পেয়েছেন। তা সত্ত্বেও রেস্টুরেন্ট এবং ক্যাফেতে- যা আমি Algren এর জন্য বেশি বেশি যাই- জনগণ আমার দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে অথবা সরাসরি আমাকে দেখিয়ে ব্যাঙ্গের হাসি হাসত। Boulevard Montparnasse এর Nos এলাকায় একদিন রাতের খাবারের সময় কাছের টেবিলের লোকজন আমাকে দেখে হাসাহাসি শুরু করল। আমি টানাহেঁচড়া পছন্দ করি না, Algren ঘটনার সময় সাথে ছিল, যখন চলে আসার সময়, আমার মনের এক টুকরো তাদেরকে দিয়ে এলাম।<br />
<br />
হিংস্রতার তীব্রতা এবং প্রতিক্রিয়ার মাত্রা দেখে আমি হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিলাম। ল্যাটিন মানুষদের মধ্যে ক্যাথলিক মতবাদ পুরুষালী নিষ্ঠুরতাকে উৎসাহিত করে এবং এমনকি ধর্ষকামীতার দিকে ঠেলে দেয়। ইটালির মানুষদের মধ্যে এর সাথে রূঢ়তাকে যোগ করার প্রবণতা আছে এবং স্প্যানিয়ার্ডরা যোগ করে ঔদ্ধত্য। কিন্তু এই ধরণের নোংরা মানসিকতা ফ্রেঞ্চদের একেবারে নিজস্ব। কেন? নারীবাদী প্রতিযোগিতাকে ফ্রান্সের একজন পুরুষ প্রাথমিকভাবে অর্থনৈতিক হুমকি বলে মনে করে অথবা রাষ্ট্রীয় আইনের মাধ্যমে নিশ্চয়তা দেয়া হয়না এমন এক শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখা জাহির করে। নোংরা কথা বলার প্রথা বিভিন্ন প্রবচন, প্রতিচিত্র, ক্ষুদ্র কাহিনী এবং শব্দভাণ্ডারেও রয়েছে। এই জাতীয় প্রথা নারীদের যৌনবস্তু মনে করার ধারণায় অনেক রসদ যোগায়। অবশ্য যৌনপ্রবৃত্তির ক্ষেত্রে ফ্রেন্স শ্রেষ্ঠত্বের বংশানুক্রমিক ধারণাটিও হুমকির মুখে পড়েছিল। ইদানীং ফ্রেঞ্চ পুরুষের চাইতে ইটালির পুরুষদেরকেই আদর্শ প্রেমিক মনে করা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত মুক্ত নারীকে সমালোচনার উদ্দেশ্য তাদের সঙ্গীকে আঘাত অথবা ক্লান্ত করে, এটা তাদেরকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। এই অর্থহীনতা হল শুধু ফ্রান্সের পুরনো কামজ্বরে আক্রান্ত হওয়া মানসিক আঘাত দিতে ও থু থু ছিটাতে সক্ষম পুরুষ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হওয়া। [২]<br />
<br />
গত নভেম্বরে তরবারিগুলো আবার একবার কোষমুক্ত হয়েছিল। সমালোচনা পাশবিকতায় পরিণত হয়েছিল। মহিলারা সবসময় পুরুষের সমান ছিল, তাদেরকে চিরকালের জন্য হীনমন্যতার আড়ালে ঠেলে দেয়া হয়েছিল, আমি যা কিছু বলেছি সবই সাধারণ জ্ঞান- এই বিষয়ে মতভেদের কোন অবকাশ নেই, সমস্ত বইতে একটাও সত্যি কথা নেই। Liberte’ de l’esprit -এ Boideffre এবং Nimier দুজনই ঘৃণা প্রকাশে আরো সাফল্য প্রকাশ করেছিল। আমি অসহায় মানসিক রোগী, আমি অবদমিত, হতাশ এবং জীবন দ্বারা প্রতারিত, খান্ডারনি, এমন এক মহিলা যে ঠিকমতো ভালোবাসতে পারেনি, পরশ্রীকাতর, তিক্ততাপূর্ণ এবং পুরুষদের সম্মানের প্রেক্ষিতে হীনমন্যতাবোধে ফেটে পড়ছিলাম; পুরুষদের প্রতি আমার বিদ্বেষ এত বেশি যে আমি যেন নিজের মাংস নিজে কামড়াচ্ছিলাম। [৩] খুব খ্রিস্টানি করুণা নিয়ে Jean Guitton লিখেছেন যে, দ্যা সেকেন্ড সেক্স তাকে খুব বেদনার সাথে আঘাত করেছে কারণ যে কেউ আমার দুঃখের জীবন নামক অংশটির ভিতর দিয়ে সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পাবে। Armand Hoog নিজেকে আরো ভালোভাবে মেলে ধরেছেন- মেয়ে হওয়ার জন্য অবদমিত হওয়া, পুরুষের চোখে মেয়ে হিসেবে তার বন্দীদশার জন্য সচেতন সন্তাপ, তিনি (সিমোঁ দা বুভোয়ার) পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং নিজের অবস্থা দুটোকেই প্রত্যাখ্যান করেছেন।<br />
<br />
আমাকে অবমাননা করার এই নতুন রীতি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সমালোচকের দ্বারা সাদরে গৃহীত হল; নিজেদের পুরুষালি আত্মঅহংকার দ্বারা তারা এত বেশি সরাসরি অনুপ্রাণিত ছিল যে আমার অবস্থা আমার কাছে যে কখনও গুরুভার ছিল না তা তারা কল্পনাও করতে পারতো না। অন্যদের উপরে যাদের স্থান দিয়েছি, সেই পুরুষরা কখনও আমাকে পুরুষের চাইতে হীন কিছু ভাবেনি। আমার অনেক পুরুষবন্ধু আছে যাদের দৃষ্টিভঙ্গি সীমানার মাঝে আমাকে বন্দী করার মনোভঙ্গি থেকে অনেক দূরে, মানুষ হিসেবে আমার নিজের অধিকারগুলোকে স্বীকার করে। এই ধরণের সৌভাগ্য আমাকে সব অপমান ও তিক্ততা থেকে রক্ষা করে; আমার পাঠকরা জানবেন যে শৈশব কিংবা কৈশোরে আমি কখনও এই ধরণের অনুভূতি দ্বারা আক্রান্ত হইনি। [৪] ভিন্নধারার (Subalter) পাঠকরা যখন নারীদের সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার ভান করছিল, তখন তারা আমাকে Misogynist আখ্যা দিয়ে উপসংহার টেনেছিল, আমি তাদের নিন্দা করেছিলাম; একথা সত্যি নয়। আমি তাদেরকে আকাশে তুলে ধরতে পারিনা এবং তাদের অবস্থার দ্বারা সৃষ্ট সব সমস্যার ব্যবচ্ছেদ আমি করেছি, কিন্তু আমি তাদের মেধা ও ভালো গুণগুলোই দেখিয়েছিলাম। নিজেকে সম্মানীয় পুরুষ হিসেবে বিবেচনা করার মাধ্যমে আমি তাদেরকে প্রতারিত করার জন্য অনেক বেশি মহিলাকে পথনির্দেশ ও প্রণোদনা দিয়েছিলাম; তাদের দেয়া উপহার আমাকে কখনও কোন আঘাতও দেয়নি। আসলে দ্যা সেকেন্ড সেক্স এর আগে আমি কখনো শ্লেষোক্তির লক্ষ্যবস্তু হিসেবে চিহ্নিত ছিলাম না; এর আগে মানুষরা হয় দয়ালু অথবা ভিন্নরকম ছিল। শেষের দিকে আমি প্রায়ই নারী হিসেবে আক্রমণের শিকার হতাম, কারণ আমার আক্রমণকারীরা মনে করতো এটাই আমার প্রধান দুর্বলতা। কিন্তু আমি ভালো জানি যে, এই সব অযৌক্তিক স্থবিরতার লক্ষ্য আমার নৈতিক ও সমাজ কথিত দোষসমূহ। না; আমার নারীত্ব সম্পর্কিত ভোগান্তি থেকে অনেক দূরে; ভিন্নভাবে বললে বলা যায় বিশ বছর বয়স থেকেই দুই লিঙ্গের সুবিধাগুলো জানা ছিল; L’Invitee এর পরে, আমার চারপাশের সবকিছু, আমাকে এই পুরুষের পৃথিবীতে তাদের সমকক্ষ, একজন লেখক হিসেবে, এবং মহিলা হিসেবে মনে করা শুরু করল, এই বিষয়টা আমেরিকাতে নির্দিষ্টভাবে লক্ষ্য করা গেছে। এক পার্টিতে আমি গিয়েছিলাম। গিন্নীরা সকলে একসঙ্গে ছিল এবং আমি যখন পুরুষদের সাথে কথা বলছিলাম তখনও তারা নিজেদের মধ্যেই বাক্যালাপ সারছিল। তারা নিজের লিঙ্গের সদস্যদের প্রতি যতটা আন্তরিক ছিল, ততোটা কৃতজ্ঞতাসুলভ আচরণ আমার সাথে করছিল না। এই ধরণের বিশেষ অধিকারভোগী অবস্থানের কারণে আমি মহার্ঘরূপে দ্যা সেকেন্ড সেক্স লিখতে উৎসাহিত হয়েছিলাম। আমি প্রশান্তির সাথে নিজেকে মেলে ধরেছিলাম। তাদের প্রস্তাবসমূহের বিরোধিতা করা, এটাই নির্দিষ্টভাবে সেই নির্বিকারত্ব যা আমার পুরুষ পাঠকদেরকে উত্তেজিত করে তুলেছিল। যখন আমার প্রতিবাদ, আপত্তিকে তারা ক্ষমা করতে পারতো না, একে অবিশ্বাসের ভান করতো তখন তারা নিজেদের উচ্চাসন থেকে নেমে আসার সহƒদয়তা এবং অবস্থানগত পরিবর্তনকে প্রকাশ করতে পারতো। কিন্তু প্রকাশিত হল এক দুর্বার ক্রোধের হুংকার এবং ক্ষতবিক্ষত হƒদয়ের প্রতিবাদ। প্রথম লিঙ্গের ঔদ্ধত্যকে উপযুক্তভাবে চিত্রিত করেছে এমন একটি শব্দবন্ধ আমি Claude Mauriac এর থেকে উদাহরণরূপে নেব। সে আমার বিরুদ্ধে কী খুঁজে পেয়েছে?”- সে জানতে চেয়েছিল। কিছুই না; যা আমি উল্লেখ করে যাচ্ছি শুধুমাত্র সেই শব্দগুলি ছাড়া কোনকিছুর বিরুদ্ধে আমার কিছু নেই। এটা অবাক ব্যাপার যে অনেক পণ্ডিত বুদ্ধিবৃত্তিক শখ বিষয়টিকে বিশ্বাস করেন না। [৫]<br />
<br />
আমি এমনকি কয়েকজন পুরুষ বন্ধুর মাঝেও ঝড় তুলে দিয়েছি। তাদের মধ্যে এক অগ্রসর একাডেমিক, আমার বই পড়া বন্ধ করে দিলেন এবং রুমের একপাশে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। কামুরা, একজন ফ্রেঞ্চ পুরুষকে হাস্যস্পদ করে তোলার জন্য গোমড়া মুখে আমাকে অভিযুক্ত করেছিল। স্প্যানীয় সংস্কৃতি নিয়ে গর্বিত এক ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের মানুষের কথা বলি- তিনি নারীকে সমান অধিকার দেবেন, যদি তারা নিজের মধ্যেই এক অন্য কল্পরাজ্যে সীমাবদ্ধ থাকেন, এবং জর্জ অরওয়েল যেমন দুইজনের মধ্যে অধিক সমতার কথা বলতেন, তিনি আসলে সেরকম বোঝাতেন। তিনি হাসিমুখে একবার আমার কাছে স্বীকার করেছেন যে তিনি নির্দিষ্ট মাপমতো হওয়া এবং মহিলাদের দ্বারা বিচার্য হওয়া পছন্দ করেন না; নারীরা হল বিষয় এবং পুরুষরা হল দৃষ্টি এবং সচেতনতা। সে এটা নিয়ে খুব হাসাহাসি করছিল, কিন্তু পারস্পরিকতাকে সমর্থন করেনি। সবশেষে হঠাৎ আবেগপ্রবণ হয়ে সে বলল- শুধু একটি যুক্তিকে তোমার গুরুত্ব দেয়া উচিত; পুরুষ নিজে মহিলাদের মধ্যে সত্যিকারের সাহচর্য খুঁজে পাওয়ার অভাবে ভুগছে। সমতার জন্য তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা আছে। সে নিরেট যুক্তিবিন্যাসের চাইতে হৃদয়দিয়ে আর্তনাদ করতে চেয়েছিল এবং আরও যা আছে তা হল পুরুষের জন্য কান্না। আমি নারীদের কামশীতলতা নিয়ে যে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছি, তাকে বেশিরভাগ পুরুষ ব্যক্তিগত বিদ্রূপ বলে গ্রহণ করেছে। তারা (পুরুষরা) কল্পনাও করতে চায় যে, যখন খুশি যে কাউকে তারা তৃপ্ত করতে পারে; এই ধরণের সামর্থ্যকে সন্দেহ করা তাদেরকে নপুংসকরণের মত।<br />
<br />
যে অধিকারকে রোম স্বাভাবিক হিসেবে কালো তালিকাভুক্ত করেছে, শুধু তার জন্য আমার বইকে ঘৃণা করা যেতে পারে। চরম বামপন্থীরা একে ভালোভাবে গ্রহণ করবে বলে আমি আশা করেছিলাম। কমিউনিস্টদের সাথে আমাদের সম্পর্ক খারাপের দিকে যেতে পারে না; সবাই সমান; আমার গবেষণা মার্ক্সিয় মতবাদকে এত বেশি বহন করে এবং তাকে এক বিশেষ সমর্থনসূচক আলোতে আলোকিত করেছে যে, আমি সামান্য কিছু পক্ষপাতহীনতা তাদের কাছে আশা করেছিলাম। দ্যা সেকেন্ড সেক্স বইটি Billancourt এর কারখানাকর্মী মেয়েদেরকে হয়তো হাসাতে পারবে বলে Les Lettres francaises পত্রিকায় Marie-Louise Barron – নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করেছেন। এটা Colette Audry এর কারখানার নারী শ্রমিকদেরকে খাটো চোখে দেখার সামিল বলে Colette Audry এক সমালোচনার পুনর্বিবেচনাতে মন্তব্য করেছেন। অমার্জিত, স্থূল, আবেগে দৃঢ়ভাবে আলিঙ্গনাবদ্ধ এক মহিলার ছবি স্পষ্টভাবে চিত্রিত হয়েছে এমন এক বেনামা নিম্নরুচির প্রবন্ধের সাথে এই মহিলা সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।<br />
<br />
অস্টালিনীয় মার্ক্সবাদীরা বড়জোর একটু বেশি স্বস্তিদায়ক। আমি Ecole Emancipee -তে দেয়া একটি বক্তৃতায় বলেছিলাম যে যখন বিপ্লব একেবারে সম্পন্ন হবে, তখন নারীদের সমস্যা আর থাকবে না। দারুণ, আমি তাই বলেছিলাম; কিন্তু এরপর? এখন এটা পরিষ্কার যে, তাদের জন্য আমার আর কোন আগ্রহ অবশিষ্ট নেই।<br />
<br />
আমার বইয়ের আলোচ্য বিষয়গুলো সম্পর্কে আমার প্রতিপক্ষ অসংখ্য ভুল ব্যাখ্যা তৈরি এবং লালন করেছে। সবগুলোর মধ্যে মাতৃত্ব নামক চ্যাপ্টারটির জন্য আমি বেশি আক্রমণের মুখোমুখি হয়েছি। সন্তান জন্ম দেইনি বলে নারী বিষয়ে কোন আলোচনা করার অধিকার নেই বলে বেশিরভাগ পুরুষ ঘোষণা করেছে; এবং তারা? [৬] তবুও তারা আমার বিরুদ্ধে ভিন্ন ধারণা প্রকাশ করে যাচ্ছিল। এমন বলা হচ্ছিল যে আমি মাতৃত্বের সহজাত প্রবৃত্তি ভালোবাসার প্রতি কোনরকম মূল্যবোধ মানতে অস্বীকার করেছি। বিষয়টা এরকম নয়। যেহেতু মেয়েরা নিজেকে ক্ষমা ও করুণাপ্রার্থী হিসেবে ব্যবহার করে সেহেতু আমি তাদেরকে শুধু নিজেকে স্বাধীনভাবে এবং সত্যি করে অনুভব করতে বলেছি; যখন আবেগগুলো হƒদয়ের মধ্যে শুকিয়ে যায় তখন যেন নিজেকে প্রাপ্ত আশ্রয়ে বন্দী মনে না করে। নির্বিচার যৌনতার প্রচারক হিসেবে আমাকে অভিযুক্ত করা হয়; কিন্তু কোন পয়েন্টে কখনো আমি কাউকে কি যে কারো সাথে যে কোন সময় বিছানায় যাবার উপদেশ দিয়েছি? এই বিষয়ে আমার মতামত হল যে পছন্দ, আস্থা এবং প্রত্যাখ্যান সবকিছু হতে হবে প্রতিষ্ঠান, সংগঠন এবং আত্মগৌরব প্রবণতা ইত্যাদির প্রভাব থেকে মুক্ত থেকে। এর কারণ যদি আচরণের সাথে সমান্তরাল না থাকে তাহলে পরিশেষে থাকবে মিথ্যা, বিকৃতি এবং পঙ্গুত্ব। গর্ভপাতের সমস্যা নিয়ে একটি চ্যাপ্টার আমি লিখেছি; সার্ত্রে বিষয়টি নিয়ে The Age of Reason নিবন্ধে এর মধ্যে লিখে ফেলেছে এবং আমি নিজে The Blood and Others এ লিখেছি। Les Temps Modernes এর অফিস সেক্রেটারি মাদাম সারবেটস এর কাছে লোকজন প্রায়ই ঠিকানার জন্য ছুটে আসতো। সে এত বেশি বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল যে একদিন নিজেই একটা পোস্টারের ডিজাইন করে ফেলল:<br />
<br />
<blockquote class="tr_bq">
"আমরা এটা প্রাঙ্গণেই করি, শুধু নিজেদের"</blockquote>
<br />
একদিন সকালে আমি ঘুমন্ত ছিলাম, এই সময় এক তরুণ দরজায় নক করা শুরু করল। সে উত্তেজিতভাবে বলছিল- আমার স্ত্রী গর্ভবতী, আমাকে একটি ঠিকানা দিন, তাকে বললাম যে- আমি কোন ঠিকানা জানিনা। কেউ কাউকে সাহায্য করে না- বলে আমাকে বকা দিতে দিতে সে চলে গেল। আমি কোন ঠিকানা জানতাম না। আমার বড়জোর জন্মগতভাবে আত্মনিয়ন্ত্রণহীন আগন্তুকের সামনে আত্মবিশ্বাসী থাকার মতো বিনয়ী হওয়া উচিত। এই সমাজ মহিলা ও দম্পতিদেরকে গোপনীয়তার আড়ালে ঠেলে দিচ্ছে। যদি আমি তাদেরকে কোনভাবে সাহায্য করতে পারি, তাহলে তা করতে আমি বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করবোনা। কিন্তু নিজেকে পেশাদার দূতিয়ালি হিসেবে মনে করে আমি কোন স্বস্তি পাইনি। কিছু পুরুষ যেমন: Francis Jeanson, Nadeau, Mounier প্রমুখ দ্যা সেকেন্ড সেক্স এর পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। এটা জনগণের মতান্তর ও বক্তৃতাবাজীকে উসকে দিয়েছিল। ভুলপাঠ এবং ভুলবোঝা দুটোই মানুষের মনের মধ্যে সমস্যা সৃষ্টি করে। যখন সবকিছু বলা এবং করা হয়ে যাবে, তখন আমি যা কিছু লিখেছি তার মধ্যে এই বইটি আমাকে অশেষ তৃপ্তি দেবে। যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, আজকে আপনি এটা নিয়ে কি ভাবছেন, তাহলে উত্তর দিতে আমার দ্বিধাবোধ হবে না; আমার সবকিছু এর জন্য।<br />
<br />
ওহ আমি স্বীকার করি, যে কেউ রচনাশৈলী ও সাজানোর ধরণ নিয়ে সমালোচনা করতে পারে। আমি পিছিয়ে গিয়ে নতুন করে আরও পরিমার্জনা করতে পারতাম। কিন্তু এ সময়ে আমি আমার যে আইডিয়াগুলোকে ব্যাখ্যা করেছি সেগুলো উদ্ভাবন করছিলাম, এটাই আমি ভাল করতে পারতাম। এখন মনে হয় প্রথম খ-ে থাকা উপাদানের জন্য এখন আমার আরও বেশি বস্তুবাদী অবস্থান গ্রহণ করা উচিত। নারীধারণার স্বাতন্ত্র এবং মণিবাদী বিতর্ককে (Manichaean argument)- যা শুধু একটি আদর্শবাদী এবং ধর্মনেতা প্রভাবিত সচেতনতার জন্য চাপিয়ে দেয়া লড়াই তা নয়, চাহিদা এবং যোগানের সাথেও সম্পর্কিত- আমার ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা উচিত। যখন আমি প্রাচীন চীনে মেয়েদের অবদমন বিষয়ে The Long March পত্রিকায় লিখছিলাম তখন একই সমস্যাকে এই পদ্ধতিতে প্রতিরোধ করেছিলাম। আমার যুক্তিবিন্যাসের উন্নয়নে এই সংশোধন ততোটা প্রয়োজনীয় হবে না। সামগ্রিকভাবে আমি যা বলেছি, তার স্বপক্ষে এখনও আমি আছি। নারীদের অবস্থা পরিবর্তনের কোন অতিকল্পনা আমি গোপনে লালন করি না। এটা ভবিষ্যতের পৃথিবীতে শ্রমের উপর নির্ভর করবে। শুধুমাত্র বিপুল উৎপাদনের মূল্যের উপর নির্ভর করে এর বিশেষ পরিবর্তন ঘটবে। এজন্য নারীবাদ এর ফাঁদে পড়ে যাওয়াটা আমি এড়িয়ে চলি। যেমন বর্ণনা করেছি তেমন কোন নির্দিষ্ট সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান আমি প্রস্তাব করিনা। কিন্তু আমি অন্তত আমার সময় এবং প্রজন্মের নারীদেরকে তাদের আত্মবোধ এবং নিজের সমস্যা সম্পর্কে সচেতন হতে সাহায্য করেছি। অবশ্যই এদের মধ্যে অনেকে আমার বইয়ের বক্তব্যকে মেনে নেননি। আমি তাদেরকে বিরক্ত করেছি অথবা বিরোধীতা করেছি অথবা তাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটিয়েছি অথবা তাদেরকে আতংকিত করেছি। কিন্তু আরও অনেকে আছেন যারা আমার সেবা পেয়েছেন। বিশেষ করে যে চিঠিগুলো বারো বৎসর পরেও এখন পর্যন্ত পেয়ে আসছি সেগুলোর অসংখ্য অভিনন্দন থেকে আমি এই বিষয়ে জেনেছি। যে রূপকথা তাদেরকে ছিন্নভিন্ন করে, নিজেদের যে প্রতিচিত্র নিজের মনে ঘৃণার সঞ্চার করে তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এই মহিলারা আমার কাজকে সহায়ক হিসেবে পেয়েছে। তারা বুঝতে পেরেছে যে, সমস্যাগুলো শুধুমাত্র তাদের একক অপমান নয় এই অবস্থা সাধারণভাবে সবার। এই আবিষ্কার আত্ম-অবজ্ঞার ভুলকে পরিহার করতে তাদের সাহায্য করেছে এবং এদের মধ্যে অনেকে পরিস্থিতির বিরুদ্ধে লড়াই করবার শক্তি বইটিতে খুঁজে পেয়েছেন। আত্মজ্ঞান সুখানুভূতির নিশ্চয়তা দেয়না, কিন্তু এটা সুখানুভূতির পক্ষে থাকে এবং এর জন্য লড়াই করার প্রেরণা যোগায়। মনোবিজ্ঞানীরা আমাকে বলেছেন যে তারা তাদের নারী রোগীদেরকে দ্যা সেকেন্ড সেক্স বইটা পড়ার জন্য দিয়েছেন। শুধু বুদ্ধিজীবী নারীদেরকে নয়, নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নারী, অফিস কর্মী, কারখানা শ্রমিক সবাইকে একই পরামর্শ দিয়েছেন। তোমার বই আমাকে বিরাট সাহায্য করেছে, তোমার বই আমাকে বাঁচিয়েছে এই ধরণের বাক্য আমি জীবনের সকল স্তরের সকল বয়সের নারীদের লেখা চিঠিতে পেয়েছি।<br />
<br />
যদি আমার বই মহিলাদেরকে সাহায্য করে থাকে, তাহলে এর কারণ হল এটা তাদেরকে উন্মোচিত করেছে। তারা তাদের পক্ষ থেকে বইটিকে এর স্বীকৃতি দিয়েছে। তাদেরকে ধন্যবাদ, দুর্নাম এবং সতর্কতার বিষয় এটা আর নয়। গত দশ বছরে পুরুষদের তৈরি উপকথা ভেঙে পড়েছে। অনেক নারী লেখক আমাকে পেরিয়ে এত দূর চলে গেছে যা আমার সাহসে কুলায়নি। আমার মতে তাদের অনেকে যৌনতাকে তাদের প্রধান বিষয় হিসেবে নিয়েছে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত যখন এই বিষয়ে লিখেছে, তখন তারা নিজেদেরকে দৃষ্টিমান, আলোচ্য, সচেতন এবং মুক্ত হিসেবে উপস্থাপন করেছে।<br />
<br />
আমি বিস্মিত এবং এমনকি বিরক্ত হতে পারতাম, যখন ৩০ বৎসর বয়সে কোন একজন আমাকে বলেছিল যে আমার মেয়েলি সমস্যাগুলো নিয়ে চিন্তা করা উচিত এবং আমার প্রকাশ্য পরিচিতি থাকা উচিত নারী প্রসঙ্গেই। এমন হবার কারণে আমি অনুতপ্ত হব না। পৃথিবীতে মেয়েরা বিভক্ত, জর্জরিত; ফলে তারা অনগ্রসরতার জালে বন্দি। মেয়েদেরকে আরও অনেক বিজয় জিততে হবে, আরও অনেক পুরস্কার অর্জন করতে হবে, পুরুষদের যত আছে, তার চেয়েও বেশি পরাজয় মেনে নিতে হবে। আমার এতে আগ্রহ আছে এবং এর মধ্য দিয়ে পৃথিবীজুড়ে সীমিত কিন্তু বাস্তব প্রভাব ফেলে আমি সার্বজনীনতায় উত্তীর্ণ হতে চাই।<br />
<br />
<br />
<br />
ফুটনোট:<br />
<br />
১। এটা ১৯৪৬ এর অক্টোবরে শুরু হয়ে শেষ হয়েছিল ১৯৪৯ সালের জুন মাসে। কিন্তু আমি ১৯৪৭ এ আমেরিকাতে চার মাস কাটিয়েছিলাম, আর "America Day by Day " বইটি আমাকে আরও ছয় মাস ব্যস্ত রেখেছিল।<br />
<br />
২। আমেরিকান পুরুষদের মধ্যে নারীদের প্রতি এক ঘৃণা ছিল। কিন্তু এমনকি সবচাইতে বিষাক্ত লেখা যেমন Philip Wylie এর A Generation of Vipers অশ্লীলতার মাত্রায় নামেনি; তাদের দৃষ্টিভঙ্গি নারীর যৌনতাকে খাটো করে দেখার মতো নয়।<br />
<br />
৩। যখন Christiane Rochefort Gi Warrior’s Rest দশ বৎসর বাদে প্রকাশিত হল, তখন কম স্ক্যান্ডাল ছড়িয়েছিল, কিন্তু সেই পুরনো গান: সে (She) একজন কুৎসিত এবং হতাশাগ্রস্ত নারী গাওয়ার জন্য অনেক পুরুষালি নিন্দা প্রস্তুত ছিল।<br />
<br />
৪। আমি বিভিন্নরকম নোংরা অসভ্য ক্রোধ, তাচ্ছিল্য এবং অন্য যত নিন্দামূলক আবেগের মুখোমুখি হয়েছিলাম। তারা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত দিয়ে প্রায়ই বিচার করত এবং কেউ কেউ বিশেষভাবে মনে করতো যে সেইসব ঘটনার অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে আমি কিছু কিছু জিনিস পাইনি। আমাকে তারা যেভাবে চিহ্নিত করেছে তা আমি প্রত্যাখ্যান করি কারণ আমার প্রত্যাশা দ্যা সেকেন্ড সেক্স লেখার সময়ে আমি যে উদ্দীপনা বোধ করেছি ঠিক সেভাবে তা অনুধাবন করা হোক।<br />
<br />
৫। একজন ডানপন্থী লিফলেট বিলিকারক উপন্যাসিক Les Temps Modernes পত্রিকায় Bost এর দ্বারা সুক্ষ¥ আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু এত ঘৃণা কেন? – এটাকে খুবই আঘাতজনক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছিল। অথচ তিনি আমাকে চেনেনও না।<br />
<br />
৬। তারা বাইরে গেল এবং মায়েদেরকে জিজ্ঞাসা করতে লাগল; কিন্তু আমি এটাও করেছিলাম।<br />
<br />
[অস্তিত্ববাদী দার্শনিক, নারীবাদী তাত্তি¦ক, বিখ্যাত লেখক সীমন দ্যা বুভোয়ার এর আত্মজীবনী ‘Force of Circumstance’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে। ইংলিশে অনুবাদ করেন রিচার্ড হাওয়ার্ড, প্রকাশ করে পেঙ্গুইন প্রকাশনী ১৯৬৮ সালে। বাংলায় ভাষান্তরিত অংশটি এই বইয়ের তৃতীয় খ-ের অন্তর্ভুক্ত। সেকেন্ড সেক্স প্রকাশকালে (On the publication of The Second Sex ) নামে এই অংশটি প্রকাশিত হয় <a href="http://www.marxists.org/reference/subject/ethics/de-beauvoir/1963/interview.htm">http://www.marxists.org/reference/subject/ethics/de-beauvoir/1963/interview.htm</a> এই ওয়েবলিংকে।]<br />
<br />
<br />
<br />
লেখক: সংস্কৃতি কর্মী।সুশান্ত বর্মনhttp://www.blogger.com/profile/02304984470756506973noreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-7423733237485716191.post-27518538955910484112013-10-02T22:13:00.000+06:002018-03-07T13:52:17.883+06:00বিপন্ন কাকতাড়ুয়া এবং আমাদের অস্তিত্বএস এম চন্দন<br />
<br />
বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের কিছু অতি পরিচিত বিষয় ছিল, যেগুলো এখন একেবারেই হারিয়ে যাওয়ার পথে। তার মধ্যে একটি হল কাকতাড়ুয়া। ফসলের ক্ষেতে পাখির আক্রমণ ঠেকাতে কৃষকরা এই অভিনব পদ্ধতির অনুসরণ করতেন। একটি হাঁড়িতে চোখ-মুখ এঁকে, বাঁশ বা কাঠ দিয়ে একটি কাঠামো তৈরি করে তাকে জামা-কাপড় পরিয়ে ভয়ংকর চেহারা দিয়ে ক্ষেতের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে রাখা হত। পাখি তো বটেই, রাতের বেলা কখনো কখনো মানুষও আঁতকে উঠত এই ভয়ালদর্শন নিরীহ পুতুলটি দেখে।<br />
<br />
এই প্রাণহীন প্রাণীটি এখন বিস্মৃতিরও তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। যখন পেশার প্রয়োজনে অথবা কৃষক সমিতির কাজে গ্রামে গ্রামে ঘুরি, কখনো কোন ফসল ক্ষেতেই কাকতাড়ুয়ার কোন চিহ্ন দেখিনা। এর কারণ হল, এখন আর পাখিরা ক্ষেতে সেভাবে হামলা চালাতে আসেনা। কিন্তু তারই বা কারণ কী? পাখিরা কি সবাই ভদ্র হয়ে গেছে? নাকি তারা কৃষকবান্ধব পাখিতে পরিণত হয়েছে? আসল কারণ হল, বর্তমানে ফসলের ক্ষেতে এমন পরিমাণে মারাত্মক সব কীটনাশক ব্যবহার করা হয় যে, পাখিকুল নিজেরাই নিজেদের ওই বিষ থেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখে। অবলা, অবুঝ, অশিক্ষিত পাখিরাও নিজের ভালো বোঝে, বুঝিনা আশরাফুল মখলুকাতরা।<br />
<br />
কীটনাশকের ব্যবহারটা নিছক কৃষক বা কৃষির উপকারের জন্য নয়। এর মূল কারণটা পুরোপুরি বাণিজ্যিক। বহুজাতিক এবং দেশিয় কৃষি উপকরণ বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসার স্বার্থেই কৃষকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে এসব নানা ধরনের নামের গুণের সব কীটনাশক। একটা সময়ে গোবর এবং খৈলই সবচেয়ে উপকারী সার হিসেবে বিবেচিত হলেও বর্তমানে রাসায়নিক সার ছাড়া চাষিরা অন্য কিছু ব্যবহার করতে চান না। আমি একবার পঞ্চগড়ের এক কৃষককে দেখেছিলাম যে, বাজারে সার না পেয়ে তিনি তাঁর ক্ষেতে গোবর ছিটিয়েছেন। প্রকৃতির লাঙ্গল কেঁচোদেরও এখন দেখা যায় কম। আবার হাইব্রিড জাতের বিভিন্ন বীজ আর সারা বছর বিরামহীনভাবে নানা ধরনের ফসলের আবাদে বিশ্রামহীন সেবা দিতে দিতে মাটিও হয়ে পড়েছে ক্লান্ত। এখন গ্রামের খুব কম বাড়িতেই হালের বলদ এবং গাভীর দেখা মেলে। পাওয়ার টিলার আর শ্যালো মেশিনের বিকট শব্দে ভার হয়ে থাকে গ্রামের পরিবেশ। ডিজেল আর বিদ্যুতের চড়া দামেও হন্যে হয়ে তার পেছনেই দৌঁড়াতে হয় চাষিদের। পেট্রোলিয়াম উৎপাদক, ট্রাক্টর-পাওয়ার টিলার প্রস্তুতকারী দেশগুলোর চলছে রমরমা বাণিজ্য। রাসায়নিক সার, কীটনাশক ইত্যাদির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় এগুলো তৈরি ও বিক্রির কোম্পানিগুলোরও হয়েছে পোয়াবারো। একদিকে চলছে একচেটিয়া ব্যবসা, আরেক দিকে সরকারি দলের ডিলারশিপের বাণিজ্য। ট্রাক্টর, শ্যালো মেশিন ইত্যাদি আমদানি করে বাজারজাত করার দায়িত্ব পান আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি এবং জামায়াতের নেতারাই। ১৯৯৫ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকারের আমলে সার সংকট সৃষ্টি করে সারের দাবিতে আন্দোলনরত ১৮ জন কৃষককে হত্যার ঘটনা এই নির্লজ্জ পুঁজিবাদী ধারণারই জ্বলন্ত সাক্ষ্য দেয়।<br />
<br />
বেশ কয়েক বছর আগে হঠাৎ করে বাংলাদেশের ব্যাঙের খুব কদর বেড়ে গিয়েছিল পৃথিবীর কয়েকটি দেশে। বাংলার গ্রাম এলাকার ডোবা, পুকুর থেকে ব্যাঙ ধরে ধরে বিদেশে রপ্তানি করা হয়েছে বিপুল পরিমাণে। বাংলার কুনো ব্যাঙ, সোনা ব্যাঙের রোস্ট, ফ্রাই, কাবাব, বার্গার, স্যান্ডউইচ সে সময় উন্নত বিশ্বের লোভনীয় খাদ্যে পরিণত হল। তখন এটিকে বাংলাদেশের জন্য লাভজনক আখ্যা দিয়ে প্রচার করা হয়েছে যে, ব্যাঙ রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।<br />
<br />
পরিণতিতে যেটা হল, সেটা হচ্ছে, ব্যাঙ কমে যাওয়ায় ক্ষতিকর পোকা-মাকড়ের সংখ্যা বেড়ে গেলো। সাধারণতঃ ফসলের ক্ষেতে ব্যাঙ বিভিন্ন ক্ষতিকর পোকা ধরে খেয়ে ফেলে, যা আদতে কৃষকের জন্য কাজে লাগে। এখন, যেহেতু ব্যাঙ নেই, তাই পোকা-মাকড় ঠেকানোর জন্য কীটনাশকের প্রয়োজন হয়ে পড়লো। এবারে সেই দেশগুলোই কীটনাশকের তত্ত্ব আমাদের দেশে রপ্তানি করল, যারা কয়েক দিন আগে আমাদের দেশের ব্যাঙ আমদানি করেছে। যত টাকা আমরা আয় করেছি ব্যাঙ বিক্রি করে, তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি টাকা প্রতি বছর ঢেলে যাচ্ছি পোকা মারার বিষ কিনতে। শুধু তাই নয়, এখন আমাদের সনাতন ধারার কৃষিও ধ্বংসের মুখে। সাম্রাজ্যবাদী সংস্থাগুলোর আবদার অনুযায়ী বিভিন্ন মডেলের চুক্তি হলে হাইব্রিড জাতের বীজ যেভাবে আমাদের বাজার সয়লাব করে ফেলবে, তাতে দেশি জাতের কোন বীজ আর নিজের অস্তিত্বই ধরে রাখতে পারবেনা। বাংলাদেশের কৃষক যে ধান, আলু, গম আবাদ করেন, তার একটি অংশ বিক্রি করেন, একটি অংশ পরিবারের খাওয়ার জন্য রাখেন, আর আরেকটি অংশ রেখে দেন পরের বছর বীজ হিসেবে আবাদ করার জন্য। ভবিষ্যতে নানা ধরনের এসব চুক্তি কার্যকর হলে আর এভাবে সনাতন প্রক্রিয়ায় বীজ সংরক্ষণ করা সম্ভব হবেনা। প্রতি বছর কৃষককে বীজ কিনে আবাদ করতে হবে। এতে একদিকে যেমন শস্যেও বৈচিত্র্যময়তা সৃষ্টির পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে, তেমনিভাবে কৃষক প্রতি বছর নতুন বীজ কেনার ব্যয়বহুল চক্রপাকে পড়বেন। আর এভাবে একচেটিয়া ব্যবসা করে যাবে আন্তর্জাতিক ও দেশিয় কিছু প্রতিষ্ঠান। এর নামই সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, একচেটিয়া পুঁজি।<br />
<br />
লেখার শুরুটা করেছিলাম কাকতাড়ুয়ার প্রসঙ্গ টেনে। কাকতাড়ুয়া বাংলার গ্রামীণ সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলেও সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদের থাবায় বিলীন হওয়ার পথে। এর পাশাপাশি এখন আমাদের জীবন-সংস্কৃতি-মনন-চেতনার সবকিছুই এই লুটেরা গোষ্ঠীর কবলে পড়ে ধীরে ধীরে নিজ চেহারা হারিয়ে নতুন একটি উদ্ভট চেহারা নিচ্ছে। বৈশাখী উৎসবকে আমরা আমাদের প্রাণের উৎসব বলে দাবি করি, তাহলে প্রশ্নটা স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসে যে, সেই প্রাণের উৎসব করতে বিদেশি মোবাইল ফোন অপারেটর প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সহায়তার প্রয়োজন হয় কেন? প্রাণের উৎসব কি প্রাণের উচ্ছ্বাস দিয়েই পালন করা উচিত না? আমাদের শৈক্ষিক-শৈল্পিক-বৌদ্ধিক চেতনার স্তর কি নির্জীব হয়ে পড়ছে? এখন কোন কোন অনুষ্ঠানে দেখি, ‘আসুন, আমরা মজা করি’ বলে ঘোষণা দেয়ার পর সকলে মজা (?) করতে শুরু করেন। মজাটাও এখন ঘোষণানির্ভর। আমি আদিবাসীদের গ্রামে গিয়ে বিস্মিত হয়ে দেখেছি, আদিবাসী ছেলেমেয়েরা তাদের ভাষায় তাদের সমস্যা নিয়ে গান লিখে ঢাকার জনপ্রিয় কোন ব্যান্ডের গানের সুরে সেই গান সাজাচ্ছে। আদিবাসী গানের চিরাচরিত সুরের ধারাটি সেখানে একেবারেই অনুপস্থিত। নবান্ন উৎসব কিংবা বসন্ত বা বর্ষবরণের উৎসব-আয়োজন-আনন্দ এখন নগর জীবনে প্রসারিত হয়েছে, যা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। কিন্তু মুশকিল হল, এই আয়োজনটা নগরকেন্দ্রিক জীবনে একটু সময় কাটানোর দিকে ধাবিত হয় মাঝে মাঝেই। যারা এর আয়োজন করছেন, যারা সাড়া দিচ্ছেন- তাঁরা আন্তরিকভাবেই করছেন, কিন্তু সর্বগ্রাসী সুবিধাবাদ আমাদের সমগ্র জীবন আর চেতনাকে এমনভাবে ঘিরে রেখেছে যে, এখন আমাদের কাছে সবটাই সময় কাটানো, অথবা হাল-ফ্যাশনে পরিণত হচ্ছে। নবান্ন উৎসবের আয়োজনে গান-নাটক-নাচ-কবিতা থাকছে, কিন্তু কৃষক ধানের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে যে ধীরে ধীরে মেরুদ- হারাচ্ছেন, সে প্রসঙ্গে এ উৎসব নীরব থাকছে। এখন পান্তা খাওয়া হয় ইলিশ ভাজার সাথে, যে ইলিশ মাছের দাম বৈশাখ উপলক্ষে হয় কয়েক হাজার টাকা। গার্মেন্টস শ্রমিকের ফ্রাই হওয়া লাশের পাশে দাঁড়িয়ে ১২ হাজার টাকার ইলিশ ফ্রাই করে খাওয়া শুধু অমানবিকই নয়, ধৃষ্টতাও বটে। বাংলা বর্ষবরণকে ঘিরে ইলিশ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের ব্যবসাও জমজমাট, বঞ্চিত শুধু পদ্মা নদীর মাঝি। এই মাছ ধরে আনতে গিয়ে কয়েক মাস আগে বঙ্গোপসাগরে যে ২০ জনের বেশি জেলে নৃশংস হত্যাকা-ের শিকার হলেন, তার খবর কে রাখে বৈশাখের উচ্ছ্বাসে? চাইনিজ রেস্তোরাঁর আলো-আঁধারিময় রোমান্টিক পরিবেশে চিংড়ি মাছ খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে প্রেমিক-প্রেমিকার আবেগ-ভালোবাসার মাঝে হতভাগ্য ওই জেলে পরিবারের অভুক্ত সন্তানদের কথা হয়তো আসেনা একবারও। কেউ জানেওনা, ভাবেওনা যে এই চিংড়ি আসে দক্ষিণের যে ঘের থেকে, সেই ঘেরে কত কৃষকের চোখের পানি আর বুকের রক্ত মিশে আছে।<br />
<br />
গ্রামের গরিব মানুষগুলো পান্তা খেতেন কী কারণে? কারণ বারবার রান্না করার মত জ্বালানী তাদের থাকতো না। সকালে ভাতের সাথে ঘি, ডিম ভাজা খাওয়ার সাধ্য তাদের হতোনা। তাই মরিচ-পেঁয়াজ দিয়ে মাখিয়ে পান্তা ভাত খেয়ে কাজে বের হওয়াই ছিল তাঁদের কাছে অনেক সহজ ব্যাপার। এখন এই পান্তা বছরের একটা দিনে ঘটা করে ইলিশ মাছ সহযোগে খাওয়াটা গরিব মানুষের প্রতি এক ধরনের উপহাসও বটে। আমাদের দেশে ফাস্ট ফুড নামক একটি উৎপাত এসে জুটেছে, পৃথিবীর নানান দেশের খাবার বিক্রির দোকান হয়েছে, হরেক কিসিমের মিষ্টি, শরবত, স্যুপ ইত্যাদি সবই বিক্রি করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, কিন্তু আজ পর্যন্ত রাজধানী বা দেশের কোথাও ৩ বেলা পান্তা পাওয়া যায়- এমন কোন দোকান আমার চোখে পড়েনি। কখনো কি কোন দাওয়াতে গিয়ে দেখেছেন যে সেখানে অতিথিদের আপ্যায়ন করা হচ্ছে পান্তা ভাত, পেঁয়াজ আর কাঁচা মরিচ দিয়ে? সেই অচ্ছুৎ-অপাংক্তেয় পান্তা ভাত বছরের ওই একটা দিনেই এতই খাতির পায় যে পাজেরো-প্রাডো গাড়িতে চড়েও কেউ কেউ বৈশাখী মেলায় আসেন এই পঁচা খাবারটি গলাধঃকরণ করতে। যে দেশে একটু ভাত আর একটু ভর্তার যোগান দিতে পরবাসী হয়ে পরবাসেই জীবন হারাতে হয়, সীমানার কাঁটাতারে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঝুলে থাকতে হয় ফেলানীদের, সে দেশে ইলিশ-পান্তার নব্য সংস্কৃতি একটি নির্মম রসিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়।<br />
<br />
তার মানে কি আমরা পান্তা খাবো না? বৈশাখে নাচবো না, গাইবো না? বর্ষার প্রথম বৃষ্টিতে শরীর ভেজাবো না? নবান্নের উচ্ছ্বাসে মাতবো না? কুয়াশা ঝরা ভোরে খেজুর রস পান করবো না? বসন্তের পয়লা দিনে ধুতি, শাড়ি পারবো না? অবশ্যই পরবো, এবং অবশ্যই অবশ্যই পরবো। কারণ ওটাই আমার জীবন, আমার সংস্কৃতি, আমার চেতনা, আমার অস্তিত্ব। পয়লা বৈশাখে পান্তা খেতে দোষ নেই, কিন্তু শুধু একটা দিনেই কেন? হাজার টাকার ইলিশ দিয়ে কেন? বাংলার গ্রামীণ জনপদের নারীরা কত পদের ভর্তা তৈরি করতে পারেন, সে খবর আমরা রাখি কি? আলু, কচু, কাঁচা কলা, পটলের খোসা, বাদাম, টমেটো, মরিচ, পোড়া বেগুন, ধনিয়া পাতা, পেঁপে, ওলকপি- আরও কত ধরনের ভর্তা তাঁরা তৈরি করেন। নবান্ন উৎসবের সময় দিনাজপুরে এক কৃষকের বাড়ি গেলে তিনি আমাদের আপ্যায়িত করেছিলেন নতুন ধানের মুড়ি, মুড়ির মোয়া, মুড়কি ইত্যাদি দিয়ে। ডাবের পানি এত, এত মিষ্টি, সেটার প্রতি আমাদের নজর নেই। ত্রিশ টাকা দিয়ে একটি ডাব কেনার চেয়ে ৬০ টাকা দিয়ে বোতলজাত কোমল পানীয় পান করার দিকে আমাদের আগ্রহ বেশি। ছোটবেলায় দেখতাম, দূরে কোথাও গেলে মা বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় বোতলে পানি ভরে নিতেন, এখন আমাদের কাছে এটি আলসেমি, কারণ ১৫ টাকা খরচ করলেই দোকান থেকে বোতলের পানি পাওয়া যায়, যে পানিতে মাঝে মাঝে শ্যাওলা পাওয়ার অভিযোগও ওঠে। আমরা আমাদের এই পুরনো ধারাগুলোকে অগ্রাহ্য করে নগরকেন্দ্রিক ও পুঁজিতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা শুরু করেছি। তাই এখন নববর্ষ উপলক্ষে তো বটেই, ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষেও ফ্যাশন শো আয়োজন করার মত ধৃষ্টতা দেখায় কোন কোন ফ্যাশন হাউজ। তবু রক্ষা যে, মৃত মানুষের কাফনের কাপড় বা কফিনের ডিজাইন নিয়ে এখনও ফ্যাশন শো বা বিজ্ঞাপন শুরু হয়নি।<br />
<br />
কখনোই এটা বলি না যে, পুরনোকে আঁকড়ে ধরতে হবে কোন ভালো-মন্দের বাছ-বিচার না করেই। এখন মাত্র ১ টাকা দিলে মিনি প্যাক শ্যাম্পু পাওয়া যায়। গ্রামের নারীরা আর আগের মত খৈল বা এঁটেল মাটি দিয়ে চুল ঘষে পরিষ্কার করেন না। পুঁজিবাদ এখন অতি সস্তায় ভোগবাদীকে প্রসারিত করেছে গ্রামের কিংবা শহরের সবচেয়ে দরিদ্র মানুষটির পর্ণ কুটিরেও। ঢাকা বা অন্যান্য শহর-নগরের বস্তিতে ঘুরে দেখেছি, এক কক্ষের সংসারেও রঙিন টিভি এবং ফ্রিজ শোভা পাচ্ছে। এটি ইতিবাচকভাবেই নেওয়া উচিৎ। কিন্তু সমস্যাটা হবে তখনই, যখন ভোগবাদ মুখ্য হয়ে উঠবে, পণ্যের ব্যবহার নয়। প্রচ- গরমে রিক্সা চালিয়ে বাসায় ফেরার পর ১২ টাকা দিয়ে একটি জীবাণুনাশক সাবান কেনাটা একজন রিকশাচালকের জন্য কোনোভাবেই বিলাসিতা নয়, এটি তার প্রয়োজন- কিন্তু ৬৫ টাকা দামের বিদেশি সুগন্ধি সাবান কেনার চেষ্টা হবে তাঁর বিলাসিতা। পুঁজিবাদ এখন সে পথেই হাঁটছে দিনে দিনে। ‘যত কথা-তত লাভ’ কিংবা ‘একবার খেলে হয়না-বারবার খেতে হয়’ ধরনের প্রচারগুলো সেই অমিতব্যয়ী-অপব্যয়ী মানসিকতারই প্রচারক। বাসর রাতে মিথ্যা কথা বলে স্বামীর সাথে প্রতারণার মাধ্যমে জীবন শুরু করার শিক্ষাও দেয়া হচ্ছে কিছু বিজ্ঞাপনে। আমাদের দেশের মানুষের সুখময় দাম্পত্য জীবনের যে মডেলটি রয়েছে পশ্চিমা বিশ্বের খরাব ঃড়মবঃযবৎ নামক চরম জঘন্য রীতির বিপরীতে, সেটিকেও নানান কায়দায় ভেঙ্গে দেয়ার কতই না কায়দা-কৌশল।<br />
<br />
আবার কাকতাড়ুয়া দিয়েই শেষ করি। আমরা কাকতাড়ুয়াকে কৃষকের বন্ধু বলে ভাবতাম, ভাবি। তার মানে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি যেটা, সেটা সব সময়েই আমাদের জন্য ইতিবাচক। সেই ইতিবাচক সবকিছুকেই আঁকড়ে ধরতে হবে শক্ত করে। বাংলার সংস্কৃতি, জীবন, কৃষি, লোকজ ধারা- কোনোকিছু কোন পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ আর ধর্মীয় অন্ধত্ববাদনির্ভর অপশক্তির কাছে ছেড়ে দেব না আমরা, কিছুতেই না।<br />
<br />
লেখক: কৃষক আন্দোলনের সংগঠকসুশান্ত বর্মনhttp://www.blogger.com/profile/02304984470756506973noreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-7423733237485716191.post-62613017298846665122013-10-02T22:09:00.000+06:002018-03-07T13:52:39.998+06:00মিশেল ফুকো’র পাগলবন্দনা<br />
রাই বাবু<br />
<br />
যাদের কথাবার্তা বা নীরবতা সভ্যসমাজের দৃষ্টিতে অসমীচীন, নিরর্থক, অযৌক্তিক বা হাস্যকর এবং যাদের বাহ্যিক আচরণ স্বভাবসিদ্ধ নয় বা সভ্যসমাজের দৃষ্টিতে বিকৃতমস্তিষ্কের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় অথবা সমাজ ও সভ্যতা যাদের মনের মধ্যে ‘অন্যরকম এক অবস্থা’ সৃষ্টি করেছে কিংবা যাদের প্রকৃতিগত প্রবৃত্তি সমাজের কাছে যুক্তিহীন, কা-জ্ঞানহীন বা ননসেন্সদের মতো, তাদের এসব আচরণ, আত্মভাব ও অঙ্গস্বভাব সম্পর্কে সভ্য মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি কী হতে পারে, তা আমরা সবাই জানি। কারও দৃষ্টিতে এরা মানসিক রোগী, কারও দৃষ্টিতে এরা উন্মাদ, বদ্ধউম্মাদ, বা অবাঞ্ছিত। অপেক্ষাকৃত এরা বেশ বিনয়ী বা ক্ষিপ্ত বলে এদের অযৌক্তিক কথোপকথন বা নীরবতা কিংবা আচরণ শুনতে বা বুঝতে কিংবা গ্রহণ করতে সভ্য মানুষ রাজী নয়। এদের স্থান পাগলাগারদে কিংবা কোনো এক মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের চেম্বারে। মধ্যযুগ থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত এরা এভাবেই সভ্য মানুষের কাছে অবাঞ্ছিত হয়ে আসছে বার বার। কিন্তু কেন? সভ্যসমাজ কেনই-বা এদের এভাবে সমালোচনা করছে যুগ যুগ ধরে। আবার কেন-ই বা এদের কথা বিকৃতভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে? কারণ সমাজ-সভ্যতার কাছে সোজা বাংলায় এরা ‘পাগল’।<br />
<br />
হ্যাঁ, পাগল শব্দটা ব্যবহার করে এই রচনাটি লিখতে আমার আপত্তি আছে। কিন্তু আমি শব্দটা ব্যবহার করছি সমাজ- সভ্যতা আমাদের এই শব্দটি দ্বারা এমন একজন মানুষকে চিনতে শিখিয়েছে যার নিকট থেকে দূরে থাকা ভালো; কারণ সে বদ্ধউম্মাদ ও অবাঞ্ছিত। তাই সভ্য মানুষের দৃষ্টিতে অবাঞ্ছিত, অযৌক্তিক, উন্মাদ, কা-জ্ঞানহীন, ননসেন্স, উদাসীন, দিওয়ানা যাই বলা হোক না কেন, আপাতত ‘পাগল’ শব্দটাকে ভিত্তি করেই অলোচনা করা যাক।<br />
<br />
কে পাগল? কারা পাগল? কেন এবং কোন স্বার্থে সভ্যসমাজ কাদের পাগল বলে? পাগল সম্পর্কে সমাজ-সভ্যতার দৃষ্টিভঙ্গি কেমন? এর সঙ্গে মানসিক ব্যাধির সম্পর্কই-বা কতটুকু? এ বিষয়ে বৈজ্ঞানিক বা ডাক্তারি ব্যখ্যার ফলাফল কী? আবার তারা যে ব্যখ্যা দিয়ে থাকেন, তা-ই বা কতটুকু সঠিক? অনেকে সমাজ-সভ্যতার বিবর্তন ও ইতিহাসের আলোকে এই বিষয়গুলির উত্তর খুঁজেছেন। ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো (১৯২৬ -১৯৮৪) তাঁদের অন্যতম।<br />
<br />
হ্যাঁ! সাম্প্রতিককালে জ্ঞানচর্চায় মিশেল ফুকো এক অনন্য প্রভাব রেখেছেন। পশ্চিমা জ্ঞান ও জ্ঞানচর্চার গ-ি পেড়িয়ে তিনি বুঝতে চেয়েছেন এর অতীত-বর্তমান, খুঁজতে চেয়েছেন এর অন্তঃসারশুন্যতা, আর মাপতে চেয়েছেন এর মেকির পরিমাণ। পাগলামি সম্পর্কিত ধারণা, জ্ঞান বিষয়ক উপলব্ধি, আইন ও শাস্তি বিষয়ক ব্যবহার, যৌনতার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি- এসবকিছুর প্রতি আমাদের মনোভাবের গোড়া নড়বড়ে করে তিনি যাবতীয় চিন্তাভাবনা উপস্থাপন করেছেন প্রচলিত চিন্তাভাবনার প্রায় বিপরীতে দাঁড়িয়ে। তিনি চিহ্নিত করেছেন আমাদের জ্ঞানচর্চার ফাঁক-ফোকর, চ্যুতি-বিচ্যুতি আর নির্মাণ-অনিমার্ণের ব্যাপারগুলোকে। ফুকোর এসব দৃষ্টিভঙ্গি ও সুগভীর বিশ্লেষণ একালের দর্শন, ইতিহাস, মনোবিজ্ঞান, সমাজবিদ্যা থেকে শুরু করে বহু বিষয়েই প্রভাব ফেলেছে, বদলে দিয়েছে চিন্তার ধরন। তিনি মানবসভ্যতার পুনর্বিচার করেছেন। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, স্কুল-হাসপাতাল-কারাগার-পাগলাগারদ হল ক্ষমতার যন্ত্র এবং ক্ষমতার দাসত্ব শেখানোর জায়গা, আর আইন হল ক্ষমতার একটি হাতিয়ার। তিনি আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন পাগলামি সম্পর্কিত সভ্যসমাজের দৃষ্টিভঙ্গি এবং এর সংশোধনযোগ্য উপলব্ধি। এই রচনায় ফুকোর পাগলামি বিষয়ক তাঁর অনবদ্য সৃষ্টিশীলতার আংশিক দিক উপস্থাপনের প্রয়াস করছি মাত্র।<br />
<br />
ফুকো কেন এই পাগলদের নিয়ে এত মেতেছিলেন? এটা কি পাগলামি ছিল? হ্যাঁ, সভ্যসমাজের দৃষ্টিকোণ থেকে হয়তো পাগলামি, কিন্তু আধুনিক সভ্যতা যখন পাগলকে যৌক্তিক মানুষের বিপরীতে স্থান দিল তখন ফুকো ওদের রক্ষা করতে ক্ষেপে উঠেছিলেন। পাশ্চাত্য সভ্যতায় বসে সবার মাঝে আলো জ্বালবার প্রয়াস নিয়ে, যারা আলোকিত নয় ফুকো তাদের বানাতে চেয়েছিলেন অলোকলোক, যে আলো স্ব-অভ্যন্তর হতে বিচ্ছুরিত হয়। ফুকোর মতে, ম্যাডনেস বা পাগলামি হতে পারে যৌক্তিকতার বিপরীত, কিন্তু অযৌক্তিকতায় ঘুরপাক খায় না, আর তাই তিনি বলছেন, সধফহবংং সধু ড়ভভবৎ ধ ারধনষব ধষঃবৎহধঃরাব ঃড় ৎবধংড়হ…<br />
<br />
ফুকো অনেককিছুই ভেবেছেন ‘পাগলামি’ নিয়ে। লিখেছেন মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েও। যদিও পাগলদের নিয়ে এই সৃষ্টিশীলতাকে অনেক সমালোচক এটাকে ‘পাগল-রোমান্টিসিজম’ বলছেন, কিন্তু তাঁর এই ‘পাগলামি তথা ম্যাডনেস’ ধারণাটি পরবর্তীতে মনোবিজ্ঞানের একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করবে সেটা বোধকরি অনেক সমালোচক বুঝে উঠতে পারেননি। ফুকো মনে করেন, ‘পাগলামি’ আর ‘যৌক্তিকতা’ এই দুটি বিষয় মানবসভ্যতার ইতিহাসে ধীরে ধীরে একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে, আর এটা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে আধুনিক বিশ্বে তথা বর্তমান সময়ে। নির্বুদ্ধিতা-বোকামি-উন্মাদনা বা আতঙ্কিত-উৎকণ্ঠিত-ক্ষিপ্তাবস্থা যা-ই বলা হোক-না কেন, যেটা কি-না বর্তমান সময়ে বৈজ্ঞানিক পন্থায় চিকিৎসা করতে হবে, উপশম ঘটাতে হবে, আর এই বিষয়কে ভিত্তি করেই সাইকোপ্যাথলজি বা অসুস্থতার কথা বলে কৃত্রিমভাবে পৃথকীকরণ করা হয়েছে এইসব বিনয়ী-বোকা বা অপ্রকৃতিস্থ-ক্ষিপ্ত মানুষদের, যাকে ফুকো ধপঃ ড়ভ ংপরংংরড়হ বলেছেন। এই ‘ধপঃ ড়ভ ংপরংংরড়হ’ বিষয়টিকে একটু সহজ করার জন্য কয়েকটি দৃশ্যের অবতারণার মধ্য দিয়ে বোঝার চেষ্টা করি:<br />
<br />
১। বঙ্গপুরে বাস করে ফটিক। সে সবকিছুতেই প্রশ্ন খোঁজে। সভ্যমানুষ থেকে একটু আলাদাভাবে সবকিছু চিন্তা করে। একদিন বঙ্গরাজা সিদ্ধান্ত নিলেন, রঙ্গরাজকে এক নৈশভোজের নিমন্ত্রণ করবেন। তাই ঢোল পিটিয়ে প্রজাদের জানানো হল। কিন্তু ফটিকের মনে প্রশ্ন জাগল, ‘কেন বঙ্গরাজা রঙ্গরাজাকে ভোজের নিমন্ত্রণ জানাবে?’ যেখানে প্রজারা অনাহারে মরে, সেখানে রাজ্যের এতোগুলো অর্থ কেন খরচ করবে? তাই ফটিক প্রজাদের সচেতন করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করে। এতে বঙ্গরাজা মুশকিলে পরে। তাই সমাধানের জন্য ফটিককে বিচারে ডাকা হল। বিচারে রায় হল, ‘ফটিক একটা উন্মাদ মানুষ’। সে পাগল হয়ে গেছে। তার নাম রাখা হল- ফটিক পাগলা। তার স্থান হল পাগলাগারদে।<br />
<br />
২। একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে এক কন্যা-শিশুর জন্ম হল। শিশুটি বেড়ে ওঠার সাথে সাথে সমাজের পুরুষতান্ত্রিকতা, ধর্মান্ধতা, অধিকার, নিয়মতান্ত্রিকতা, যৌনতা প্রভৃতি বিষয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হল। কেন এমন হল নারীদের জীবন? পুরুষের মত নারীরা কেন এত সুযোগ সুবিধা পেল না? প্রাপ্তবয়সে তার মনের মধ্যে এক ‘অন্যরকম অবস্থার’ সৃষ্টি হল। একটা সময়ে সমাজের প্রচলিত রীতিনীতিকে উপেক্ষা করার চেষ্টা করলো সে। বাবা-মা ও আত্মীয়রা মেয়েটির এই পরিস্থিতি সমাধানের উপায় হিসেবে তাকে বিয়ে দিল। বিয়ের পর স্বামী বিষয়গুলো মেনে নিতে পারল না। স্বামীর অভিযোগ তার স্ত্রী একজন মানসিক রোগী। স্বামীর অভিযোগে অভিযুক্ত মেয়েটিকে অবশেষে যেতে হল মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে। অবশেষে সেই মেয়েটিকে হারাতে হল সামাজিক মর্যাদা, বঞ্চিত হতে হল পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে, এমনকি পরিত্যক্ত হলেন ঘর সংসার থেকে।<br />
<br />
৩। বিদ্যালয়ের একজন বাংলা শিক্ষক। তিনি জ্ঞানচর্চায় অনেক বেশি আবেগী। তার এই আবেগটা এমন এক পর্যায়ে ঠেকেছে যা তাঁর মনের মধ্যে ‘অন্যরকম এক অবস্থা’ সৃষ্টি করেছে। ফলে তিনি শিক্ষার্থীদের পাঠদানে আগ্রহ হারিয়ে ফেললেন। শ্রেণিকক্ষে সুযোগ পেলে কিংবা অতিরিক্ত সময় পেলে শিক্ষার্থীদের সাথে ভূগোল ও বিজ্ঞান বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। বিষয়টি প্রধান শিক্ষক জ্ঞাত হয়ে ওই শিক্ষককে পাঠদানে মনোযোগী হতে বললে তাঁকেও (প্রধান শিক্ষক) ভূগোল ও বিজ্ঞান বিষয়ের গুরুত্ব তুলে ধরেন। একটা পর্যায়ে ওই শিক্ষক সবার মাথাব্যথার কারণ হলেন। আখ্যায়িত হলেন উন্মাদ শিক্ষক হিসেবে। সুতরাং তার চিকিৎসা প্রয়োজন। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে মানসিক চিকিৎসালয়ে পাঠালেন। চিকিৎসা শেষে তিনি উপলব্ধি করলেন যে, সমাজ-সভ্যতা মানুষকে যেভাবে চলতে বলে সেভাবে চলাই হল সভ্যতা। পরে যখন শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীরা ওই শিক্ষককে বিজ্ঞান ও ভূগোল বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি উত্তর দিলেন, ‘মানসিক চিকিৎসা নিয়ে আমি-তো এখন সুস্থ আমি আর ভূগোল-বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করব না, আমি তোমাদের বাংলা পড়াব।’<br />
<br />
বিষয়গুলোর আলোকে বলতে হয়, সমাজ-সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারাবাহিকতায় প্রচলিত ধ্রুববিশ্বাস, আদবকায়দা, অনুশাসন, নৈরাজ্য, ধর্মান্ধতা, ধ্যানজ্ঞান, প্রেম প্রভৃতির বিপরীতে বা প্রায়-বিপরীতে যখন কোন মানুষের মনোজগতে সন্দেহ, উৎকণ্ঠা, দ্বন্দ¦, আতঙ্ক প্রভৃতির বহিঃপ্রকাশ ঘটে তখন সে হয় পাগল, বদ্ধউন্মাদ বা দিওয়ানা। এসব মানুষের আত্মদর্শন বা অনুসন্ধিৎসু মন অথবা দ্বিধাগ্রস্থতা অবমূল্যায়ন করে তাদের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে উন্মাদ আশ্রম বা মেন্টাল অ্যাসাইলাম তথা পাগলাগারদ। ফুকোর মতে, মধ্যযুগে ইউরোপে যে পাগলামিগুলো ছিল মানব অভিজ্ঞতার এক ‘আধ্যাত্মিক’ অংশ, রেনেসাঁ পরবর্তী সময়ে তথা সভ্যতা অগ্রগতির সাথে সাথে সেই পাগলামিগুলোই যেন হয়ে উঠলো সভ্য মানুষের ঠিক বিপরীত অবস্থা তথা বিশেষ কারণে এক ধরণের ‘বিদ্রুপাত্মক অবস্থা’। আর তাই উন্মোচন ঘটল এই জগতের ননসেন্সগুলোর, যারা সমাজে প্রয়োজনহীনতার মর্যাদা পেল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই ননসেন্সরা হয়ে উঠলো ট্র্যাজিক, আবার কখনও-বা কমিক।<br />
<br />
অর্থাৎ যে মানুষগুলো সভ্যসমাজের সাথে শামিল হতে পারে না কিংবা যাদের হতে দেওয়া হয় না, সেই অযৌক্তিক ও সভ্যতা-বঞ্চিত মানুষগুলোর বাতিলীকরণ হয় ‘পাগলামি’ নামে। আলোকপ্রাপ্ত ইউরোপে যুক্তি, বিজ্ঞান ও সভ্যতার আলোকে পৃথিবীব্যাপী ক্ষমতার মতাদর্শের যখন উৎসব চলে, সেই সময়ে ইউরোপে বড়-বড় পাগলাগারদে পাগলেরা ছাড়াও চোর, ডাকাত, বিপ্লবীরাও স্থান পেত। অর্থাৎ সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এইসব পাগল বিষয়ক ধারণা, ওদের আউটলুক, ওদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি তথা প্রতিটি ক্ষেত্রে নতুন সমাজ-সভ্যতার স্বভাবসিদ্ধ মানুষের অবস্থার যে পরিবর্তন হয়েছে, তা-যেন এই পাগলদেরকে ‘ট্র্যাজিক-কমিক’ ও ‘উন্মাদ-অবাঞ্ছিত’ খোলসসমূহে রাখা হয়েছে। সেই সাথে মহাবিশ্বের আইনের সাথে বিরোধিতায় ফেলা হয়েছে। পরবর্তীতে তাদের রাখা হল হাসপাতালের একঘেয়ে বিমর্ষ শয্যায় অথবা উন্মাদ আশ্রমে। বিবর্তনের ধারায় ওরা এখন ‘সাইকিয়াট্রিক প্রবলেম’ খোলসে আবৃত। ফুকো বলছেন, সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীর পাগলাগারদগুলো ঠিক মেডিকেল-আশ্রম ছিল না, ছিল ‘ংবসর-লঁৎরফরপধষ’ প্রতিষ্ঠান। পাগল ছাড়াও বেকার, গরীব, নিঃস্ব, ফকির তথা যারা ছিল মেইনস্ট্রিম সমাজ থেকে বাইরে, তাদের আশ্রয় জুটতো সেখানে।<br />
<br />
ফুকোর মতে, মেইনস্ট্রিম সমাজ থেকে বঞ্চিত হয় না- মাতালেরা। এই মাতলরা যদি বদ্ধউন্মাদের মতো বা তার চেয়ে বেশি উন্মাদনায় মেতে থাকে তারপরও তারা মেইনস্ট্রিম সমাজ থেকে বঞ্চিত হয় না। এক্ষেত্রে সমাজের সভ্যমানুষদের যুক্তি হল, তারা ‘মাতলামি করে’, পরদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে মেইনস্ট্রিম সমাজের একটা অংশ হয়ে যাবে, তারা অযৌক্তিক মানুষ না। কিন্তু পাগলরা নেশাগ্রস্থ না হয়েই বদ্ধ উম্মাদের মাতো আচরণ করে বলেই তাদের অবস্থান যুক্তির ঠিক বিপরীত, তাই তারা সমাজ বহির্ভূত, তাদের আচরণ সভ্যসমাজের নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। এটা কোন বিচার?<br />
<br />
আমরা যারা সভ্য মানুষ, তারা কী বুঝতে চাই-না যে, নেশাগ্রস্থ না হয়েও কোনো একজন মানুষ রাস্তায় একপাশে দাঁড়িয়ে কিংবা চলতে চলতে ‘বিড়বিড়’ করে কথা বলছে অথবা রাস্তার মাঝে চিৎকার করে আবল-তাবল বকছে? না আমরা তা কখনোই বুঝতে চাই না। কারণ সমাজ তাদের খাস বাংলায় বলে ‘পাগল’। আর পাগল যা করে তা নিছক পাগলামি ছাড়া কিছুই না। আবার এই পাগলামি যখন বাড়াবাড়ি পর্যায়ে যায়, তখন ‘পাগলের মাথাখারাপ হয়েছে’ বলতে একটুও দেরি করি না। কারণ এই সভ্যসমাজ আমাদের এভাবেই শিখিয়েছে। ওরা অযৌক্তিক, ওরা অসম্ভব কল্পনা করে, ওদের কথাবার্তা অর্থহীন ইত্যাদি অভিযোগে অভিযুক্ত এই পাগলেরা এই সমাজ সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে অনেক আগেই। আবার এই সভ্যসমাজে কেউ যদি এই পাগলদের আচরণ বা পাগলামি নিয়ে মাতামাতি করে তাহলে তারও রেহাই নেই। পাগলের খাতায় তারও নাম সংযুক্ত হবে।<br />
<br />
কিন্তু যে মানুষটি সমাজের অসংগতি বা পরিবার কর্তৃক আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে কিংবা সমাজের নানা অনৈতিক বা আতংকিত বিষয়ের প্রেক্ষিতে মনের মধ্যে যে ‘অন্যরকম অবস্থার’ বহিঃপ্রকাশ ঘটায় তাকে পাগল বলে আখ্যা না দিলে কি সমাজ-সভ্যতার খুব ক্ষতি হয়ে যেত? নাকি অন্য কিছু বিষয় লুকিয়ে আছে এখানে। যা এই সমাজ বা পরিবারের অপেক্ষাকৃত ক্ষমতাবানরা তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য ওইসব আতংকিত, আঘাতপ্রাপ্ত, অতিমাত্রায় যুক্তিশীল, প্রতিবাদী, বিপ্লবী, অনুসন্ধিৎসু মানুষদের পাগল বলে সমাজ বা পরিবার বিচ্ছিন্ন করার একটা ঐতিহাসিক ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার অংশ। আর এই ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার আর একটি অংশ মানসিক চিকিৎসা যা সমাজে বেশ শক্তপোক্ত অবস্থান করে নিয়েছে। সুতরাং তোমারা যারা পাগল, তারা চিকিৎসা নাও, তারপর যুক্তিবাদী হও। সমাজের যে নোংরা কাজটির কারণে তোমরা যারা আতংকিত হয়ে নিশ্চুপ সারারাত নির্ঘুম থেকে সারাক্ষণ উদাসীন হয়ে থাকো, তারা ভুলে যাও সমাজের ওই নোংরা বিষয়টিকে। আবার যারা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছ তারাও আঘাতের কারণ ভুলে যাও। যে অসামাজিক কাজটির প্রতিবাদ করতে গিয়ে যারা প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে রাস্তার মাঝে চিৎকার-চেঁচামেচি কর, তোমরা সেই অসামাজিক ঘটনাটি ভুলে যাও। এভাবে অতিমাত্রায় যুক্তিশীল যারা, তারা সব প্রশ্ন মন থেকে ভুলে যাও। ঔষধ খাও, চিকিৎসা নাও, তারপর সভ্যসমাজে ফিরে আসো।<br />
<br />
কিন্তু যে পাগলটি রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে অদৃশ্য কাউকে উদ্দেশ্য করে কথা বলছে আনমনে, কিংবা রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে অদৃশ্য কোনোকিছুকে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করছে, সে পাগলটির এই অদৃশ্য ব্যক্তি বা বস্তুর রহস্য কী? যাকে বা যা সভ্যসমাজ দেখতে পারে না। না-কি সভ্যসমাজের অনেক অসভ্যতা, নোংরামি, গতানুগতিকতার বাইরে প্রতিটি পাগল তাদের মনের মধ্যে স্বতন্ত্রতা বজায় রেখে এক-একটি জগত তৈরি করেছে যা সাধারণ মানুষের বোধগম্য নয়।<br />
<br />
ফুকো তাই উন্মাদ পাগলদের নির্বুদ্ধিতার নীরব ভাষাগুলোর বিজ্ঞানভিত্তিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক উৎস খুঁজেছেন। ফুকোর মতে, ইউরোপের সেইকালের অর্থনৈতিক অবস্থার উঠা-নামায় এই পাগলদের দুই রকম অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়। এক- অর্থনৈতিক মন্দাবস্থায় তাদের আশ্রমে ঠেলেঠুলে ‘বিশ্রামে’ রাখা; এবং দুই- কর্মক্ষম প্রোডাক্টিভ সময়ে তাদের কম পয়সায় কাজে লাগানো। সপ্তদশ শতাব্দীর ইউরোপে ‘অযৌক্তিক’ মানুষদের ‘আশ্রমে’ পুনর্বাসনের এই সময়টিকে ফুকো বলছেন ঞযব এৎবধঃ ঈড়হভরহবসবহঃ।<br />
<br />
এই ঞযব এৎবধঃ ঈড়হভরহবসবহঃ এর সময়ই পাগলদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের আরেকটি ধাপ শুরু হয়। শুরু হয় ওদেরকে মানুষ হিসেবে গণ্য না করার পাঁয়তারা। মানবোচিত গুণাবলী হতে বিচ্যুতি ঘটানো। মানবোচিত বৈশিষ্ট্য হরণ। আগে যেটা ছিল মানুষের সহজাত-প্রবৃত্তির একটি দিক মাত্র, এখন সেটি যেন হয়ে উঠলো নিম্নস্তরের বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন জন্তু বিশেষের প্রকৃতি। পশু-প্রকৃতি। এখান থেকেই শুরু হয় প্রাথমিক মনোবিদ্যার একটি ধারা। শুরু হয় শ্রেণিকরণের সূত্রাবলীর। আবেগ-অনুভূতির তীব্র বহিঃপ্রকাশের উপর ভিত্তি করে নামকরণ করা হয় ম্যানিয়া, মেলানকোলিয়া, হিস্টিরিয়া, হাইপোক-্রয়িা ইত্যাদি লেবেলিং-ট্যাগিং। আধুনিকতার সূর্য উঠার সাথে সাথে এই ‘পাগলামি’ ক্রমান্বয়ে পরিণত হয় মনোবিদ্যার একটি অবজেক্ট হিসেবে। সর্বপ্রকার ধর্মীয় আর নৈতিকতার লেবাস ছাড়িয়ে এটাকে এখন পুরোপুরি চিকিৎসাবিদ্যার তত্ত্বাবধানে আনা হয়। ফুকো বলছেন, যেখানে পূর্ববর্তী সময়ে ‘অযৌক্তিকতা’ হয়তো ‘যুক্তিবাদীতা’র একটা ‘বিশেষ’ রূপ হিসেবেই বিদ্যমান ছিল, আধুনিক মনোবিদ্যা এখন পাগলদের নীরবতার উপর দাঁড়িয়ে তাদের জন্য নিবন্ধ রচনা করছে যেন। ফুকো যখন মানসিক অসুখের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিকটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তখন তিনি এটিকে ক্ষমতাসীনদের একটি রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেও ব্যাখ্যা দিয়েছেন।<br />
<br />
ফুকোর মতে, রেনেসাঁর সময় এই ‘পাগল-মানুষ’রাই যেন জগতের মানব-নাট্যশালা-রঙ্গমঞ্চের দুটো দিক তুলে ধরেছিল, একদিকে ছিল ওরা নিজেরা, আর আরেকদিকে ছিল ‘কাক্সিক্ষত’ সেই যুক্তিবাদ; কীভাবে কত সহজে বোঝা যেত, দাঁড়িপাল্লার কোন উৎকৃষ্ট দিকটিতে ‘সভ্য-মানুষ’ আছে? ফলে সভ্যজগতের মূল অর্থহীনতার একটা রূপ তৈরি হল, আর সেটা হল- যারা উন্মাদ তারা অসুস্থ আর আমরা সুস্থ, আমাদের (সভ্যদের) দলে তুমি (উন্মাদ) না, সুতরাং ডাক্তার দেখাও, যুক্তিবাদী হতে শেখো অথবা যুক্তির আলোয় তোমার উন্মাদনা ব্যাখ্যা কর।<br />
<br />
ফুকো আরো বলেছেন, পাগলামিকে ইতিহাসের যুক্তিতে ফেলা যায় না। কারণ, তখন আর সেটা পাগলামি থাকে না। আর তাই পাগলামির ইতিহাস রচনা করতে পারবে একমাত্র পাগলই। এরাই পারবে অযৌক্তিক, অসামাজিক এবং ভাষা-বহির্ভূত বিষয়গুলো ধরতে এবং এতে কিছু উপলব্ধি ও অনুভূতি অবশ্যই পাওয়া যাবে।<br />
<br />
লেখক: সংস্কৃতি কর্মীসুশান্ত বর্মনhttp://www.blogger.com/profile/02304984470756506973noreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-7423733237485716191.post-3763605199135388952013-10-02T22:07:00.000+06:002018-03-07T13:52:17.931+06:00বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল সমস্যানিবেদিতা রায়<br />
<br />
বইপত্রের সংজ্ঞা মতে, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, স্থায়ী জনসমষ্টি, সরকার ও সার্বভৌমত্ব- এই চারটি উপাদানের সমন্বয়ে রাষ্ট্র পরিচিতি পায়। কিন্তু রাষ্ট্রের পথপরিক্রমায় বা বিবর্তনের ইতিহাসে যদি কখনো ‘ক’ রাষ্ট্রের কিছু অংশ মানচিত্রের বাইরে অন্য কোন ‘খ’ রাষ্ট্রের মাধ্যে থেকে যায়, তবে বিক্ষিপ্তভাবে ‘ক’ রাষ্ট্রের ঐ ক্ষুদ্র অংশের পরিস্থিতি কী হবে? বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের প্রায় চারটি জেলায় রয়ে গেছে এরকম ভারতের ১১১টি ক্ষুদ্র অংশ, আর ভারতের ভূখণ্ডে রয়েছে বাংলাদেশের ৫১টি ক্ষুদ্র অংশ; যা ছিটমহল নামে পরিচিত। ছিটমহলের আভিধানিক অর্থ দ্বীপায়নিক রাজ্য। কিন্তু ভারত-বাংলাদেশের ছিটমহলগুলো সমতল ভূমির উপর অবস্থিত হওয়ায় এ ধরনের ছিটমহলের ক্ষেত্রে যা বোঝায় তা হচ্ছে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের ভূখণ্ড পার্শ্ববর্তী দেশের ভূমি পরিবেষ্টিত।<br />
<br />
জানা যায়, ষোড়শ শতাব্দীতে মোঘল সেনাপতি মীরজুমলা কোচবিহার রাজ্য আক্রমণ করেছিলেন। এ সময় কোচ রাজা মোঘলদের বশ্যতা স্বীকার করে ‘কারদ’ রাজ্যে পরিণত হয়। সে সময় মোঘল অধিকৃত ১১১টি এলাকার অধিবাসী কোচ রাজার বশ্যতা স্বীকার করে তার রাজ্যে প্রজা হিসেবে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করে তার রাজ্যভুক্ত হয়। তখন তাদের বলা হতো রাজগির। তখন থেকে ঐ এলাকার অধিবাসীগণ রাজগির নামে পরিচিতি লাভ করে।<br />
<br />
অনুরূপভাবে কোচ রাজ্যভুক্ত ৫৩টি (বর্তমান দহগ্রাম আঙ্গুরপোতাসহ) এলাকার অধিবাসী মোঘলদের বশ্যতা শিকার করে তাদের অধিকৃত অঞ্চলে সম্পৃক্ত থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করলে তারাও ঐ রাজ্যভুক্ত থেকে যায়। তখন থেকে তারা মোঘলাই নামে পরিচিতি লাভ করে। এভাবেই তারা শতাব্দীর পর শতাব্দী থেকে যায়। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত ১১১টি ছিটমহল ভারতীয় ছিটমহল হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। একইভাবে ভারতের অভ্যন্তরে ৫৩টি ছিটমহল বাংলাদেশী ছিটমহল হিসাবে পরিচিতি লাভ করে।<br />
<br />
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ১৯৪৭ সালে বাংলা পাঞ্জাবের সীমারেখা টানার পরিকল্পনা করেন লর্ড মাউন্টবেটন। তার পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্রিটিশ আইনজীবী সিরিল রেডক্লিফকে প্রধান করে সে বছরই গঠন করা হয় সীমানা নির্বাচনের কমিশন। ১৯৪৭ সালের ৮ জুলাই লন্ডন থেকে ভারতে আসেন রেডক্লিফ। মাত্র ছয় সপ্তাহের মাথায় ১৩ আগস্ট তিনি সীমানা নির্ধারণের চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন। এর তিন দিন পর ১৬ আগস্ট জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয় সীমানার মানচিত্র। কোনরকম সুবিবেচনা ছাড়াই হুট করে এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ায় সীমানা নির্ধারণের বিষয়টি যথাযথভাবে হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, কমিশনের সদস্যদের নিষ্ক্রিয়তা আর জমিদার নবাব, স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও চা বাগানের মালিকেরা নিজেদের স্বার্থে দেশ ভাগের সীমারেখা নির্ধারণে প্রভাব ফেলেছে। আর উত্তরাধিকার সূত্রেই উপমহাদেশের বিভক্তির এই সমস্যা বয়ে বেড়চ্ছে দুই দেশ।<br />
<br />
১৯৫৮ সালের নেহেরু-নুন্ চুক্তি অনুযায়ী বেরুবাড়ির উত্তর দিকের অর্ধেক অংশ ভারত এবং দক্ষিণ দিকের অর্ধেক অংশ ও এর সংলগ্ন এলাকা পাবে বাংলাদেশ। চুক্তি অনুযায়ী বেরুবাড়ির সীমানা নির্ধারণের উদ্যোগ নেওয়া হলেও ভারতের অসহযোগিতায় তা মুখ থুবড়ে পড়ে। ফলে বেরুবাড়ির দক্ষিণ দিকের অর্ধেক অংশর ছিটমহলের সুরাহা হয়নি। কারণ, চুক্তিতে ছিটমহল বিনিময়ের উল্লেখ থাকলেও এ ব্যাপারে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সে দেশের সংবিধানের ১৪৩ ধারা সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের মতামত চান। তখন আদালতের পক্ষ থেকে বলা হয়, সংবিধানের সংশোধনীর মাধ্যমে বিষয়টির নিষ্পত্তি করতে হবে। পরে ভারতের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে সংবিধান সংশোধনী আর জনগণনার অজুহাতে বিলম্বিত হয়েছে ছিটমহল বিনিময়।<br />
<br />
সীমান্তের অমীমাংসিত সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৪৭ সালের ১৬ মে দিল্লিতে স্থল সীমানা চিহ্নিতকরণ-সংক্রান্ত এক চুক্তি সই করেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ভূমি হস্তান্তরের বিষয়ে চুক্তির তৃতীয় ধারায় বলা হয়েছে, ভূমি বিনিময়ের সময় লোকজন কোথায় থাকতে চান, সে ব্যাপারে তাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। ভূমি বিনিময় হলে বাড়তি ১০ হাজার একর জমি বাংলাদেশের পাওয়ার কথা। চুক্তির পর দুই দেশ ছিটমহলের আলাদা আলাদাভাবে তালিকা তৈরির কাজ শুরু করে। কিন্তু দুই পক্ষের তালিকায় দেখা যায় গরমিল। পরে ১৯৯৭ সালের ৯ এপ্রিল চূড়ান্ত হয় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ১১১টি ও ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল রয়েছে।<br />
<br />
দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকে ২০০০ সালের ডিসেম্বরে যৌথ সীমান্ত কার্যদল (জয়েন্ট বাউন্ডারি ওয়ার্কিং গ্রুপ জেবি ডব্লিউ জি) গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। এরপর এ পর্যন্ত ছয়টি বৈঠক করে কমিটি। ২০১০ খ্রিস্টাব্দের দুই পক্ষ দিল্লিতে সর্বশেষ বৈঠক করে ১৯৪৭ সালের চুক্তির আলোকে বিষয়গুলো সুরাহার সিদ্ধান্ত নেয়। এক্ষেত্রে ভারতের পক্ষ থেকে সমন্বিতভাবে বলা হয়েছিল, সাড়ে ছয় কিলোমিটার সীমান্ত চিহ্নিত করা, চুয়াত্তরের চুক্তির অনুসমর্থন, ছিটমহল এবং অপদখলীয় জমি হস্তান্তর এই ধারাবাহিকতায় বিষয়গুলো সমাধান করা হবে। ২০০৭ সালে ছিটমহল ও অপদখলীয় জমিগুলোতে যৌথ সফরের পর বাংলাদেশও ধাপে ধাপে বিষয়গুলো সুরাহার প্রস্তাব দেয়। ভারতের পক্ষ থেকে বিষয়গুলো সমাধানের আশ্বাস আসে। তবে এরপরে কেটে গেছে পাঁচটি বছর কিন্তু ছিটমহল সমস্যার সমাধান আলোর মুখ দেখে নাই। মাঝখানে একটি প্রটোকল, দহগ্রাম-আঙ্গুরপোতা দুটি ছিটমহলের সমস্যার কিছুটা অগ্রগতি ছাড়া সীমান্তের অন্যান্য সমস্যাগুলি রয়ে গেছে।<br />
<br />
সরকারি তালিকা অনুযায়ী বাংলাদেশ ও ভারতের ছিটমহলের আয়তন দাঁড়ায় ২৪ হাজার ২৬৮ দশমিক ০৭ একর। তালিকা অনুযায়ী বাংলাদেশের মধ্যে ভারতের ছিটমহলগুলো লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জেলার অন্তর্গত হলেও এগুলো অবস্থান করছে ভারতের কুচবিহার জেলায়। বেসরকারি তথ্য মতে, এসব ছিটমহলের মোট জনসংখ্যা প্রায় ৭০ হাজার। বাংলাদেশের চতুর্থ আদমশুমারি ২০০১ সালের প্রতিবেদন ছিটমহলের জনসংখ্যার কোন হিসাব পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের অবস্থান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে। ৪৭টি কুচবিহার এবং চারটি জলপাইগুড়ি জেলায়। আবার এমনও আছে, বাংলাদেশের ভেতরে ভারত, তার ভেতরে আবার বাংলাদেশ। যেমন: কুড়িগ্রামে ভারতের ছিটমহল দাসিয়ারছড়া আর দাসিয়ারছড়ার ভেতরেই আছে চন্দ্রখানা নামের বাংলাদেশের একটি ছিটমহল। কেন এমন হল? একটু পেছনের দিকে ফিরে তাকানো যাক।<br />
<br />
ইতিহাসের বিবর্তনে উপমহাদেশের বিভক্তি ঘটে। ভারত ও পাকিস্তানের (পূর্ব ও পশ্চিম) মানচিত্র তৈরি হয়। ভারত ও পাকিস্তানের দু’টি অংশের সীমানা চিহ্নিত করার প্রাক্কালে অমীমাংসিত অঞ্চলের বাসিন্দারা অনেকেই জানে না ইতিহাসের সবখানি। শুধু জানে তাদের পরিচয় বড্ড অদ্ভুত, সরকার আছে, রাষ্ট্রীয় নামও আছে তবে সেসব ধরা ছোঁয়ার বাইরে। পরাধীন নয় তবে স্বাধীনভাবে বাঁচার জন্য মৌলিক অধিকার তাদের নেই। প্রশাসনের অভাবে নাগরিকত্বহীন জনগোষ্ঠী যে জীবন-যাপন করছে তা সুদীর্ঘ ৬৫ বছর যাবৎ সমাধানের অপেক্ষায় আছে। তাই এপার বাংলা আর ওপার বাংলার ছিটমহলবাসীরা মাঝে মাঝে সোচ্চার হয়ে উঠে নিজেদের নাগরিকত্বের প্রশ্নে। ভারত স্বাধীন হলেও ছিটমহলের ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত না হওয়ার বিষয়টি ঝুলে থাকে। সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ সরকার ভারতের সঙ্গে তিনটি চুক্তি করলেও সেই চুক্তি বাস্তবায়ন হয়নি।<br />
<br />
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীন হলেও কোচবিহার ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়নি। কোচবিহার ছিল রাজ্যশাসিত পৃথক রাজ্য। ১৯৪৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর কোচবিহারের রাজা জগদ্বীপেন্দ্র নারায়ণ কোচবিহারকে ভারত রাষ্ট্রের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করার এক চুক্তিতে আবদ্ধ হন। এরপর ১৯৫০ সালের ১লা জানুয়ারি কোচবিহারকে পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। দেরিতে যুক্ত হওয়ায় দেখা গেল কোচ রাজ্যের জমিদারির একাংশ রয়ে গেছে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ)। আবার বিপরীত ঘটনাও দেখা গেল। পূর্ব পাকিস্তানের কিছু জমিদারের ভূসম্পত্তির একটা অংশ রয়ে গিয়েছিল কুচবিহারে এই অংশগুলো নিয়েই তৈরি হল ছিট। এই ধরনের দুটো ছিট চন্দ্রখানা ও দাসিয়ারছড়া, একটির মালিক বাংলাদেশ আরেকটি ভারত। কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ি উপজেলার অন্তর্গত দাসিয়ারছড়া ভারতের ছিটমহল। ভারতীয় সীমান্ত থেকে ২ কিলোমিটার বাংলাদেশের জমিন পেরোলে দাসিয়ারছড়া। ভারতীয় এই ছিটের ভেতরে রয়েছে বাংলাদেশের ছোট এক বসতি। নাম ছিট চন্দ্রখানা। লোকসংখ্যা প্রায় ৪৫০।<br />
<br />
স্বদেশে পরবাসী যে জনগোষ্ঠী কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ি উপজেলার সদর ইউনিয়নের তাদের বসবাস। ব্রিটিশ শাসনের অভিনব সীমানা চিহ্নিতকরণের কারণে মাত্র ১০০ মিটারের ব্যবধানে চন্দ্রখানা ছিটমহলটি অবস্থান করছে ভারতের দাসিয়ারছড়া নামক অপর একটি ছিটের মধ্যে। মাত্র কিছুদিন আগে স্বচক্ষে দেখে আসা এই ছিটমহল দু’টি নিয়ে যে অভিজ্ঞতা তা অন্যান্য ১৬০টি ছিটমহলের সমস্যাকেই প্রতিনিধিত্ব করে।<br />
<br />
লেখক: শিক্ষক, রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।সুশান্ত বর্মনhttp://www.blogger.com/profile/02304984470756506973noreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-7423733237485716191.post-21055512291315740852008-02-25T22:54:00.000+06:002018-03-05T23:24:23.776+06:00'ব্যবচ্ছেদ' পত্রিকার পিডিএফ ডাউনলোড করুন<div style="text-align: center;">
<br /></div>
<div class="separator" style="clear: both; text-align: center;">
<a href="https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEhr7UR7BSabQqbj2HZcsggu2UhDLMPZ43UOhW-PhojckyofV9W5uvYsx_-aA7ecBlq3XbPHRMUtPJZloKgXrIDzEzXBgKojgr_eB1bs_clN_CdZKxaldAb2j4YmoUrv4uyRIYShKsiT-RQ/s1600/bb.PNG" imageanchor="1" style="clear: left; float: left; margin-bottom: 1em; margin-right: 1em;"><img border="0" data-original-height="529" data-original-width="385" height="200" src="https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEhr7UR7BSabQqbj2HZcsggu2UhDLMPZ43UOhW-PhojckyofV9W5uvYsx_-aA7ecBlq3XbPHRMUtPJZloKgXrIDzEzXBgKojgr_eB1bs_clN_CdZKxaldAb2j4YmoUrv4uyRIYShKsiT-RQ/s200/bb.PNG" width="145" /></a></div>
<div style="text-align: center;">
<span style="font-size: large;"><br /></span></div>
<div style="text-align: center;">
<div style="text-align: left;">
<span style="font-size: large;">প্রথম সংখ্যা</span></div>
</div>
<div style="text-align: center;">
<span style="font-size: large;"><br /></span></div>
<div class="separator" style="clear: both; text-align: center;">
<a href="https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEgIuiwi_O5pyCgzdlvFn2lnXYKeCYqKKqIFPQdWE126qgGJJwpJ2M1OwGq2895IVdneJc8r9L8zPQhPQLuAekCiYZ8Iy0XGANGmEKmxivcp7iseLu-tcnk1kgGpxy80fgJFC4qRGQ68agM/s1600/baybachched-2.jpg" imageanchor="1" style="clear: left; float: left; margin-bottom: 1em; margin-right: 1em;"><img border="0" data-original-height="1350" data-original-width="900" height="200" src="https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEgIuiwi_O5pyCgzdlvFn2lnXYKeCYqKKqIFPQdWE126qgGJJwpJ2M1OwGq2895IVdneJc8r9L8zPQhPQLuAekCiYZ8Iy0XGANGmEKmxivcp7iseLu-tcnk1kgGpxy80fgJFC4qRGQ68agM/s200/baybachched-2.jpg" width="133" /></a></div>
<div style="text-align: center;">
<div style="text-align: left;">
<span style="font-size: large;">দ্বিতীয় সংখ্যা</span></div>
<div style="text-align: left;">
<span style="font-size: large;"><br /></span></div>
<div style="text-align: left;">
<a href="https://baybachched.files.wordpress.com/2013/10/baybachched-2.pdf" target="_blank">১ম লিংক</a></div>
<div style="text-align: left;">
<a href="https://drive.google.com/file/d/1ithV0sp2aOUnt7QtGSb4Txm8IT_I50Hl/view" target="_blank">২য় লিংক</a> (অনলাইনে পড়ুন)</div>
</div>
সুশান্ত বর্মনhttp://www.blogger.com/profile/02304984470756506973noreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-7423733237485716191.post-69411302830536664342008-02-21T21:09:00.002+06:002018-03-07T13:50:17.436+06:00১ম সংখ্যার উচ্চারণ<div style="text-align: center;"><span style="font-size:130%;">ভিড়ের ভিতর বসবাস করার সময় এটা নয়।<br />এখন নিঃসঙ্গতার মধ্যে আশ্রয় খুঁজে নিতে হবে।<br />-অতীশ দীপঙ্কর</span><br /></div>সুশান্ত বর্মনhttp://www.blogger.com/profile/02304984470756506973noreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-7423733237485716191.post-44825800153816654142008-02-21T20:21:00.001+06:002020-07-10T20:47:26.149+06:00১ম সংখ্যার প্রচ্ছদ<a href="https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEj_8e2iqK5lGhqaQDHhip910-iGd6JU4jmsgAxwWTBT8lW1vQzXNmhx2fKnuuq19CSQpt0OG1XhwrUGxNNBYFO0BW7s5tfn_vDM2dcMkqhHI0rxGTDu4PE4uwAjXUJNg7E9pC50-7kXt8U/s1600-h/bb.PNG" onblur="try {parent.deselectBloggerImageGracefully();} catch(e) {}"><img alt="" border="0" id="BLOGGER_PHOTO_ID_5169439451562117010" src="https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEj_8e2iqK5lGhqaQDHhip910-iGd6JU4jmsgAxwWTBT8lW1vQzXNmhx2fKnuuq19CSQpt0OG1XhwrUGxNNBYFO0BW7s5tfn_vDM2dcMkqhHI0rxGTDu4PE4uwAjXUJNg7E9pC50-7kXt8U/s320/bb.PNG" style="display: block; margin: 0px auto 10px; text-align: center;" /></a> <br />
<div style="text-align: center;">
সম্পাদক: সুশান্ত বর্মন</div>
সুশান্ত বর্মনhttp://www.blogger.com/profile/02304984470756506973noreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-7423733237485716191.post-78807593997073485702008-02-21T00:40:00.000+06:002018-03-07T13:50:17.584+06:00সংস্কৃতি ও রাজনীতি : লক্ষ্য ও উপায়<div style="text-align: center;"><span style="font-weight: bold;">যতীন সরকার</span><br /></div><br />হাঙ্গেরির প্রখ্যাত দার্শনিক ও চিন্তাবিদ লুকাচ বলেছিলেন- ‘সংস্কৃতিই হচ্ছে মূল লক্ষ্য, রাজনীতি সেই লক্ষ্য সাধনের একটি উপায় মাত্র।’ লুকাচের এই ছোট্ট কথাটি যে অনেক বড় তাৎপর্যের দ্যোতক, সেদিকটিতে আমরা মোটেই মনোযোগী হইনি। যদি হতাম তবে সংস্কৃতি ও রাজনীতির পারস্পরিক সম্পর্কটি যেমন আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠত, তেমনি আমাদের রাজনীতিতে সঞ্চিত অনেক জঞ্জালও আমরা পরিস্কার করে নিতে পারতাম। অথচ তার বদলে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক পর্বে রাজনীতিকেই আমরা লক্ষ্য বলে নির্ধারিত করে নিয়েছি, আর সংস্কৃতিকে সেই লক্ষ্য থেকে অনেক দূরবর্তী স্থানে স্থাপন করে তাকে একান্তই চিত্তবিনোদনের উপায় বলে মনে করছি। সংস্কৃতি ও রাজনীতি সম্পর্কে এ রকম ভ্রান্ত বিচারই অনেক অনেক ভ্রান্তির গোলক ধাঁধায় প্রতিনিয়ত আমাদের ঘুরপাক খাওয়াচ্ছে। আমাদের অর্বাচীন ও মননবিহীন রাজনীতিই এ ধরণের ভ্রান্তির সৃষ্টি ও সম্প্রসারণ ঘটিয়েছে। অনেক রাজনীতিক ও রাজনৈতিক গোষ্ঠীই এ থেকে অনেক সুযোগ নিচ্ছে, ‘বিশুদ্ধ’ চিত্তবিনোদনের ক্ষেত্র থেকেও ছিনিয়ে এনে সংস্কৃতিকে তারা নিজেদের ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ স্বার্থ হাসিলের কাজে ব্যবহার করছে।<br /><br />সংস্কৃতি অবশ্যই তথাকথিত ‘বিশুদ্ধ’ কোনো বিষয় নয়, কিংবা কেবল নয় নিতান্তই চিত্তবিনোদনের কোনো সামগ্রী। মানবজীবনের সকল কিছুকেই ধারণ করে এই সংস্কৃতি। জীবনের সমগ্রতা থেকে পৃথক বা অন্য নিরপেক্ষ বা অনন্য নয় বলেই সংস্কৃতি কিছুতেই ‘বিশুদ্ধ’ হতে পারেনা। চিত্তবিনোদন বা চিত্তরঞ্জন যেহেতু জীবনেরই অংশ, তাই সেটি সংস্কৃতিরও অংশীভূত বটে। আর যেহেতু কেবল হালকা চিত্তবিনোদনে জীবনের সম্পূর্ণতা আসেনা, কঠিন কঠোর মননশীলতা ছাড়া জীবন হতে পারেনা অর্থময়, তাই মননশীলতাও মানব-সংস্কৃতির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য। অর্থাৎ বিনোদন ও মনন, কোমল ও কঠোর, আত্মিক ও বৈষয়িক- সব কিছুর সমবায়ে গঠিত যে মানবিক কৃতি, তা-ই সংস্কৃতি। তাই, সংস্কৃতি অবিমিশ্র বা বিশুদ্ধ হয় কীসে?<br /><br />তবে অন্য এক অর্থে সংস্কৃতির বিশুদ্ধতাও আছে বৈকি। সেটি এই অর্থে যে সংস্কৃতির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে গ্লানিহীন মানব-বিকাশ, প্রতিটি ব্যক্তিমানুষের ও সামাজিক মানুষের বাধামুক্ত বিকাশ। তাই এই বিকাশের অনুকূল যা তাই বিশুদ্ধ সংস্কৃতি। এর প্রতিকূল যা তাই অশুদ্ধ সংস্কৃতিÑ একালের ভাষায় ‘অপসংস্কৃতি’, সংস্কৃতি নামের যোগ্যই নয় যা। তবু এই অপসংস্কৃতিই আত্মবিজ্ঞাপনের ঢক্কা নিনাদে প্রকৃত বা বিশুদ্ধ সংস্কৃতিকে প্রায়ই আড়াল করে ফেলে। অপসংস্কৃতির সঙ্গে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করেই শুদ্ধ সংস্কৃতিকে তথা মানবিকতাকে আত্মপ্রতিষ্ঠা করতে হয়। অর্থাৎ সংস্কৃতির জন্য সংগ্রামই মানুষের সংগ্রাম-মানবিক সংগ্রাম। দানবের সাথে মানুষের সংগ্রামই অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম।<br /><br />মানুষের সংগ্রামের এই ক্ষেত্র অনেক বিস্তৃত, এবং তার প্রকৃতি বহুমাত্রিক। সেই বহুমাত্রিকতারই একটি মাত্রার নাম রাজনীতি। এই রাজনীতিও অবশ্যই একপাক্ষিক নয়, বহুপাক্ষিক। অন্তত দ্বিপাক্ষিক তো বটেই। এর একটি পক্ষের লক্ষ্য বিশুদ্ধ সংস্কৃতি তথা মানবিক সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা দান, অন্যপক্ষটি মানব-বিরোধী অপসংস্কৃতির সেবায় নিয়োজিত। আমাদের দেশের রাজনীতিরও নিশ্চয়ই এ রকম দুটো পক্ষ ছিল এবং আছে। তাই ধরে নেয়া যায় যে, এই দুটোরই একটি পক্ষ মানবিক সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠাকে লক্ষ্যবিন্দুতে রেখে সংগ্রাম করেছে এবং অন্যপক্ষটি এর বিপরীত অর্থাৎ মানব-বিরোধী সংস্কৃতি তথা অপসংস্কৃতির প্রতিষ্ঠাকেই তার লক্ষ্যভূত করে রেখেছে। শুধু ‘ধরে নেয়া’ কেনো, পাকিস্তান পর্বে আমাদের রাজনৈতিক সংগ্রামের ক্ষেত্রটি সন্দেহাতীত রূপেই ছিল মানবিক সংস্কৃতি ও মানবিকতা-বিরোধী সংস্কৃতির দ্বৈরথ।<br /><br />বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, বাংলা বর্ণমালার সংস্কার ও সংহারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, রবীন্দ্র-বর্জন ও নজরুলের মুসলমানীকরণ প্রতিরোধের সংগ্রাম- এ রকম সকল সংগ্রামই ছিল মানবিকতা-বিরোধী অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে শুদ্ধ মানবিক সংস্কৃতির সংগ্রাম। তৎকালীন পাকিস্তানের পূর্ব অংশের অধিবাসী বাঙালির কাছে ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।<br /><br />পাকিস্তান নামক অপরাষ্ট্রটিই সকল প্রকার অমানবিক অপসংস্কৃতির ধারক, এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে এবং এ ভূখণ্ড থেকে পাকিস্তানকে উচ্ছেদ করেই ঘটতে পারে মানবিক সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা। এভাবেই জেগে উঠল সুস্থ সবল বাঙালি জাতীয়তাবাদ। হাজার বছরের বাঙালি জাতির ঐতিহ্য, সম্পদ ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে এ ভূখণ্ডের মানুষ সচেতন হয়ে উঠল। ‘জাতীয়তাবাদ’ অবশ্যই একটি রাজনৈতিক প্রত্যয়, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই জাতীয়তাবাদ সার্থকতা পায়। কিন্তু জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ও বিকাশ একটি সাংস্কৃতিক ঘটনা। জাতীয়তাবাদ যখন মানবিকতাকে আশ্রয় করে এবং অমানবিক অপসংস্কৃতিকে প্রতিরুদ্ধ করে, তখনই তাকে বলি আমরা সুস্থ জাতীয়তাবাদ। এর বিপরীতটি হলেই জাতীয়তাবাদ হয়ে যায় উগ্র ও অসুস্থ। পাকিস্তান ও পাকিস্তানি ভাবধারার বিরুদ্ধে সংগ্রামরত বাঙালি জাতীয়তাবাদ ছিল সুস্থ মানবিক সংস্কৃতির বাহক। তাই যে রাজনীতি সেই বাঙালি সংস্কৃতির বাধামুক্ত বিকাশকে সেদিন লক্ষ্যবিন্দু বলে নির্ধারণ করে নেয়, সংস্কৃতির উত্তুঙ্গ মহিমার প্রতি যে রাজনীতি নম্র ও নতশির থাকে, সে রাজনীতিও অসুস্থ থাকতে পারেনা। স্বাধিকার-আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত বাঙালির সকল রাজনৈতিক কর্মপ্রয়াস ছিল সেই বিশুদ্ধ সংস্কৃতি-বলয়ের অন্তর্ভুক্ত, রাজনৈতিক সংগ্রাম ছিল সংস্কৃতির সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ, সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠা দানের উপায় রূপেই দেখা দিয়েছিল রাজনীতি।<br /><br />কিন্তু দুঃখ এই, রাজনীতি ও রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের অনেকেই অকুন্ঠ চিত্তে সংস্কৃতির প্রাধান্যকে মেনে নিতে পারেননা। সংস্কৃতিই যে রাজনীতির মূল লক্ষ্য, অধিকাংশ রাজনীতিকের চৈতন্যে সে ধারণা অনুপস্থিত। সংস্কৃতির বিরাটত্ব ও সর্বব্যাপিত্ত উপলব্ধি করার মতো প্রজ্ঞার অধিকারী নন বলেই তারা সংস্কৃতিকে রাজনীতির সেবাদাস বানাতে চান, কখনও কখনও বা ফরমাস দিয়ে সংস্কৃতি নির্মাণ করতে চান।<br /><br />স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরই এ অবস্থাটি অত্যন্ত বিশ্রী রকমে প্রকট হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতি যে দীর্ঘকালের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বিনির্মিত হয়েছিল, মুক্তিসংগ্রামটা যে নিজেই ছিল একটা সাংস্কৃতিক সংগ্রাম কিংবা সাংস্কৃতিক সংগ্রামের পরিণাম মাত্র, মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের রাজনীতিকরা সে কথাটা অস্বীকার করতে বা বেমালুম ভুলে যেতে চাইলেন। তাঁদের কথায় ও আচরণে সংস্কৃতিহীনতা ও সংস্কৃতি-বিরোধীতার প্রকাশ উগ্র হয়ে দেখা দেয়। আনকালচার্ড রাজনীতি বাংলা ও বাঙালির কালচারকে রাহুগ্রস্ত করে ফেলে। এরই পরিণামে মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত সুফল বাঙালির হাতছাড়া হয়ে গেল, এমনকি জাতির বাঙালি নামটা পর্যন্ত মুছে দিয়ে ‘বাংলাদেশী’ নামে এক পিতৃপরিচয়হীন নামফলক তার গায়ে সেঁটে দেয়া হলো। পরাজিত পাকিস্তান তার বাংলাদেশি অনুচরদের দিয়ে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিল, ওই বাংলাদেশীদের দিয়েই স্বাধীন বাংলাদেশে পাকিস্তানি অপসংস্কৃতিকে ফিরিয়ে আনল, দেশটিকে ধর্মান্ধতা ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার অবাধ বিচরণক্ষেত্র করে তুলল। অর্থাৎ অপসংস্কৃতি জয় করে নিল বিশুদ্ধ সংস্কৃতিকে। মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতি মানবিক সংস্কৃতির দিকে লক্ষ্য রেখে যতদূর অগ্রসর হয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধোত্তর রাজনীতি বাংলাদেশকে ততদূরই পিছিয়ে নিয়ে গেল।<br /><br />এ থেকেই বোঝা যায়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়নি। অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধের কথা এবং তার সমাপ্তিকরণের কথা রাজনীতিকরাও বলেন। যে রাজনীতিকরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন তারাতো বলেনই। যারা মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের সহযোগী হয়ে মুক্তিকামী বাঙালিকে নিপীড়ন করেছে, মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে রাজনীতি করার অধিকার পেয়ে তারাও চোরের মায়ের মতো বড় গলায় মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে। তারাই বরং বেশি বলে। বাংলা ও বাঙালির ওই চিরশত্রুদের মুখেই আজ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের কথার খৈ ফোটে। তবে মুখে যা-ই বলুক- এরাতো বাংলাদেশকে পাকিস্তানের নতুন সংস্করণ হিসেবেই দেখতে চায়, এরা যে আবহমান বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতি তথা সুস্থ মানবিক সংস্কৃতির দুশমন, এ কথাতো যে কোনো সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষই বোঝে। এদের কাছে সুন্দর বা মহৎ কিছু আশা করাটাই বোকামি। অপসংস্কৃতির কীটগুলো সংশোধিত হয়ে সুস্থ সংস্কৃতির লক্ষ্যে সুস্থ রাজনীতি করবে এমন আশা করে বোকামির পরিচয় দেবো কেনো আমরা?<br /><br />কিন্তু সত্যি সত্যিই মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন যে সব রাজনীতিক ও রাজনৈতিক গোষ্ঠী। যাদের ঘোষিত লক্ষ্য একটি সেক্যুলার ও সমাজতন্ত্রমুখী বাংলাদেশ, সেই লক্ষ্যাভিসারী বলে কথিত হওয়ার দরুনই যারা স্বাধীন বাংলাদেশেও পাকিস্তানপন্থী ও অপসংস্কৃতির বাহকদের রোষের শিকার, তাঁদের প্রতিতো আমাদের প্রত্যাশা থাকবেই। অথচ অপ্রিয় হলেও সত্য যে, আমাদের প্রত্যাশা পূরণের যোগ্যতা ওই রাজনীতিক ও রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর নেই। অর্থাৎ এরাও সংস্কৃতিমনা নন। এরাও রাজনীতিকেই চুড়ান্ত বলে ধরে নেন, রাজনীতিকেই একাধারে উদ্দেশ্য ও উপায় বলে জ্ঞান করেন।<br /><br />প্রেম আর যুদ্ধের মতো রাজনীতিতেও অন্যায় বলে কিছু নেই- এরকম কৌটিল্য ভাবনাতেই এদেরও আস্থা। তাই যদি হয়, তাহলে আমরা কেনো ও কীভাবে ওই সংস্কৃতিহীন রাজনীতিকদের ওপর আস্থা রাখব? আমরা যারা রাজনীতিক নই, কোনো রকম রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ বা ক্ষমতা দখলের স্পৃহা যাদের নেই, সেই আমরা কেন প্রতিনিয়ত রাজনীতিকদের দাবার ঘুঁটি হয়ে থাকবো? আমরা অগণিত সাধারণ মানুষতো চায় মানুষের মতো বেঁচে থাকতে। মানুষের মতো বেঁচে থাকা মানে সংস্কৃতিমান হয়ে বাঁচা। সংস্কৃতিমান হয়ে বেঁচে থাকার জন্য প্রথমেই প্রত্যেক মানুষের অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-বাসস্থান-স্বাস্থ্য-নিরাপত্তা-কর্মসংস্থানের নিরাপত্তা থাকা প্রয়োজন। কোনো এক গোষ্ঠীর মানুষ বিত্তে-বিদ্যায়-প্রতিপত্তিতে অসাধারণ প্রতাপশালী হয়ে অন্য গোষ্ঠীর মানুষদের শোষণ-পীড়ন-দমন করবে, এমন অবস্থার অবসান প্রয়োজন। সকলে অবাধে আপন মত প্রকাশ করবে, যে কেউ যে কোন ধর্ম-মতের অনুসারী হতে পারবে কিংবা কোনো ধর্মমতে বিশ্বাসী না হওয়ার অধিকারও একজন নাগরিকের থাকবে, ক্ষুদ্র বা বৃহৎ যে কোনো জাতিসত্তার মানুষ আপন ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের সুযোগ পাবে, কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য কোনো মানুষ নিগ্রহ বা বৈষম্যের শিকার হবেনা, জন্মই হবে না কারো আজন্ম পাপ- সমাজের প্রতিটি মানুষের জন্য এমন ব্যবস্থা নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। আমরা চাইব, ওইসব প্রয়োজন মেটানোর জন্য রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলো আমাদের সহায় হবে। আমাদের এই চাওয়ার বিরোধী যারা তাদের আমরা অবশ্যই রুখে দাঁড়াব এবং এই রুখে দাঁড়ানোয় যে সব রাজনৈতিক গোষ্ঠী আমাদের পাশে থাকবে তাদেরই আমরা মিত্র বলে গ্রহণ করব। এই মিত্রদের নিয়েই আমরা মুক্তিযুদ্ধের নতুন পর্যায়ে অর্থাৎ অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তিকরণে প্রবৃত্ত হতে পারব।<br /><br />কিন্তু এ রকম সংস্কৃতি-চেতনায় পরিশীলিত রাজনৈতিক গোষ্ঠী আমরা কোথায় পাবো? আজকের সব রাজনীতিই তো অসংশোধনীয় রূপে কলুষিত। সংস্কৃতিবোধহীন কলুষিত রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলো সুস্থ সংস্কৃতির লক্ষ্যাভিমুখী হয়ে সেই লক্ষ্য সাধনের উপায় রূপে সুস্থ রাজনীতির চর্চা করবে- এমন প্রত্যাশা অসম্ভবের প্রত্যাশা। সেই অসম্ভবের পিছনে না দৌড়ে আজকে গণমানুষের মধ্যেসুস্থ সংস্কৃতি-চেতনার প্রসার ঘটানোর প্রয়াস গ্রহণ করাই হবে সঠিক ও সঙ্গত পদক্ষেপ। সেই পদক্ষেপের মধ্য দিয়েই গড়ে তোলা যায় একটি সর্বতোমুখী সংস্কৃতি-আন্দোলন। এ রকম সংস্কৃতি আন্দোলন ছাড়া সমাজের কোনো অংশ থেকেই কলুষ-কালিমা দূর করা এবং কাক্সিক্ষত বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটানোর দিকে অগ্রসর হওয়া যাবে না। সেই সংস্কৃতি-আন্দোলন থেকেই সুস্থ রাজনৈতিক ধারাটি বেরিয়ে আসবে। সেই রাজনীতির লক্ষ্যটি সঠিক হবে বলেই সে লক্ষ্য সাধনের উপায়টিও সঠিক না হয়ে পারবে না। লক্ষ্য ও উপায়ের সামঞ্জস্য ঘটিয়েই আমরা নতুন মুক্তিযুদ্ধে নামতে পারি। সেই মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভ করেই আমরা পারবো বিশুদ্ধ মানবিক সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা করতে ও সব রকম অমানবিকতার হাত থেকে মুক্ত হতে।সুশান্ত বর্মনhttp://www.blogger.com/profile/02304984470756506973noreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-7423733237485716191.post-73469143955361118082008-02-21T00:37:00.000+06:002018-03-07T13:50:17.485+06:00বহমান সমাজ বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে কবিতা লেখা ও কবির নির্ভরযোগ্যতা<div style="text-align: center;"><span style="font-weight: bold;">তপন কুমার রুদ্র</span><br /></div><br />আমি এবং অনেকেই হয়ত বড় বেশী ভালোবেসে কবিদের বলি, ‘ওরা ভাবুক, ওরা ভাবতে ভাবতেই কবিতা লেখে। ওদের কোন জাতি নেই, ওদের জাত থাকতে নেই।’ সেই ভালো, কবির জাত না থাকাই ভালো। কিন্তু কবিদের সবার উপরে মানুষ হওয়াটাই আশু প্রয়োজন। ‘নিছক কবির কবিতা’ বড়ই ভয়ংকর। পক্ষান্তরে একজন মানুষের মতো মানুষ, খাঁটি মানুষ, কবিতা লিখে লিখে যিনি নিজের ও পরের বাঁচার ধারাটিকে প্রবলভাবে বিচিত্র এবং আলোকিত করে তুলতে সক্ষম হবেন। তখন তাঁর নিজের উচ্চারণে কিংবা ঘোষণায় নয়, বরং অজস্র সজ্ঞান মানুষ তাঁকে কবি বলে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হতে পারেন। তাই কবি-লিখিয়েদের কাছে সময়ের একটা সতর্কবার্তা এমনই ভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছেÑ ‘শুধুমাত্র কবি হবার জন্য কবিতা লেখার পাগলামিটা করো না।’<br /><br />আমারও তাই মনে হয়। যে তরুণ কিংবা যে কোন বয়সের বন্ধুটি কবি হবার জন্য আজ বড় চঞ্চল। এক্ষুনি কবি তাকে হতেই হবে এমনই যার ভাব, তাঁর কাছে দিন-রাত্তির মধ্যে কোন ব্যবধান নেই সব একাকার। আশাভঙ্গের বেদনাই হতে পারে তাঁর তাৎক্ষণিক পাওনা। বন্ধুদের সহানুভূতি আর অপরের বিরক্তি হতে পারে তার উপরি পাওনা। উপকারটি হয়তো তিনিই করতে পারেন যিনি ধমক দিয়ে তাঁকে বলে দিবেন- ‘একমাত্র সংবেদনশীল একজন মানুষ হতে পারে কবিতার স্রষ্টা এবং যথার্থ কবিতাই প্রকৃত কবির কাক্সিক্ষত পরিচয় ক্রমাগত জন্ম দিতে থাকে।’<br />তাই কবি হবার জন্য কবিতা লেখার চেষ্টা বাদ দিলেই ভালো হয়। এখানে ব্যবহারকারী হবার আগে, প্রেমিক হবার বিবেকী দায়িত্বটি পালন করা অত্যন্ত জরুরি।<br /><br />কবিতাও বড় চতুর। না ধরা গোপনগঞ্জের মত ওর রহস্য। ওকে দখল করতে গেলে ওর জন্য প্রেম খরচ করতে হবে জীবনের মূল্যে। এর জন্য সাধনা উদ্বেগময় হলেও তা গভীরভাবে অন্তর ঘনিষ্ঠ হতে হবে। খাঁটি অর্থে জীবন সংশ্লিষ্ট হতে পারলে কবিতা প্রেম কখনোই কাউকেই পুরোপুরি হতাশ করবে না। খুব তাড়াতাড়ি কবিতা কারুর পাওনা চুকিয়ে দেয় না। এটাও বিশ্বাস করতে হবে। একবিংশ শতাব্দীর এই দ্বিধাগ্রস্থ প্রারম্ভে যিনি আসলেই কবি হবার জন্য বড় বেশি চঞ্চল তার তো আছে অনেক অনেক সান্তনা ও সম্ভাবনা। কারণ চাইলেই তিনি বইয়ের পৃষ্ঠা খুলতে পারেন, পৃষ্ঠা খুললেই তো এমন অনেককে পাওয়া যায় যাঁরা না ধরা যাতনায় দারুণভাবে পরীক্ষিত এবং এদের অনেকেই অনেকাংশে সফল কবিতা প্রেমিক। হতে পারেন তিনি হোমার, সেক্সপিয়র, কালিদাস, ভারতচন্দ্র, হুইটম্যান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা নজরুল। তিনি হতে পারেন সুকান্ত, জীবনানন্দ, সুধীন কিংবা নির্মলেন্দু গুণ। আজকের কবিতা প্রেমিকরা জন কিটস এর ‘সাইকী’কে আলিঙ্গন করতে পারেন। শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা’ নামের রূপটিকে স্বশরীরের কাছে টেনে নিতেও পারেন। কত রস ও রসিকের সন্ধান নব্য কবিদের নাগালের সীমানায় ও ধরা দেয়ার অপেক্ষায়। উদ্যোগে আর চিনে নেয়াতে তার যত অহঙ্কারী আলস্য অথবা অহেতুক দেরি।<br /><br />কবিতা নামের রূপসী তিলোত্তমাটির প্রতি ধৈর্য্যশীল প্রেমজ্ঞাপনের পথেই আমরা আবিষ্কার করতে পারি নিজের অপারগ আগ্রহের দরিদ্র ছবিটি। সেই একই পথে এগুলে সকলেই হয়ত বুঝতে পারব নিজের কাজের সীমাবদ্ধতা কত দূর। কারণ অন্যের লেখা কোন কবিতার অসংলগ্ন ঝংকার যদি নিজ কানে বেসুরো ঠেকে, অপরিচ্ছন্ন বোধ হয়, তবে নিজের লেখার অসুর তীরটি কেন নিজের কানে বিঁধবেনা? একটি অপ্রতিদ্বন্দ্বী সত্য এই যে, যিনি কবিতা বা অন্য কিছু লেখেন তাঁর প্রতিটি লেখার প্রথম পাঠক তিনি নিজেই। সেখানে তাঁকে নিরপেক্ষ হতে হবে। আবেগান্ধ না হয়ে নিজের লেখার নিরপেক্ষ পাঠক ও নিরপেক্ষ বিচারক হতে পারলে নিজের হতাশা যাবে দূরে, তার জায়গায় জেঁকে বসবে আত্মবিশ্বাস। এরপর তাবৎ কালের শ্রেষ্ঠ কিছু কবিতাকে ভালোবেসে পড়লে সৃজনশীল শক্তির শেকড় আরও দৃঢ় ও গভীরগামী হবেই।<br /><br />কবিতা কি? এ প্রশ্নটিও চাঙ্গা হয়ে উঠেছে বলে মনে হয়। নোট বই আর গাইড বই এর যুগে ত্বরিৎ গতিতে সংক্ষিপ্ত উত্তর পাওয়ার তাগিদে সবাই যখন চঞ্চল, তখন কবি খ্যাতি প্রত্যাশীরাই বা কেন তার ব্যতিক্রম হবেন। ধৈর্য্যশীল উত্তরদাতাকেও বাধ্য হয়ে তাড়াতাড়ি সংক্ষিপ্ত পথ খুঁজতে হতে পারে। এমন একটা সংক্ষিপ্ত পথ দেখা যাক কবিতার সংজ্ঞা নিরূপণে সফল হওয়া যায় কিনা? ভিক্টোরিয় যুগের ইংরেজ কবি ও সমালোচক ম্যাথু আরনল্ড বলেছিলেন, "The best words in the best order" (অর্থাৎ উপযুক্ত শব্দগুলোকে সর্বোত্তম বিন্যাসে উপস্থাপনের নামই কবিতা)। আশি-পঁচাশি বছর পরও এই সংজ্ঞাটি বেশ জনপ্রিয়। তবে ইতিমধ্যে অন্য যে সব দূরের ও কাছের কবিদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তাঁদের মহত্তম কবিতাগুলো আন্তরিক আগ্রহে বিশ্লেষণ করলে একটু বেশি রকমের স্বচ্ছ ধারণা পেতে পারি নাকি? ‘চেষ্টায় অসাধ্য নেই’- কথাটি মানতে না চাইলেও অন্তর থেকে জোর দিয়ে বলা যায়, ‘চেষ্টায় দোষ নেই।’<br /><br />কবিতা গুণের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে, মহত্তম কবিতার প্রায় সকল শব্দই বহুমাত্রিক অর্থ ও ব্যাঞ্জনা দান করে। তখনই কোনো লাইন এমনকি কোন ক্ষুদ্র বর্ণনা কবিতার মান পেয়ে যায় যখন তার অন্তর্গত শব্দ বা শব্দগুচ্ছ অভিধানে নির্দিষ্ট করা অর্থের সীমানা অতিক্রম করে ব্যাপ্ত অর্থে বিচিত্র হয়ে ওঠে। একটি উদাহরণের হয়ত প্রয়োজন হয়ে পরছে 'Fragrant Eyed' (সুগন্ধি চোখ) এই মনোগ্রাহী বাক প্রতিমাটি ইংরেজ কবি কিটস এর বিখ্যাত কবিতা 'Ode to Psyche' থেকে নেয়। এখানে এক দেবীপুত্র ও আর এক দেবীকন্যার মিলনছবি প্রকটিত হয়েছে হৃদয় ছোঁয়া শব্দ বিন্যাসে, তারই এক ক্ষুদ্র অবসরে কবি উল্লেখিত এই বাকপ্রতিমাটি ব্যবহার করেছেন। “সুগন্ধি চোখ” এমনই এক দৃশ্যপট যেখানে চোখও দেখছি ফুলও দেখছি আবার সুগন্ধের স্পর্শও পাচ্ছি। কিন্তু চিহ্নিত অর্থের তুলনায় অনেক বেশি কিছু পাচ্ছি নাকি? একজনের চোখ আর একজনের চোখে কখন এবং কেন সুগন্ধি হয়ে ওঠে। আসলে কিটস এর ‘সুগন্ধি চোখ’ শুধুমাত্র সুগন্ধ আর শুধুমাত্র চোখ নয়। এর ব্যাঞ্জনা ও ভাবের গভীর আবেগ সংবেদনশীল পাঠককে অভিনব কিছু একটা আবিষ্কার করতে প্রেরণা যোগায়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের এমনই অসংখ্য কবিতা আছে যার শব্দ বিন্যাসের কোষে কোষে আমরা আবিষ্কার করতে পারি। নিজের অন্তরে জাগ্রত যেসব চিত্র ও প্রবণতা নিয়ত একটি মানুষকে জাগিয়ে রাখছে যেসব প্রতিচ্ছবি ও প্রতিধ্বনি কবিগুরুর অজস্র গানে, কবিতাতে এমনকি তাঁর ছোট গল্পে বহু লাইনে বিশ্বস্ত মাত্রায় প্রতিভাত হচ্ছে, তাঁর ‘সোনার তরী’ কাব্যের ‘নিদ্রিতা’ নামের কবিতায় পড়া একটি পংক্তিমালা এই প্রসঙ্গে ব্যবহার না করে পারছিনা-<br /><span style="font-style: italic;">“নিমেষে পাছে সকল দেশে জাগে...</span><br /><span style="font-style: italic;">শঙ্কা মোর চলিল আগে আগে</span><br /><span style="font-style: italic;">কমল ফুল বিমল শেজখানি</span><br /><span style="font-style: italic;">নিলীন তাহে কোমল তনুলতা</span><br /><span style="font-style: italic;">মুখের পানে চাহিনু অনিমেষে</span><br /><span style="font-style: italic;">বাজিল বুকে সুখের মত ব্যথা "</span><br /><br />তাঁর ‘বাঁশি’ কবিতার সেই শব্দমালাগুলোই বা কম কীসে-<br /><span style="font-style: italic;">“ঘরেতে আসেনা সে</span><br /><span style="font-style: italic;">মন তার নিত্য আসা যাওয়া</span><br /><span style="font-style: italic;">পরনে ঢাকাই শাড়ি</span><br /><span style="font-style: italic;">কপালে সিঁদুর”</span><br />‘বাঁশি’ কবিতার উপরোক্ত শব্দগুলোর অর্থের কোনো সীমানা নেই। শব্দগুলোর প্রচলিত অর্থ এখানে বিচিত্র মাত্রায় বিস্তৃত পরিসর লাভ করেছে। প্রতিটি মানব মনে দৃঢ়মূল একটি আকাক্সক্ষা ক্রিয়াশীল তাহল এমন এক সুন্দরকে কামনা করা যা আসলে কোনো দিনই কেউ স্পর্শ করতে পারেনা। স্পর্শ করা তো সম্ভবই নয় বরং বলতে পারি চিরবাঞ্চিত সেই সুন্দরের বাসনা কেবল অনুভবে ও চিন্তায় তাকে মনের চোখেও পূর্ণ অবয়বে কেউ দেখতে পায়না। অতএব সেই চিরবাঞ্চিত সুন্দর মনে আসে বারবার, কিন্তু ঘরে অর্থাৎ বাস্তবে কদাচিত আসে। চিরন্তন এই বাসনায় সুখ আছে তবে দুঃখও সেখানে গভীর। বিশ্বজনীন এই অপূর্ণ আবেগ বিশ্বকবি তার ‘বাঁশি’ কবিতায় কি অদ্ভূত সুষমায় শিল্পমণ্ডিত আকারে প্রতিভাত করেছেন। সেই সাথে আরও যা করেছেন তা কেবল তার মতো কবির পক্ষেই সম্ভব। সেটি হল এই, যখন তিনি বলেছেন <span style="font-style: italic;">‘পরনে ঢাকাই শাড়ি কপালে সিঁদুর।’</span> চিরন্তন মানব বাসনা বা মানব বেদনা একটি হৃদয়ে স্থায়ী হওয়া একটি সুন্দর কামনার বঙ্গজ প্রতিকৃতি, অর্থাৎ ‘পরনে ঢাকাই শাড়ি কপালে সিঁদুর’ এ যেন সিন্ধু ও বিন্দুর অপূর্ব মিলন; এক অসাধারণ শৈল্পিক সমন্বয়, যা গুণে-জ্ঞানে আর ধ্যানে অনুভবে পূর্ণ ও অথচ মার্জিত। আমাদের সমকালের কবিদেরও সেই ক্ষমতা অর্জনে নিবেদিত হওয়া আশু দরকার। সেই ক্ষমতা যা বহুমাত্রিক বাকপ্রতিমা নির্মাণের জন্য প্রয়োজন।<br /><br />এমনটাও হয় যে একটি মাত্র শব্দ যা একটি নামের কিংবা একজন ব্যক্তির উল্লেখ বা একটি ইতিহাসের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে এমন একটি বিশাল প্রতিশ্রুতিময় চেতনা প্রবাহ পরিস্ফুট হতে পারে কালজয়ী ব্যঞ্জনা নিয়ে। এর জ্বলজ্বলে উদাহরণ অবশ্যই দেয়া যায়। মাত্র একুশ বছর বয়সে মারা যাওয়া কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘লেনিন’ কবিতাটিতেই সেই কাব্যশক্তির উদাহরণ পাওয়া যায়। কবিতাটির গোড়ায় লাইন দুইটি এমন-<br /><span style="font-style: italic;">“লেনিন ভেঙেছে রুশে জনস্রোতে অন্যায়ের বাধ</span><br /><span style="font-style: italic;">অন্যায়ের মুখোমুখি লেনিন প্রথম প্রতিবাদ।”</span><br /><br />কবি যদি এখানেই থেমে যেতেন তা হলেও রক্ষা পেতাম আমরা, যারা বড় বেশি চঞ্চল কেবল কবি হবার জন্য। কারণ এই লাইন দুইটিতে ‘লেনিন’ নিছক একটি ইতিহাসের প্রতি ইঙ্গিত। কিন্তু আবার যখন দেখি-<br /><span style="font-style: italic;">‘আজকেও রুশিয়ার গ্রামে ও নগরে হাজার লেনিন যুদ্ধ করে...</span><br /><span style="font-style: italic;">বিপ্লব স্পন্দিত বুকে মনে হয় আমিই লেনিন।’</span><br />তখনই পড়তে হয় বিপাকে। কিভাবে ‘লেনিন’ বা একটি নাম যার উচ্চারণ ঘটল একটা সংগ্রামশীল চেতনা ও প্রবাহের প্রতীক রূপে। এখানে লেনিনকে বুঝতে হচ্ছে একটি আদর্শ ও একটি বিশাল অঙ্গিকারের দ্যুতিময় স্থাপত্য রূপে।<br />কবিতা তো গদ্য নয়। এর একটি উচ্চারণে বিধৃত হবে বহুমাত্রিক ইঙ্গিত। যেন এও এক ছলনা। যে বোঝাবেনা কিছুই অথচ ভালোবাসলে তাকে বোঝা বড় বেশি কঠিন নয়। তবে এতটুকুও বোঝা যায়না এমন কোনো প্রতিমা কবিতা নামের গৌরব অর্জন করেছে তা কেউ বিশ্বাস করতে পারেনা বলেই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। ইঙ্গিতময়তার জোরেই নারী পুরুষের কাছে বড় প্রিয় এবং পুরুষও নারীর কাছে তেমনটা। তবে একটু বেশি খোলামেলা বলেই হয়ত পুরুষ নিয়ে নারীর স্বপ্ন ততটা আকুল নয়, যতটা পুরুষরা ব্যাকুল নারীর জন্য। সম্ভবত, তাই ইতিহাস বলে দেয় পুরুষ রোমান্টিক কবির সংখ্যার তুলনায় নারী রোমান্টিক কবি সংখ্যা বড় সীমিত। তবে এই ক্ষণে এই নারী-পুরুষ প্রসঙ্গটি অবান্তর মনে হলেও দোষের কিছু নেই। আমাদের কালের কবিরা অবশ্যই একটা কথা ভাবতে পারেন। তাঁরা নিজেকে প্রশ্ন করতে পারেন, ‘কি নেই আমাদের?’ কেননা এমন একটা পৃক্ষাপট বিরাজ করছে যেখানে রুচিশীল এবং সচেতন ব্যক্তিমাত্রই অনুভব করছেন একটা অব্যক্ত অভাব। যাঁদের রুচি-রুটি তথা ভাতের অভাব নেই তাঁদের মধ্যেই যারা রুচিশীল, অন্তত তাঁরা বোধ করছেন ‘কিছু একটা’ নেই যা থাকা দরকার ছিল। নিত্যদিনের জীবন চর্চায়, জীবিকার অন্বেষায়, শিক্ষা অর্জনে কিংবা সামাজিক এবং পেশাগত কাজকর্মে সবাই যেন অতৃপ্ত। কি যেন নেই যা থাকা উচিত ছিল। নেই নেই এই ভাবটা সবাইকে পীড়িত করছে। এই পীড়ন বর্তমান বাস্তবতায় সমাজ সচেতনতারই অঙ্গ। এই সচেতনতা কবিকেও ধারণ করতেই হবে। অবশ্য অনেক কবি বন্ধু ইতিমধ্যে ভাবতে শুরু করেছেন, শুধু কবিতা নয় জীবন নিয়েও তাদের এই ভাবনা।<br /><br />আমাদের কি নেই? আছে তো অনেক কিছু। প্রায় দেড় হাজার বছরের সাহিত্য চর্চা আমাদের ইতিহাস- আমাদের আছে একজন রবীন্দ্রনাথ, আছে একজন কবি নজরুল, আরও আছে একজন সুকান্ত, আছে আপন ভরা একজন জীবনানন্দ দাস। আমাদের আছে বিশ্বনন্দিত ২১শে ফেব্র“য়ারি, আরও আছে রক্তাক্ত ইতিহাস, একাত্তুরের মুক্তি সংগ্রাম, আর সৃজনশীল বজ্রকণ্ঠ। আমরা ভুলতে পারিনা আমরাও টংক ও তেভাগা আন্দোলনের মত সংগ্রামী ইতিহাসের উত্তরাধিকারী। অথচ ‘কি নেই, কি নেই?’ -এই প্রশ্ন আমাদের বিবেককে বিদ্ধ করছে অনুক্ষণ। সম্ভবত, এর একটা উত্তর আছে সেটা এই আমরা পরস্পরের কাছে সকলেই বিশ্বাসঘাতক। আমাদের নিজেদের কাছে নিজেরাই নির্ভরযোগ্য নই। আসল অভাবটা এখানেই। নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি নেই, নির্ভরযোগ্য শিক্ষক নেই, নির্ভরযোগ্য ডাক্তার নেই, নির্ভরযোগ্য রাজনৈতিক নেতা ক্রমেই যেন অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। আমরা ভুলে যাচ্ছি নির্ভরযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কথা; যথার্থ ধর্মজ্ঞানসম্পন্ন মানুষও যেন বড়ই দুষ্প্রাপ্য। নির্ভরযোগ্য কবির চেহারাও কল্পনা করা অসম্ভব হয়ে পরেছে। কারণ হিপোক্রিসি অর্থাৎ ভণ্ডামী যখন জাতির সকল কবজায় মরচে ধরিয়ে দিচ্ছে তখন নির্ভরযোগ্যতা এক ‘ইমপসিবল কোয়ালিটি’ হিসেবে গণ্য হতে বাধ্য। আজকের কবিকে নির্ভরযোগ্য খাঁটি মানুষ হিসেবে দাঁড়াতে হবে। কাউকে তোষণ করা কিংবা অহেতুক কাউকে চটানো কোন নির্ভরশীল কবির দায়িত্ব নয়। তিনি যা সত্য বলে ভালোবাসেন তাই কবিতার আঙ্গিকে ফুটিয়ে তোলা তার আদর্শ। পূর্বপুরুষের ঋণ শোধের অঙ্গিকার আর সমকালের অভাবী মানুষ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে পেতে হবে কবিতা লেখার প্রেরণা আর সেই উৎস থেকে কবিতার বাণী যতক্ষণ পুষ্টি সঞ্চয় করতে পারবে না ততক্ষণ কবিকে সংগ্রাম করতে হবে নিজের সীমাবদ্ধতা ও অসামর্থের বিরুদ্ধে। এই সংগ্রাম শেখার জন্য চাই নিরন্তর ইতিহাস চর্চা ও কবিতা পাঠের অনুশীলন আর চাই কবিতার প্রতি নির্ভরযোগ্য অগাধ ভালোবাসা।<br /><br />একবিংশ শতাব্দীর আরম্ভ পর্বে বাংলাদেশে কবিতার চর্চায় একটা ভিন্ন মাত্রিক ‘আরম্ভের’ শুরু হলো। হয়ত নতুন শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের সংস্কৃতি একটু বেগ পেতে পারত। একটা ঐতিহাসিক উদাহরণ থেকে এই ‘আরম্ভের’ সূচনাটা ঠিক কেমন হবে তার রূপরেখা নির্দিষ্ট করতে আমরা প্রেরণা পেতে পারি। লাটিন আমেরিকার দেশ চিলিতে পাবলো নেরুদা বলে একজন কবি ছিলেন। বিশ শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশক এবং সত্তর দশকের গোড়া পর্যন্ত সময়কালে তার দায়বদ্ধ কাব্যসংগ্রাম পরম সুস্থ্যতায় জাতীয় সংঘবদ্ধ মুক্তিকামী অঙ্গিকারে সংগঠিত হতে একটি আদর্শনিষ্ঠ পথে এগিয়ে নিয়েছিল। সেই কবিই জাতির প্রয়োজনে জনগণের দাবীতে রাষ্ট্রপতি পদের জন্য নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আবার জাতির বৃহত্তর স্বার্থে তারই আদর্শের অনুসারীদের পরামর্শে সেই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। বিপরীতমুখী দুইটি সিদ্ধান্তই কালের বিচারে ছিল ঐতিহাসিক এবং গবেষণা করে দেখার মতো বিষয়। সভ্যতার আসল কারিগর মেহনতি মানুষের উদ্দেশ্যে তাঁর অজস্র কাব্য উচ্চারণের মধ্যে অত্যন্ত স্মরণীয় একটি ঘোষণা এমন “হারাবার মতো আছে শুধু শৃংখল অথচ জয় করবার মতো আছে গোটা পৃথিবীটা।” তিনি আরও বলেছেন “তোমাদের পিঠ ফাটা, হাত ফাটা, আছে উপবাস কিন্তু তারপরও তোমাদের আছে একজন কবি।” সেই জন্যই আজ অবশ্যই কেউ মনে করতে পারে শুধু মাত্র আরও কজন রবীন্দ্রনাথ নয়, চাই আরও অনেক অনেক জন পাবলো নেরুদা। এ চাওয়াতে অপরাধ হলে দোষ কি?<br /><br />সময় সমাগত মনকে ডেকে তুলবার জন্য যে কবি সমন্বিত সৌন্দর্যের একান্ত পূজারী এবং বিবেকের কাছে বিশ্বস্ত সেই চাইলে হতে পারে পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য। সময়ের বিচারে সেই প্রয়োজনীয় যোগ্যতা কবিরা অর্জন করুক। একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে হোক তার আরম্ভ। কবিদের গন্তব্য স্থির হোক মানব মুক্তির বৃহত্তম সংগ্রামে।সুশান্ত বর্মনhttp://www.blogger.com/profile/02304984470756506973noreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-7423733237485716191.post-48268327857199565212008-02-21T00:32:00.002+06:002018-03-07T13:50:17.327+06:00বিশ্বায়নে বাংলাদেশের অর্থনীতি<div style="text-align: center;"><span style="font-weight: bold;">এম. এম. আকাশ</span><br /></div><br /><span style="font-weight: bold;">অপুঁজিবাদী বিশ্বায়ন : বাজার ভিত্তিক নয় শক্তি ভিত্তিক</span><br />বিশ্বায়ন মর্মবস্তুর দিক থেকে কোনো নতুন ধারণা নয়। যদিও আদিম সাম্যবাদী সমাজে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া অনুপস্থিত ছিল কিন্তু দাস ও সামন্তযুগে সীমিত পরিসরে হলেও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য জলত। দাস যুগে আফ্রিকা থেকে দাস সংগ্রহ করে অন্যান্য স্থানে বিক্রি করা হতো কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় দাসদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল না। কাজেই দাস যুগের সীমিত বিশ্বায়ন (আন্তর্জাতিক বাণিজ্য অর্থে) ছিল বলপূর্বক। একই কথা সামন্ত যুগের বিশ্বায়নের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেও বিশ্বায়ন ছিল সীমিত। পুঁজিবাদী দেশগুলো সোভিয়েত ইউনিয়ন বা পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর সাথে কখনই ব্যাপক ধরনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করেনি। বর্তমানে বিশেষত ৯০’র দশক থেকে যে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া চলছে সেটি মূলত পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন এবং এর চরিত্র দাস কিংবা সামন্তযুগের বিশ্বায়নের মতো বলপূর্বক না হলেও পুরোপুরি স্বতঃস্ফুর্ত বিনিময়-নির্ভরও নয়। এর পরিসরে তুলনামূলকভাবে অধিকতর বিস্তৃত এবং গভীর।<br /><br /><span style="font-weight: bold;">পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন : বাজার ও শক্তির দ্বান্দ্বিক ঐক্য</span><br />পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের তত্ত্বানুযায়ী দাবি করা হয় যে, এর ফলে পুঁজি, পণ্য, সেবা, শ্রমশক্তি এবং তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ বিচরণ ঘটবে এবং সামগ্রিকভাবে বিশ্ব অর্থনীতির উন্নয়ন হবে। কিন্তু একটি প্রশ্ন এখানে গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো পুঁজি, পণ্য কিংবা প্রযুক্তির এই অবাধ চলাচল কি স্বতঃস্ফুর্তভাবে হবে? কোনো ধরনের কেন্দ্রীয় সমন্বয় ছাড়া যদি এদের মুক্তভাবে বিচরণ করতে দেয়া হয় তাহলে অরাজকতা সৃষ্টি হতে বাধ্য। সুতরাং দেখা যাচ্ছে পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের জন্যও একটি কেন্দ্রীয় শাসন বা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা আছে। পুঁজিবাদী বিশ্বের হর্তা-কর্তারা তা ভালভাবেই বোঝেন। উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলো বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সমন্বয়কারী সংস্থার জন্ম দিয়েছে। এর মধ্যে প্রধান দুটি হলো বিশ্বব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (International Monetary Fund-IMF)। ২য় মহাযুদ্ধের পরে আমেরিকার ব্রেটন উডস শহরে মার্শাল চুক্তির অধীনে এই দুটি সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। এ কারণে এদেরকে একত্রে বেটন উডস সংস্থাও বলে। সম্প্রতি এর সাথে যুক্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থা (World Trade Organization-WTO)। বর্তমানে এই ত্রয়ীই পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।<br /><br /><span style="font-weight: bold;">পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন : অনিবার্য সীমাবদ্ধতাসমূহ</span><br />এখন আমরা যদি পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করতে যাই তাহলে প্রথমেই এর কিছু কিছু নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা দরকার যা থিওরির সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। প্রথমত চলমান বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় পুঁজি কিংবা পণ্যের অবাধ চলাচল নিশ্চিত করা হলেও শ্রমশক্তির ক্ষেত্রে সেটা আদৌ ঘটেনি। আমেরিকার বাজারে বাংলাদেশের পুঁজি, পণ্য অথবা সেবা স্বাধীনভাবে প্রবেশ করতে পারে, অথচ আমাদের শ্রম আমদানীর ব্যাপারে তারা মোটেও আগ্রহী নয়। এর ফলে যেসব দেশের মূল সম্পদ পুঁজি তারা লাভবান হয় ঠিকই কিন্তু যাদের মূল সম্পদ শ্রমশক্তি তারা তুলনামূলকভাবে ততটা সুবিধা পায় না। তাই পুঁজিবাদী বিশ্বায়নে শুরু থেকেই একটি কাঠামোগত সুযোগ বৈষম্য থেকে যায়। সব খেলোয়াড়রাই সমান সুবিধা নিয়ে সমান বিশ্ব মর্যাদায় খেলার সুযোগ পায় না। দ্বিতীয়ত ইদানীং ইন্টারনেটের প্রসারের ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং তথ্য প্রযুক্তি খুব সহজেই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলতে শুরু করেছে। কিন্তু পুঁজিবাদীরা জ্ঞানের এই অবাধ প্রবাহ সহজে মেনে নিতে পারছেন না। তারা লক্ষ্য করেছেন যে, এতে তাদের ভীষণ অসুবিধা কেননা তাদের বিভিন্ন প্রোগ্রাম, বিভিন্ন উদ্ভাবন খুব সহজেই নকল বা ছিনতাই (Pirated) হয়ে যাচ্ছে। ফলে পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের যারা কর্তা তারা একটা নতুন আইন করেছেন, যার নাম Intelectual Property Rights এবং এর মাধ্যমে জ্ঞানের অবাধ চলাচলকে তারা রুদ্ধ করে দিতে চাচ্ছেন। বিশ্বায়ন সংক্রান্ত WTO প্রণীত আন্তর্জাতিক সনদে যেসব দেশ বর্তমানে স্বাক্ষর করেছে তারা এই আইন মানতে বাধ্য। তাহলে দেখা যাচ্ছে পুঁজিবাদী বিশ্বায়নে পুঁজি, পণ্য এবং সেবার স্বাধীন চলাচলের ব্যবস্থা থাকলেও শ্রমশক্তি এবং জ্ঞানের অবাধ বিচরণের ক্ষেত্রে নানা কৃত্রিম বাধা প্রদান করা হচ্ছে। এ কারণেই চরিত্রগত দিক থেকে এই বিশ্বায়ন অসম।<br />ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণে দেখা যায় এই ধরনের বিশ্বায়নের কাঠামোটিও অগণতান্ত্রিক। কেন অগণতান্ত্রিক তার কারণ নিচে উল্লেখ করা হলো। বিশ্বায়নের জন্য অপেক্ষাকৃত গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা হতে পারেতা জাতিসংঘ। কিন্তু যেহেতু জাতিসংঘ ‘একদেশ এক ভোট’- এই পন্থা অনুসরণ করে এবং যেহেতু শিল্পোন্নত দেশগুলো সারা বিশ্বে সংখ্যায় লঘিষ্ট, সেহেতু এই গণতান্ত্রিক ভোট পদ্ধতিতে ধনী দেশগুলো তাদের স্বার্থসিদ্ধি করতে পারবে না। এই পুঁজিবাদী দেশগুলো জাতিসংঘকে বিশ্বায়নের দায়িত্ব না দিয়ে দায়িত্ব দিয়েছে বিশ্বব্যাংক IMF এবং WTOকে। বিশ্বব্যাংক এবং ওগঋ এর ভোটদান পদ্ধতি হচ্ছে যে দেশ এই সব সংস্থার ফান্ডে যতবেশি চাঁদা দিয়ে থাকে তার ভোটের গুরুত্ব সংখ্যাগতভাবে ততবেশি। নিচের ছক থেকে দেখা যায় বিশ্বব্যাংক ও IMF এর ভোটের সিংহভাগই শিল্পোন্নত দেশগুলো কিনে নিয়েছে। যার মধ্যে প্রধান হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।<br /><br />দেশ-----শতকরা হিসেবে ভোট (বিশ্বব্যাংক)-----শতকরা হিসেবে ভোট (IMF)<br /><br />যুক্তরাষ্ট্র -------- ১৯.৬৩ -------------------- ১৯.৩<br />জাপান --------- ৯.৪৩ --------------------- ৪.৬<br />জার্মানি --------- ৭.২৯ --------------------- ৫.৮<br />যুক্তরাজ্য -------- ৬.৯৯ ------------------- ৬.৭<br />ফ্রান্স ---------- ৪.৭৬ --------------------- ৪.৮<br />চীন ----------- ২.৫৫ ------------------- ২.৬<br /><br />বিশ্বব্যাংক এবং IMF এর মৌলিক নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন আনতে গেলে ৮৫% প্রাধান্য দরকার হয়। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একাই যে কোনো ধরনের মৌলিক পরিবর্তনের প্রচেষ্টাকে থামিয়ে দিতে পারে। এই সংস্থাগুলো থেকে সব সিদ্ধান্ত আসে সেগুলো সাধারণভাবে শিল্পোন্নত দেশগুলোর স্বার্থ রক্ষা করে এবং অবাধ প্রতিযোগিতার ছদ্মাবরণে অসম বাণিজ্য প্রতিযোগিতার জন্ম দেয়। এ ধরণের অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার নিয়ন্ত্রণাধীন যে বিশ্বায়ন তার ফলাফল দু’টি: ধনী এর ফলে আরও ধনী হবে এবং গরীব আরও গরীব হবে। এটি যেমন দেশের বা সমাজের ভেতরে ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে হবে তেমনি বিভিন্ন দেশের মধ্যেও বৈষম্য বৃদ্ধি হবে। অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত ধনী দেশগুলো আরও ধনী হবে এবং দরিদ্র দেশগুলো আরও দরিদ্র হবে। একই ভাবে যাদের হাতে পুঁজি এবং পণ্য আছে প্রচলিত ব্যবস্থায় তাদের আয় উন্নতি বাড়বে, যদিও তারা সংখ্যায় খুবই কম। আর যাদের তা নেই তারা পিছিয়ে পড়বে। এ কারণেই বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় ধনী ও গরীব দেশগুলোর মধ্যে যেমন বৈষম্য বৃদ্ধি পায় তেমনি প্রতিটি দেশের ভিতরেও ধনী ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে বৈষম্য বেড়ে যায়। এটি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যেমন সত্যি তেমনি সত্যি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও। তেমনি সত্যি উত্তর এবং দক্ষিণের দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান ব্যবধান।<br /><br /><span style="font-weight: bold;">পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন : ক্রমবর্ধমান বৈষম্য</span><br />বিশ্বায়ন যে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্যকে প্রকটিত করে তোলে তার প্রমাণ মেলে এই পরিসংখ্যানগুলো থেকে। জাতিসংঘের HumanDevelopment Reportরিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৯৩ সালে পৃথিবীর মোট এঘচ’র GNP'র পরিমাণ ছিল ২৩ ট্রিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ১৮ ট্রিলিয়ন ডলার এসেছিল উন্নত শিল্পায়িত দেশগুলো থেকে আর ৫ ট্রিলিয়ন ডলার এসেছিল তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো থেকে যার জনসংখ্যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার শতকরা ৮০ ভাগ। ৩০ বছর আগে পৃথিবীর দরিদ্রতম ২০ শতাংশ জনগণের কাছে ছিল পৃথিবীর মোট আয়ের ২.৩%। বর্তমানে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১.৪% এ। অপরদিকে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ২০ শতাংশ জনগণের কাছে ছিল পৃথিবীর মোট আয়ের শতকরা ৭০ ভাগ যা বর্তমানে বেড়ে গিয়ে হয়েছে ৮৫%। বর্তমানে পৃথিবীর ৪৫% জনগণের আয়ের সমান অর্থের মালিক মাত্র ৩৫৮টি ধনী পরিবার। এগুলো হচ্ছে জাতিসংঘের Human Development Report এ এমন কিছু তথ্য প্রকাশিত হয়েছে যা বিশ্বায়নের নেতিবাচক ভূমিকাকেই উন্মোচিত করে। যেমন: এই রিপোর্টে প্রকাশ- পৃথিবীর ৫৭% জনগণের (যারা ৬৩টি দরিদ্র দেশে বাস করে) আয় পৃথিবীর মোট আয়ের মাত্র ৬%। ১৯৮৯ থেকে ৯৯ এই সময়ের মধ্যে পৃথিবীর মোট চরম দরিদ্র লোকের সংখ্যা একটিও কমেনি। ১৯৯৮-৯৯ সালে উন্নয়নশীল দেশসমূহের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১.২% যা বিগত যে কোনো বছরের তুলনায় কম। অর্থাৎ বিশ্বব্যাংকও স্বীকার করছে যে বিশ্বায়নের সার্বিক চিত্র খুবই হতাশাব্যঞ্জক। অন্তত প্রচলিত বিশ্বায়ন দারিদ্র্য নিরসনে বা বৈষম্য নিরসনে যে পর্যাপ্ত নয়, তা এসব পরিসংখ্যান নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করেছে।<br /><br /><span style="font-weight: bold;">বাংলাদেশে বিশ্বায়নের সূচনা</span><br />এতো গেল সমস্ত বিশ্বের প্রেক্ষাপট, এবার দেখা যাক বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিশ্বায়নের প্রভাব কি। কোন দেশে বিশ্বায়ন হচ্ছে কি হচ্ছে না অর্থনীতিবিদরা তা পরিমাপ করার জন্য আমদানি ও রপ্তানির মোট মূল্য যোগ করেন এবং এই যোগফল দেশের মোট জাতীয় আয়ের কতটুকু তা বের করেন। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বিশ্বায়নের সঙ্গে সঙ্গে এই অনুপাত বাড়তে থাকে। বাংলাদেশে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া কবে শুরু হয়েছে সেটা যদি আমরা দেখতে চাই তাহলে আমাদেরকে ১৯৮০ পরবর্তী বছরগুলোর দিকে তাকাতে হবে। ১৯৮০ পর্যন্ত বাংলাদেশ পুরোপুরি মুক্তবাজার অর্থনীতির দর্শন গ্রহণ করে নেয়নি। ১৯৮২ সালে জেনারেল এরশাদ যখন সামরিক শাসন চালু করেন এবং New Industrial Policy ঘোষণা করলেন তখন থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্বায়নের অধীনে তথাকথিত মুক্তবাজারের অর্থনীতির দিকে যাত্রা শুরু করে।<br /><br />১৯৮৫-৮৬ সালে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংক প্রস্তাবিতStructural Adjustment Policy (SAP) গ্রহণ করে যার মূল বিষয় ছিল তিনটি: প্রথমত বেসরকারিকরণ অর্থাৎ পাবলিক সেক্টরের আয়তন কমিয়ে ফেলা, দ্বিতীয়ত বাজার উন্মুক্ত করা এবং তৃতীয়ত সরকারি আয়-ব্যায়ের সামঞ্জস্যতা বিধান, যার মধ্যে প্রধান প্রবণতাগুলো ছিল ভর্তুকি প্রত্যাহার করা, প্রয়োজনে উন্নয়ন ব্যয় কমানো এবং সামাজিক খাতে ব্যয় সংকোচন করা। এরপর থেকেই বলা যায় ধাপে ধাপে এইসব পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাণিজ্য বিস্তারের মাধ্যমে আমরা চলমান বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার সাথে একীভূতি হয়েছি। যাই হোক এরপরেও ১৯৮০-৮৪ সাল পর্যন্ত আমাদের দেশে বিশ্বায়ন তেমন একটা দ্রুত তালে এগোয়নি। ১৯৮৪ থেকে ৯৪ সার পর্যন্তও বাণিজ্য বিস্তার ধীর গতিতেই হয়েছে কিন্তু ৯৪ এর পর থেকে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বাণিজ্য বিস্তার হয়েছে। ১৯৮৪ সালে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মূল্য ছিল জাতীয় আয়ের মাত্র ২০ শতাংশ কিন্তু ১৯৯৮ সালে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মূল্য ছিল দেশের জাতীয় আয়ের ৪৫ শতাংশ। এখানে উল্লেখ্য যে, এই সময়ের মধ্যে আমাদের রপ্তানি আয় তুলনামূলকভাবে খুব একটা বাড়েনি। মূলত আমদানি ব্যয় দ্রুত বাড়ার কারণেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মূল্য মোট আয়ের অনুপাত হিসেবে বৃদ্ধি পেয়েছে।<br /><br />১৯৯৪ সালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকার এবং একটি ঘনিষ্ঠ সূত্রের মতে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান বিশ্বব্যাংকের Alternative Director এর পদ পাওয়ার আশায় বিশ্বব্যাংকের অনেক কর্মসূচি যতটুকু পালন করা দরকার তার চেয়ে অনেক বেশি বাস্তবায়ন করেছেন। অর্থাৎ “বাবু যত বলে পরিষদ বলে শতগুণ”- এই নীতিতে তিনি খুব দ্রুত বাজার উদারীকরণ করেন। উদ্দেশ্য সত্য কি না তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তিনি যে তা করেছেন এটা সত্য! ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে Unweighed গড় শুল্ক হার ছিল ৫৭.৩%। ১৯৯২-৯৩ সালে এসে সেটি দাঁড়ায় ৪৭.৪%-এ এবং ১৯৯৩-৯৪ সালে মাত্র এক বছরের ব্যবধানে সেই শুল্ক হার আরও কমিয়ে ৩৬-এ আনা হয়। এভাবে রাতারাতি বাজার উন্মুক্তকরণের ফলে দেশী শিল্প তীব্র প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয় এবং প্রায় এক হাজার শিল্প রুগ্ন হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসেও শুল্ক হার কমানোর এই ধারার বিরুদ্ধে কৌশলগত নিন্দা জানালেও এ থেকে নিজেরা সরিয়ে আসেননি। যদিও আওয়ামী মন্ত্রীরা নির্বিচারে বাজার উদারীকরণের জন্য সাইফুর রহমানের দোষ দিয়ে থাকেন তারপরও দেখা যায় Unweighed শুল্ক হার ১৯৯৫-৯৬ এর ২২.৩% এর চেয়ে কমে ১৯৯৭-৯৮ এ ২০.৭% এ দাঁড়ায়। অর্থাৎ সাধারণভাবে বলা যায় আমাদের শাসকশ্রেণী পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাসমূহের বশ্যতা স্বীকার করেই বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। উল্লেখ্য যে, শুল্ক হার শূন্যে নামিয়ে আনাই হচ্ছে বর্তমানে বিশ্বায়নের মোড়লদের অন্যতম প্রেসক্রিপশান।<br /><br /><span style="font-weight: bold;">পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন : বিদেশী পুঁজি বিনিয়োগের মিথ!</span><br />পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের কিছু ইতিবাচক ভূমিকার কথা দাবি করা হয়। গ্লোবাল গুরুরা বলে থাকেন এর ফলে যে শুধুমাত্র দেশীয় শিল্প প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ধ্বংস হয়ে যাবে তা নয় বরং বিদেশী পুঁজির ব্যাপক বিনিয়োগও ঘটবে এবং এর ফলে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, নতুন প্রযুক্তি আসবে ইত্যাদি। তাহলে আমাদের দেখা দরকার বিশ্বায়নের ফলে বাংলাদেশে কতটা বৈদেশিক পুঁজি এসেছে। শিল্পোন্নত দেশের পুঁজিপতিরা তাদের উদ্বৃত্ত ক্যাপিটাল সেই সব দেশে বিনিয়োগ করে থাকে যেখানে শ্রম অপেক্ষাকৃত বেশি দক্ষ কিন্তু সস্তা এবং যেখানে ব্যবসার জন্য ভাল অবকাঠামোগত সুবিধা আছে। এ কারণেই তারা চীন বা ভিয়েতনামে পুঁজি বিনিয়োগ করে যদিও আদর্শগত দিক থেকে এ দৃ'টো দেশের সাথে তাদের কোন মিলই নেই। পক্ষান্তরে খুবই স্বল্পোন্নত দেশ, যেখানে অবকাঠামোগত সুবিধা নেই, ঘন ঘন লোডশেডিং হয়, যেসব দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভাল না এবং শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ না দিলে কাজ করতে পারে না সেসব দেশে তার পুঁজি বিনিয়োগে কুণ্ঠিত থাকে। এক হিসেবে দেখা যায়, ১৯৯৭ সালে শিল্পোন্নত দেশ থেকে ৩য় বিশ্বের দেশসমূহে বিনিয়োগকৃত মোট পুঁজির পরিমাণ ছিল ১২৯ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে সর্বমোট বিনিয়োগ হয়েছে ১ বিবিলয়ন ডলারেরও কম। বাংলাদেশে ১৯৭৭ সালে বিদেশী বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল Export Processing Zone। ১৯৭৭-৯০ সারের মধ্যে EPZ সমূহে যে বিদেশী বিনিয়োগ হয়েছিল তার মাত্র ২৪% ছিল শিল্প পুঁজি। এই সময়ে এসব বিদেশী বিনিয়োগের সূত্রে যে পরিমাণ নতুন প্রযুক্তি আমাদের দেশে এসেছিল তার মূল্য ছিল মোট বিনিয়োগের মাত্র ১২.৮%।<br /><br />তবে বিশ্বায়নের ফলে বাংলাদেশে সবচেয়ে উদ্বেগজনক যে ঘটনাটি ঘটেছে তাহলো ধনী দরিদ্রের আয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য বৃদ্ধি। বৈদেশিক বাণিজ্য, বৈদেশিক সাহায্য ও বিদেশী পুঁজির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার সুবাদে মুষ্টিমেয় কিছু লোক রাতারাতি বিরাট ধনীতে পরিণত হয়েছে। ১৯৮৫-৮৬ সালে যখন বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয় তখন বাংলাদেশের দরিদ্রতম ২০% জনগণের মাথাপিছু আয় ছিল ১৫৩১ টাকা আর সবচেয়ে ধনী ২০% জনগণের মাথাপিছু আয় ছিল ১০০৮৫ টাকা। ১৯৯৫-৯৬ সালে দরিদ্রতম ২০% মানুষের আয় দাঁড়ায় ১৫৭১ টাকা অথচ ২০% ধনী জনগণের আয় বেড়ে হয় ১৩৭৮২ টাকা। এই ২০% এর মধ্যে যারা কোটিপতি তাদেরকে আলাদাভাবে হিসাব করলে হয়তো এই বৈষম্য বৃদ্ধির চমকপ্রদ হারটি আরও সুষ্ঠু হয়ে ধরা পড়তো অর্থাৎ বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও বিশ্বায়নের সুবিধা আয়ত্ব করতে পেরেছে কেবল ধনীরাই এবং ধনী-গরীবের বৈষম্যও এতে করে বেড়ে গিয়েছে। পাটশিল্প ধ্বংস হয়ে যাবার পরে গার্মেন্টস বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি শিল্প। আমাদের রপ্তানি আয়ের ৭৬%-ই আসছে গার্মেন্টস থেকে। অনেকেই বলে থাকেন যে বিশ্বায়ন না হলে গার্মেন্টস শিল্পের এই বিকাশ সম্ভব হতো ন। এ কথাটা সত্যি। কিন্তু এখানে ফাঁকি হচ্ছে এই জায়গায় যে গার্মেন্টস আমাদের রপ্তানি আয়ের ৭৬% দিচ্ছে এটি হলো মোট মূল্য (Gross Value)। এর মধ্যে দুই তৃতীয়াংশই ব্যয়িত হয় প্রয়োজনীয় কাঁচামাল কিনতে। এই রপ্তানী শিল্পটি মূলত আমদানি নির্ভর, আমরা শুধুমাত্র গড়ে ২৫% মূল্য সংযোজন করে থাকি। তবে যেখানে যেখানে Backward Linkage তৈরি সম্ভব হয়েছে, সেখানে সেখানে এই মূল্য সংযোজন হার বৃদ্ধি পাবে। উপরন্তু সস্তা শ্রম ও কোটার কারণে ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে আমাদের গার্মেন্টস যে সুবিধা বর্তমানে ভোগ করে আসছে, ২০০৪ সালের পর সেই সুবিধা আর থাকবেনা। থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত প্রভৃতি কাপড় উৎপাদনকারী দেশ কোটা পদ্ধতি বলবৎ থাকার কারণেই তারা তাদের অতিরিক্ত উৎপাদিত কাপড় বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে। কোটা ব্যবস্থা না থাকলে এই দেশগুলো নিজেরাই তৈরি পোশাক রপ্তানির হার বাড়িয়ে দেবে। তারা আমাদের দেশে কাপড় নাও রপ্তানি করতে পারে। তখন চড়া দামে আমরা কাপড় এবং অন্যান্য কাঁচামাল কিনতে বাধ্য হবো।<br /><br />কিন্তু এভাবে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণেই আমরা তখন হয়তো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবনা। সেই সম্ভাব্য সংকট মোকাবেলার জন্য আমাদের দেশের স্বল্প দৃষ্টিসম্পন্ন (Myopic) সরকার বা পুঁজিপতি শ্রেণীর কোনো চিন্তা আছে বলে মনে হয়না। কিছু সেমিনার ও ঢাক-ঢোল পেটানোই সার। গার্মেন্টস শিল্পে আমরা যে ২৫% মূল্য সংযোজন করেছি সেটা মূলত আসে সস্তা শ্রম বিক্রি থেকে। এ কারণে বিদেশী অর্থনীতিবিদরা আমাদের গার্মেন্টস কারখানাগুলোকে বলে থাকেন ‘ঘামের দোকান’ এবং পশ্চিমা পুঁজিবাদীদের বক্তব্য হচ্ছে তারা আমাদের মতো স্বল্পোন্নত দেশে শিল্পায়ন হতে দেবে কিন্তু তার চরিত্র হবে এই ঘামের দোকানের মতোই। উন্নত প্রযুক্তি এবং জনশক্তি ব্যবহার করে যে শিল্প তা তারা এখানে গড়ে উঠতে দিচ্ছেননা। আর অবাধ পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের অসম প্রতিযোগিতার আওতায় থেকে সংরক্ষণ সুবিধা ছাড়া সে ধরণের শিল্প যে গড়ে উঠতে পারেনা তা বলাই বাহুল্য। এই যদি হয় বাস্তবতা তাহলে আন্তর্জাতিক শ্রম বিভাজনের যে চক্রে আমরা পড়ে যাবো তাতে আমাদের ভাগ্যে পড়বে Inferior শিল্প আর পুঁজিবাদী উন্নত দেশগুলোর ভাগে পড়বে Superiorশিল্প। এবং এই চক্র থেকে আমরা কোনদিনই বেরিয়ে আসতে পারবনা। এ প্রসঙ্গে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থনীতিবিদদের বক্তব্য হচ্ছে, স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে এভাবে ঘামের দোকান দিয়েই শুরু করতে হবে। এরপর যারা প্রতিযোগিতায় ভাল করবে তারা এগিয়ে আসবে। যেমনটি ঘটেছে দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, হংকং এবং সিঙ্গাপুরের ক্ষেত্রে। সম্প্রতি ইস্ট এশিয়ান ক্রাইসিসের সময় এই দেশগুলোর অর্থনীতি যেভাবে ভেঙে পড়েছে তাতে এই যুক্তির আকর্ষণী ক্ষমতাও বিপুলভাবে হ্রাস পেয়েছে।<br /><br />বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে আমাদের দেশে নির্বিচারে সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু যেহেতু আমাদের বেসরকারি খাত প্রস্তুত ছিলনা, রুগ্ন শিল্প কারখানা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিয়েও কোনো লাভ হয়নি বরং নতুন করে খেলাপী ঋণের সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বায়নের আরেকটি দিক হচ্ছে সরকারি ব্যয় কমানো। কিন্তু সাধারণ প্রশাসন বা সামরিক খাতের মতো অনুৎপাদনশীল খাতে এই ব্যয় কমানো সম্ভব হয়নি। ফলে তুলনামূলকভাবে ব্যয় কম বৃদ্ধি করা হয়েছে শিক্ষা কিংবা স্বাস্থ্য খাতে। বাংলাদেশে যদিও শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ের মোট পরিমাণ বেড়েছে কিন্তু অন্যান্য অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি হারে। যেটুকু ব্যয় সামাজিক খাতে বৃদ্ধি পেয়েছে সেইটুকু বরাদ্দকৃত অর্থ টার্গেট গ্রুপের কাছে পৌঁছেছে কিনা সে বিষয়েও বিতর্ক রয়েছে। ব্যয়ের কোয়ালিটি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।<br /><br /><span style="font-weight: bold;">নিরাপত্তা জাল, এনজিও এবং মাইক্রো ক্রেডিট </span><br />বিশ্বব্যাংকের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জেমস উলফসনের একটি সাক্ষাৎকার ১৯৯৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর দৈনিক মুক্তকণ্ঠে প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি ঐ সাক্ষ্যাৎকারে বলেছিলেন:<br />১। পৃথিবীতে এখন ৩০০ কোটি লোক আছে যাদের দৈনিক আয় ২ ডলারের কম।<br />২। এদের মধ্যে ৩০ কোটির আয় এমনকি ১ ডলারেরও কম।<br />৩। ১০ কোটি লোক আছে যারা প্রতিদিন ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমাতে যান।<br />৪। ১৫ কোটি শিশু আছে যারা স্কুলে যেতে পারছেনা।<br /><br />এই পরিস্থিতিকে বর্ণনা করার পর তিনি আরো বলেন, ‘আমরা একটি টাইম বোমার উপর বসে আছি- যদি কিছু করা না যায়, তাহলে আমাদের শিশুরা যখন বড় হবে ততদিনে এই টাইম বোমা বিস্ফোরিত হবে।’ কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই অবস্থা নিরসনে বিশ্বব্যাংক ও গ্লোবাল গুরুরা বাস্তবে কি পদক্ষেপের পরামর্শ দিচ্ছেন। বস্তুত তারা অনুঋণ, আত্মকর্মসংস্থান, নিরাপত্তা জাল ইত্যাদি এমন কতকগুলো গরীব মানুষের জন্য টার্গেট কর্মসূচির কথা বলছেন যা দিয়ে পৃথিবীর কোথাও দারিদ্র্য স্থায়ীভাবে দূর করা যায়নি। এসব কর্মসূচির ফলে দরিদ্ররা সাময়িকভাবে তলিয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পায় কিন্তু নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়। অর্থনীতির মূলধারা তথা বৃহদায়তন শিল্প ও কৃষি খাতের উৎপাদনে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে দারিদ্র্য থেকে স্থায়ীভাবে মুক্ত হওয়া সম্ভব হয়না। কম পুঁজি, কম লাভ, কম আয় ও অসংখ্য মধ্যস্বত্ত্বভোগীর বোঝা মাথায় নিয়ে দারিদ্র্য ও কষ্টের মধ্যেই কোনো মতে বেঁচে থাকতে হয় তাদেরকে। এভাবেই দারিদ্র্য বিস্ফোরিত হয়না ঠিকই, কিন্তু দারিদ্র্য টিকে থাকে দীর্ঘ কাল। বিশ্বব্যাংকের এই প্রেশক্রিপশান বর্তমানে আসলে দারিদ্র্য নিয়ে মধ্যবিত্ত ম্যানেজারদের ব্যবসায় পরিণত হতে চলেছে। বিশ্বব্যাংকের নিজের হিসাবেই দেখানো হয়েছে যে, তারা ১০ কোটি দরিদ্রকে জনপ্রতি ১০০ ডলার হিসেবে মোট ১০ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু এই ঋণ প্রদানের “ম্যানেজমেন্ট কস্ট” (Management Cost) হিসাব করা হয়েছে ১১.৬ বিলিয়ন ডলার। তাহলে দেখা যাচ্ছে, প্রতি ডলার ঋণ দরিদ্রকে পৌঁছে দেয়ার জন্য মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা পাবেন ১.১৬ ডলার। এটা কি প্রমাণ করে? গ্লোবালাইজেশনের গুরুরা আমাদের দেশের জন্য যে পলিসি নির্ধারণ করে নিজেদের দেশে সেই পলিসি তারা মানেননা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কৃষিতে ভর্তুকির কথা। কৃষিতে ভর্তুকি উঠিয়ে নেয়ার জন্য তারা সব সময় ৩য় বিশ্বের দেশগুলোর উপর চাপ প্রয়োগ করে থাকে। কিন্তু এক হিসেবে দেখা যায়, ১৯৯৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র চালের বাজার মূল্যের উপরে ৪৯ শতাংশ হারে ভর্তুকি দিয়েছে, জাপানে এই হার ছিল ৩৬৮% এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে ১২২ শতাংশ। একই বছর গরুর মাংসের বাজার মূল্যের উপরে যুক্তরাষ্ট্র ৩৮ শতাংশ, জাপান ১১৩ শতাংশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ১১২ শতাংশ হারে ভর্তুকি দিয়েছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে “ভর্তুকি প্রত্যাহার করে মুক্তবাজার” প্রবর্তনের বিষয়টি দেশ ও পণ্য নিরপেক্ষ নয়। ধনী দেশের কৃষি পণ্যের জন্য হবে এক নিয়ম আর গরীব দেশের গরীব চাষীর জন্য হবে আরেক নিয়ম।<br /><br /><span style="font-weight: bold;">বিশ্বায়ন বিরোধী বিক্ষোভের ঢেউ</span><br />আজ অগণতান্ত্রিক পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে শুধু তৃতীয় বিশ্ব নয়। উন্নত দেশগুলোতেও বিক্ষোভের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ছে। এই সব বিক্ষোভে শামিল হচ্ছেন বন্ধ কারখানার শ্রমিকরা। সবুজ দলের তথা পরিবেশ আন্দোলনের প্রতিনিধিরা, অসংখ্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, শান্তিবাদী, সমতাপন্থী এবং বামপন্থী দল ও গোষ্ঠীবৃন্দ। তাদের প্রধান আওয়াজ হচ্ছে “বিশ্বব্যাংক আইএম এফ ও WTO তথা জি-৮ দেশগুলোর নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন প্রত্যাখ্যান করে জনগণের কল্যাণে জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল বৈশ্বিক সংস্থার নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক বিশ্বায়ন চালু করতে হবে। পৃথিবীর বড় বড় শহরগুলোতে এই আন্দোলন চলছে। তাদের এই আন্দোলনের একটি সংক্ষিপ্ত সাম্প্রতিক কালপঞ্জি নিচে দেয়া হলো:<br /><br /><span style="font-weight: bold;">মে ১৯৯৮:</span> জেনেভাতে WTO এর সম্মেলন চলাকালে দাঙ্গা হাঙ্গামা।<br /><span style="font-weight: bold;">১৮ জুন ১৯৯৯: </span>লন্ডনের Financial Center এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ এবং সকল আর্থিক কার্যক্রম বন্ধ।<br /><span style="font-weight: bold;">৩০ নভেম্বর ১৯৯৯:</span> সিয়াটলে WTO সম্মেলনের বিরুদ্ধে জঙ্গী বিক্ষোভ।<br /><span style="font-weight: bold;">২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৯:</span> পৃথিবীর ১১০টি নগর এক সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ভবিষ্যত সভা বিরোধী বিক্ষোভ।<br /><span style="font-weight: bold;">২৬ নভেম্বর ২০০০:</span> বিক্ষোভের মুখে প্রাগে অনুষ্ঠিতব্য সভা পণ্ড হয়ে যায় ও উদ্রোক্তারা সভা স্থগিত ঘোষণা করেন।<br /><span style="font-weight: bold;">২৭ মে ২০০১:</span> বার্সিলোনায় অনুষ্ঠিতব্য বিশ্বব্যাংকের সম্মেলন বিক্ষোভের মুখে স্থগিত ঘোষণা।<br /><span style="font-weight: bold;">জুলাই ২০০১:</span> জেনেভাতে জি-৮ এর অনুষ্ঠিতব্য সম্মেলনের বিরুদ্ধে প্রবল বিক্ষোভ এবং সংঘর্ষে একজন বিক্ষোভকারীর মৃত্যু।<br /><br />এইসব ঘটনা থেকে বোঝা যায় ভবিষ্যতে বর্তমান পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া বিনা চ্যালেঞ্জে সামনে এগোতে পারবে না।সুশান্ত বর্মনhttp://www.blogger.com/profile/02304984470756506973noreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-7423733237485716191.post-36849951386223476242008-02-21T00:30:00.000+06:002018-03-07T13:50:17.180+06:00কৃষক শ্রমিক ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধ<div style="text-align: center;"><span style="font-weight: bold;">শামছুন নাহার চৌধুরী</span><br /></div><br />আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিস্তার আকাশের মতই বিশাল। মাত্র কয়েকজনের চোখে তা দেখা সম্ভব নয়। অনেকগুলো খণ্ডচিত্র জোড়া দিলেও তা হয়ে উঠতে পারে একটি আংশিক চিত্রমাত্র, কেননা এ যুদ্ধে যারা অংশ নিয়েছিলেন তারা এদেশেরই লক্ষ লক্ষ নারীপুরুষ যারা পেশায় নানাভাবে জড়িত এবং লক্ষ লক্ষ শহীদ যারা প্রাণ দিয়েছিলেন তাদের কথা কে কিভাবে লিখবে! তাদের নাম সহ যুদ্ধে অবস্থানের কাহিনী হয়তোবা লেখা যাবে কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে তারা কি ভেবেছিলেন তা কে জানে! আর সে জন্যই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চিরকালই থেকে যাবে অসম্পূর্ণ। এমনিভাবেই হয়তোবা সর্বকালে সর্বদেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনায় অসম্পূর্ণতা রয়ে গেছে।<br /><br />এমনিভাবে আমাদের বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনায় যারা অগ্রগামী হয়েছেন তাদের অধিকাংশ লেখায় (আমার পড়ার আওতায়) যুদ্ধের মূলকাহিনী লিপিবদ্ধ হয়েছে অত্যন্ত বর্ণনামূলকভাবে। যা তথ্যে পূর্ণ এবং রোমাঞ্চকর ও বেদনাময়। সে সব কাহিনী পড়লে অনেকসময় মনে হয় আমিই বুঝি বা দাঁড়িয়ে আছি সেই যুদ্ধের ময়দানে। অবস্থান নিয়েছি শত্র“পক্ষের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো সৈনিকের পাশে। নিজের অজান্তেই নিজেকে যুদ্ধক্ষেত্রে আবিষ্কার করে ধন্য মনে হয়েছে নিজেকে। আর এই যে মহান যুদ্ধ, এই যুদ্ধে বিরাট একটি অংশ জুড়ে রয়েছে এদেশের সন্তান। এদেশের কৃষক শ্রমিক। সেই ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবে পলাতক সিপাহীদের আশ্রয় দিয়ে, ব্যারাক থেকে ব্যারাকে, সিপাহীদের মাঝে খবরাখবর পৌঁছে দিয়ে যারা এই বিদ্রোহকে সফল করতে সহায়তা করেছিলন তারাও ছিলেন এদেশের কৃষক। সিপাহীদের সাথে কৃষকদের মিলিত এ বিদ্রোহকে তাই পরবর্তিকালের ঐতিহাসিকগণ স্বাধীনতা যুদ্ধ বলেও অভিহিত করেছেন। যদিও তা বিভিন্ন কারণে সফল হয়নি।<br /><br />আমাদের ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে এদেশের মানুষ, এদেশের কৃষক শ্রমিকগণ যে ভূমিকা রেখেছিলেন তা স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করেছিল, তারা অস্ত্রহাতে যেমন ছিলেন যুদ্ধের মাঠে, তেমনি দেশের অভ্যন্তরেও প্রতিরোধ ও সশস্ত্র অবরোধে অংশ নিয়েছিলেন ব্যাপকভাবে। এক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই “রক্তে ভেজা একাত্তর” এর লেখক মেজর(অব.) হাফিজ উদ্দিন আহম্মদকে যিনি ৩০ মার্চ যশোহর ক্যান্টনমেন্টে বিদ্রোহ করে তার দল নিয়ে বেড়িয়ে গ্রামে এলে শত শত নারী পুরুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে তাদের অভ্যর্থনা করে। ডাব কেটে দেয়, নাম না জানা একজন দরিদ্র কৃষক রাতে আশ্রয় দেয় লেখককে এবং একটি মাত্র চৌকি ছেড়ে দেয় তাদের ঘুমোবার জন্য। স্বল্প আহার কিন্তু অত্যন্ত যত্নসহকারে তুলে দেয় তাদের মুখে(পৃ. ৩০)। মহেশপুরের চৌরাস্তার ট্রাকটরের ড্রাইভার আলী মিঞা সরকারি গোডাউন থেকে স্থানীয় জনগণের সহায়তায় চাল, ডাল সহ খাদ্য সরবরাহ করেছিল নিজের জীবন বিপন্ন করে এই বাহিনীকে (পৃ. ৩০)।<br /><br />অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে ৩৫ জনের একটি বাহিনী শ্রীমঙ্গল রেইডের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলে গাইড হিসাবে কাজ করে চা বাগানের কুলি হরি। ঠিক যাত্রার মুহূর্তে খবর আসে হরির আসন্নপ্রসবা স্ত্রী অসুস্থ। হরি চলে যায় স্ত্রীর কাছে। এক ঘন্টা পর খবর আসে হরির স্ত্রী একটি মৃত সন্তান প্রসব করে মারা গেছে। সবাই চিন্তিত হয়ে পড়ে এ অবস্থায় হরিকে কিভাবে কাজে লাগাবে। আর এই মুহূর্তে হরির মতো গাইড ছাড়া চা বাগানের মাঝ দিয়ে রাস্তা চিনে যাওয়াও সম্ভব নয়। কিন্তু চিন্তার অবসান হয় ঠিক আধা ঘন্টা পরই। হরি কাঁদতে কাঁদতে এসে উপস্থিত প্লাটুনের সামনে। ঐ মানসিক অবস্থায়ও তার উপর অর্পিত দায়িত্ব গাইড এর কাজ সম্পন্ন করেই সে নিরুদ্দেশে যাত্রা করেছে। কেউ তার খোঁজ পায়নি আর সেদিন হরির সহায়তা আর অংশগ্রহণ ছাড়া সম্ভব ছিলনা এই অপারেশনের (পৃ. ৯৬)। আটগ্রাম থেকে জাকিগঞ্জ পর্যন্ত শত্র“মুক্ত এলাকায় পলায়নরত পাকসেনাদের পকেটগুলো সরিয়ে মিত্র বাহিনীর সঙ্গে Link up করতে গ্রামবাসীদের যে সহায়তা তা যশোহর ক্যাম্প ছেড়ে আসার দিনের মতই উদ্দীপক (পৃ. ১০৮)।<br /><br />মুক্তিযুদ্ধের এমনি একজন আরেক যোদ্ধা তাগড়া। ছাব্বিশ বছরের এক যুবক। সমুদ্র উপকুলের চরাঞ্চলে জোতদারদের চরদখলের সৈনিক একাত্তুরে হয়ে গেল দেশমাতার মুক্তির জন্য যোদ্ধা, সৈনিক, গণযোদ্ধাদের একজন। ১৭ নভেম্বর শর্ষিনার পীরের বাড়ীতে শত্র“র আস্তানায় আক্রমণের উদ্দেশ্যে আসার সময় পথে অবরুদ্ধ অবস্থায় একজন পাক সৈন্যের মল্লযুদ্ধের আহ্বানে সাড়া দিতে গেলে পাক বাহিনীর গুলিতে শহীদ হয় এই তাগড়া নামের ছেলেটি-(জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা- লেখক মেজর কামরুল ভুইয়া)। (পৃ. ৩৮)<br /><br />মদনের কেন্দুয়া এলাকায় পাক সেনাদের মগরা নদী পার হয়ে আসার সময় যারা অস্ত্র হাতে লড়াই করে তাদের অগ্রাভিযান বন্ধ করে দিয়েছিল তারা সোবহান, গাজী, রমজান, আইয়ুব আলী। এরা সবাই এ গাঁয়েরই ছেলে। কৃষক শ্রমিক। (পৃ. ৬২)। জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা। দু’দিন ধরে এগ্রামে যুদ্ধ হয়েছিল। আইয়ুব, রমজান, কুদ্দুস শহীদ হয়েছিল এখানে। ২য় দফায় ৩১ অক্টোবর পাকবাহিনী উক্ত পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে মদন আক্রমণ করেছিল। জনযোদ্ধাদের সহায়তায় মুক্তিবাহিনী ৭ নভেম্বর মুক্ত করে মদনকে। মুক্ত মদনের সাধারণ মানুষ কবর খুঁড়ে মৃত পাক সেনাদের লাশ তুলে নদীতে ফেলে দেয়। ঘৃণা আর আক্রোশে মদনের মানুষ উচ্চারিত করে “জীবিত কিংবা কোনও মৃত পাকিস্তানী রাখব না আমরা মদনে” মোট ৪২টি লাশ কবর খুঁড়ে এবং ৮২টি লাশ বাংকার থেকে উদ্ধার করে গ্রামবাসী (পৃ. ৬৭)। ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে দুই কোম্পানীর মোট তিনশ জন যোদ্ধার মধ্যে মাত্র দশ জন পদাতিক, আট জন ইপিআর ও তিনজন পুলিশ। বাকি সবাই মাত্র সাত দিনের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষ যারা পরবর্তী কালে ময়মনসিংহ সীমান্তে নকশী বিওপিতে পাকিস্তানী প্রতিরক্ষা ব্যুহ আক্রমণ করেছিল। (জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা, পৃ.৭৮) সরাসরি যুদ্ধ না করলেও অন্যরকম একটি যুদ্ধ করেছিল মোকছেদ নামের এক নৌকা চালক। যার কাজই ছিল যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের নদী পাড়াপাড় করা। যুদ্ধ দেখতে দেখতেই মোকছেদ একদিন প্রস্তাব দেয় কুমিল্লা দাউদকান্দি সড়কের উপর খাদখড় এলাকার ব্রিজটি অপারেশনের। নৌকার মাঝি হয়েও সে খুব সুন্দরভাবে এই অপারেশনের পরিকল্পনা শোনায় লেখককে। যা অতিমাত্রায় উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও সাহসী পরিকল্পনা। রণকৌশলগত কারণে সামান্য কিছু পরিবর্তন করে মোকছেদ এর মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী এই ব্রিজ অপারেশন করে সফলতা আনে যোদ্ধারা। এই অপারেশনের মূল প্রণেতা মোকছেদ কোনো অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করেনি। যুদ্ধের সময় শুধু গুলির বাক্স কাঁধে বহন করে নিয়ে গিয়েছিল। অস্ত্র ছাড়াই এক অন্যরকম আশ্চর্য যুদ্ধ করল মোকছেদ এভাবেই। (জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা, পৃ. ৮৭)। এভাবেই আরেকজন জনযোদ্ধার নাম পাওয়া যায় এই বইয়ে। তার নাম আমজাদ। গ্রামের একজন সাধারণ মানুষ। ৯৬ জন ছেলের একটি দল যখন ত্রিপুরার মেলাগড়ে ২ নম্বর সেক্টরের সদর দফতর থেকে কুমিল্লার মুরাদনগরের আসবে তখন রাস্তা পার হবার প্রাক্কালে শত্র“ সৈন্যের আক্রমণের শিকার হয়। রাস্তা পারাপারের কোন সুযোগ নেই। কারণ সেখানে শত্র“ সৈন্যের সারি সারি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। চারিদিকে গুলি শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। এমন সময় এই সাধারণ মানুষটি এসে দাঁড়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে। পূর্বের কোন পরিচয় নেই। শুধুই স্বাধীনতার যোগসুত্র। সেই পরামর্শ দেয় শত্র“সৈন্যের গাড়ির নিচ দিয়েই রাস্তা পারাপারের একমাত্র পথ। যা অত্যন্ত বন্ধুর ও বিপদজনক। কিন্তু অন্য উপায়ও নেই। আমজাদের নির্দেশিত পথ দিয়েই সকল মুক্তিযোদ্ধা নিরাপদে পৌঁছে যায় নদীঘাটে এবং নৌকাও গ্রাম থেকে সেই জোগাড় করে দেয়। এভাবেই এদেশের হাজারো কৃষক শ্রমিক অংশ নেয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধে। (পৃ. ৮৮)<br /><br />খিলগাও স্কুলে অপারেশন শেষে লেখক যখন ফিরছিলেন তখন নাম না জানা এক সাধারণ স্কুটার চালক লেখকের অস্ত্র তার যাত্রীসিটের নিচে লুকিয়ে রাখে; তাকে নিরাপদে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেয়। (একাত্তুরের গেরিলা পৃ. ১৪২) এমনিভাবেই এদেশের লক্ষ লক্ষ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যদি অনুসন্ধান করা যায় তা হলে দেখা যাবে যে শতকরা আশিভাগ যোদ্ধাই ছিলেন গ্রামের। আর বাকী যারা শহুরে ছিলেন তাদের মধ্যেও অনেকেই গ্রাম থেকেই এসেছেন আর আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একটি বৃহৎ অংশ যারা গেরিলাযোদ্ধা তাদের সমস্ত রকম সফলতার পিছনে কিন্তু জড়িয়ে আছেন আমাদের অতি সাধারণ মানুষ। তারা আশ্রয় না দিলে, সহযোগিতা না করলে তথ্য না দিলে কিন্তু গেরিলা যুদ্ধ কখনো সম্ভব হোতনা। আসতোনা কোন সফলতা, এই যুদ্ধে গাইড হিসাবে যারা কাজ করেছেন, হাইডআউট অর্থাৎ মুক্তিবাহিনীকে যারা গ্রামে গঞ্জে লুকিয়ে থেকে যুদ্ধ করার জন্য আশ্রয় দিয়েছেন সেই আশ্রয় স্থল বা হাইডআউট নির্ধারণ করতে যারা সহায়তা করেছেন তারা সবাই গ্রামের নিরন্ন জনসাধারণ। এক্ষেত্রে মাহবুব আলম রচিত ‘গেরিলা থেকে সম্মুখ যুদ্ধে’ দু’খণ্ডে রচিত বইটি ইতিহাসে কৃষক শ্রমিকদের অবদানের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য উপাদান। যেমন ট্রেনিং সমাপ্ত করে লেখক যখন প্রথম ভেতরগড় বাংলাদেশের একটি গ্রামে ঢুকতে যাচ্ছেন তখন গ্রামের সাধারণ মানুষ তাদের অভ্যর্থনা জানায় সাদরে। যখন জানতে পারে তারা মুক্তিফৌজ। কিছুক্ষণ আগেও গ্রামবাসীরা বস্তিবাসী জাগো বলে গ্রাম পাহারা দিচ্ছিলেন। তারা অপেক্ষা করেই ছিলেন কবে আসবে মুক্তিবাহিনী। তারাই প্রথম গাইড জোগাড় করে দিলেন মুক্তিযোদ্ধাদেরকে।<br /><br />এই যোদ্ধা ও গ্রামবাসীদের প্রথম মিলনের যে বর্ণনা তা সত্যিই হৃদয়কে স্পর্শ করে যায়। আর মুক্তিযোদ্ধা তো এক নিরলস যোদ্ধা। কুমিল্লার লোক তিনি। জীবনের তাগিদে দিনাজপুরের পঞ্চগড় এলাকায় এই জঙ্গলাকীর্ণ এলাকায় কৃষক হিসাবে বসতি স্থাপন করেন। বিভিন্ন ব্রিজ অপারেশনে মকতুমিঞার ভূমিকা দক্ষতা অপূর্ব। তালম ব্রিজ অপারেশনে তিনি গ্রামের জোনাব আলী, ওমর আলীকেও প্রত্যক্ষ কাজে লাগিয়েছিলেন। (খণ্ড ১ম, পৃ. ৬৭) বিসমনি ব্রিজ অপারেশন ২৭ জুলাই। সমস্ত বাহিনী আশ্রয়নের ধনাদাসের বাড়িতে, সমস্ত কমিউনিটি ও নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এতগুলো মানুষকে হাইডআউট এ আশ্রয় দিয়েও তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না যে তিনিও একজন মুক্তিযোদ্ধা, দেশের জন্য কাজ করেছেন। (খণ্ড ১ম, পৃ. ১৭০) ৩১শে জুলাই হাইডআউট ভাবলা মিঞার বাড়িতে ৪/৫টি ঘরের মধ্যে ২টি ঘরই ছেড়ে দেয় মুক্তিবাহিনীর জন্য। বিসমনি ব্রিজ অপারেশনের পর ১ আগস্ট পাক সৈন্য আসে এখানে। গ্রামের সাধারণ মানুষ মুক্তিসেনাদের অবস্থানের খবর খুব সযতেœ লুকিয়ে রাখে এবং এ বিষয়ে বিস্তারিত খবর দেয় আমানউল্লাহ মিয়া বলে একজন সাধারণ মানুষ। তার দেয়া খবরের উপর নির্ভর করেই গেরিলা যোদ্ধাগণ পরবর্তি অপারেশনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়। (পৃ. ১৯১, খন্ড ১ম) মধুপাড়ার যুদ্ধে শহীদ আক্কাস নিহত হলে গ্রামবাসীরাই তার কাফন ও মিলাদের ব্যবস্থা করে। যেন তাদেরই সন্তান ছিলেন শহীদ আক্কাস। (পৃ. ২১৩, খন্ড ১ম)<br /><br />করতোয়া পাড়ের হাসান মাঝি। তার পরিবার ভারতের মানিকগঞ্জ শরণার্থী শিবিরে ছিল। তিনি যখন খবর পেলেন যে মুক্তিযোদ্ধাগণ তার বাড়ীতে হাইডআউট স্থাপন করেছেন তখন তিনি ছুটে এসেছেন তাদের সাহায্য করতে। যেন অনেক দিনের ঘনিষ্ঠ স্বজন তার বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। সব ধরণের তদারকিসহ পানিতে ডোবানো নৌকাটিও ইতিমধ্যে তুলে ভাসিয়ে রেখেছেন প্রয়োজনের জন্য। সর্বদা সজাগ, সতর্ক, শুধু একা নয় তার ১৩/১৪ বছরের ছেলেকেও সাথে নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন, ফাইফরমাশ খাটার জন্য গ্রামের নিজস্ব লোক এনে দিয়ে নৌকাপাড়ে বসে পর্যবেক্ষণের কাজটিও করে যাচ্ছেন অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে। যেন জীবনের বৃহৎ উৎসবে মেতে উঠেছেন হাসান মাঝি।<br /><br />শুধু কি তাই রাজাকারদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া মুক্তিযোদ্ধা মন্টুর পরিবারের সকল নারী পুরুষকে উদ্ধার করে ফেরার পথে আবারও ভরসা, হাসান মাঝি। মারোয়ার দ্বিতীয় আক্রমণের খবরও অত্যন্ত দ্রুত ও নির্ভুল এনে দেয় এবং করতোয়া নদী পাড় করে নিরাপদ স্থানে পৌছে দেয়। এই দলটির সাথে এমনি একজন সাধারণ মানুষ হাসান মাঝির একাত্ম¡তা মুক্তিপাগল বলেই শুধু সম্ভব হয়েছিল। (পৃ. ১০১, পৃ. ১১৩, খন্ড ২য়)<br /><br />আরেক গাইড জোনাব আলী। যুদ্ধের প্রথমদিকে সহযোদ্ধা। এখন পাক বাহিনীর আক্রমণের মুখে দিশেহারা। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার অপরাধে অনেক ধকল যাচ্ছে তার পরিবার ও গ্রামটির উপর দিয়ে। সীমান্ত এলাকা বলে বি. এস. এফ. দের সাথে অতীতের মতানৈক্যর কারণে ভারতের সীমানাও পাড় হতে পারছেনা। জোনাব আলী রাজাকার আর পাকসেনাদের ভয়ে দিনের বেলা পালিয়ে থাকে শিয়ালের মতো। কিন্তু অত্যন্ত গোপনে তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে সে তার গোপন অবস্থান জানিয়ে রেখেছেন, যদি কখনো কোনো মুক্তিযোদ্ধা আসে। তাদের যদি গাইড বা অন্য কোন সাহায্যের প্রয়োজন হয় তখন তিনি যেন তাদের সাহায্য করতে পারেন। (পৃ. ২৬৮, ২৭০, খন্ড ২য়) এমনি শত শত জোনাব আলী, সোনামিঞা, মতি, নূরুমিঞা, হুজুর ছড়িয়ে আছে যুদ্ধক্ষেত্রে। যাদের সাহায্য ও সহযোগিতা, অংশগ্রহণ মুক্তিযুদ্ধকে এনে দিয়েছে সফলতা।<br />মুক্তিযুদ্ধের বিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে ১৯৯১ সালে যে বিজয়মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সেই মেলাকে কেন্দ্র করে যে বিস্তৃতি ও পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে গবেষণারত বি আই ডি এস- এর গবেষকগণ মেলাতে যান এবং সমবেত ১৫৯ জন মুক্তিযোদ্ধার সাথে আলাপ আলোচনা, প্রশ্নমালা ব্যবহার করা ছাড়াও তাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলেন, এতে যে ১৫৯ জন মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার তারা গ্রহণ করে তথ্য দিয়েছিলেন তাতে দেখা যায় যে তাদের মধ্যে শতকরা ৭৮ ভাগের বসবাস ছিল গ্রামাঞ্চলে, বাকী ২২ জন থাকতেন শহর অঞ্চলে। কুষ্টিয়া ও ময়মনসিংহে এই সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছিল প্রত্যন্ত অঞ্চলে। যশোর ও কুমিল্লার শহর ও গ্রাম মিলিয়ে শুধুমাত্র চট্টগ্রামে শহরে। তবে চট্টগ্রামে যাদের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছিল তাদের ৫০ ভাগের বসবাস ছিল গ্রামাঞ্চলে- মুক্তিযুদ্ধের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন। (পৃ. ২৫) এই বইটিতে আরো একটি তথ্য দেখা যায় যে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে শতকরা ৬০.৩৭ জন ছাত্র। ১২.৫৮ জন চাকুরিজীবি, ১১.৯৫ জন কৃষক, ৮.১৮ জন ব্যবসায়ী, ১.৮৯ জন শিক্ষক, বেকার ১.২৬ জন। তবে ছাত্রদের বেশির ভাগই ছিলেন কৃষকের সন্তান। এভাবেই দেখা যায় যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের যোদ্ধাদের মধ্যে কৃষকদের সংখ্যাই বেশি। (পৃ.২৫) ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মাঝেও দেখা যায় যে সবাই সাধারণ মানুষ, অভিজাত নাগরিক নয়, সখের বিপ্লবী নয়, বিত্তবান, ভাগ্যবান নয়- সবাই একেবারে সাধারণ মেহনতি মানুষ। যারা সেদিন ঘর ছেড়ে নেমেছিলেন জন্মভূমির ডাকে- (মুক্তিযুদ্ধের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন, লেখক আতিউর রহমান, পৃ. ২)<br /><br />সুতরাং ইতিহাস রচনায় আজ যদি সেই সমস্ত সাধারণ মানুষ শ্রমিক কৃষকের সঠিক তথ্য সমৃদ্ধ ইতিহাসটুকু ধরে রাখা না যায় লিপিবদ্ধ করে, তাহলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চিরকালই অসম্পূর্ণই রয়ে যাবে। আর এই অসম্পূর্ণ ইতিহাস কোন বিবেকবান জাতি গঠনে নিশ্চয়ই সহায়ক হবেনা। তাই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কৃষক ও শ্রমিকদের বিষয়টি একটি বিরাট গবেষণার বিষয় বলে নিশ্চিত করে তার গতি সৃষ্টিকে উৎসাহিত করার জন্য সমাজের সর্বস্তরের বিবেকবান মানুষের যেমন সাহায্য সহযোগিতার প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা।সুশান্ত বর্মনhttp://www.blogger.com/profile/02304984470756506973noreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-7423733237485716191.post-75095820342529768432008-02-21T00:24:00.000+06:002018-03-07T13:50:17.535+06:00নাসরীন জাহান : তাঁর পরাবাস্তববাদী গল্প<div style="text-align: center;"><span style="font-weight: bold;">চঞ্চল বোস</span><br /></div><br />নাসরীন জাহান মানবজীবনের আভ্যন্তর-বাস্তবতার (Inner Reality) শিল্পী। মানবচৈতন্যের নিগূঢ় অস্তিত্ববাদী বোধ, ফ্রয়েডীয় মনোবিকলনবাদী চিন্তা এবং ব্যক্তি-মানুষের অস্তিত্বকেন্দ্রিক জীবনাভিজ্ঞতা, তার ভয়, উৎকণ্ঠা, মনস্তাপ নাসরীন জাহানের গল্পে শিল্পস্বাতন্ত্র্য লাভ করেছে। নিরন্তর দ্বন্দ্বক্ষত ব্যক্তি-মানসের পুনরাবৃত্তিময় চেতনা, ক্লেদ, ক্ষয় ও বিবমিষা নাসরীন জাহানের গল্পে মানব-অস্তিত্বের স্বতন্ত্র মাত্রা নির্ধারণ করেছে। মানবচৈতন্যের নিগূঢ় অন্তর্বাস্তবতা উন্মোচনে তাঁর গল্পে প্রবল হয়ে উঠেছে নারীবাদী আদর্শের তীব্র প্রভাব। সামন্ত মূল্যবোধশাসিত সমাজে নারীর স্বাবলম্ব সত্তার শনাক্তকরণে (Identification) গল্পকার নারীবাদী দৃষ্টিকোণকে জোরালোভাবে উপস্থাপন করেছেন গল্পে; পরিণামে এই নারীবাদী চেতনা মূলত মানবতাবাদী জীবনজিজ্ঞাসারই সমার্থক হয়ে উঠেছে।<br /><br /> নাসরীন জাহানের গল্প ব্যক্তির সূক্ষ্ম মনোচৈতন্যের শব্দরূপ। ব্যক্তি-অস্তিত্বের নিগূঢ় প্রণোদনা ও মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা তাঁর গল্পে যেমন মনোবিকলনের রূপ নিয়েছে তেমনি ফ্রয়েডীয় যৌনবোধে তাড়িত নরনারীর অবচেতন কামনা পরাবাস্তবের জগতে মুক্তি লাভ করেছে। আশির দশকে প্রকাশিত নাসরীন জাহানের ‘বিচূর্ণ ছায়া’(১৯৮৮) ‘পথ, হে পথ’ (১৯৮৯), ‘সূর্য তামসী’ (১৯৮৯) এবং নব্বইয়ের দশকে প্রকাশিত ‘সারারাত বিড়ালের শব্দ’ (১৯৯১), ‘পুরুষ রাজকুমারী’ (১৯৯৬), ‘সম্ভ্রম যখন অশ্লীল হয়ে ওঠে’ (১৯৯৭), 'কাঠপেঁচা’ (১৯৯৯) প্রভৃতি গ্রন্থে গল্পকার বিষয়-উৎস সন্ধানে বৈচিত্র-অভিনিবেশী; প্রকরণ-পরিচর্যার ক্ষেত্রেও নাসরীন জাহান ক্রমাগত আত্মরূপান্তরশীল, অন্তর্ভেদী ও নিরীক্ষা-সতর্ক। প্রথাগত কাহিনী-প্রধান গল্পরচনায় নাসরীন জাহান বর্ণনাত্মক পরিচর্যারীতির পাশাপাশি মনোবিকলনধর্মী কাহিনীবিন্যাসে বিশ্লেষণাত্মক পরিচর্যারীতির আশ্রয় নিয়েছেন।<br /><br /><span style="font-weight: bold;">প্রথাগত বর্ণনাপ্রধান আঙ্গিকঃ</span><br />আশির দশকে প্রকাশিত ‘বিচূর্ণ ছায়া’ (১৯৮৮), ‘পথ, হে পথ’ (১৯৮৯), ‘সূর্য তামসী’ (১৯৮৯) গ্রন্থে নাসরীন জাহানের প্রকরণ-নিরীক্ষা ও আঙ্গিক সচেতনতার পাশাপাশি গল্পকার প্রথাগত আঙ্গিকেও জীবনসঙ্কটের বিচিত্র রূপ উন্মোচন করেছেন। ‘অভ্যাস’, ‘দাহ’ (বিচূর্ণ ছায়া), ‘পাখিওয়ালা’, ‘পথ, হে পথ’ (পথ, হে পথ), ‘বিলীয়মান হলুদ নীল স্বপ্নগুলো,’ ‘কাঁটাতার’, ‘প্রেতাত্মা’, ‘খোলস’, ‘নিশাচর’ (সূর্যতামসী) প্রভৃতি গল্পে বর্ননাত্মক পরিচর্যারীতি ও বিশ্লেষনের মিশ্রণে নাসরীন জাহানের প্রকরণ-স্বাতন্ত্র্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রথাগত এ-গল্পগুলো কাহিনীনির্ভর হলেও সে কাহিনীবর্ণনায় গল্পকার সীমিত মনস্তাত্ত্বিকতার স্পর্শ এনেছেন; ফলে বর্ণনাত্মক পরিচর্যার সঙ্গে বিশ্লেষণাত্মক রূপটিও স্পষ্টত উপলব্ধি করা যায়। সর্বজ্ঞ দৃষ্টিকোণ থেকে অধিকাং গল্প রচিত হয়েছে। ঘটনা-উপকরণ সংগ্রহে গ্রামীণ ও নাগরিক অনুষঙ্গই মুখ্য। ছোট ছোট সাবলীল বাক্যের যোজনায় নাসরীন জাহান যে কাহিনীর স্ট্রাকচার দাঁড় করিয়েছেন, সময়ের সরল ব্যবহারই তার বৈশিষ্ট্য।<br /><br /><span style="font-weight: bold;">পরাবাস্তববাদী গল্পঃ আধুনিক শিল্পরীতি:</span><br />নাসরীন জাহানের ছোটগাল্পিক শিল্পজিজ্ঞাসার অন্যতম মৌল লক্ষণ মানুষের আভ্যন্তর ক্ষয়, ক্লেদ, বিকার ও তার মনস্তাত্ত্বিক আলোড়নের স্বরূপ সন্ধান। জীবনসঙ্কটের জটিল বৃত্তে ঘূর্ণ্যমান ব্যক্তির স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা, সম্পর্কের টানাপোড়েনে ক্ষতবিক্ষত মানুষের দ্বন্দ্বময় অস্তিত্ব, তার আদিম যৌন কামনা ও মনোবিকলনের পরাবাস্তববাদী রূপ তাঁর গল্পে অন্যতম শিল্পলক্ষণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। ‘বিচূর্ণ ছায়া’ গ্রন্থের ‘সুন্দর লাশ’, ‘কুকুর’, ‘বিকার’, ‘সূর্য তামসী’ গ্রন্থের ‘ল্যাম্পপোস্টের নীচে’, ‘সারারাত বিড়ালের শব্দ’, ‘অস্পষ্ট আলোর ছবি’ প্রভৃতি গল্পে ব্যক্তির মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা, বিকলন, প্রবৃত্তিগত সংঘাত-সংঘর্ষের প্রতিফলন ঘটেছে আলো-আঁধার, বাস্তব ও পরাবাস্তবের মিশ্র আবহে।<br /><br />‘সুন্দর লাশ’ গল্পের ঘটনাবৃত্ত বর্ণনায় নাসরীন জাহান নির্মাণ করেছেন এক রহস্যঘেরা স্বপ্ন-বাস্তবময় পরিবেশ। বহুকৌণিক দৃষ্টিকোণ (Multiple angle of vision) থেকে গল্পের কাহিনী উপস্থাপিত হয়েছে। অজ্ঞাত যুবকদের দ্বারা আক্রান্ত ও পরে নিহত যুবকটির আতঙ্কিত উচ্চারণের মধ্য দিয়ে গল্পের সূচনা হয়েছে ‘আকাশের মুখোমুখি’ অংশে। গল্পের কেন্দ্রীয় সঙ্কটের বীজ উপ্ত হয়েছে এই অংশে। অতঃপর লেখকের সর্বজ্ঞ দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনাংশ বিধৃত হলেও গল্পের মৌল জটিলতা উন্মোচনে লেখক ব্যবহার করেছেন গল্পের মূল চরিত্র সুশান্ত ও জিনাতের দৃষ্টিকোণ। গল্পের কেন্দ্রীয় সঙ্কটের মূলে রয়েছে সুশান্তর অস্বাভাবিক যৌনমনস্তত্ত্ব। জিনাতের ‘পুরুষালী বলিষ্ঠতা আছে’ বলেই সুশান্ত তাকে বিয়ে করে কিন্তু ক্রমেই জিনাত উপলব্ধি করে ‘একটা মহিলার চেয়ে একটা সুন্দর পুরুষের সান্নিধ্য ওকে অনেক বেশী আন্দোলিত করে।’ মৃত যুবকটিকে কেন্দ্র করেই সুশান্তর অদ্ভুত যৌন মনস্তত্ত্বের প্রকাশ ঘটে। শহরের বাইরে জ্যোৎস্নারাতে যুবকের মৃতদেহটিকে ফেলে মনে হয় তার ভালোলাগা পুরুষ অমিয়র মতো। সুশান্ত এই মৃত দেহকে রেখে গৃহে প্রত্যাবর্তনে অস্বীকৃতি জানায়। ক্ষুব্ধ জিনাত গাড়িতে উঠে ফিরে আসার মুহূর্তে তার দৃষ্টির সম্মুখে উন্মোচিত হয় পরাবাস্তবের জগৎ:<br /><span style="font-style: italic;">“জিনাত দেখলো সুশান্তর মুখটা হুবহু সেই মৃত যুবকের মুখ হয়ে গেছে, দুচোখে আগুন জ্বলছে। দু’লাফে জিনাত জিপের মধ্যে এসে বসে। তারপর দ্রুত হাতে গাড়ীতে স্টার্ট দিয়ে ঘোর-লাগা চোখে দেখে জ্যোৎস্না রাতের উজ্জ্বল আলোয় মৃত যুবকটি উঠে দাঁড়িয়েছে। আর সুশান্ত তাকে জড়িয়ে ধরে ছোট ছেলের মতো আদর করছে। (পৃ. ৩৭)</span><br /><br />পরাবাস্তববাদী শিল্পপরিচর্যার ক্ষেত্রে গল্পকার চরিত্রপাত্রের বিকার-বিকৃতি, মানসিক ক্লেদ-বৈকল্য ও মনস্তত্ত্বের অন্ধকারাচ্ছন্ন স্তরকে উন্মোচন করেছেন। মনোজগতের এবং অবচেতন স্তরের এই গুহায়িত প্রবৃত্তি-প্রতিক্রিয়ার রূপায়ণে গল্পকার স্বভাবতই গ্রহণ করেছেন বিশ্লেষণাত্মক পরিচর্যারীতি। লেখকের সর্বজ্ঞ দৃষ্টিকোণ থেকে এই বিশ্লেষণাত্মক প্রকরণ-কৌশলের ব্যবহার হলেও চরিত্রের প্রেক্ষণ বিন্দু থেকেও বহির্বাস্তবের স্তম্ভিত বিকৃত রূপ অঙ্কিত হয়েছে। লেখকের সীমিত সর্বজ্ঞতার (Limited Omniscience) মধ্যে প্রধান হয়ে উঠেছে চরিত্রের বিশেষ অন্তর্ময় প্রেক্ষণবিন্দু। ‘বিকার’ গল্পে মতির মস্তিষ্ককোষে ক্রিয়াশীল শৈশবের মৃত লোকটির রক্তাক্ত স্মৃতি এবং তারই সাইকেলের আঘাতে নিহত বৃদ্ধাটির বীভৎস দৃশ্য মতিকে নিক্ষেপ করে ভীতিকর আতঙ্ক-স্তম্ভিত তীব্র টানাপোড়েনে। মতির এই শিহরিত দৃষ্টিকোণ-উৎসারিত বহির্বাস্তবের রূপায়ণে লেখকের শিল্পপরিচর্যা এক্সপ্রেশনিস্ট:<br /><span style="font-style: italic;">“মাথা ঝিমঝিম করছে মতির। সে এক দৃষ্টে বউয়ের পা দুটো দেখতে থাকে। এক সময় তা’ হলদে দেখায়। নড়াচড়া করে পাশ ফিরে বউ। ওর একটা পা আয়েশে শাড়ীর নীচে গুটিয়ে যায়। এতে আরেকটা পা আরো বেশী উদোম দেখা যায়। ক্রমশ মতির কাছে মনে হয় পা-টা খয়েরী হতে হতে কালো হয়ে যাচ্ছে। মতির মাথা চক্কর খেতে থাকে, সবশেষে মনে হয় পা-টা সবুজ। সতেজ বাঁশের মতো সবুজ। আবার পা-টা নড়ে উঠতেই মতি কাঁপতে থাকে। পা-টা যেন সেই খুনী লোকটার হাতের বাঁশ। এবং মতির মাথায় তাহেরা সেটা সজোরে বসিয়ে দিচ্ছে। তাহেরার পা-টা প্রাণপণে চেপে ধ'রে চিৎকার ক'রে উঠে মতি।” (পৃ. ৪৩)</span><br /><br />মতির অস্থির উত্তুঙ্গ প্রেক্ষণবিন্দু-উৎসারিত এক্সপ্রেশনিস্ট বহির্বাস্তব তার অন্তর্ময় তীব্র টান ও টেনশনে পরাবাস্তববাদী রূপ লাভ করেছে:<br /><span style="font-style: italic;">“মতি বিস্ফারিত চোখে দেখলো বউয়ের চিৎকার দিয়ে উঠা মুখ জোসনার চিলতে আলোয় বুড়ীর বিকৃত মুখে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে সেই রহস্যময় রাতের স্তব্ধতা ছিন্ন ক'রে তাহেরা চিৎকার ক'রে ওঠে-কে আছো গো। পাগল হয়া গেছ। পাগল।” (পৃ. ৪৬)</span><br /><br />‘বিবসনা’ গল্পে হোসেন আলীর ধর্মীয় চেতনা ও জৈবিক সত্তার দ্বন্দ্ব রূপায়ণে কিংবা ‘রজ্জু’ গল্পে চিরকুমার চাঁদউদ্দিনের নিঃসঙ্গ জীবনের নিরুদ্ধ কামনা, শৈশবে তার পিতাকে খুন করার দৃশ্য, গাড়ির নিচে চাপাপড়া মহিলার বীভৎস রক্তাক্ত অনুষঙ্গ প্রভৃতির চিত্রণে লেখক বিশ্লেষণাত্মক পরিচর্যাতেই সুস্থির থেকেছেন।<br /><br />ঘটনাবিন্যাসে নাসরীন জাহানের গল্পে স্বপ্নদৃশ্য, স্মৃতিময়তা ও চরিত্রের অতীতমগ্নতা বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে বিচলিত, ভয় ও আতঙ্কশিহরিত চরিত্রেরমনোবাস্তবতা যেন স্বপ্নের জগতে মুক্তি পেয়েছে। ব্যক্তির অপূর্ণ আকাক্সক্ষার রূপায়নেও স্বপ্ন বিশেষ শিল্পমোটিফ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ‘বিবসনা’ গল্পে হোসেন আলীর স্বপ্নদর্শন; স্বপ্নে ‘যৌবনবতী নারীর’ এগিয়ে আসা, ‘রজ্জু’ গল্পে নিঃসঙ্গ চাঁদউদ্দিনের স্বপ্নে অদ্ভুত ছায়ামূর্তি দর্শন, ‘দাহ’ গল্পে ভূমিহীন হাফিজের স্বপ্নে তার স্ত্রীর ‘রোদ ঝলমল করা উঠোনে পা দিয়ে গোল ক'রে ধান শুকোতে’ দেয়ার দৃশ্য প্রভৃতি স্বপ্ন-অনুষঙ্গ চরিত্রের অবচেতন মনস্তত্ত্ব-উত্থিত এবং অধিকাংশক্ষেত্রে চরিত্রের অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষার রূপায়ণে লেখক স্বপ্নদৃশ্যকে শৈল্পিক মোটিফ বা ঘটনাগত উপাদান হিসেবে ব্যবহার করেছেন।<br /><br />‘বিচূর্ণ ছায়া’, ‘পথ, হে পথ’, ‘সূর্য তামসী’ গ্রন্থের গল্পগুলিতে লেখকের চরিত্রায়ণরীতি তাঁর শৈল্পিক জীবনাগ্রহের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। ব্যক্তির বিকারগ্রস্ত মনস্তত্ত্ব ও আতঙ্কশিহরিত অস্তিত্বের সূক্ষ্ম ব্যবচ্ছেদই তাঁর এ পর্যায়ের গল্পগুলোর প্রধান লক্ষণ। আত্মজগতে সক্রিয় ও মনোজগতে ক্রিয়াশীল চরিত্ররা মুখোমুখি হয় আত্মচৈতন্যের। ভয় আতঙ্ক, মনস্তাপ, ভীতি ও অন্ধকারের কালো স্রোতে নিমজ্জিত চরিত্ররা নিজেকে উন্মোচন করে মনোকথনে। ‘বিবসনা’ গল্পে (বিচূর্ণ ছায়া) হোসেন আলীর ধর্মানুভূতি ও জৈবানুভূতির তীব্র দ্বন্দ্ব রূপায়ণে লেখকের সীমিত সর্বজ্ঞতার সঙ্গে চরিত্রের স্বগতকথনরীতি প্রযুক্ত হয়েছে:<br /><span style="font-style: italic;">“হোসেন আলী বনের ভেতর বারবার চক্কর খায়। ভেতরের সবচেয়ে কঠিন প্রতিবাদী দ্বন্দ্ব হোসেন আলীকে সতর্ক করে দেয়-কেন এসেছো এখানে? তুমি কি তোমার পরিণতি নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবিত নও?</span><br /><span style="font-style: italic;">ছুটে বন থেকে বেরিয়ে আসে হোসেন আলী। সামনে সবুজ ক্ষেত। ক্ষেতের আলে সে বার বার হোঁচট খায়। সূর্যের আলোর ভেতর দিয়ে একটা দেহ ছুটতে ছুটতে নদীর কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। ভাবে আমার এইটা কি হইলো? আমি ধর্মকর্ম ভুইলা কিসের পিছনে ছুটতাছি? একজন রমণীরে দেখছি তো কি হইছে? কিন্তু ব্যাপারটা সেইখানে শেষ হইল না কেন?” (পৃ. ৫৩)</span><br /><br />‘রজ্জু’ গল্পে নিঃসঙ্গ চাঁদউদ্দিনের ভীতসন্ত্রস্ত মনস্তত্ত্বের উন্মোচনেও চরিত্রের মনোলগ ব্যবহৃত হয়েছে।<br /><br />‘কুকুর’ গল্পটির ফর্ম পরাবাস্তববাদী। সমগ্র গল্পটিই বিন্যস্ত হয়েছে এক রহস্যময় আলো-অন্ধকারাচ্ছন্ন নির্জন রাতের নৈঃশব্দে। শৈশবের কুকুরভীতিতাড়িত বালিকাটি নির্জন রাস্তায় প্রত্যক্ষ করে ভীতিকর ছায়া, ল্যাম্পপোস্টের আলোয় প্রত্যক্ষ করে বিচিত্র দৃশ্য। মেয়েটির আতঙ্কিত দৃষ্টিকোণ-প্রসূত রাতের পরিবেশটি স্বপ্নবাস্তবময় পরাবাস্তবধর্মী:<br /><span style="font-style: italic;">“মেয়েটি ধূসর চোখে দেখলো-সুন্দর ফুলগুলি, এতক্ষণ যারা নৃত্য করছিল, তারা বিস্ময়ে চেয়ে আছে। এবং তার স্বপ্নের পায়রা-বাড়ীটি শুভ্র ডানা মেলে শূন্যের উপর উঠে পড়েছে। মেয়েটি ধূসর চোখে দেখলো-অসংখ্য কুকুরের ঘেউ ঘেউ, অসংখ্য রাত্রির অন্ধকার আক্রমণ এবং অসংখ্য মশার গুনগুনের মধ্য দিয়ে তার কোঁকড়ানো চুল ও ক্ষতের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে।” (পৃ. ৮৬)</span><br /><br />‘সূর্যতামসী’(১৯৮৯) গ্রন্থের ‘ল্যাম্পপোস্টের নীচে’ গল্পের কাহিনীবিন্যাসে আধুনিক শিল্পনিরীক্ষার প্রকাশ ঘটেছে। জনৈক দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারী কর্মকর্তা মুশতাক আহমেদের তরুণ ছেলে পাপ্পু জণ্ডিসে মারা যায়। মুশতাক সাহেবের অস্বাভাবিক বিকৃত মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে গল্পের পরিবেশ ও বহির্বাস্তব চিত্রিত হয়েছে। সমগ্র গল্পে পরাবাস্তবধর্মী ও অ্যাবসার্ড কতগুলো দৃশ্যচিত্রের সন্নিবেশ ঘটেছে। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র মুশতাকের আত্মবিশ্লিষ্ট চৈতন্যই যেন বিচিত্র পরাবাস্তববাদী রূপ লাভ করেছে। গল্পের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পরাবাস্তবের যে-জগৎ নির্মিত হয়েছে তা’ বীভৎস রসব্যঞ্জক:<br /><span style="font-style: italic;">“জল তৃষ্ণা পাচ্ছে প্রাণীটির। টিনের জং ধরা কৌটোটা ময়লা খুঁড়ে বের করলো। দূরে ট্রাফিক জ্যাম। সেদিকে উদাস চোখে তাকিয়ে ওয়াক ওয়াক করে কিছু থুতু সেটিতে জমা করলো। মজে যাওয়া আনারসের টুকরো চিপে তার সাথে মেশালো। তারপর সেই পানীয় ঢকঢক করে গিলে দেখলো কুকুরটি দাঁড়িয়ে আছে।”</span><br />মুশতাক আহমেদের মৃতপুত্র পাপ্পুর পুনর্জীবন লাভের ঘটনা অ্যাবসার্ড শিল্পলক্ষণের দৃষ্টান্ত। পুনর্জীবিত পাপ্পুর আচরণ বাস্তবপ্রতীতি-অতিক্রান্ত, বীভৎস রসনির্দেশী:<br /><span style="font-style: italic;">“বমির বেগ পেতেই জীবিত হয়ে উঠলো পাপ্পু। জীবিত হয়ে দেখলো ওপরে ঝাড়বাতি নড়ছে। চারপাশে সবুজ ডিসটেম্পার। বিছানায় উঠে বসতেই বমির স্রোতে চাদর ভেসে গেলো। এতক্ষণে কি একটা গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসছিলো তার। চেয়ে দেখলো আগরবাতি জ্বলছে। বাঁচিয়ে তোলার জন্য কিছু একটা খাওয়ানো হয়েছে তাকে। সেটা খেয়ে মৃত্যুর শীতলতায় গভীরভাবে তলিয়ে যাচ্ছিলো সে। বমি চলে আসায় বেঁচে গেছে। বিছানার বমির দিকে চেয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো চোখ। হামাগুড়ি দিয়ে লেজওয়ালা প্রাণীর মতো বিছানার সমস্ত বমি চেটে চেটে খেয়ে ঢেকুর তুললো সে।” (পৃ. ১৫)</span><br /><br />নব্বইয়ের দশকে প্রকাশিত ‘সারারাত বিড়ালের শব্দ’ (১৯৯১) গ্রন্থের গল্পগুলিতে নাসরীন জাহানের আধুনিক শিল্পরীতির নিপুণ প্রয়োগ ঘটেছে। ‘অস্পষ্ট আলোর ছবি’, ‘শাদা ভাস্কর্য’, ‘টবের অশ্বত্থ’, ‘একগুচ্ছ অন্ধকার’, ‘আলো পাথরের টান’ প্রভৃতি গল্পে মনোবিকলন ও মানসিক বৈকল্যের বিশ্লেষণাত্মক রূপ চিত্রিত হয়েছে।<br /><br />‘অস্পষ্ট আলোর ছবি’ গল্পে নীলিমা নামক এক চিত্রশিল্পীর মনোবিকার ও অদ্ভুত মনস্তত্ত্বের বিশ্লেষণাত্মক ডিটেইলস পাওয়া যায়। নীলিমা প্রেতাত্মাকে আহ্বান ক'রে আনে, অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখে এবং তার উদ্ভট মনোবিকলনধর্মী চিন্তা রঙে ও রেখায় তার ক্যানভাসে ছবি হয়ে ওঠে। নীলিমার অঙ্কিত ছবিগুলো তার অসুস্থ মনস্তত্ত্বেরই প্রতিরূপক। সমগ্র গল্পে এক স্বপ্ন-বাস্তবময় পরিবেশ নির্মিত হয়েছে; সে পরিবেশ রহস্যময়, ভৌতিক, অচেনা। ‘একগুচ্ছ অন্ধকার’ গল্পের পরিবেশ নির্মাণে ও ঘটনাবিন্যাসে আধুনিক শিল্পনিরীক্ষার উজ্জ্বল প্রকাশ ঘটেছে। দীর্ঘ দুই বছর পরে গৃহে প্রত্যাবর্তনের পর সদ্যাগত লোকটির দৃষ্টিকোণ থেকে উন্মোচিত হয় বিচিত্র দৃশ্যগুচ্ছ। সাতটি অনুচ্ছেদে বিভক্ত এ-গল্পে প্রথাগত কোনো কাহিনী নেই। অন্ধকার, ভয়ভীতি, আতঙ্ক, বিকার, রক্তপাত প্রভৃতি অস্তিত্ববিনাশী বিচিত্র অনুষঙ্গ ঘটনাবৃত্ত তৈরি করেছে। একগুচ্ছ অন্ধকারের ইমেজে এ-গল্পে সৃষ্টি হয়েছে এক অচেনা দুর্জ্ঞেয় পরিবেশ। রাতের মৃদু আলোয় গৃহ-প্রত্যাগত লোকটির ছায়া এক্সপ্রেশনিস্ট রূপ নিয়ে আবির্ভুত:<br /><span style="font-style: italic;">“এ রকম ভাবনার পর সে খাড়া হয়। ঘরের ঝাপসা আলোয় তার ক্ষুদ্র দেহটা দেয়ালে প্রকট আকার ধারণ করে। এ-কি! ছায়াটি কি ভয়ংকর ভঙ্গিতে দুলছে। রক্তাক্ত ভীত চোখে তাকায় লোকটি। পেছন হটতে থাকে। ছায়াটা এগিয়ে আসছে, আশ্চর্য। তার নিজের ছায়ার এ কি ভয়ানক আকৃতি।” (পৃ. ২১৩)</span><br /><br />‘বিচূর্ণ ছায়া’, ‘পথ, হে পথ’, ‘সূর্য তামসী’, ‘সারারাত বিড়ালের শব্দ’ গ্রন্থের অধিকাংশ গল্পে ফ্রয়েডীয় মনোবিকলন এবং ব্যক্তির ক্ষয়, বিকার ও বৈকল্যের বিশ্লেষণাত্মক রূপ অঙ্কিত হওয়ায় এ-গল্পগুলিতে অধিকাংশক্ষেত্রে প্রথাগত কোনো কাহিনী নেই। ব্যক্তির প্রতিক্রিয়া, আচরণ, মনোভাব ও মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার চিত্রণে এবং চরিত্রের অবচেতন স্তরের সূক্ষ্ম উন্মোচনে লেখকের সর্বজ্ঞ দৃষ্টিকোণের সঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছে চরিত্রের মনোকথন। ব্যক্তির অন্তর্বাস্তবতাই এ-পর্যায়ের গল্পের প্রধান লক্ষণ হওয়ায় ঘটনাংশ সীমিত; ঘটনা মুখ্য হয়ে উঠেছে চরিত্রের অবলোকনবিন্দু।<br /><br />নব্বইয়ের দশকে প্রকাশিত ‘পুরুষ রাজকুমারী’ (১৯৯৬), ‘সম্ভ্রম যখন অশ্লীল হয়ে ওঠে’ (১৯৯৭) এবং ‘কাঠপেঁচা’ (১৯৯৯) গ্রন্থে নাসরীন জাহানের ছোটগাল্পিক শিল্পরীতি ভিন্ন বাঁক নিয়েছে। আশির দশকে রচিত গল্পে পরাবাস্তববাদী আবহ প্রধান শিল্পলক্ষণ হয়ে ওঠে, ফলে অনেক ক্ষেত্রেই গল্পে কাহিনী ছিল না। এক অসুস্থ মনোবিকার এবং মৃত্যুর মতো আত্মদ্বন্দ্ব তাঁর গল্পের মৌল উপজীব্য হওয়ায় বিশ্লেষণ ও মনোলগই হয়ে ওঠে প্রধান পরিচর্যারীতি। ভাষা তির্যক ও আবেগবর্জিত হওয়ায় গল্পবস্তু ধারণে তা’ সুপ্রযুক্ত হয়েছে। নব্বইয়ের দশকে রচিত গল্পে নাসরীন জাহান তাঁর মৌল জীবনবীক্ষায় অর্থাৎ এ্যান্টিরোমান্টিকতা, আত্মপীড়ন, নারীবাদী চিন্তা প্রভৃতিতে স্থিত থেকেও তাঁর গল্পে এসেছে নিটোল কাহিনী। এক অদ্ভুত ফ্যান্টাসীর জীবন অতিক্রম ক'রে গল্পকার নিজের স্থান খুঁজে পেয়েছেন। ‘পুরুষ রাজকুমারী’, সম্ভ্রম যখন অশ্লিল হয়ে ওঠে’ এবং ‘কাঠপেঁচা’ গ্রন্থের গল্পগুলিতে লেখকের নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে নিটোল কাহিনীপ্রধান বেশকিছু গল্প রচিত হয়েছে। ‘পুরুষ রাজকুমারী’ গ্রন্থের ‘রূপকথার পাখি’, ‘আমাকে আসলে কেমন দেখায়’, ‘আলো বালিকা’, ‘সন্দেহ অথবা তার সত্যিকার বোধ’, ‘প্রিয় তর্জনী’, ‘সম্ভ্রম যখন অশ্লীল হয়ে ওঠে’ গ্রন্থের নাম-গল্প, ‘পূর্বপুরুষ আর সোনার মাকড়সার গল্প’, ‘দ্বিতীয় কবর’, ‘আমার জন্ম’ প্রভৃতি নারীবাদী গল্পে কাহিনীই প্রধান হয়ে উঠেছে। ‘কাঠপেঁচা’ গ্রন্থের স্বল্পায়তন গল্পগুলোতেও জীবন ও সমাজসত্যের নানাপ্রান্ত অনবদ্য কাহিনীতে বিধৃত হয়েছে। এ-পর্যায়ের গল্পে চরিত্র নয়, কাহিনীই মুখ্য। কাহিনীমুখ্য গল্পগুলিতে সহজ ভাষার মধ্য দিয়ে ক্লেদজ, কখনো বর্ণাঢ্য, কখনো কর্কশ জটিল জীবনকে গভীরভাবে উপস্থাপন করার প্রয়াস পেয়েছেন গল্পকার।<br /><br /><span style="font-weight: bold;">গ্রন্থপঞ্জীঃ</span><br />১। বিচূর্ণ ছায়া, ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮, রুপম প্রকাশনী, ঢাকা।<br />২। পথ, হে পথ, ফেব্রুয়ারি ১৯৮৯, অনিন্দ্য প্রকাশন, ঢাকা।<br />৩। সূর্য তামসী, ফেব্রুয়ারি ১৯৮৯, পল্লব পাবলিশার্স, ঢাকা।<br />৪। সারারাত বিড়ালের শব্দ, ১৯৯১।<br />৫। আশ্চর্য দেবশিশু, ১৯৯৫।<br />৬। পুরুষ রাজকুমারী, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬, অনন্যা, ঢাকা।<br />৭। সম্ভ্রম যখন অশ্লীল হয়ে ওঠে, জানুয়ারি ১৯৯৭, অন্যপ্রকাশ, ঢাকা।<br />৮। গল্পসমগ্র (১), বইমেলা ১৯৯৮, অন্যপ্রকাশ, ঢাকা।<br />৯। কাঠপেঁচা, একুশে বইমেলা ১৯৯৯, অন্যপ্রকাশ, ঢাকা।সুশান্ত বর্মনhttp://www.blogger.com/profile/02304984470756506973noreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-7423733237485716191.post-62034707177095074592008-02-21T00:17:00.000+06:002018-03-07T13:50:17.384+06:00বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহ<div style="text-align: center;"><span style="font-weight: bold;">কামাল হোসেন</span><br /></div><br />সম্ভবত বাঙালির মতো অদ্ভুত জাতি পৃথিবীতে আর নেই। এ জাতির ভিক্ষুক সম্প্রদায় ভিক্ষে করে গান গাইতে গাইতে। এ জাতির ভিক্ষুক সম্প্রদায়ের একটা অংশ (ফকির ও সন্ন্যাসী) পরাক্রমশালী ঔপনিবেশিক ইংরেজ শক্তির বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ বিদ্রোহের মাধ্যমে অনেক যুদ্ধ করেছে- অনেক যুদ্ধে ইংরেজ বাহিনীকে পরাভূতও করেছে। বঙ্কিমচন্দ্র রচিত ‘দেবী চৌধুরানী’ উপন্যাসের নায়ক নায়িকার কথা বাঙালি শিক্ষিত সম্প্রদায়ের কারনা জানা? যে বিষয়টা সাধারণ পাঠকের জানা নেই তাহলে ঐ উপন্যাসের নায়ক নায়িকা ছিলেন ঐতিহাসিক চরিত্রের সাহিত্যিকরূপে মাত্র। তাঁরা আর কেউ নন; ভবানী পাঠক হচ্ছে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের নায়ক। তিনি বরেন্দ্র অঞ্চলের একজন ব্রাহ্মণ এবং পলাশীযুদ্ধের একজন পরজিত সৈনিক। তিনি ইংরেজ কোম্পানীর কর সংগ্রাহকদের নিকট থেকে টাকা লুট করে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিতরণ করতে থাকেন এবং পর্যায়ক্রমে সন্ন্যাসীদের নেতায় পরিণত হন। আর দেবী চৌধুরানী হচ্ছেন পীরগাছা মন্থনার জমিদার। তিনি ভবানী পাঠকের ইংরেজবিরোধী কাজকর্মে আকৃষ্ট হন এবং তাঁর নিকট দীক্ষা গ্রহণ করেন। অতপর উভয়ের প্রচেষ্টায় ফকির ও সন্ন্যাসীদের সশস্ত্র অভ্যূত্থান ঘটে ইংরেজ কোম্পানীর বিরুদ্ধে। তাদের সঙ্গে যুক্ত হন নুরুল উদ্দীনের নেতৃত্বে কৃষক বিদ্রোহ (সৈয়দ শামসুল হকের নুরুলদীনের সারাজীবনের আহ্বান ‘জাগো বাহে কোনঠে সবাই’ স্মরণযোগ্য)। এই তিনজনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় উত্তরবঙ্গের বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে যে বিদ্রোহ সংঘটিত হয় তার ফলে সদ্য প্রতিষ্ঠিত কোম্পানীর শাসকগণ বেশ বেকায়দায় পড়েন। প্রকৃতপক্ষে বক্সার যুদ্ধে মীর কাশিম, অযোগ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা ও মোঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম কোম্পানীর নিকট পরাজিত হবার পরে যখন তাদেরকে বাধাদানের কোনো রাজনৈতিক শক্তি অবশিষ্ট ছিলনা তখন বৃহত্তর রংপুর, রাজশাহী, বগুড়া ও বাকেরগঞ্জ অঞ্চলে ফকির ও সন্ন্যাসী সম্প্রদায় ইংরেজ শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার মাধ্যমে সর্বপ্রথম ইংরেজ বিরোধী (উপমহাদেশে) সামাজিক শক্তির সূচনা হল। শুধু তাই নয় ‘সত্যাগ্রহ আন্দোলন’, ‘তেভাগা আন্দোলন’, ‘তুলাগুন্ডি আন্দোলন’ সহ অনেক সংগ্রামে উত্তর জনপদের বৃহত্তর রংপুর ইতিহাসে বীরত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে।<br /><br /><span style="font-weight: bold;">ফকির সন্ন্যাসীদের পরিচয়:</span><br />আমাদের বাঙালি সমাজে সাধারণত দুধরণের ভিক্ষুক দেখা যায়। এক শ্রেণীর ভিক্ষুক নিছক জীবিকার জন্যে দ্বারে দ্বারে গিয়ে ভিক্ষে করে, আধুনিককালে এদের সমিতির কথা জানা গেলেও একা বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করে। অর্থাৎ অন্যান্য ভিক্ষুকদের সঙ্গে একত্রে বাস করেনা। অন্যদিকে আর একটা ভিক্ষুক সম্প্রদায় আছে যারা সংসার জীবন ত্যাগ করে মুষ্ঠিভিক্ষার মাধ্যমে অর্জিত খাদ্যশস্যাদির দ্বারা নিজেদের জীবীকা নির্বাহ করে এবং যৌথ বা সংঘবদ্ধ জীবনাচারে অভ্যস্ত। তারা প্রায় উলঙ্গ বা অর্ধ উলঙ্গ থাকে। সাধারণতঃ তাদের সঙ্গে থাকে চিমটা, ত্রিশূল কিংবা বেশ শক্ত লাঠি অথবা লৌহদন্ড। রাস্তায় চলাচলের ক্ষেত্রে এগুলি সহায়ক ভূমিকা পালন করে। কখনো বন্যজন্তু, পোকামাকড় দস্যুর দ্বারা আক্রান্ত হলে এসকল দেশী অস্ত্র আত্মরক্ষার কাজে লাগায়। তারা সাধারণত দিনের বেলায় গৃহস্থের দ্বারস্থ হয়ে মুষ্টিভিক্ষা সংগ্রহ করে এবং দিবসান্তে একটা নির্দিষ্ট স্থানে আখড়ায় সকলে প্রত্যাবর্তন করে। অতপর যৌথ ব্যবস্থাপনায় আহারাদি সম্পন্ন করে এবং ঈশ্বরের গুণকীর্তণ করে। স্বাভাবিকভাবেই তাদের জীবনযাপন আধ্যাত্মিক কোনো মতবাদ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বাংলা অঞ্চলে ভিক্ষুক সম্প্রদায় ধর্মীয় বিভাজন দ্বারা অনেক ক্ষেত্রে বিভক্ত। সমাজের অন্তরালে বিরাজমান প্রায় অবহেলিত এই ভিক্ষু সম্প্রদায় কেন ইংরেজ কোম্পানীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এটা তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়।<br /><br /><span style="font-weight: bold;">ফকির সন্ন্যাসীদের বিদ্রোহের কারণ: </span><br />এ সম্পর্কে ঐতিহাসিক ড: সিরাজুল ইসলাম ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’ নামক সংকলিত গ্রন্থে বলেন: “দেশ, জাতি, জাতীয়তাবাদ প্রভৃতির বিষয়ে জনগণ তখন সজাগ ছিলনা ও ধর্মভিত্তিক আচার অনুষ্ঠানই ছিল সামাজিক ও রাজনৈতিক চিন্তা ধারার ভিত্তি। এই সব বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করিলে যে কোন দেশী বা বিদেশী কেন্দ্রীয় সরকারকে মানিয়া নিতে তাহাদের আপত্তি ছিলনা। সরকারী নীতির সমালোচনা ও প্রতিরোধের পদক্ষেপ নিত তাহারা তখনই যখন সরকার স্থানীয় শাসনে, ধর্মীয় ও সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে হস্তক্ষেপ করিত।” সম্রাট আকবরের আমল হতে সমাজের ভিক্ষুক সম্প্রদায়টি রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে গুরুত্ব পেতে থাকে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ‘নাগা’ ও ‘গিরি’ সন্ন্যাসীরা বিভিন্ন সেনাবাহিনীতে যোগদান করে। অযোধ্যার নবাবের সৈন্য বাহিনীতে ‘গোসাই’ বাহিনী গঠিত হয় মূলত: ঐ সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের মানুষদের নিয়ে। কোম্পানীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে মীর কাশিম ফকির সন্ন্যাসীদের সাহায্য নিয়েছিলেন। কোম্পানী বিজয়ী হয়ে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা অঞ্চলে তাদের কর্তৃত্ব স্থাপন করে দিঊয়ানী লাভের মাধ্যমে। এই সময়ই কোম্পানী ফকির ও সন্ন্যাসীদেরকে সন্দেহের চোখে দেখে এবং তাদেরকে ‘দস্যু’ বলে আখ্যায়িত করে। তাই তাদের গতিবিধির ওপর সরকার নানা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। শুধু তাই নয় ভিক্ষাবৃত্তি নিষিদ্ধ হলো এবং তাদের ওপর তীর্থকর আরোপ করা হলো যা ইতোপূর্বে কোন সরকার বা কর্তৃপক্ষ করেনি। তাই বাংলা অঞ্চলে ১৭৬০-১৮০০ খৃস্টাব্দের মধ্যে অসংখ্য ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহ সংঘটিত হয় এবং কোন কোন ক্ষেত্রে সরকারকে বেকায়দায় ফেলে দেয়। ফকির সম্প্রদায়ের ওপর উপরোক্ত বিধিনিষেধ চাপিয়ে দেয়ার ফলে বিদ্রোহ করেছিল। তাদের বিদ্রোহের সঙ্গে যুক্ত হয় কোম্পানী রাজস্ব আদায়কারী কর্মচারীদের নির্যাতন প্রসূত সাধারণ মানুষের অসন্তোষ। সাধারণ মানুষেরাও ফকির সন্ন্যাসীদের সঙ্গে যোগ দিয়ে বিদ্রোহ করে। কোম্পানীর রাজস্ব আদায়কে কেন্দ্র করে কৃষকরা যে ভীতিকর অবস্থায় পড়ে তা হতে মুক্তি পাবার জন্যে তারা চাষাবাদ বন্ধ করে দিয়ে জঙ্গলে আশ্রয় গ্রহণ এবং ফকির সন্ন্যাসীদের সঙ্গে যোগদান করে। একদিকে চাষাবাদ বাধাগ্রস্থ অন্যদিকে ১৭৬৯-১৭৭০ খৃস্টাব্দে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় যা ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে (বাংলা ১১৭৬) নামে পরিচিত। এই পরিস্থিতিতে ফকির ও সন্ন্যাসীদের সঙ্গে যোগ দিয়ে সাধারণ কৃষকেরাও ইংরেজ কোম্পানী ও তাদের সহায়ক শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহে অংশ নেয়।<br /><br /><span style="font-weight: bold;">বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহ:</span><br />এতদঞ্চলে ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহে তিনজন নেতার পরিচয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এরা হলেন ভবানী পাঠক, দেবী চৌধুরানী ও নুরুলউদ্দীন। ভবানী পাঠক ১৭৬০ সাল থেকে কর আদায়কারী, উৎপীড়ক শ্রেণীটির নিকট থেকে টাকা পয়সা লুট করে সাধারণ মানুষের মধ্যে বন্টন করতেন এবং গভীর জঙ্গলে তাঁর ডেরা গড়ে তোলেন। ভবানী পাঠক পরবর্তীকালে বর্তমান কুড়িগ্রাম জেলাধীন রাজারহাট থানায় চাকিরপাশা গ্রামে বসবাস শুরু করেন। তাঁর নামানুসারে ঐ গ্রামের নাম পাঠকপাড়া হয়েছে বলে জানা যায়। তাঁর উত্তরসূরীরা আজও পাঠক পাড়াতে বসবাস করছেন। ভবানী পাঠক বৃহত্তর রংপুর জেলার বিভিন্ন গভীর অরণ্যে দেবী চৌধুরানীর সহযোগীতায় সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলেন। পীরগাছা মন্থনার জমিদার দেবী চৌধুরানী ভবানী পাঠকের আদর্শে দীক্ষা গ্রহণ করে এই আন্দোলনকে শক্তিশালী রূপ দান করেন। এভাবে তিস্তা নদীর তীরবর্তী বিভিন্ন গভীর জঙ্গল, ধরলা ও পয়রাডাঙ্গা নদীর তীরবর্তী বিভিন্ন স্থান, মীরবাগ ভূতছাড়ার গভীর অরণ্যে সন্নাসীদের আস্তানা তথা দুর্গ গড়ে ওঠে। এ ছাড়াও উলিপুর, মরাতিস্তা, পীরগাছা ও চৌমুহনীতেও সন্ন্যাসীদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে ওঠে। দেবী চৌধুরানী ও ভবানীপাঠক ফকির সন্ন্যাসীদের সঙ্গে মাঝে মধ্যে গোপন বৈঠকে মিলিত হতেন। এ সময় রাজস্ব আদায়কারী দেবী সিংহ ও তার কর্মচারী হরেরামের অত্যাচারে সাধারণ মানুষের জীবন অতিষ্ট হয়ে ওঠে। এমতাবস্থায় সাধারণ মানুষকে রক্ষার্থে এগিয়ে এলো সমাজের অবহেলিত প্রায় অংশটি ফকির সন্ন্যাসীরা। কোম্পানী ও মীর জাফরের কাহিনীর সঙ্গে ১৭৬০ সালের ৯ ফেব্র“য়ারি তারিখে মাসিমপুরে ভবানীপাঠক ও দেবী চৌধুরানীর ফকির সন্ন্যাসী বাহিনী প্রচন্ড যুদ্ধে লিপ্ত হয়। কোম্পানীর বাহিনী সাঁড়াশী অভিযান চালায়। কিন্তু বিদ্রোহী ফকির সন্ন্যাসীরা প্রচন্ড সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে কোম্পানী ও মীরজাফরের বাহিনীকে পরাজিত করে। ইংরেজ ক্যাপ্টেন ক্রকেনসহ বেশ কিছু শত্র“সৈন্য নিহত হয় মাসিমপুরের এই যুদ্ধে। অন্যদিকে ফকির সন্ন্যাসীদের পক্ষে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে দলীব খাঁ ও আসালত খাঁ সহ অনেকেই নিহত হন। এরপর পীরগাছা মন্থনার একজন ছোট জমিদার হওয়া সত্ত্বেও দেবী চৌধুরানী তাঁর বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের কারণে বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে ‘জয় দূর্গাদেবী’ বা ‘চন্ডী মা’ নামে জনসাধারণের নিকট শক্তির উৎস ও ভরসাস্থলে পরিণত হন। তার নামানুসারে দেবী চৌধুরানী নামক একটা এলাকা ও রেলস্টেশন আজও তাঁর পূণ্যস্মৃতি বহন করে চলছে। কিন্তু চন্ডী মা দেবী চৌধুরানী শেষাবধি ১৭৮৩ খৃস্টাব্দে স্বয়ং ওয়ারেন হেস্টিংসের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে নিহত হন বলে জানা যায়। লড়াইটি হয় রংপুর জেলার পীরগাছা মৌজায় ১৭৮৩ সালের বৈশাখ মাসের প্রথম সপ্তাহের বৃহস্পতিবারে। পরবর্তীকালে বঙ্কিমচন্দ্র রংপুর জেলার ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালনকালে এই ঘটনা জানতে পারেন এবং দেবী চৌধুরানী নামে উপন্যাস লেখেন।<br /><br />পরবর্তীকালে আরো অনেক নারী নেত্রী ইংরেজ বিরোধীতায় অবতীর্ণ হন। পাঙ্গার রানী লক্ষ্মীপ্রিয়াও এ ধরণের একজন যোদ্ধা বলে জানা যায়। পাঙ্গার রাজা/ রাণীদের বীরত্বের প্রতীক হিসেবে কুড়িগ্রাম শহরে বি.ডি.আর. ব্যাটালিয়ন গেটের সামনে ‘কালু খাঁ’ ও ‘ফতে খাঁ’ নামক দুটো কামান শোভা পাচ্ছে। অবলা ও অবহেলিত নারী সমাজের একজন হওয়া সত্ত্বেও দেবী চৌধুরানী বীরত্ব ও সাহসিকতার যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন তা বর্তমানকালেও নারী সমাজ তাদের সমস্যা সমাধানে অনুপ্রেরণা পেতে পারে।<br /><br />অন্যদিকে ভবানী পাঠক তার সন্ন্যাসী দল নিয়ে কর্মকান্ড অব্যাহত রাখেন। এ জন্য রংপুর জেলা কালেক্টরেট গুডলাক সাহেব লে. ব্রেনানকে একদল সৈন্যসহ প্রেরণ করেন। অকস্মাৎ ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে আক্রমণ করে ভবানী পাঠকের বাহিনীকে ব্রেনান পরাভুত করেন। তাঁর রিপোর্ট অনুযায়ী ঘটনাস্থলেই ভবানী পাঠকের মৃত্যু হয়। অন্য আর একটি সূত্র হতে জানা যায় ধৃত ভবানীপাঠকের বিচার হয় ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে এবং তাকে দ্বীপান্তরে প্রেরণ করা হয়। তবে অন্য একটি সূত্রের মতে তিনি পরাভুত হননি, তাঁর শেষ জীবন পর্যন্ত সন্ন্যাসীদের নেতৃত্ব প্রদান করেন। তিনি কুড়িগ্রাম, উলিপুর, কাঁঠালবাড়ী, নাগেশ্বরী, মাদারগঞ্জ প্রভৃতি স্থানে অসংখ্য ভক্ত রেখে গেছেন। তার উত্তর মুরুষেরা রাজারহাটের পাঠকপাড়ায় অদ্যাবধি বসবাস করছেন।<br /><br />এতদঞ্চলের অপর একজন কৃষক বিদ্রোহের নেতা নুরুলউদ্দীন। তবে ভোগবিলাসী ছিলেন বলে জানা যায় এবং সে সুযোগ গ্রহণ করেই ইংরেজ কোম্পানী গুপ্তচর মারফত তথ্য সংগ্রহ করে তাঁকে অকস্মাৎ আক্রমণের মাধ্যমে হত্যা করে। কাকিনার জমিদার অলকা কোম্পানীর সঙ্গে পরামর্শ করে পবিত্রা নামক একজন নারীকে ছদ্মবেশে দেবী চৌধুরানীর দরবারে প্রেরণ করে। দেবী চৌধুরানীর নিকট থেকে নুরুলউদ্দীন সম্পর্কিত তথ্য পবিত্রার মাধ্যমে সংগ্রহপূর্বক"অলকা কোম্পানীর নিকট প্রেরণ করেন। এরই ভিত্তিতে কোম্পানী ম্যাগডোনাল্ড নামক একজন সেনাপতিকে নুরুলউদ্দীনের বিরুদ্ধে প্রেরণ করে। মোগলহাট নামক স্থানে ম্যাগডোনাল্ড তাকে আক্রমণ করলে নুরুলউদ্দীন নিহত হয়। এটা উপকথা, এতে ইতিহাস কতটুকু আছে বিচার করা কঠিন কাজ। কথিত আছে, সফল গুপ্তচর বৃত্তির পুরস্কার হিসেবে অলকা ও পবিত্রা কোম্পানীর নিকট থেকে কাকিনা ও বামনডাঙ্গার জমিদারী লাভ করে এবং প্রজাপীড়ন অব্যাহত রাখে।<br /><br />ফকির সন্ন্যাসীদের গতিবিধির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও অন্যান্য কারণে বর্ধমানে যে ফকির সন্নাসী বিদ্রোহের সূত্রপাত হয় তা ক্রমাগত রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর, গাইবান্ধা ও বাকেরগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে। এই প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে ফকির সন্ন্যাসীদের বিদ্রোহ। তাই অন্যান্য অঞ্চলে সংঘটিত অনুরূপ বিদ্রোহ সম্পর্কে এখানে আলোকপাত করা হলোনা। ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহের মাধ্যমে বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে রাজশক্তি ও উৎপীড়কদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের যে উত্থান ঘটে তা নানা দিক থেকেই তাৎপর্যবাহী। পরবর্তীকালের অনেক সংগ্রামকে এটি অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এতদঞ্চলের মানুষ আজও যে সৎসাহসের পরিচয় দেন তার ভিত্তি সম্ভবত অতীতের সেইসব বিদ্রোহী চেতনা।সুশান্ত বর্মনhttp://www.blogger.com/profile/02304984470756506973noreply@blogger.com1tag:blogger.com,1999:blog-7423733237485716191.post-44273206891788778072008-02-21T00:11:00.002+06:002018-03-07T13:50:17.229+06:00মধ্য এশিয়ার দর্শনে-সংস্কৃতিতে ভারতীয় প্রভাব<div style="text-align: center;">
<span style="font-weight: bold;">সুশান্ত বর্মন</span></div>
<br />
আদিম জীবনকাঠামোর ধারাবাহিক পথে হেঁটে এসে খ্রিস্টপূর্বকালেই প্রাচীন ভারতীয় মানবগোষ্ঠীরা কাঙ্ক্ষিত মানবিক বোধকে স্পর্শ করতে পেরেছিল। সাড়ে সাত হাজার বৎসর আগে ভারতসহ প্রায় সারা পৃথিবীতে একই সময়ে একাধিক মানবগোষ্ঠী কৃষিজীবী হওয়া শুরু করে। কৃষক জীবন যাপনকালীন সহস্র বৎসরে সমস্ত পৃথিবীর সভ্যতার পীঠস্থানগুলিতে দর্শনের বিভিন্ন শাখার উদ্ভব, চর্চা ও বিকাশ হওয়ার মাধ্যমে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যগুলি স্বতন্ত্ররূপ গ্রহণ করে। পার্সীয়, ইনকা, মায়া, গ্রিক, মিসরীয়সহ সমসাময়িক প্রাচীন সভ্যতা ও সেই সংশ্লিষ্ট সংস্কৃতির অনুশীলন সহস্র বৎসর পরে আর নিরবিচ্ছিন্ন থাকেনি। ভারতীয় সভ্যতা এর একমাত্র ব্যতিক্রম। পাঁচ-সাত হাজার বৎসর পুরনো ভারতীয় সংস্কৃতি চিন্তা-চেতনার অসংখ্য পরিমার্জন-পরিবর্ধনের চিহ্নকে ধারণ করে প্রবহমান নদীর মতো এখনও সজীব রয়েছে। হিমালয় থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত এই অঞ্চলে উদ্ভূত দর্শনগুলো অহিংসা, উদারতা, মানবতা, শিল্পবোধ ও নন্দনতাত্ত্বিক সৌকর্যের কারণে সারা পৃথিবীতে বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছে। ইতিহাসের ধারাবাহিক পৃক্ষাপটে দেখা যায় পৃথিবীর প্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া ভারতীয় সংস্কৃতির যাত্রাপথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনভাবেই অস্ত্রের স্পর্শ বা প্রভাব ছিল না। ‘ধৃ’ ধাতু থেকে উদ্ভূত সংস্কৃত ‘ধর্ম’ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ‘ধারণ করা’। ভারতীয় উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক আবহাওয়া এমন যে এখানে মানুষ ধর্মকে নয় ধর্মই মানুষকে ধারণ করে; পালন করে।<br />
<br />
ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলের দেশগুলো খ্রিস্টপূর্ব সময় থেকেই সনাতন সংস্কৃতিকে বিভিন্ন নামে ও রূপে বহন করে আসছে। সনাতন মাতৃধর্মের সন্তান বৌদ্ধধর্ম তার মহত্ববোধ নিয়ে আজও চীন, জাপান, কোরিয়া, তিব্বত, মঙ্গোলিয়া, সুমাত্রা, জাভা, বোর্ণিও, থাইল্যান্ড, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি অঞ্চলের মানুষের সুখে দুঃখে পাশে দাঁড়িয়ে আছে। গ্রিস, মিসর, ইরান, আফ্রিকা প্রভৃতি অঞ্চলেও খ্রিস্টপূর্বকালে অশোকের সময়ে বৌদ্ধধর্ম পৌঁছে গিয়েছিল। আমেরিকা মহাদেশে ৪৫৮ খ্রিস্টাব্দে বৌদ্ধধর্মীয় আদর্শ প্রচারিত হয়েছিল। এখনও সেখানকার সংস্কৃতিতে বৌদ্ধধর্মের অবশেষ খুঁজে পাওয়া যায়। মেক্সিকোর একজন প্রাচীন ঋষির নাম ‘উই সি পোকোকা’। স্পানিস ভাষায় পরিবর্তিত এই নামটির মূল রূপ সম্ভবত ‘হই সেনভিক্ষু’। ১৫ শতকের দিকে মেক্সিকো এবং মধ্য আমেরিকাতে যে ধর্মমত, বিশ্বাস, গৃহনির্মাণ কৌশল, মাস গণনার রীতি ইত্যাদি প্রচলিত ছিল তার সাথে ভারতীয় বিশ্বাস ও সভ্যতার একাধিক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এছাড়াও বিভিন্ন স্থানের নামের সাথে বৌদ্ধধর্মীয় নামের একাধিক মিল লক্ষ্য করা যায়। ‘গুয়াতেমালা’- ‘গৌতম আলয়’, 'গ্বাতেমোট'- ‘জিন গৌতম’ ইত্যাদি। এছাড়া ‘শাকাটাপেক’, ‘শাকা পুলাস’ প্রভৃতি শব্দের পূর্বে ‘শাক্য’ নামের সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিপর্যয়ের দেশ আফগানিস্তানেও যে বৌদ্ধ ধর্ম সগৌরবে সভ্যতা বিকিরণের উৎস ছিল তা শিক্ষিত প্রত্যেকেই জানেন। কান্দাহারে বহু সংখ্যক অশোকের শিলালিপি পাওয়া গেছে। আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের ১৫০ কি.মি.(৯০ মাইল) পশ্চিমের বামিয়ান প্রদেশের হিন্দুকুস পর্বতে গৌতম বুদ্ধের অনেক মূর্তি ছিল। প্রধান বুদ্ধমূর্তি দুটি উচ্চতায় ছিল ৫৩ মিটার (১৭৫ ফুট) এবং ৩৭ মিটার (১২০ ফুট)। এর মধ্যে প্রথমটি হলো মহান গৌতম বুদ্ধের দাঁড়ানো অবস্থায় পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু মূর্তি। এই মূর্তিদুটোর আশেপাশে গৌতম বুদ্ধের আরও অনেক মানবাকৃতির বিভিন্ন ভঙ্গির মূর্তি ছিল।
<br />
ইসলামবাদী তালেবানদের হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত বেলে পাহাড় খোদাই করে গান্ধার শিল্পরীতিতে তৈরি করা প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শণ এই অমূল্য মূর্তিগুলো আমাদের জানিয়ে দেয় ২০০০ বছর আগের আফগানিস্তানে বৌদ্ধসংস্কৃতির সানন্দ উপস্থিতির কথা। একাধিক চীনা পর্যটক-শ্রমণ এই মূর্তিগুলোকে ১১-১২ শতকের পূর্ব পর্যন্ত দেখেছেন। তখন মূর্তিগুলোর সমস্ত শরীর সোনার পাত দিয়ে মোড়ানো ছিল। হীরা, পান্নাসহ বিভিন্ন রত্নশোভিত অলঙ্কারে বৌদ্ধমূর্তিগুলো সজ্জিত ছিল। পরবর্তীকালে আফগানরা নিজেদের নীতিবোধ-শিল্পকলা-সৌন্দর্যতত্ত্ব তথা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সবটুকু বিদেশী আক্রমণকারীদের কাছে হারিয়ে ফেলেছে। একারণে তারা প্রাচীন ভাস্কর্যগুলির বহিরঙ্গের রত্নখচিত ঐতিহ্যিক কারুকার্যমণ্ডিত স্বর্ণপাতের বহিরঙ্গগুলো বিভাষী-বিদেশী লুণ্ঠনকারীদের হাত থেকে আর রক্ষা করতে পারেনি। প্রাসঙ্গিক তথ্য এই যে আফগানিস্তানে খৃস্টপূর্বকালে যখন বৌদ্ধধর্ম গৌরব ও নেতৃত্বের শিখরে আসীন ছিল সেসময়ে পৃথিবীর অনেক ‘ধর্ম’ নামাঙ্কিত ধর্মের উৎপত্তিই হয়নি।<br />
<br />
শাক্যসিংহ গৌতম বুদ্ধ জন্ম নেন ৬২৩ খ্রিস্টপূর্বে এবং মৃত্যু বরণ করেন ৫৪৩ খ্রিস্টপূর্বে। তাঁর কিছু পরে ৫৯৯ খ্রিস্টপূর্বে জন্ম নেন জৈন ধর্মগুরু মহাবীর। মহাকাল দ্রষ্টা এই দুই মনীষীর পরবর্তীকালের অন্যান্য প্রণম্য পণ্ডিতেরা হলেন- পিথাগোরাস (৫৭০- ৫০০ খ্রি.পূ.), হেরাক্লিটাস (৫৩৫- ৪৭৫ খৃ.পূ.), সক্রেটিস (৪৬৯- ৩৯৯ খ্রি.পূ.), এরিস্টটল (৩৮৪- ৩২২ খ্রি.পূ.) প্রমুখ। এরিস্টটলের সাক্ষাৎ শিষ্য আলেকজান্ডার ভারত জয় করেছিলেন। সেই সাথে এরিস্টটল-প্লেটোর তত্ত্বে জ্ঞানী অনেকেই উপমহাদেশে আগমন করেন। তাঁদের জ্ঞান সাধনায় মগ্ন মননকে গৌতম বুদ্ধের বাণী স্পর্শ করতে পেরেছিল। তাঁরা গৌতম বুদ্ধের ভাবাদর্শকে ইউরোপে বহন করে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাই আরও পরের কান্ট, হেগেল, মার্কস, জাঁ পল সার্ত, আলবেয়ার কাম্যু প্রমুখের মানসিকতায় বৌদ্ধ দর্শনের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ২০০০ বৎসর পূর্বে রচিত ঈসপের গল্পে গৌতম বুদ্ধের জীবন কাহিনীর সংগ্রহ ‘জাতক’ এর ব্যাপক প্রভাব পণ্ডিতেরা খুঁজে পেয়েছেন। পালি ভাষায় রচিত জাতকের গল্প সংখ্যা ৫০০ এরও বেশি।<br />
<br />
শক ও আর্যেরা খ্রিস্টের জন্মের কয়েক হাজার বছর আগে থেকেই ভিন্ন ভিন্ন ভূখণ্ডে বাস করত। তাদের মাঝখানে সুবিশাল হিমালয় পর্বতমালা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকলেও পারস্পরিক যোগাযোগ কখনও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি। শকদের সম্পর্কে ‘বাণভট্ট’ তাঁর ‘অষ্টাঙ্গ হৃদয়’(উত্তরতন্ত্র) গ্রন্থে বলেছেন- “যস্যোপয়োগেন শকাঙ্গনানাম লাবণ্যসারাদি- বিনির্মিতানাম।’ ‘মহাভারতে’ ও কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্রে’ চীনের উল্লেখ আছে।<br />
<br />
প্রাচীন চীনাসাহিত্য ভারতের সাথে চীনের পরিচিতির কথা অকপটে স্বীকার করে। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের প্রথমভাগে পারস্পরিক যোগাযোগের মাত্রা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। ২০৬ থেকে ২২০ খ্রিস্টপূর্ব সময়কালের মধ্যে দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। খ্রিস্টপূর্ব ১৩৬ সালে হান সম্রাট ‘উ’ মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন জাতিদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপনের জন্য ‘চাং থিয়েন’ নামক একজন দূতকে প্রেরণ করেন। খ্রিস্টপূর্ব ০২ সালে কুষাণ রাজারা চীনে বৌদ্ধধর্মীয় সন্ন্যাসীদেরকে প্রেরণ করেন। হান সম্রাট ‘মিঙ’(৫৮-৭৬ খ্রিস্টাব্দ) এর সময়ে ৬৫ খ্রিস্টাব্দে মগধ থেকে ‘কাশ্যপ মাতঙ্গ’ এবং ‘ধর্মারণ্য’ (মতান্তরে ধর্ম্মরক্ষ বা ধর্ম্মরত্ন) নামে দুইজন বৌদ্ধ পণ্ডিত চীনে গিয়ে বৌদ্ধধর্মীয় সুক্তগু অনুবাদ শুরু করেন। আনুমানিক খ্রিস্টের জন্মের সমসাময়িক সময়ে ‘তা ইয়ুয়ে তি’ চীনের সাথে বৌদ্ধধর্মের পরিচিতি ঘটান। ৭০ খ্রিস্টাব্দ থেকে বৌদ্ধধর্ম চীনে ব্যাপক প্রসার লাভ শুরু করে। এই সময় থেকেই চীনের আধ্যাত্মিক উপলব্ধি, ধ্যান-ধারণা, শিল্পকলার ক্ষেত্রে এক নতুন উৎকর্ষের যুগ শুরু হয়। কনফুসিয়াসবাদের সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের মিশ্রণ এক্ষেত্রে বিরাট প্রভাবকের কাজ করেছিল।<br />
<br />
পারস্যের ‘আরসকিদীয়’ রাজবংশের রাজপুত্র বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হয়ে ‘ভিক্ষু লোকোত্তম (আন মো কাও)’ নাম ধারণ করেন। তিনি বিভিন্ন দেশ পরিভ্রমণ শেষে ১৪৮ খ্রিস্টাব্দে চীনে যান এবং সেখানে বিশ বৎসরকাল অবস্থান করে ভারতীয় বৌদ্ধধর্মের উপরে লেখা প্রায় ১৭৯টি গ্রন্থ চীনাভাষায় অনুবাদ করেন। ‘লোকক্ষেম’ নামক একজন বৌদ্ধভিক্ষু চীনে এসে ১৮৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাস করেন এবং ২৩টি বৌদ্ধশাস্ত্র চীনাভাষায় অনুবাদ করেন। ১৯০ খ্রিস্টাব্দে আনহুই প্রদেশের একটি শহরে বৌদ্ধমন্দির নির্মিত হয়। লিয়াং রাজবংশের সম্রাট ‘উ তি’র রাজত্বকালে (৫০২-৫৪৯ খ্রি.) কেবলমাত্র চিয়ানখাং নামক স্থানে পাঁচশত বৌদ্ধমঠ ছিল। সেখানে একলক্ষেরও বেশি বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং ভিক্ষুণী বৌদ্ধধর্ম প্রচারকার্যে নিযুক্ত ছিলেন। কনফুসীয় নীতি এবং তাও ধর্মের সঙ্গে বৌদ্ধধর্মীয় সংস্কৃতির তুলনামূলক ও ব্যাপক বিতর্কের শেষে চীনারা বৌদ্ধদর্শনকে অধিকতর গ্রহণযোগ্য বলে মনে করে। বৌদ্ধ ধর্মের জন্মান্তরবাদ, আত্মা সম্পর্কিত দর্শন ও বৈরাগ্যের বিপরীতে ‘মহান লাওৎ সে’ এর তাওবাদ এবং ‘জ্ঞানী কনফুসিয়াস’ এর ইহলৌকিকতাবাদ খুব বেশিদিন অপরিবর্তিত থাকতে পারেনি। ফলে শক্তিশালী সামন্তরাজাদের সহায়তায় বৌদ্ধদর্শনের বিরুদ্ধে কনফুসীয় পণ্ডিতরা আক্রমণাত্মক মনোভাব গ্রহণ করেছিল।<br />
<br />
৪২৬ খ্রিস্টাব্দে উত্তর ওয়েই রাজ্যের রাজারা তাওবাদের সমর্থনে বৌদ্ধভিক্ষুদেরকে ধর্ম প্রচারে বাধা দিতে চেষ্টা করেন। উত্তর ছি রাজ্য এবং উত্তর চৌ রাজ্যেও বৌদ্ধধর্ম সরকারি বিরোধীতার সম্মুখীন হয়। ৫৭৪ খ্রিস্টাব্দে উত্তর চৌ রাজ্যের সম্রাট ‘উ তি’ (৫৬১-৫৭৮ খৃ.) বৌদ্ধধর্মকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলেন। ৬২৬ খৃস্টাব্দে বৌদ্ধ ধর্মের বিরুদ্ধে কনফুসীয় মতবাদী রাজারা সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারী করেন। ৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট ‘উ সুঙ’ এর এক সরকারি আদেশে অন্তত চল্লিশ হাজার বৌদ্ধ মঠ ধ্বংস করা হয়েছিল। বিরোধীভাবাপন্নদের এত কীর্তির পরও জনসাধারণ বৌদ্ধধর্মীয় সংস্কৃতিকে ত্যাগ করতে চায়নি। উত্তর চীনের বেশিরভাগ শাসকেরা বরং বৌদ্ধ ধর্মকে প্রবলভাবে সমর্থন করতেন। ৫৩৪ খৃস্টাব্দে লুওইয়াং এ ১,৩৬৭টি বৌদ্ধমন্দির ছিল। এই সময়ে উত্তর চীনে সর্বমোট ৩০,০০০ বৌদ্ধ মঠ ছিল। মোট বৌদ্ধভিক্ষুর সংখ্যা ছিল ২০ লক্ষ।<br />
<br />
অধ্যাপক ‘লিয়াং চি চ্যাও’ এর মতে খ্রিস্টিয় তৃতীয় থেকে অষ্টম শতকের মধ্যে ১৬৯ জন এরও বেশি চীনা শ্রমণ বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে ভারতবর্ষে আসেন। ‘ফা হিয়েন’ (মতান্তরে ‘ফা হিয়ান’) আসেন ৩৯৯ খ্রিস্টাব্দে, ‘চে মেং (মতান্তরে ‘চি য়েন) আসেন ৪০৪ খ্রিস্টাব্দে, ‘ফা ইয়ং আসেন ৪২০ খ্রিস্টাব্দে, ‘হিউয়েন সাঙ’ ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে, ‘ই চিং’ (মতান্তরে ‘আই ৎ সিঙ্গ’ বা ‘ইৎ সিঙ’) ৬৭২ খ্রিস্টাব্দে এবং ‘উ খোং’ আসেন ৭৫১ খ্রিস্টাব্দে। এঁরা বৌদ্ধধর্মশাস্ত্রে সুপণ্ডিত এবং প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব ছিলেন বলেই সঠিক কালটি পাওয়া গিয়েছে। ফা হিয়েন এর মূল নাম ছিল ‘কুঙ্গ’। তিনি মাত্র তিন বৎসর বয়সে বৌদ্ধধর্মের আশ্রয় গ্রহণ করেন। দীক্ষা-গ্রহণের পর তার নতুন নামকরণ হয় ‘ফা হিয়েন’। এর অর্থ ‘বিনয়ের প্রতিমূর্তি’। তিনি ‘সি’ উপাধিতে ভূষিত হন। এর মর্মার্থ ‘শাক্যনন্দন’। ফা হিয়েন ‘চী হাই’ নামক চীনা ক্যালেন্ডারের ‘হাংশী’র প্রথম বৎসরে (খ্রিস্টিয় ৩৯৯ অব্দে) ভারতবর্ষের দিকে পদব্রজে যাত্রা করেন। তিনি ছয় বৎসর ভারতবর্ষে অবস্থান করেছিলেন। এসময় তিনি অসংখ্য হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মীয় তীর্থস্থান যেমন মথুরা, কনৌজ, শ্রাবস্তী, কপিলাবস্তু, কুশীনগর, বৈশালী, পাটলীপুত্র, রাজগৃহ, গয়া, বারাণসী, কৌশাম্বী, চম্পা, তাম্রলিপ্ত প্রভৃতি নগর পরিভ্রমণ করেন। ফা হিয়েন এর লিখিত বিখ্যাত গ্রন্থটির নাম ‘ফো কিউ কি’ অর্থাৎ ‘বুদ্ধভূমির বিবরণ’। গ্রন্থটি ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ সহ বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে। হিউয়েন সাঙ ভারতবর্ষে আসার প্রেরণা পান ফা হিয়েন ও চি য়েন এর স্মৃতিকথা এবং ভ্রমণকাহিনী পড়ে। তিনি ৬০০ শতকে চীনের হো নান প্রদেশের চিন লিউতে জন্মেছিলেন। কিন্তু জ্ঞানলাভের অদম্য ইচ্ছা তাঁকে নিয়ে আসে চাঙ অন শহরে। এই শহর থেকে তিনি রওনা হন ভারতবর্ষের দিকে। এক বৎসর পায়ে হেঁটে হেঁটে তিনি ভারতীয় উপমহাদেশে পৌঁছান ৬৩০ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে। তিনি প্রায় সমস্ত ভারতীয় জনপদগুলোতে ১৪ বছর ধরে ভ্রমণ করেছেন। চীনে ফিরে যাবার সময় যা সাথে নিয়েছিলেন তার তালিকা নিম্নরূপ:-<br />
<ul>
<li>গৌতম বুদ্ধের দেহভষ্ম - ৫০০ গ্রেন।</li>
<li>স্বচ্ছ স্তম্ভের উপর বসানো সোনার বুদ্ধমূর্তি - ২টি।</li>
<li>স্বচ্ছ বেদীর উপর বসানো রূপার তৈরি বুদ্ধমূর্তি - ১টি।</li>
<li>স্বচ্ছ বেদীর উপর বসে থাকা চন্দন কাঠের তৈরি বুদ্ধমূর্তি - ৩টি। এর একটি কৌশম্বীর রাজা উদয়নের মূর্তির আদলে তৈরি, আর একটি ৩৩তম স্বর্গ বা তুষিত স্বর্গ থেকে বুদ্ধের ফিরে আসার সময়কালের আদলে ও অন্যটি গৌতম বুদ্ধের ধ্রুপদী অবয়বে তৈরি হয়েছে।</li>
<li>মহাযান শাখার ১২৪টি সূত্রের পুঁথি। এবং</li>
<li>২২টি ঘোড়ার পিঠে করে বয়ে নিয়ে যাওয়া ৫২০ বোঝা বিভিন্ন শাস্ত্রের গ্রন্থ।</li>
</ul>
<br />
চীনে প্রত্যাবর্তন করে তিনি ভারতবর্ষ থেকে নিয়ে আসা গ্রন্থগুলি অনুবাদে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ৬৬৪ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু বরণের আগ পর্যন্ত তিনি ৭৫টিরও বেশি গ্রন্থ চীনা ভাষায় অনুবাদ করেন। হিউয়েন সাঙ ভারতবর্ষের মানুষের শান্তি ও স্বস্তির মধ্যে জীবনযাত্রা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি দেখেছেন সামাজিক আইনশৃঙ্খলার প্রতি সম্মানবোধ ভারতবর্ষের মানুষকে তৃপ্ত ও স্বচ্ছন্দ্য জীবন যাপনে সহায়তা করেছিল। দেশের দরিদ্র ও ভিখারীরাও তাঁর দৃষ্টিকে এড়িয়ে যায়নি। ই চিং ৬৭২ খৃস্টাব্দে ভারতবর্ষে পৌঁছেন। তিনি ২৪ বৎসর ধরে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে বৌদ্ধধর্মের উপর অপার জ্ঞানলাভ শেষে ৬৯৫ খ্রিস্টাব্দে চীনে ফিরে আসেন। তিনি ৬৭৫ সাল থেকে ৬৮৫ সাল পর্যন্ত নালন্দা মহাবিহারে অবস্থান করেছিলেন। এই সময়ে তিনি হিউয়েন সাঙ এর পর থেকে তাঁর পূর্ব পর্যন্ত ভারতে আসা ৫৬ জন চীনা শ্রমণের ভারতবর্ষ ভ্রমণের কাহিনী নিয়ে ‘কাউ ফা কাঙ সাঙ চুয়েন’ (চীনাশ্রমণদের ভারত ভ্রমণ) নামক একটি বিখ্যাত গ্রন্থ লেখেন।<br />
<br />
উপর্যুক্ত মধ্য এশীয় শ্রমণগণ যে সময়কালে ভারতীয় উপমহাদেশে বাস করেছিলেন সেকালে এ অঞ্চলের ভিন্ন ভিন্ন ধর্মসংস্কৃতিতে মতপার্থক্য থাকলেও আন্তধর্মীয় আক্রমণপ্রবণতা ছিলনা। হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মাবলম্বী প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্মের প্রতি যথেষ্ট পরিমাণে মনোযোগী ছিলেন। ফলে অপার্থিব বিষয় নিয়ে সময় ব্যয় করার মতো যথেষ্ট কারণও সাধারণ বিশ্বাসীদের ছিলনা। এই নিরাতঙ্ক জীবনধারা বেশিদিন প্রবহমান থাকতে পারেনি। প্রায় এক দেড় হাজার বছর সুপ্রতিবেশীসুলভ জীবন কাটানোর পর হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মীদের পারস্পরিক মতভেদ এত বেশি হয়ে যায় যে বুদ্ধ অনুসারীরা ‘নাস্তিক’, ‘অসামাজিক’ ইত্যাদি বিবেচিত হতে থাকে। ১০-১২ শতকের পূর্বেই ভারতে প্রাপ্ত গৌতম বুদ্ধ সম্পর্কিত বেশিরভাগ গ্রন্থের সবগুলো তিব্বতী ও বিভিন্ন বিদেশী ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল। এগুলোর আনুমানিক সর্বমোট সংখ্যা ১৪ হাজার। ভারতবর্ষে পরবর্তী বিধর্মী শাসনের কালে সংস্কৃতে লেখা এই অমূল্য গ্রন্থরাজি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। তিব্বতী ভাষারগুলো এখনও আছে। তিব্বতে এই বিশাল গ্রন্থরাশিকে দুইভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রথমটির নাম ‘তাঞ্জুর’ এবং দ্বিতীয়টির নাম ‘কাঞ্জুর’। তাঞ্জুরে আছে সাড়ে তিন হাজার বৌদ্ধ ধর্মীয় গ্রন্থের অনুবাদ আর কাঞ্জুরে রয়েছে বুদ্ধের বাণী সম্বলিত এগারোশো আটটি গ্রন্থ।<br />
<br />
আধুনিক যুগে তিব্বতী অনুবাদ থেকে ইংরেজি অনুবাদের মাধ্যমেই ইতিহাসকে পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব হয়েছে। বিদেশ থেকে দর্শন অনুরাগী শ্রমণরা শুধুমাত্র ভারতেই এসেছেন এমন নয়। ভারত থেকেও বেশকিছু বৌদ্ধশাস্ত্রীয় পণ্ডিত মধ্য এশিয়ার প্রান্ত পর্যন্ত বুদ্ধের বাণী বহন করে নিয়ে গিয়েছেন। ‘শান্তরক্ষিত’, ‘পদ্মসম্ভব’, ‘কমলশীল’ প্রমুখ ভারতীয় পণ্ডিতের নাম তিব্বতীয় গ্রন্থগুলিতে পাওয়া যায়। ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে গিয়ে যাঁরা বৌদ্ধদর্শনের মহত্বকে বিদেশীদের চোখে কাঙ্ক্ষিত করে তুলেছিলেন তাঁদের মধ্যে বাঙালি পণ্ডিত অতীশ দীপংকর প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। সোমপুর মহাবিহারে কয়েক বৎসর শিক্ষকতাকালে তিনি ‘মধ্যমকরত্নপ্রদীপ’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। তিব্বত ও মঙ্গোলিয়ায় তিনি এত বেশি সুখ্যাত যে এখনও তিনি ‘জোবো জে’ (মহাগুরু অতীশ) নামে পূজিত হন। তিব্বতে অতীশ দীপঙ্করের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল ‘বোধিপাঠ প্রদীপ’ গ্রন্থটি লেখা। এর টীকা গ্রন্থটির নাম ‘বোধিপাঠ প্রদীপ পঞ্জিকা’। এছাড়াও তিনি ‘রত্নকরণ্ডোদঘাট’, ‘অভিসময় বিভঙ্গ’, ‘চিতা বিধি’, ‘নাগ বলি বিধি’, ‘চিকিৎসা জীব সার’, ‘দশ অকুশল কর্ম পথ দেশনা’, ‘চর্য্যাসংগ্রহ প্রদীপ’ প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেন। তেরো বৎসরের তিব্বত বাসকালে তিনি প্রায় সমস্ত তিব্বতী বৌদ্ধমঠে ভ্রমণের সঙ্গে সঙ্গে অন্তত ৭৯টি গ্রন্থ সংস্কৃত ভাষায় রচনা করেন। এজন্য তিনি তিব্বতীদের দ্বারা সম্মানজনক ‘অতীশ’ উপাধিতে ভূষিত হন। গ্রন্থগুলির সবগুলো এখনও তিব্বতী ভাষায় অনূদিত হয়ে ‘তাঞ্জুর’ সংকলনে রয়েছে। তিব্বতী ভাষায় তেমন অধিকার না থাকার কারণে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান সবসময় সংস্কৃত ভাষায় লিখতেন এবং সাথে থাকা অনুসারীরা তা তিব্বতী ভাষায় অনুবাদ করে ফেলত। ১০৫৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি তিব্বতেই মৃত্যু বরণ করেন। প্রাচীন যুগের এই বাঙালী পণ্ডিত প্রধান সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের মর্যাদায় তিব্বতের ইতিহাসে চিরস্থায়ী আসন লাভ করেছেন।<br />
<br />
ভারতীয় সংস্কৃতির প্রাণসৌন্দর্য মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলব্যাপী জনগণের মনে এক নতুন মর্মবোধের জন্ম দিয়েছিল। এই ভূখণ্ডের অধিবাসীদের মানসিক সভ্যতার মান আগে থেকেই উন্নত ছিল, তাই ভারতীয় দর্শন-নন্দনতত্ত্ব উপলব্ধি করা তাদের জন্য সহজ হয়েছে। এই অঞ্চলের সুপ্রাচীন ও সুসভ্য জাতিরা ভারতীয় সংস্কৃতির স্পর্শে নিজেদের সুপ্ত শক্তিকে নতুনভাবে আবিষ্কার করতে পেরেছিল। ৩৭২ খ্রিস্টাব্দে কোরিয়ার উত্তরাঞ্চলের রাজ্য ‘কোকুলি’ বৌদ্ধধর্মের মহান প্রভাবকে নিজ জনজীবনে স্বীকার করে নেয়। কোরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের রাজ্য ‘পেক্চে’ বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে ৩৮৪ খ্রিস্টাব্দে। চীন-কোরিয়ার সভ্যতাপ্রসবিনী বৌদ্ধধর্ম জাপানে আসে ৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে। জাপানের সময়ানুক্রমিক ইতিহাস গ্রন্থ ‘নিহোন-শোকি’ বা ‘নিহোংগি’-তে লেখা আছে যে পেক্চের রাজা স্যোইয়ং ম্যিইয়ং ৫৩৮ খ্রিস্টাব্দের ১৩ অক্টোবর একটি প্রতিনিধি দল জাপানে প্রেরণ করেন। এই প্রতিনিধি দলে প্রধানত ছিলেন বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ। তারা তথাগত বুদ্ধের স্বর্ণখচিত তাম্রনির্মিত মূর্তি, বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের মূর্তি, বৌদ্ধ সূত্রের অনুলিপি ও অন্যান্য বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কিত উপহার নিয়ে যান। জাপানের সম্রাট কিম্মেই এর কাছে লেখা চিঠিতে পেক্চের রাজা লিখেছেন- “এ<span style="font-style: italic;">ই ধর্ম সমস্ত শিক্ষার মধ্যে উৎকৃষ্ট যদিও এ বিষয়ে পাণ্ডিত্য অর্জন করা দুঃসাধ্য এবং বোধগম্য হওয়া কঠিন; এমন কি চীনের মহাজ্ঞানী ব্যক্তিগণও দেখেছেন যে এই ধর্ম সহজবোধ্য নয়। এই ধর্মে বিশ্বাসীগণ এক পরম আশীর্বাদ ও অপরিমেয় ফল লাভ করেন, এমন কি এই ধর্ম মহাসিদ্ধিও (বোধি) দান করে। চিন্তামণি রত্ন যেমন সকল ইচ্ছাই পূরণ করে, তেমনি এই মহিমময় ধর্মের সম্পদগুলি প্রাপ্তির জন্য যাঁরা চেষ্টা করেন তাঁদের প্রতি সাড়া প্রদানে সম্পদগুলি কখনই বিরত হয় না। অধিকন্তু, সুদূর ভারতবর্ষ থেকে এই ধর্ম কোরিয়ায় উপনীত হয়েছে এবং (এই দুই দেশের মধ্যবর্তী দেশগুলিতে) মানুষ অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে এই ধর্মের শিক্ষা অনুসরণ করছে এবং কেউই এর প্রভাবের বাইরে নয়।</span>”<br />
<br />
ধর্ম বা রাজ্য সম্প্রসারণের নামে কখনো কোন ভারতীয় ব্যক্তি কোন ভিন্ন ধর্মকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, দার্শনিক, সাংস্কৃতিক বা তাত্ত্বিকভাবে আক্রমণ করেননি; কোন কল্পিত অজুহাতে বিদেশে প্রচলিত ধর্মকে খর্ব বা অপমান করেননি। নিজ ধর্ম প্রচার করে অন্য দেশের সংস্কৃতিকে পঙ্গু করে দেয়ার মানসেও কোন ভারতীয় ব্যক্তি বিদেশে ধর্মবাণিজ্য করতে যাননি। এমনকি ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের ব্যক্তিগত দ্রব্যাদির মধ্যে অস্ত্র কখনও স্থান পায়নি। অন্যদের মতো চিকিৎসার নামে, ক্ষুধার্তকে খাদ্য প্রদানের নামে, ধনী-গরীব সমান অধিকারের নামে কোন ভারতবাসী ধর্মীয় আধিপত্যবাদকে সমর্থন করেননি। বস্তুত আধ্যাত্মিক একচ্ছত্রবাদ বা সাম্রাজ্যবাদকে ভারতীয় সংস্কৃতি কখনই অন্তর্দর্শন বলে স্বীকার করেনি। ফলে ধর্মীয় শাসন বলতে যা বোঝায় তা কখনও ভারতীয় সংস্কৃতির প্রধান অঙ্গ হয়ে ওঠেনি। ভারতীয় দর্শন কোনদেশেই ধ্বংস করতে যায়নি বরং পূর্ণকে পরিপূর্ণ করার দিকে তার যত দায়। ভারতীয় সংস্কৃতির মূল শক্তিই হল আত্মবিশ্লেষণ। এজন্য ভারতীয় দর্শনগুলো সাহিত্য, ভাস্কর্য, চিত্রকলা, সঙ্গীত, নৃত্য, নাটক অর্থাৎ শিল্পের প্রতিটি শাখার ধারণ ও চর্চাকে সবসময়ই উৎসাহিত করেছে। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে শত্র“ ভাবেনি, ন্যায়-নীতির তুলাদণ্ডে বিশ্লেষণের নামে সাংস্কৃতিক মনন ও অনুভবগুলোকে সীমিত করতে চায়নি। ভারতীয় ধর্ম প্রচার হয়েছে মূলত তার অন্তর্নিহিত দর্শন ও শিল্পকলাজাত সৌন্দর্যবোধের জন্য। ৬০৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই বৌদ্ধধর্ম কোনো অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে বা অস্ত্রবাজী করে নয়, প্রচলিত ধর্মকে নিন্দা বা আক্রমণ করে নয়, পরকালের ভয় বা লোভ দেখিয়ে নয় (বৌদ্ধধর্মে ঈশ্বর বা পরকাল বলতে কিছু নেই) বরং নিজের ধর্মীয় সৌন্দর্য, শিল্পকলাজাত মহত্ব, মানুষের প্রতি ভালোবাসা, নন্দনতাত্ত্বিক বিশিষ্টতা, ব্যবহারিক সংস্কৃতির প্রতি পক্ষপাত এবং সামাজিক উন্নতির প্রতি অঙ্গীকার নিয়ে সমগ্র জাপানে ছড়িয়ে পড়ে। হিন্দু সংস্কৃতিজাত বৌদ্ধধর্মের এই অঙ্গীকার যে মিথ্যা ছিল না তা আজকের মধ্য এশিয়াকে মনোযোগের সাথে বিভিন্ন দিক দিয়ে বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়। আসলে বৌদ্ধধর্মের রূপে মধ্য এশিয়ায় গিয়েছিল নতুন সভ্যতা, নতুন জ্ঞান, নতুন জীবনবোধ, নতুন ভাষা আর লিপি। নতুন জীবনদর্শন, নতুন সমাজবোধ ভারতীয় সংস্কৃতির আলোর রূপে মানুষকে আলোকিত করে তুলেছিল। ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন- “<span style="font-style: italic;">ভারতীয় মনোভাব এমন ছিল না যে এই-সব জাতির চিন্তা-রীতির এবং অনুভূতির আধার-ভূমির বৈশিষ্ট্যকে অনুকম্পা-বিহীন দৃষ্টিতে দেখিয়া অস্বীকার করিবে, অথবা উড়াইয়া দিতে চাহিবে। কারণ, ভারতীয় বা হিন্দু সভ্যতা নিজেই একটি বিরাট সমন্বয় ও সর্বগ্রাহিতা বা সর্বন্ধরত্বের ভিত্তির উপরে স্থাপিত; এই সমন্বয় ও সর্বগ্রাহিতা মানব-সংক্রান্ত কোনও কিছুকে তাহার নিজ সত্তায় ঈশ্বরের কাছে অথবা অন্য মানবের কাছে অগ্রাহ্য অথবা জুগুপ্সার যোগ্য বলিয়া মনে করেনা। ভারতের মধ্যে এবং ভারতের বাহিরে যে সকল জাতি ভারতীয় হিন্দু সংস্কৃতির সহিত সংস্পর্শে আসিয়াছিল, তাহাদের আত্মসম্মানের কোনও হানি না করিয়া, ভারতীয় হিন্দু চিত্তের ওই মৌলিক উদারতা তাহাদের সভ্য মানুষ করিয়া তুলিয়াছিল; তাহারা এই সংস্কৃতির অন্তর্নিহিত গভীর এবং বিস্তৃত জীবনে অংশ গ্রহণ করিয়াছিল, এবং সঙ্গে সঙ্গে তাহাদের নিজেদের আহৃত ও স্বকীয় বিশিষ্ট উপাদান-সম্ভারের দ্বারা, এই সংস্কৃতিকে দেশ-কাল-পাত্র অনুসারে আরও পরিবর্ধিত ও বিশ্বমানবের পক্ষে আরও উপযুক্ত করিয়া তুলিতে সহায়তা করিয়াছিল। হিন্দু বা ভারতীয় সংস্কৃতি প্রসারের মূলমন্ত্র ছিল, সকল প্রকার চিন্তা ও চর্য্যার সমন্বয় একটি বিশিষ্ট বা শাস্ত্রানুসারী অথবা বিশেষ-সংঘ-নিয়ন্ত্রিত মতবাদের দ্বারা আর সমস্ত চিন্তা ও চর্য্যার দূরীকরণ, অপসারণ, অবনমন বা বিনাশ নহে। এই জন্যই ভারতীয় সংস্কৃতির কৃতিত্ব কেবল একটি বিশিষ্ট পার্থিব সভ্যতা বা সভ্য ও সামাজিক জীবনের প্রতিষ্ঠাতেই নিবদ্ধ ছিল না। অবশ্য, ভারতীয় সংস্কৃতি তাহার নিজের অভিজ্ঞতায় দৃষ্ট আদর্শ ও ভাবরাজি অন্য জাতির লোকদের সমক্ষে আনিয়া দিয়াছিল, এ কথাও সত্য; কিন্তু ইহা ছাড়া আরও একটা বড়ো কাজ করিয়াছিল অন্য জাতির স্বকীয় আদর্শ ও ভাবরাজিকে সম্পূর্ণ রূপে বিনষ্ট করিয়া এ কার্য্য করে নাই, বা বিনাশ করিবার চেষ্টা করে নাই।</span>"<br />
সনাতন ধর্মের বৈচিত্র্যপ্রবণ দার্শনিক চেতনার প্রভাবে বৌদ্ধ ধর্ম চীন-জাপানে বিস্তার লাভ করার আগেই কিছু কিছু পরিবর্তিত হওয়া শুরু করেছিল। বৌদ্ধধর্মের মহাযান শাখাতেই এই পরিবর্তনটা লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন হিন্দু দেব-দেবীরা ধীরে ধীরে বৌদ্ধধর্মে স্থান লাভ করে নিতে থাকে। ৭৯৪ খৃস্টাব্দে জাপানের রাজধানী ‘নারা’ শহর থেকে ‘কিয়েটো’ শহরে স্থানান্তর করা হয়। সমসাময়িক সময়ে সম্রাট কাম্মু বৌদ্ধধর্মের সাংস্কৃতিক সৌন্দর্য হৃদয়ঙ্গম করেন। এই সময়েই হিন্দু ধর্মের দেব-দেবীদের বৌদ্ধধর্মে স্বীকৃতিদান সম্পূর্ণ হয়। ইন্দ্র, ব্রহ্মা, অগ্নি, যম, বরুণ, বায়ু, কুবের, মহেশ্বর, মহাকাল, পৃথিবী, সূর্য, চন্দ্র, নারায়ণ(বিষ্ণু), কার্তিক, দুর্গা(চণ্ডী), সরস্বতী, লক্ষ্মী, চিত্রগুপ্তসহ একাধিক দেব-দেবী চীনা সংস্কৃতি বাহিত হয়ে জাপানের সংস্কৃতিতে স্থান করে নেয়। জাপানের সাথে ভারতের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ, রাজনৈতিক বা আত্মীয়তার দিক থেকে কোন সম্পর্ক সেকালে ছিলনা। ভারত থেকেও বেশি সংখ্যক মুণি-ঋষি জাপানে যাননি। তারপরও জাপানী ঋষি-পণ্ডিত-দার্শনিক-পরিব্রাজক প্রমূখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ভারতীয় দর্শনে মুগ্ধ হয়েই তা নিজেদের জীবন যাত্রায় গ্রহণ করেছেন। এর সাথে মিশিয়ে নিয়েছেন নিজের মনের নান্দনিক সচেতনতা।<br />
<br />
চীনাদের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের প্রভাবে ভারতীয় দেব-দেবীর বহিরঙ্গের নান্দনিক সৌন্দর্য মঙ্গোলীয় কাঠামো অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু মৌলিক গুণগত বৈশিষ্ট্যের কোন পরিবর্তন ঘটেনি। ফলে ভারতীয় দেব-দেবীরা চীনে গিয়ে অনেকাংশেই চৈনিক হয়ে উঠেছিলেন। তাদের নামও পাল্টে গিয়েছিল। ইন্দ্র হয়েছে তাইশাকু তেন্; ব্রহ্মা- বন্ তেন্; অগ্নি- কা তেন্; যম- এম্মা তেন্; বরুণ- সুই তেন্; বায়ু- হু তেন্; বৈশ্রবন কুবের- বিশামন তেন্; মহেশ্বর(শিব)- মাকেইশুরা তেন্; নীলকণ্ঠ (শিবের আরেকটি রূপ)- শোক্যিও কান্নন; মহাকাল- দাইকোকু; পৃথিবী- জি তেন্; সূর্য- নিত তেন্; চন্দ্র- গাত তেন্; নারায়ন(বিষ্ণু)- নারায়েন তেন্; দুর্গা(চণ্ডী)- জুনতেই কান্নন; সরস্বতী- বেনজাই তেন্; লক্ষ্মী- কিচিজো তেন্; গণেশ- শো তেন্; চিত্রগুপ্ত- তাইজান ফুকুন্; অসুর- আসুরা; রাক্ষস- রাসেৎসু তেন্; গরুড়- কারুরা প্রভৃতি।<br />
<br />
খ্রিস্টিয় সপ্তম শতকে বৌদ্ধ দার্শনিক গ্রন্থের হাত ধরে ভারত থেকে তিব্বতে লিপি যায়। এর পূর্বে তিব্বতী ভাষার নিজস্ব কোন লিপি ছিলনা। তিব্বতের লিপি তৈরি হয় দেবনাগরী এবং সিদ্ধমাতৃকা লিপির আঙ্গিকে। ভারতীয় সংস্কৃতির অন্যান্য উপাদানগুলোও চীনা-জাপানী পণ্ডিতদের দ্বারা ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ভাস্কর্য ও চিত্রাঙ্কন মধ্য এশিয়ার শিল্পাঙ্গনকে অনেকাংশে সমৃদ্ধ করেছে।<br />
<br />
সমকালীন ‘কানসু’ প্রদেশের ‘তুনওয়াং’ এর ‘হাজার বুদ্ধ গুহা’ (যা তৈরি শুরু হয়েছিল পূর্ব লিয়াং রাজবংশের সময়), উত্তর ওয়েই রাজবংশের সময়ে নির্মিত পি-লিং এর গুহামন্দির, মাইচিশানের গুহামন্দির, ইয়ুনকাং এর গুহামন্দির, লোংমেন এর গুহামন্দির প্রভৃতি বৌদ্ধমন্দিরগুলি চীনের ভাস্কর্যশিল্পের ইতিহাসে চিরকাল অমূল্য সম্পদ বলে বিবেচিত হবে। চীনের ভাস্কর্যতত্ত্বে এই বৌদ্ধমঠগুলোর শিল্পরীতি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। চীনা-জাপানী ভাষার বহু শব্দ সংস্কৃত ভাষা থেকে নেয়া। যেমন- ‘জেন’(সংস্কৃত ধ্যান), ‘বিওয়া’(বীণা), ‘বাইরো’(ভৈরব), ‘বুৎসু’(বুদ্ধ), দারুমা(ধর্ম) প্রভৃতি।<br />
<br />
চীনা ভাষায় ভারতকে একাধিক নামে ডাকা হতো। ‘সিন তু’(সিন্ধু), ‘হিয়েন তু’(হিন্দু), ‘ইন তু’(ইন্দু) প্রভৃতি শব্দ ভারত দেশটিকে চিহ্নিত করার জন্য ব্যবহার করা হতো, এখনও হয়। লক্ষ্যযোগ্য যে সংস্কৃতে ভাষায় ‘ইন্দু’ অর্থ চাঁদ, চীনা ভাষাতেও ‘ইন তু’ অর্থ চাঁদ। ভারতীয় সংস্কৃতির স্নিগ্ধ কোমল রূপ প্রত্যক্ষ করেই চীনা ঋষিগণ হয়তো এই শব্দটিকে অধিক যথাযথ মনে করেছিলেন।<br />
<br />
ভারতবর্ষের বাইরে সংস্কৃত ভাষার প্রাচীন পাণ্ডুলিপি বা মূল গ্রন্থের বিশাল ভাণ্ডার বেশ কয়েকটি দেশে পাওয়া গেছে। তার মধ্যে তুরস্কের সংগ্রহটি সবচেয়ে বড়। জাপানেও সংস্কৃত ভাষার প্রাচীন গ্রন্থের বিশাল সংগ্রহ পাওয়া গেছে। জাপানী সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস বা বড় গল্প ‘তাকেতোরি মোনোগাতিরি’ দশম শতাব্দীর প্রথম দিকে লেখা হয়। এর বিষয়বস্তু নেয়া হয়েছে জাতকের কাহিনী এবং অন্য বৌদ্ধ ধর্মীয় গ্রন্থ ‘গ্বোয়াৎসুজোন্যিও’, ‘আগম-গ্যিও’ ইত্যাদি গ্রন্থ থেকে। বিখ্যাত চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ চীনে ভারতীয় তর্কশাস্ত্র প্রবর্তন করেন। এর চীনা নাম ‘ইম্মিও’ ও জাপানী নাম ‘ইম্মিও গাকু’। জাপানের বর্তমান বিতর্কবিজ্ঞান প্রাচীন ভারতীয় তর্কশাস্ত্রকে আশ্রয় করেই প্রতিষ্ঠিত ও বিকশিত হয়েছে।<br />
<br />
এছাড়া ভারতীয় সঙ্গীত, নৃত্য, চারু ও কারুকলা, বাদ্যযন্ত্র, স্থাপত্যশিল্প, দর্শনচিন্তা, মানবতাবোধ, বিজ্ঞানসচেতনতা এবং নন্দনতত্ত্ব চীন-জাপানের মানসলোককে বহুলাংশেই আলোকিত করেছে। বৌদ্ধশাস্ত্রীয় গ্রন্থগুলি অনুবাদের ফলে চীনাভাষা সমৃদ্ধ হয়েছে। আধুনিক যুগ পর্যন্ত ক্ষীণধারায় বয়ে আসা তাও ও কনফুসীয় দর্শন বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে তাত্ত্বিকরূপ ধারণ করেছে।<br />
<br />
তেমন কোনো রাজনৈতিক প্রভাব ছাড়াই ভারতীয় সংস্কৃতি সমস্ত চীন-জাপান-কোরিয়া অঞ্চলে যে সুমহান সভ্যতার জন্ম দিয়েছে তা পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভারততত্ত্ববিদ ও বৌদ্ধশাস্ত্রে সুপণ্ডিত অধ্যাপক হাজিমে নাকামুরা মনে করেন, “<span style="font-style: italic;">ভারতবর্ষের প্রভাব ভিন্ন জাপানের সংস্কৃতি ঠিক আজকের মত এরূপ হতো না।” </span>ভারত সংস্কৃতি ও চীন-জাপান সংস্কৃতিতে সুপণ্ডিত স্যার বাসিল হল চেম্বারলেইন বলেন- <span style="font-style: italic;">“একথা বলা যায় যে জাপান সর্ব বিষয়ে ভারতবর্ষের কাছে ঋণী; কারণ ভারতবর্ষ থেকে এসেছিল বৌদ্ধধর্ম আর এই বৌদ্ধধর্মই সভ্যতা আনয়ন করে- চৈনিক সভ্যতা; কিন্তু চীনের মানুষ সাধারণভাবে যতটা স্বীকার করেন তার চেয়ে চীন অনেক বেশি ভারতীয় রং-এ রঞ্জিত।</span>”<br />
<br />
মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ ভূভাগে খ্রিস্টপূর্বকালে ভারতীয় সংস্কৃতি সৃষ্টি করে এক নতুন মর্মচেতনার। তিব্বতের মালভূমি ও হিমালয় পর্বতমালা থেকে শুরু করে চীন সাগরের উপকূল ও তার আশেপাশের দ্বীপাঞ্চল পর্যন্ত ভারতীয় সংস্কৃতির আলোকরশ্মি এক নতুন পথের দিক নিদের্শনা দিয়েছিল। পৃথিবীর সবচাইতে উঁচু পর্বতশ্রেণী ও কনকনে বরফঝড় ভারতীয় সংস্কৃতির যাত্রাপথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। আবেগের দায়, ধীশক্তির সহানুভূতি, দৃষ্টির ঋজুত্ব ও উপায়ের মহত্ত্বকে সঙ্গী করে ভারতীয় সনাতন সংস্কৃতির যে সজ্ঞান পদক্ষেপ তা সহস্র বৎসরের সীমানায় থমকে যায়নি। যে সুপ্রাচীন সংস্কৃতির মৌলচেতনা মানববোধ তা কালে কালে দেশজ গন্ডির বাইরে বিকিরিত যে হবে এ কথা বলাই বাহুল্য। প্রযুক্তির সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছাতে, সাম্যবাদী সমাজ বিনির্মাণ করতে গেলে যে সাংস্কৃতিক বোধের বিকাশ প্রয়োজন, চীন জাপানের ভারতীয় সংস্কৃতি শাসিত সমাজে তার অভাব হয়নি। কারণ ভারতের নিজস্ব সামাজিক নীতিবোধ সাংস্কৃতিক বিকাশের বৈচিত্র্যে মোটেও বিব্রত নয় বরং তাকে ভালবাসে, উৎসাহিত করে। ভারতীয় দর্শন মানবতার যে সংজ্ঞা উপস্থাপন করেছে তা আজও কালের নিক্তিতে হ্রস্ব হয়নি। পার্থিব মনুষ্যজীবনের সীমানায় বন্দি জীবনকে অর্থপূর্ণ করার জন্য ব্যাকুলতা ভারতীয় দর্শনের অন্যতম অনুষঙ্গ। যা মধ্য এশিয়ার দর্শন চেতনায় স্থির দীপশিখার মতো নিষ্কম্প প্রজ্জ্বলিত রয়ে গেছে।<br />
<br />
<b>সহায়ক গ্রন্থ:</b><br />
<ul>
<li> অতীশ দীপংকর- একরাম আলি।</li>
<li> গৌতম বুদ্ধ, দেশকাল ও জীবন- রুবী বড়ুয়া, বিপ্রদাশ বড়ুয়া।</li>
<li> চীনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস- চিয়ান পোজান, শাও স্যুনচেং, হু হুয়া।</li>
<li>ফা হিয়েনের দেখা ভারত- শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মুখোপাধ্যায়।</li>
<li>বৃহৎ বঙ্গ- শ্রী দীনেশ চন্দ্র সেন</li>
<li>ভারত সংস্কৃতি- সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়।</li>
<li>মধ্য এশিয়া- রাহুল সাংকৃত্যায়ন।</li>
<li>হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত- প্রেমময় দাশগুপ্ত।</li>
<li>হিন্দু দেবদেবী: জাপানের বৌদ্ধধর্মে- ডঃ দ্বিজেন্দ্রনাথ বকসি।</li>
</ul>
<br />
<b>সহায়ক প্রবন্ধ:</b><br />
<ul>
<li>চীনদেশে ভারতীয় সভ্যতা- প্রবোধচন্দ্র বাগচী, আনন্দসঙ্গী ১ (প্রবন্ধ), ২০০১, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, পৃষ্ঠা- ১২৩</li>
</ul>
সুশান্ত বর্মনhttp://www.blogger.com/profile/02304984470756506973noreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-7423733237485716191.post-25041749565573952502008-02-21T00:08:00.001+06:002018-03-07T13:50:17.132+06:00আমাদের শিক্ষা, শিক্ষার্থী ও সমাজবাস্তবতা<div style="text-align: center;"><span style="font-weight: bold;">রাশেদুল ইসলাম বাবু</span><br /></div><br />টোল কিংবা মক্তবের বদ্ধযুগ শেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই। তাই হালের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা নিজেদের আধুনিক ভাবতে ভাবতে কখন যে ভ্যাড়ার পাল হয়ে গেছে- তা আর ভাবার সময় পায়নি। কেননা আমাদের নিষ্ঠুর বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থা যখন দেখিয়ে দেয় আমাদের ‘শিক্ষা’ পণ্যের রূপ নিয়েছে, তখন সে পণ্যের উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত এসব মিডলক্লাশ ভ্যাড়াদের রাখালমশাই যে মার্গে চলতে কিংবা যে অচর্ব্য গিলতে বলছে এরা তাই করছে। যদিও দুই একটি অন্বিত মুভমেন্ট শিক্ষার সুপথ্য ও পথের জন্য দাবি করেছে কিংবা করছে- কিন্তু তাতে লাভ কোথায়? সমস্যাটা যখন সবার তখন সবাইতো এই মুভমেন্টে আসছেনা। রাখালমশাইয়ের হাতে লাঠি দেখে ভয় পেলেতো চলবেনা। তাহলে আজীবন ভ্যাড়াই থাকতে হবে। এখানে উল্লেখ্য যে, সুস্থ শিক্ষা সংস্কারের জন্য আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা এ ভ্যাড়ার পালভূক্ত নয়। তার অর্থ এই নয় যে, আন্দোলন করছেনা এরকম সকল শিক্ষার্থীই এ ভ্যাড়ার পালভুক্ত। বিষয়টি নির্ণয় করতে হবে- নৈতিকভাবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কে-কতটুকু গ্রহণ অথবা বর্জন করছে তার উপর। সেক্ষেত্রে শিক্ষার ‘উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য’কে দুভাবে উপস্থাপন করা হলো-<br /><br />প্রথমত: শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য যদি এমন হয়- শিক্ষার মাধ্যমে অর্থাৎ ছাত্র-শিক্ষকের সরাসরি আদান-প্রদানের মধ্যদিয়ে একজন শিক্ষার্থী ব্যক্তিজ্ঞানের পাশাপাশি কর্মদক্ষতা, যুক্তিনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিক শক্তির বিকাশ ঘটাবে এবং নিজস্ব সংস্কৃতি ও সমাজের প্রতি বিশেষ দায়বোধ গড়ে উঠবে। এভাবে একজন শিক্ষার্থী উন্নত মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।<br /><br />দ্বিতীয়ত: শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য যদি এমন হয়- একজন শিক্ষার্থী শিক্ষার বিষয়বস্তুকে অর্থাৎ সিলেবাস-কারিকুলামকে সুবিন্যস্তভাবে ধারাবাহিক অধ্যয়নের মাধ্যমে একে একে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক... প্রতিটি পর্যায়ে ভালো ফলাফলের মধ্যদিয়ে শিক্ষা জীবন শেষে একটি ভালো চাকুরী করবে। এভাবে একজন শিক্ষার্থী উন্নত মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।<br /><br />উভয় ক্ষেত্রে শিক্ষার লক্ষ্য যখন উন্নত মানুষ হওয়া, তখন উন্নত ভ্যাড়া হওয়া কী দরকার? অতঃপর যদি তাই ঘটে তাহলেতো শিক্ষার লক্ষ্য ভ্রষ্ট হয়ে যাবে। তাই উপরে উপস্থাপিত শিক্ষার দুটি ‘উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য’র মধ্যে কোন ‘উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য’কে সামনে রেখে শিক্ষার্থীরা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়? প্রথমটি না দ্বিতীয়টি?-সেটাই বিবেচ্য বিষয়। পর্যবেক্ষণে দেখা যায় দ্বিতীয়টির কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসা শিক্ষার্থীদের সংখ্যা এত বেশি যে প্রথমটির ক্ষেত্রে এর সংখ্যা দাঁড়ায় এক থেকে দেড় শতাংশ। এখন যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিচারে আলোচ্য দুটি শিক্ষার ‘উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য’র মধ্যে দ্বিতীয়টিকেই নিষ্প্রমাদ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়, তাহলে নিম্নাংশে উপস্থাপিত শিক্ষার প্রথম সংজ্ঞাকে বর্জন করে দ্বিতীয় সংজ্ঞাটিকে প্রকৃষ্ট হিসেবে গ্রহণ করা যুক্তিসিদ্ধ কী না?<br /><br /><span style="font-weight: bold;">প্রথম সংজ্ঞা:</span> যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যক্তিজ্ঞান বৃদ্ধি, বৈজ্ঞানিক চেতনা, যুক্তিনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গি, চরিত্র ও মানসিক শক্তির বিকাশ ঘটানো যায় তাই শিক্ষা।<br /><br /><span style="font-weight: bold;">দ্বিতীয় সংজ্ঞা:</span> যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মুখস্তবিদ্যা, তিন ঘন্টার পরীক্ষায় দ্রুত লেখার দক্ষতা অর্জন ও একটি ভালো চাকুরীর জন্য মানসিক প্রস্তুতির বিকাশ ঘটানো যায় তাই শিক্ষা।<br /><br />এখন যদি দ্বিতীয় সংজ্ঞাটি যথার্থ হিসেবে পরিগৃহীত হয়, তাহলে শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে দেখা দোষ কোথায়? সুন্দরী নারীরা যেভাবে পণ্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে (যেমন লাক্স মিস ফটোজেনিক) অনুরূপভাবে শিক্ষাও পণ্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে নানাভাবে। যেমন পরীক্ষায় পাস করা ও উচ্চতর ডিগ্রী প্রদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে যে দুটি ব্যবসা জমজমাট তাহলো গাইডবই ব্যবসা ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবসা। সাথে কোচিং সেন্টার, কিন্ডারগার্টেন এবং ইংলিশ মিডিয়ামতো আছেই। আর প্রতি বছর নতুন সিলেবাসের আলোকে নতুন বই মুদ্রণের জন্য টেন্ডারবাজির মতো এক ভিন্ন আইটেমের ব্যবসা লেগেই রয়েছে। শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণের চলমান প্রক্রিয়ার আরও একটি উদাহরণ- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; যেখানে দুটি ইনস্টিটিউটে (সমাজ কল্যাণ এবং গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান) বাণিজ্যিকভাবে উচ্চ শিক্ষার ধারণা পরিপন্থী ডাবল সিফট চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সম্প্রতি।<br /><br />এখন প্রশ্ন হলো, শিক্ষার এই নাজুক ব্যবস্থায় আমাদের সিংহভাগ শিক্ষার্থীদের অবস্থান কিরূপ? মোটা দাগে বলতে হয় যে, আমাদের শিক্ষার্থীরা শুধু সিলেবাসের আলোকে তোতা পাখির মতো পাঠ মুখস্থ করে ডিগ্রী অর্জনের মধ্যদিয়েই নিজেদের সত্যিকারের শিক্ষিত কিংবা সংস্কৃতিমান ভাবছে। বিষয়টা এমন যে, ময়না ও টিয়া পাখিকে বছরের পর বছর ট্রেনিং দিয়ে সিলেবাসের পাঠ মুখস্থ করালে তারাও যেন শিক্ষিত হয়ে যাবে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়। দেখা যায় অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ ভাবনা- পরীক্ষায় ভালো ফলাফল ও ভালো চাকুরী। এসব শিক্ষার্থী পড়াশুনার পাশাপাশি বন্ধু-বান্ধবের সংগে যে আড্ডা দেয় তা হয় কামগন্ধী নতুবা মুখরোচক। তাদের মধ্যে পড়াশুনা বিষয়ক যে বাক্যালাপ হয় তা পরীক্ষা সংক্রান্ত আর অমুক স্যারের হ্যান্ডনোট- তমুক ছাত্রের হ্যান্ডনোটের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সাহিত্য বলতে এরা বোঝে সমসাময়িক জনপ্রিয় লেখকের উপন্যাসের প্রেম, কমেডি আর ডিটেকটিভ কাহিনীর মুখরোচক অংশ। আর সংস্কৃতি বলতে এরা গান-বাজনাকেই বোঝে। মাঝে মাঝে বোম্বে কিংবা হলিউডের নায়কদের নায়কী স্টাইল এবং নায়িকাদের নরম দেহের প্রসঙ্গও এসব শিক্ষার্থীদের আড্ডায় আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।<br /><br />এ পর্যবেক্ষণলব্ধ ফলাফল থেকে যে বিষয়টি উঠে আসে তাহলো শতকরা প্রায় ৯৫ ভাগ শিক্ষার্থীর ব্যক্তিচিন্তার অবস্থান উপরের অনুচ্ছেদের অনুরূপ এবং সবাই রোমান্টিসিজমে ভোগে। পাশাপাশি এদের প্রত্যেকে স্বীয় সম্প্রদায়ের ধর্মীয় প্রভাব অন্যের উপর (বিশেষ করে নারীদের উপর) কার্যকর করতে চায়- যতটা না নিজের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে। এদের মধ্যে ২৫ ভাগ শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে আরও একটি লাইন যুক্ত করতে হয় যে ‘তারা তাদের প্রেমিক/ প্রেমিকার জন্য সময় নষ্ট করে।’ প্রায় ৩-৪ ভাগ শিক্ষার্থী শুধুমাত্র পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত। অবশিষ্ট ১-২ ভাগ শিক্ষার্থীর প্রসঙ্গ পূর্বেই বলা হয়েছে। তাই এ ফলাফল থেকে একথা বলা যায় যে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনার পাশাপাশি নিজেদের সংস্কারের তাগিদ অনুভব করাতে বাধ্য করছেনা। ফলে তারা যা শিখছে (মুখস্থ করছে) তা শুধু পরীক্ষায় পাশের জন্য; ব্যক্তিজ্ঞান সমৃদ্ধের জন্য নয়। এর কারণ, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের সঠিক চেতনাসম্পন্ন, বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী এবং সমাজ সচেতন দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যকে সামনে রেখে পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করা হয়নি। এমনকি সেখানে গণমুখী ও সৃজনশীল শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার কোন অবস্থান নেই। সুতরাং আমরা বলতে পারি যে, সঠিক ‘শিক্ষাদর্শন’কে চরমভাবে অবমূল্যায়ন করে ক্ষমতাশীন রাজনৈতিক দলের ইচ্ছার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা আমাদের শিক্ষানীতি সমাজ-সংস্কৃতি-জীবন ঘনিষ্ঠ শিক্ষানীতি নয়।<br /><br />শিক্ষার এই দূষিত পরিস্থিতি থেকে বিশুদ্ধ শিক্ষাদর্শনের ভিত্তিতে আমাদের শিক্ষানীতি কী হওয়া উচিত?- এটাই বড় প্রশ্ন। কিন্তু অদ্ভূত ব্যপার হল, এ বিষয়ে আমাদের শিক্ষার্থীরা সঠিকভাবে মন্তব্য করতে পারছেনা। বাহ্যিক বোধ থেকে তারা যে ভাবনাটি ভাবছে তা নিম্নরূপ-<br /><ul><li>পরীক্ষা নকলমুক্ত করতে হবে এবং পরীক্ষা পদ্ধতির রূপান্তর ঘটাতে হবে।</li><li>শিক্ষাপদ্ধতিকে আরও আধুনিক করতে হবে।</li><li>ইংরেজি শিক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।</li><li>পর্যাপ্ত পরিমাণ শিক্ষক নিয়োগ ও লাইব্রেরিতে বইয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে।</li><li>সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, হলদখল, ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করতে হবে।</li></ul><br />সংখ্যাগরিষ্ঠতার দিক দিয়ে এগিয়ে থাকা এসব শিক্ষার্থীরা সঠিক শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য উপরিউক্ত যেসব মন্তব্য উপস্থাপন করেছে তা যুক্তিসঙ্গত নয়। তাদের মন্তব্যগুলো একটি শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে সৃষ্ট কিছু সমস্যা সমাধানের উপায় মাত্র- সুস্থ শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য কোনো পদ্ধতি নয়। তাই সুস্থ শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য সার্বজনীন স্বীকৃত একটি বিজ্ঞান সম্মত অর্থাৎ সুস্থ শিক্ষাদর্শনের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা একটি শিক্ষা পদ্ধতির প্রয়োজন। যার মধ্যদিয়ে একজন শিক্ষার্থী সঠিকভাবে ভাবতে ও শিখতে বাধ্য হবে। এখন প্রশ্ন হলো ‘শিক্ষাদর্শন কী?’ মোটা দাগে এ কথায় বলতে হয় ‘দর্শন হলো গভীরভাবে বিশ্লেষণের মাধ্যমে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি চেনার রাস্তা।<br />আর শিক্ষাদর্শন হল গ্রহণ ও জ্ঞানান্বেষণের মাধ্যমে সত্যের উপলব্ধি হবার দৃষ্টিভঙ্গি বা উপায়।’ সেদিক বিবেচনায়, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষানীতি বলতে কিছু আছে কী নেই- সেটাই ভাবার বিষয়। ড. অজয় রায় ‘বিজ্ঞানচর্চা ও সমকালীন বাংলাদেশ’ গ্রন্থে ‘শিক্ষা-দর্শন ও শিক্ষানীতি এবং বিজ্ঞান শিক্ষা: কিছু অনিয়মিত ভাবনা’ প্রবন্ধে আমাদের শিক্ষাদর্শন ও শিক্ষানীতি সম্পৃক্ত নিচের মন্তব্যটি করেছেন- ‘‘আমাদের কোনো শিক্ষাদর্শন নেই, সুতরাং শিক্ষানীতিও নেই। এ নিয়ে আলোচনার কোনো ভিত্তি নেই। তবে অদ্ভূত হলেও দর্শন ও পলিসি ব্যতিরেকেই আমরা একটা শিক্ষা ব্যবস্থাকে লালন করছি। এই শিক্ষাব্যবস্থাটি কোন দর্শন ও নীতিকে আশ্রয় করে দাঁড়িয়ে আছে আমরা কেউ জানিনা।”<br /><br />সুতরাং বোঝ যায়, ব্যক্তিগত পড়াশুনা ও উপলব্ধি এবং ব্যক্তিইচ্ছাকে বাদ রেখে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে কেউ শিক্ষার প্রকৃত স্বাদ গ্রহণ করতে পারবেনা। অর্থাৎ সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারবেনা। তাই সুস্থ শিক্ষানীতির জন্য একটি সঠিক পদ্ধতির তাগিদ অনুভব করতে গিয়ে, যেসব শিক্ষার্থী পড়াশুনার পাশাপাশি ব্যক্তিজ্ঞান সমৃদ্ধির লক্ষ্যে সুস্থ সংস্কৃতি, সাহিত্য, দর্শন, রাজনীতি চর্চার মাধ্যমে সঠিক বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হচ্ছে কিংবা হতে চাচ্ছে- একমাত্রতারাই সঠিকভাবে শিক্ষিত হতে পারছে। আর অবশিষ্ট শিক্ষার্থীরা শাসকের নীতিকে আশ্রয় করে সৃষ্ট আমাদের ‘শিক্ষাব্যবস্থা’ কর্তৃক মদদপুষ্ট হয়ে নিরীহ প্রাণীর মতো অবোধ ও অন্তর্মুখী হয়ে পড়ছে। এ যুক্তিকে আশ্রয় করে এসব শিক্ষার্থীদের (৯৫%) ভ্যাড়ার পাল বলে আলাদা করে দেখা দোষের নয়। কেননা ভ্যাড়া একটি অবোধ ও অন্তর্মুখী প্রাণী। তাই আজকের শিক্ষার্থীরা (৯৫%) সালাম-বরকত(৫২’র ভাষা আন্দোলন), আসাদ (৬৯’র গণঅভ্যুত্থান), রাজুর (’৯২ এর ১৩ মার্চে ঢাবি ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসবিরোধী মিছিলে সন্ত্রাসী কর্তৃক গুলিতে নিহত) মতো দেশপ্রেমিক ছাত্রদের অনুসরণ না করে পরীক্ষায় ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করা কোনো এক ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ আমলাকে অনুসরণ করছে। এবং তাদেরকেই আদর্শ হিসেবে দেখছে।<br /><br />শিক্ষার্থীদের আরও একটি অংশ বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলো বিশুদ্ধ শিক্ষাদর্শনের ভিত্তিতে একটি যথাযথ শিক্ষানীতির দাবি করলেও তাদের আন্দোলনকে চাঙ্গা করতে পারছেনা। এর মূল কারণ, আমাদের সাধারণ শিক্ষার্থীরা; যারা অবোধ-অন্তর্মুখী ও সাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ এক আরামপ্রিয় সাচ্চা মধ্যবিত্ত অথবা নিম্ন মধ্যবিত্ত। এসব শিক্ষার্থীদের যখন কোনো উচ্চাশা জাগে তখন সামান্য ব্যর্থতায় অদৃষ্টের দোহাই দিয়ে নিজেকে গৃহকোণে আবদ্ধ রাখে। সংগ্রামের পথ বেছে নিতে এরা নারাজ। শিক্ষাদর্শনের সঠিক চেতনা এদের নেই; কেননা শিক্ষাদর্শন বলতে এরা বোঝে পরীক্ষায ভালো ফলাফল ও শিক্ষা শেষে ভালো চাকুরী। সেদিক বিবেচনায় ‘শিক্ষাদর্শনের’ সঠিক রূপরেখা সাধারণ শিক্ষার্থীদের সামনে সঠিকভাবে উপস্থাপন করে তাদের শ্রেণী অবস্থান ও শ্রেণীচরিত্রের রূপরেখা সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে হবে। কেননা ওই সব সাধারণ শিক্ষার্থীদের (৯৫%) শ্রেণীচরিত্রের রূপান্তর না ঘটা পর্যন্ত এ প্রকারের শ্রেণীহীন শিক্ষার আন্দোলন কখনই শক্ত ভিত গড়তে পারবেনা। আর এসব ছাত্র সংগঠনগুলোর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।<br /><br />কিন্তু আজকের সমালোচকগণ এসব ছাত্র আন্দোলনকে যৌক্তিক বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে ব্যাখ্যা না করেই এদের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করছে। বিষয়টা এমন যে ছাত্ররাজনীতিকে ব্যবসা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজী, ঠিকাদারী ইত্যাদির মানদণ্ডে মেপে এদের সম্ভাবনাময় আন্দোলনের ভেলোসিটি কমিয়ে দিচ্ছে। তাদের ধারণা আর কখনও বঙ্গবন্ধু কিংবা মহাত্মা গান্ধী জন্মাবে না। কিন্তু মূল বিষয়টা হল, মাথাব্যথায় মাথা কেটে না ফেলে সঠিক ঔষধ প্রয়োগ করাই যদি বিজ্ঞানসম্মত হয় তাহলে ছাত্র আন্দোলনের সম্ভাবনাময় এই দ্বিতীয় ধারাকে সরাসরি নাকচ করে না দিয়ে যৌক্তিকভাবে বিশ্লেষণ করে সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়ে এদের আন্দোলনের পথকে সম্প্রসারিত করাই একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক-প্রগতিশীলের ভূমিকা হতে পারে।সুশান্ত বর্মনhttp://www.blogger.com/profile/02304984470756506973noreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-7423733237485716191.post-89546711954571158772008-02-01T22:27:00.000+06:002017-12-08T22:40:35.280+06:00স্বাগতমব্যবচ্ছেদ পত্রিকা পড়বার জন্য আপনাকে আমন্ত্রণ!<br />
<br />
<div class="separator" style="clear: both; text-align: center;">
<a href="https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEgeqcZvI-g2ulscDirrJNOvdD91-nZ9dXYg9c858gPYISaRMGPcN43R2CUTm1mNMpPxNNeIqb5gi6h5OKHjAMri-0z11-MkEQC3ybF7k7WHPk-CeqLpfgdqanGT0KtFMAxYsuRaVJ0oZ0M/s1600/bb.PNG" imageanchor="1" style="margin-left: 1em; margin-right: 1em;"><img border="0" data-original-height="529" data-original-width="385" height="320" src="https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEgeqcZvI-g2ulscDirrJNOvdD91-nZ9dXYg9c858gPYISaRMGPcN43R2CUTm1mNMpPxNNeIqb5gi6h5OKHjAMri-0z11-MkEQC3ybF7k7WHPk-CeqLpfgdqanGT0KtFMAxYsuRaVJ0oZ0M/s320/bb.PNG" width="232" /></a></div>
<div style="text-align: center;">
<b><a href="https://baybachched.blogspot.com/index.html">প্রথম পাতা</a> থেকে শুরু করুন</b></div>
সুশান্ত বর্মনhttp://www.blogger.com/profile/02304984470756506973noreply@blogger.com